fbpx

আমার কলেজ জীবন

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমাদের S.S.C পরীক্ষা হয়েছিল। তারপর দুই মাস জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় সময় পেয়েছিলাম। কারণ কোনো পড়াশুনা ছিলো না, শুধু খাওয়া, খেলা আর ঘুম। এভাবেই দুই মাস কেটে গেলো অনেক দ্রুত। ভালো সময় গুলো অনেক তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায় আর খারাপ সময় সহজে শেষ হয় না- এই কথাটা মোটামুটি সবার জন্যই প্রযোজ্য। যদিও বাস্তবে সময় সময়ের আপন গতিতে চলতে থাকে। খারাপ সময়গুলো আমাদের বেশি মনে থাকে, এজন্য হয়তো এরকম মনে হয় -এটা আমার ব্যক্তিগত ধারণা। ২০১৯ সালের মে মাসের ৬ তারিখ সম্ভবত আমাদের S.S.C exam এর রেজাল্ট দিয়েছিলো। আলহামদুলিল্লাহ রেজাল্ট ভালো এসেছিলো। এরপর কলেজে ভর্তির পর্যায় আসলো। ৬ তারিখ রেজাল্ট দেয়ার পরের দিন নটর ডেম কলেজ এ ভর্তির সার্কুলার দিয়ে দেয়। নটর ডেম কলেজ এর নাম প্রথম শুনেছিলাম আমার স্কুলের গণিত শিক্ষকের কাছে, তখন আমি ক্লাস টেন এ ছিলাম। ৮ তারিখে নটর ডেম কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার জন্য আবেদন করেছিলাম। ভর্তি পরীক্ষা হয়েছিলো রেজাল্ট দেয়ার এক সপ্তাহ পর। কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই এক্সাম দিতে গিয়েছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ চান্স ও পেয়েছিলাম। এরপর ভর্তির সব কার্যক্রম সম্পন্ন করেছিলাম। জুন মাসের শেষের দিকে নবীনবরণ অনুষ্ঠান হয়েছিলো। নবীনবরণ এর দিনই আমাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছিলো যে জুলাই এর ১ তারিখ থেকে কলেজের ক্লাস শুরু হবে। তো যেই কথা সেই কাজ, জুলাই মাসের ১ তারিখেই ক্লাস শুরু হয়েছিলো। কলেজের প্রথম দিন, নতুন পরিবেশ, নতুন জায়গা ,নতুন বন্ধু -এগুলোর সাথে মানিয়ে নিতে একটু সময় লেগেছিলো আমার। যদিও প্রথম দিন অনেকের সাথে পরিচয় হয়েছিলো। কলেজে আমার গ্রুপ ছিলো 06, ক্লাস টা ছিলো হ্যারিংটন ভবনের তিন তলায় ৩০৯ নাম্বার রুমে। আমার গ্রুপ এর সবাই অনেক ট্যালেন্টেড ছিলো মাশাল্লাহ। আমার পাশে যে ছেলেটা বসতো সে রংপুর থেকে আসছিলো, অনেক নমনীয় ও ভদ্র ছিলো ছেলেটা। পুরো কলেজ জীবনে আমার পাশের সিটে ঐ ছেলেটাই বসতো। একটা সিটে আমরা দুইজন পারমানেন্ট ছিলাম। মাঝে মাঝে মাঝখানে একজন বসতো। প্রথম দিকের কয়েকটা বেঞ্চে এভাবে বসতে হতো। নটর ডেম কলেজের সিট প্ল্যান টা অফিস থেকেই দিয়ে দিতো, যেই কারণে কলেজে কোনো রোল কল করা হয় না। যার যে আসন নির্ধারিত ছিলো , সেই ব্যক্তি সেই আসনে না থাকলে অনুপস্থিত দিয়ে দিতো স্যাররা, মুখে কখনো কোনো কথা বলতো না। তো কলেজের ক্লাস প্রথম দিকে ভালোই লাগছিলো, কারণ কোনো কুইজ,ল্যাব এগুলো হতো না প্রথম দিকে। এক মাস অতিক্রম করার পর ই কুইজ এর রুটিন দিয়ে দেয়। আরেকটা বিষয় হলো আমার গ্রুপ এর সকল ছাত্র অনেক মাল্টি ট্যালেন্টেড ( আমি বাদে )। আমার কলেজ রোল ছিলো 12106073, যারা নটর ডেম কলেজে পড়ে তারা আর কিছু পারি আর না পারি কলেজ রোল টা মোটামুটি সবাই বলতে পারি। তো যেটা বলতেছিলাম , আমাদের সপ্তাহে দুইটা কুইজ হতো , মঙ্গলবার আর বৃহস্পতিবার সকাল ৮ টায়। আর ল্যাব