যেতে যেতে মানালির পথে
আমার মাথায় একটা জিনিস ঢুকছে না। আমরা সিমলা থেকে মানালি যাব, তো সকালে কেন রওনা দিলাম?
আমরা যখন কক্সবাজার যাই রাতের গাড়িতে উঠি, সকালে পৌঁছে যাই। তাতে করে একটা দিন বেঁচে যায় আমাদের। এখন সারা দিন গাড়িতে থাকবো। রাতে গিয়ে মানালি পৌছবো। দিনটা নষ্ট না?
উত্তর পেলাম যাত্রা শুরুর পর।
সিমলা থেকে মানালি ৩০০ কিলোমিটারের বেশি পথ। রাস্তার দু পাশে পাহাড়, মাঝে একটা নদী তার পাশে রাস্তা। বাড়ি ঘরের চিহ্ন নেই। কল্পনায় দুর্গম খাইবার পাস যেই রকম ভেবেছিলাম প্রায় ওই রকমই, শুধু নদী টা বেশি।
এই রকম একটা স্থানে বিপদে পড়লে কেউ উদ্ধার করার নেই। আর এই জটিল পাহাড়ি রাস্তায় রাতে গাড়ি চালানো অত্যন্ত রিস্কের।
কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল রাস্তার দুপাশের দৃশ্য। মনে হলো জীবনে অন্তত এই সৌন্দর্যটুকু না দেখে মারা গেলে অন্যায় হত। রাতে গেলে দেখতাম কিভাবে?
সারাদিনে এক মিনিটের জন্য চোখ বুজতে মন চায়নি। আমি চাইলেই এপথে আরেকবার আসতে পারবো না। অনেকেই গাড়িতে ঘুমাচ্ছে। তারা জানে না তারা কি মিস করছে।
হটাৎ দেখি পরিচিত স্থান। আরে জায়গা তো আমি চিনি। 3 Idiots মুভির ‘Bethi hawa se tha wah’ গানে দেখেছি।
পাশে জুঁই ছিলো বললাম গানটা ছাড়তে। ভিডিওর সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে দেখছি কোন কোন স্থান মেলে গানটা চলতে থাকলো, গাড়ির জানালায় কপাল ঠেকিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি।
মুভিতে রাস্তাটা যত সুন্দর দেখতে বাস্তবে আরও সুন্দর।
গান শেষ হওয়ার পর আরেকটা গান দিতে গিয়ে নিচের দৃশ্যটা চোখে পড়ে। আরে এটা তো সিমলার মল রোড।
গতকাল সারা দিন এই জায়গাটা খুঁজেছি। কোন স্থানের সাথেই মিলছিলো না। আধারাত মল রোডে কাটিয়েছি, তখনো বুঝতে পারিনি এটিই সেই শুটিং স্থান।
উপরে কয়েকজন বোরকা পড়া মহিলা ছবি তুলছে। ঠিক ওই স্থানে দাঁড়িয়ে রাতের মল রোডের অপরূপ দৃশ্য দেখেছিলাম। এখন আফসোস হচ্ছে তখন কেনো চিনতে পারলাম না।
আফসোস করতে করতে দুপুর হয়ে গেলো। খাবারের জন্য গাড়ি থামানো হলো।
জায়গাটা পরিপটি, সিঁড়ির মত করে বসার ধাপ আছে। খোলা আকাশের নিচে গাছের ছায়ায় বসে হাতে প্লেট নিয়ে খাচ্ছি।
দুপুরে কৃষিকাজ করে মাঠে যে খাবার খায় তাদের সাথে কখনো খেয়েছেন? ওই খাবারটা পৃথিবীর সবচেয়ে তৃপ্তির ভোজন। গাছের ছায়ায় খোলা পরিবেশে খাওয়ার জন্য খাবারের স্বাদ বেড়ে যায় কয়েকগুন।
আমাদেরটা এই দুপুরের খাবার মনে হয়ে তৃপ্তির তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে থাকবে। পরিবেশটাই এর অন্যতম কারণ।
পাশেই কিছু দোকান ছিল, কফির অর্ডার দিলাম। কি ব্যাপার কফির স্বাদ এই রকম কেনো? এত দাম দিয়ে কেনা কফিটা খেতে পারছি না। অখাদ্য।
মাহাদী হাসতে হাসতে এসে বলল, “এখানে গরুর দুধ পাওয়া যায় না। এগুলো ইয়াকের দুধ দিয়ে বানানো হয়। এই জন্য স্বাদ এই রকম লাগে।“
এই ছেলের মনে হাসি রোগ আছে। কোন কথাই সে হাসি ছাড়া বলতে পারে না।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ইয়াক কি?”
রাস্তার পাশেই একটা গরু সাদৃশ একটা প্রাণী দেখিয়ে বলল, “ওইটাই ইয়াক।“
চেহারায় মহিষ মহিষ ভাব আছে। তবে লোম অনেক বেশি। এইগুলো হিমালয় অঞ্চলের প্রাণী, বিশেষ করে তিব্বত অঞ্চলে বেশি পাওয়া যায়। শীত অঞ্চলের প্রাণীদের লোম বেশিই থাকে।
বাকি দিনটা গাড়িতেই কেটে গেলো। সন্ধ্যা হয়ে গেলো, কুল্লু পৌঁছে গেছি ততক্ষণে। কুল্লু হলো হিমাচল প্রদেশের একটে জেলা। মানালি কুল্লুর একটা শহর।
একই জেলা হলেও মানালি এখনো বেশ দূর আছে। কুল্লুতে শপিং করার জন্য গাড়ি থামানো হলো। গতকাল কেউ শপিং করেনি।
শপিং এর জন্য তাদের পরাণটা খাঁ খাঁ করছে। পর পর দুদিন শপিং ছাড়া থাকলে দু জন হার্টফেল করতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।
জীবন বাঁচাতে এই শপিং জরুরী। এখানে একটাই বড় দোকানে। আশে পাশে ঘর বাড়িও নেই। এখানে নাকি ভালো শাল (চাদর) পাওয়া যায়।
দোকানের নিচতলায় তাঁত, উপরে বিক্রি। প্রথমে তাঁত ঘুরে দেখালো। আগে কখনো তাঁত দেখিনি। জিজ্ঞেস করলাম “এক দিনে কয়টা চাদর বানানো যায়?”
বলল “তিন চারটা বানানো যায়।“
উপরে গিয়ে দেখি বিশাল দোকান। কয়েক হাজার চাদর তো হবেই। ঐ একটা তাঁত দিয়ে এই চাদর বানানো হলে তো কয়েকশ বছর লেগে যাওয়ার কথা।
বুঝলাম এইটা একটা বিজনেস কৌশল। ঘানি সরিষার তেলের মত তাঁতের চাদর।
একটু ঘুরাঘুরি করেই অধৈর্য হয়ে গেলাম। সারাদিন গাড়িতে, এখন আবার কেনাকাটার ঝামেলা।
আমার মনে হয় শপিং ভীতি আছে। মেয়েরা তো অধৈর্য হচ্ছে না। আমি অল্পতেই অধৈর্য হয়ে পড়ি। এই ভীতি কাটানোর কি কোনো কোর্স আছে কিনা খোঁজ নিতে হবে।
আমার মনে হয় কোর্স আছে। কারণ আমার মত অনেক ছেলেই অধৈর্য হয়ে পড়েছে। তার মানে এইধরনের লোকের সংখ্যা কম না। এদেরও তো শিক্ষা দেয়া জরুরি। কোর্স আবশ্যক।
মেয়েদের শপিং দেখে মনে হচ্ছে তারা আজকে রাতে এই দোকান থেকে বের হবে না। তাদের সতর্ক থাকতে হচ্ছে তারা যে চাদর কিনেছে সেটা আর কেউ কিনেছে কিনা।
কিনেলেই সর্বনাশ। সুতরাং নিজেরটা দেখলেই হবে না বাকিদের খোঁজ রাখতে হবে। এই খোঁজ রাখতে রাখতে তারা রাত গভীর করে ফেলছে।