হইতো সোমবার আর বুধবার ৩ টা থেকে ৫ টা। প্রতিদিন ৮ টা থেকে ১ টা ক্লাস তো আছেই। কলেজের টিচাররা বলতো – প্রথম প্রথম কলেজের সাথে তাল মিলাতে কষ্ট হবে, দুই তিন মাস এভাবে কুইজ, ল্যাব, ক্লাস চলতে থাকলে একটা গতি পেয়ে যাবে, আর গতি মানেই জীবন। Nothing is automatic, everything is systematic- যার উৎকৃষ্ট উদাহরন হলো নটর ডেম কলেজ। নোটিশ থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রোগ্রাম আয়োজন করা – সবকিছু অনেক Systematic ভাবে সম্পন্ন করে থাকে নটর ডেম কলেজ। কলেজের কুইজ গুলো অনেক কঠিন হতো কারণ এখান থেকে তারা সেরাদের সেরা বাছাই করবে। সকালবেলা যখন কলেজে যেতাম ,অনেক আনন্দ পেতাম। সকালবেলা কলেজের পরিবেশ টাও অনেক সুন্দর থাকে। নিস্তব্ধ, নিরব, ঠান্ডা পরিবেশ, পড়ালেখা বা বিদ্যা চর্চা করার উত্তম পরিবেশ। কলেজে অনেকগুলো ক্লাব ছিলো যেগুলো সহশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতো। এছাড়া প্রতি বছর বিভিন্ন খেলাধুলার ও আয়োজন করেছিলো। কলেজের একটা মাঠ ছিলো, ঢাকা শহরের জায়গা হিসেবে এটাকে বিশাল মাঠ ই বলা যায়। মাঠে আমরা সবাই মিলে ফুটবল খেলতাম, ব্যাটের বদলে বাঁশ দিয়ে ক্রিকেট খেলতাম। কলেজে অনেক কম্পিটিটিভ এক্সাম হতো, যেমন – সায়েন্স অলিম্পিয়াড। আমি কুইজগুলো বেশি ভালো দিতে পারতাম না কারণ প্রশ্ন গুলো অনেক জটিল করতো। যদিও আমার মাল্টি ট্যালেন্টেড সহপাঠীরা ভালোই পারতো। কলেজের শুধু বাংলা, ম্যাথ আর আইসিটি কুইজগুলো ভালো হইতো কারণ ঐ সাবজেক্ট এর প্রশ্ন বই আর স্যার দের নোট থেকে আসতো। এভাবে চার মাস কেটে গেলো। এরপর Sent Up-1 exam এর রুটিন দেয় এবং এক্সাম ও হয়। শুধুমাত্র ম্যাথ রিটেন এক্সাম এ ভালো করেছিলাম, আর একটা সাবজেক্ট ও ভালো পারি নাই। কারণ ম্যাথ বই থেকে দিয়েছিলো, এজন্য পেরেছিলাম। Progress report ও দিয়ে দিলো কয়েকদিনের মধ্যে। রেজাল্ট পেয়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, কারণ ৬৪% মার্ক্স পেয়ে ৬৯৬ পজিশন আসছিলো। আমি ভেবেছিলাম এতো কম মার্ক্স পেয়ে এই পজিশন কিভাবে আসে? আমি ভেবেছিলাম ১৫০০ এর দিকে সিরিয়াল আসবে, হাজারি ক্লাব এর সদস্য হয়ে যাবো। এরপর শীতকাল চলে আসলো। ডিসেম্বরের শেষ দুই সপ্তাহ শীতকালীন ছুটি দেয়া হয়। এই দুই সপ্তাহ ছুটি অনেক আনন্দের। টানা পাঁচ মাস পড়ার প্রেসার এর পর একটু অবসর সময় সত্যিই অনেক আনন্দদায়ক। এই ছুটিটা অনেক আনন্দেই কাটিয়েছিলাম। কিন্তু অনেক দ্রুত সময় টা শেষ হয়ে গিয়েছিলো। তারপর আবার জানুয়ারি মাসে কলেজ শুরু হলো। মাঝখানে ব্রেক দেয়ায় গতি কিছুটা কমে গিয়েছিলো , আবার দুই সপ্তাহ ক্লাস , ল্যাব, কুইজ দেয়ার পর আবার গতি ফিরে আসছিলো। কলেজ শুক্র, শনি দুইদিন বন্ধ থাকতো। ঐ দুই দিন চাকরির পরীক্ষা, বিভিন্ন কালচারাল ফেস্ট, ক্লাব কার্যক্রম, সেমিনার, ওয়ার্কশপ, কম্পিটিশন ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান হতো। তবে আমি কোনো দিন শুক্র ,শনি কলেজ এ যেতাম না, কারণ পাঁচদিন ক্লাস, ল্যাব, কুইজ করার পর আবার কলেজে যাওয়ার সেইরকম অনুভূতি হতো না। এভাবেই কলেজ জীবন অতিবাহিত হতে লাগলো। বসন্ত কালে কলেজে অনেক কালচারাল অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। কলেজের