আমার মনে আছে ইন্ডিয়া থেকে দেশে ফিরে ক্লাসে এসে দেখি আমার জুতার মত আরো তিন জোড়া জুতা দরজার সামনে। সবই ইন্ডিয়া থেকে কেনা।
এতে কারো মধ্যে কোনো আফসোস দেখিনি। সবাই খুশিই হয়েছে, কারণ এতে তারা নিশ্চিত হয়েছে তাদের চয়েস ভাল।
কেনাকাটা ইস্তফা দিয়ে কয়েকজন গেলাম চা খেতে। বাইরে এসে দেখি প্রচন্ড ঠান্ডা। একটা চায়ের দোকান পাওয়া গেলো। ইয়াকের দুধের চা তো খাবো না। রং চায়ের খেতে হবে।
কিন্তু রং চায়ের হিন্দি কি?
একজন বলল, “জিজ্ঞেস কর লাল হবে কি না?”
হিন্দি বুঝতে পারলেও বলার সক্ষমতা নেই আমার। তাই যা বলার বাকিরাই বলে, আমি দর্শক।
দোকানদারকে লাল চায়ের হিন্দিতে তরজমা করে বললো। কিন্তু বুঝতেছে না।
আরেকজন বলল, “জিজ্ঞেস কর কালো চা হবে কি না? রং চা দেখতে আসলে কালো।”
যুক্তি মেনে নিলাম। চা লাল না কালো সেটা পরে দেখা যাবে। কিন্তু এটাতেও কাজ হলো না।
অপশন কি আরো কিছু বাকি আছে?
আছে। আরেকজন, “আদা চা বলে দেখ। এইটা অন্তত চেনার কথা।”
হয়তো চিনবে কিন্তু আদার আবার হিন্দি কি?
সবাই মিলে অনেকক্ষণ Trail and error method এর মাধ্যমে চেষ্টা করে সব অপশন মিলিয়ে রং চায়ের হিন্দি তরজমা ঠিক করলো ‘আদ্রাক ওয়ালা কালি চায়ে’।
এইবার বুঝলো। খাইছে আমারে সামান্য রং চায়ের এত বড় নাম?
এরপর দোকানদার কালো রংয়ের একটা গরম তরল বস্তু গ্লাসে গ্লাসে দিতে লাগলেন। এদের দেশে কি চায়ের কাপ পাওয়া যায় না?
চায়ের স্বাদ এত বিশ্রী হতে পারে? কে বলবে এ জাতি চা খেতে জানে। আর চাইলেই কেউ এত বিশ্রী চা বানাতে পারবে না। এর জন্যও ট্রেনিং দরকার হবে।
চা শেষে আমরা গাড়িতে ওঠে বসে আছি। এদিকে মেয়েদের শপিং শেষ হচ্ছে না। বারবার শপিং এর বেলায় শুধু মেয়েদের কথাই বলছি। ব্যাপারটা আসলে পুরোপুরি সত্যি না।
কিছু কিছু ছেলে শপিং এ মেয়েদের চাইতেও কয়েক ডিগ্রি উপরে। এরশাদ স্যার নিজেও তার জীবনের সর্বোচ্চ শপিং করেছেন এই ট্যুরে।
মানালি
মানালি যখন পৌঁছলাম রাত অনেক হয়ে গেছে। তাপমাত্রা দেখাচ্ছে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এখানে আসা মূলত বরফ দেখতে। তাপমাত্রা জিরোর কাছাকাছিই আছে এখন।
এখন খেয়েদেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে হবে। খুব সকালে উঠে তুষার দেখতে যাবো।
মানালির উচ্চতা ২০০০ মিটারের বেশি। তবে ২৫০০ মিটারের উপরে নভেম্বরে বরফ থাকে। সেজন্য আমাদের আরেকটু উপরে উঠতে হবে।
আগে বলে নেই মানালিতে আমাদের প্লানগুলো কি কি-
১। সকালে তুষার দেখা
২। বিকেলে শপিং
৩। রাতে DJ Party এবং BBQ
৪। পরদিন সকালে River Rafting (বিয়াস নদীতে রাবারের নৌকায় স্রোতে ভেসে বেড়াবো)।
মানালি শহরটার আসে পাশে অনেক উঁচু উঁচু পাহাড়। তার দিকে তাকালে মনে হয় যেন আমরা সমতলেই আছি।
হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অনুসারে মানালি খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান। আচ্ছা হিন্দু ধর্মের মন্বন্তর সম্পর্কে জানেন? যারা না জানেন তাদের জন্য বলছি।
পুরাণ অনুসারে, পৃথিবীর সময়কাল ১৪ টি কাল বা সময়ে বিভক্ত। প্রতিটি কালকে বলে ‘মন্বন্তর’। প্রত্যেক মন্বন্তরে একজন মনু রাজত্ব করে। ‘মন্বন্তর’ মানে হলো মনুর রাজত্ব কাল।
একটি মন্বন্তর শেষে আরেকটি মন্বন্তর শুরুর আগে বন্যা হয়, ‘মহাপ্লাবন’। এরপর পৃথিবী আবার নতুন করে শুরু হয়।
এখন চলছে সপ্তম মন্বন্তর। প্রথম মনু ছিলেন মনু ‘স্বয়ম্ভুব’। সপ্তম মন্বন্তরের মনু হলেন মনু ‘বৈবস্বত’। তিনি ছিলেন দ্রাবিড়ের রাজা।
বিষ্ণুর মৎস্য অবতার বৈবস্বতকে মহাপ্লাবন সম্পর্কে সতর্ক করেন। একটা নৌকা বানাতে বলেন। বৈবস্বত নৌকা বানান, তাতে তার পরিবার ও সাতজন ঋষিকে রক্ষা করেন। অনেকটা মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদি ধর্মের নূহ নবীর বন্যার মতই।
তারপর ধীরে ধীরে এই বন্যা এক সময়ে কমে আসে। একটা পাহাড়ের চূড়া দেখতে পান।
বন্যা শেষে মনু বৈবস্বত যেই পাহাড়ের চূড়ায় প্রথম পা রাখেন সেটা এই মানালিতে। বর্তমান পৃথিবীতে যে মানুষ আছে তারা এই মানালি থেকেই এসছে।
এই মানালি শব্দটাও এসেছে মনু শব্দ থেকে। যার অর্থ মনুর বাসভুমি।
‘মানব’ শব্দটাও এসেছে মনু থেকে যার অর্থ হচ্ছে ‘মনুর সন্তান’। মানুষজন যখন মানালিতে ঘুরতে আসে তখন বলা যায় মনুর সন্তানেরা মনুর বাসভূমিতে ফিরে এসেছে। সুন্দর নাহ?