স্যাররা অনেক বন্ধুসুলভ ছিলেন। কলেজের স্যারদের মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লাগতো রেজা স্যার আর তাপস স্যার কে। যেসব স্যারদের বই আমরা academic এ পড়তাম, তাদের কাছে সরাসরি ক্লাস করতে পারাটা এক অন্যরকম ব্যাপার মনে হতো। ২০২০ সালের মার্চ মাসের ১৬ তারিখ বিশ্বব্যাপী মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাস এর কারণে এক সপ্তাহ কলেজ বন্ধ ঘোষণা করেছিলো। আবার মনে একটা শান্তি অনুভব করেছিলাম যে দুই মাস পর আবার একটু বিশ্রাম নেয়া যাবে। কিন্তু এই বন্ধ টা যে বাড়তে বাড়তে দেড় বছর বন্ধতে পরিণত হবে এটা কখনো ভাবিনি। করোনাকালীন সিরিয়াস ভাবে কোনো পড়ালেখাই করি নাই। কলেজ থেকে প্রথম দিকে Youtube এ রেকর্ডেড ক্লাস দিতো, ঐগুলো বেশি সময় ধরে করতে পারতাম না, কারণ অনলাইন এ টানা ক্লাস অনেক বিরক্তিকর। ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল এক্সাম অনলাইনে নিয়েছিলো। এরপর সেকেন্ড ইয়ার এ কলেজ থেকে জুম ক্লাস এর ব্যবস্থা করা হয়। করোনাকালীন সবকিছুই মোটামুটি বন্ধ ছিলো, কোথাও ঘুরতে যাওয়ার ও সুযোগ ছিলো না। লকডাউন, আইসোলেশন এ সবাই গৃহবন্ধী ছিলো। করোনাকালিন জীবন অনেক বিভীষিকাময় ছিলো। মানসিক, শারীরিক এবং অর্থনৈতিক সকল দিক দিয়েই জীবন এর লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য হারিয়ে গিয়েছিলো। বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে বড় যুদ্ধ ছিলো করোনাকালীন সময়ে। পুরো বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও করোনা আঘাত হেনেছিলো, যার কারণে আমাদের অনেকের মানসিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থানও পরিবর্তন হয়েছে। করোনার প্রভাব আমার পরিবারেও এসে পড়েছিলো। করোনাকালিন একটা জিনিস এর সাথে নতুন পরিচিত হয়েছিলাম ,সেটা হলো জুম মিটিং এ ক্লাস। আগে কখনো এটা ব্যবহার করিনি। এভাবেই ঘরে বসে করোনাকালীন দেড় বছর কেটে গেলো। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আবার কলেজ খুলেছিলো। দুই থেকে আড়াই মাসের মতো ক্লাস হয়েছিলো। ঐ সময় প্রতিদিন তিন টা ক্লাস হতো,আগের মতো সব ক্লাস হতো না। ক্লাস এ উপস্থিতি অনেক কম থাকতো। সিলেবাস অনলাইনেই শেষ করে দিছে স্যাররা। এই তিন মাস অফলাইন ক্লাস দিয়ে কলেজ জীবনের শেষ ক্লাস এর আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়েছিলো। এছাড়া পুনর্বিন্যাসকৃত সিলেবাস এ কিভাবে এক্সাম দিবে, টাইম ম্যানেজমেন্ট কিভাবে করবে এগুলো সম্পর্কে কথা বলতেন স্যাররা। ডিসেম্বর মাসে HSC exam হয়েছিলো। কেন্দ্র নির্ধারিত হয়েছিলো Willes Little Flower School and College, যেহেতু এক্সাম পুনর্বিন্যাসকৃত সিলেবাস এ হয়েছিলো তাই এক্সাম মোটামুটি ভালো দিয়েছিলাম। MCQ exam এ একটু ভীত ছিলাম যে টাইম ম্যানেজ করতে পারবো কিনা। আলহামদুলিল্লাহ এক্সাম ভালো দিয়েছিলাম। এভাবেই আমার ছোট্ট জীবনের ছোট্ট কলেজ লাইফের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। পরিশেষে একটি কথা বলে শেষ করবো তা হলো – অপূর্ণ কলেজ লাইফ টা আমার কাছে আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়