তুষার দেখা
সকালে তুষার দেখতে গেলাম Solang Valley. এখানে আমাদের আনা পোশাকে যাওয়া যায় যাবে না, তাই পোশাক ভাড়া করতে হবে।
যাদের কাছে পোশাক ভাড়া নিলাম তাদের আবার বরফে স্কেটিং সার্ভিস আছে। দুইটা সার্ভিসই নিলাম। ৫০০ রুপি লেগে গেল। লাগলে লাগুক। খরচের ভয়ে সখ আহ্লাদ বিসর্জন দেয়া ঠিক হবে না।
গাড়ি পাহাড়ের গাঁ ঘেঁষে রাস্তা বেয়ে উঠছে। কোথাও কোথাও অল্প অল্প সাদা বরফ। তা দেখেই চিৎকার চলে আসে। প্রথমবার সাগর দেখে এই রকম অনুভূতি হয়েছিলো।
গাড়ি যেখানে থামালো সেখান থেকে Snow Point এ যেতে আরো কিলোমিটার খানেক হেঁটে যেতে হবে।
রাস্তার দুদিকে সাদা বরফ। এই রাস্তা আর শেষ হয় না। এক কদম আগাই আর দুইটা ছবি তুলি। আবার দুই কদম আগাই চারটা ছবি তুলি। কখনো দাঁড়িয়ে, কখনো বসে, সুযোগ পেলে শুয়ে পড়ি।
রাখাল যেভাবে গরুর পাল যেভাবে খেদিয়ে খেদিয়ে নিয়া যায়, স্যারেরাও আমাদের সেইভাবে নিয়ে যাচ্ছে।
গরু খেদানোর পরিশ্রমও এর চেয়ে কম। গরুর পাল আর যাই করুক ঘাস দেখলে চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়ে না, আমরা বরফ দেখলেই শুয়ে পড়ি।
স্পটে পৌঁছেই রাব্বানী আমার কানে কানে বলল, “চল, স্যারদের মেরে আসি। এই সুযোগ আর পাবো না।“
ইতোমধ্যে বরফ ছোড়াছুড়ি পর্ব শুরু হয়ে গেছে। আমিও বললাম, ‘চল, আল্লাহ ভরসা।“
কাঞ্চন স্যার মনে হয় একা এক দলে পড়ছে। এরশাদ থাকেন দূরে দূরে হাতের নাগালে পাচ্ছি না। আজকে শুধু পেলেই হইছে তারে!
কিছুক্ষন পর পর পোলাপান দল পাল্টায়। কাঞ্চন স্যারের দলে এখন অনেক লোক। আমাদের দলে লোক কমে গেছে। রাব্বানী গেছে আরো পোলাপান ডাকতে।
এরশাদ স্যারকে ডেকে নিয়ে আসা হয়েছে। হাতে বিশাল এক গোলা নিয়ে স্যারের আগামন। রণাঙ্গনে যুদ্ধ এখন তুঙ্গে।
শাফকাত বড় বড় বরফের চাই তুলে ধড়াম ধড়াম করে এরশাদ স্যারকে মারছে, আর বলছে “আপনার জন্য আমি ফার্স্ট ইয়ারে C তে ফেল করছি। আপনার জন্য আমি ফার্স্ট ইয়ারে C তে ফেল করছি।“
স্যার হয়তো শুনতে পায়নি। আমরা শুনে বরফ মারার উৎসাহ বেড়ে যাচ্ছে। বন্ধুর হয়ে প্রতিশোধ নেয়ার ইচ্ছা প্রবল হচ্ছে।
কাঞ্চন স্যার সেই উৎসাহে ঘি ঢেলে দিচ্ছেন। আমাদের বলছেন “জীবনে যার যা ক্ষোভ আছে মিটিয়ে রাখেন এই সুযোগ কিন্তু আর পাবেন না।“
কাঞ্চন স্যার এখনো আমাদের কোন কোর্স নেননি। সে জানে তার উপরে কারো ক্ষোভ নেই। বিপদ তাই এরশাদ স্যার একার।
কতটুকু মারলাম আর কতটুকু মার খেলাম সে হিসাব করার সময় পেলাম না। কিছুক্ষন পরে খেয়াল করলাম শীত নেই। আমার মোটেই শীত লাগছে না। কি ব্যাপার, কি হলো আমার?
ভাড়া করা ভারী ভারী জামা-কাপড় খুলে হালকা হলাম। এখন একটা শার্ট আর টিশার্ট পড়ে আছি। শীত যে করছে না তার প্রমাণ নিচের ছবি।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো দেশে ফিরে এরপর আমার শীত ভীতি কেটে গেছে। আগে অল্প শীততেই মেরুদন্ড বেঁকে কুঁকড়ে যেত।
কিন্তু এই ট্যুরের পর শীতকাল ভাল লাগতে শুরু করেছে। এখন আর কুঁকড়ে যাই না। এর হয়তো অন্য কারণ আছে, তবে আমি বিশ্বাস করতে পছন্দ করি যে এটা ট্যুরে ঘুরে আসার জন্যই হয়েছে।
তবে এটা অনেকেই স্বীকার করে যে বরফ পড়া অঞ্চলের শীতের চাইতে আমাদের দেশের উত্তর অঞ্চলের শীত এর কষ্ট অনেক বেশি।
এক সময় মারামারি থামলো। মারামারির পর দেখি স্যারেরাও খুশি। খুশির কারণ কি হতে পারে?
তারাও তো ছাত্রদের উপর ক্ষোভ দেখানোর তেমন সুযোগ পান না। তাদেরও তো অনেক ক্ষোভ আছে। এই ফাঁকে হয়তো তারাও একটু ক্ষোভ মিটিয়ে নিলো।
আসল ব্যাপার হলো এই ট্যুরের এক-সপ্তাহে ছাত্র-শিক্ষকের দূরত্ব ঘুচে গেছে। শিক্ষকরাও চাচ্ছেন তাদের ট্যুর টা সুন্দর হোক।
বরফ ছুড়াছুড়ির পর আরো দুইটা পর্ব ছিলো আমাদের।
১। স্কেটিং করা।
২। বরফের পুতুল বানানো।
২৫০ রুপি খরচ করতে হয়েছে স্কেটিং এর জন্য। স্কেটিং এর জুতা পরার পর কয়েকটা ছবি তুলেই স্কেটিং পর্ব ক্ষান্ত করতে হয়েছে। বরফের উপর দিয়ে জিনিসটা কিভাবে চালাতে হয় সেটা আর জানা হলো না।
হাতে দুটো লাঠি দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু এইগুলো দিয়ে কেমনে কোথায় ঠেলা দিয়ে চালাতে হয় সেটাও বুঝতে পারছি না। ব্যালান্স ঠিক রাখতেই বেগ পেতে হচ্ছে, সামনে আগাবো কি?
দুই তিনজন মিলে ক্ষাণিকটা টেনে, ক্ষাণিকটা ঠেলে ৪-৫ হাত নিয়ে গিয়ে বলল জুতা খুলেন। বললাম, “এই টুকুই?”
আরো দুইটা ঠেলা দিয়ে বলল, “এখন খুলেন।”
খুললাম। আড়াইশ রুপির জন্য মায়া লাগছে। মেয়েরা কয়েকজন স্কেটিংএ উঠছিলো, বাকিরা ঝামেলায় গেলো না।
তারা বরফ দিয়ে পুতুল (Snowman) বানিয়েছে। সেই পুতুলকে টুপি মাফলার পরিয়ে তার সাথে ছবি তুলছে।
Frozen movie তে Olaf চরিত্রের মাধ্যমে প্রথম Snowman সম্পর্কে জানি। এর আগে এই সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতাম না।
আমরা বৃষ্টির দেশের মানুষ। কাদা নিয়ে আমাদের কারবার। সেই কাদা দিয়ে শত শত পুতুল বানিয়েছি।
তখন আমাদের কল্পনাতেও ছিলো না পৃথিবীর কোথাও কোথাও বৃষ্টি না পড়ে বরফ পড়ে এবং সেই বরফ দিয়েও বাচ্চারাও আমাদের মতই পুতুল বানায়।
ফেরার পথে কে যেন এক কামড় ভুট্টা খাওয়ালো। ভুট্টাটা শক্ত না নরম, হালকা লেবু মাখানো, অস্থির স্বাদ।
এক কামড় খেয়ে তৃপ্তি হচ্ছে না। জিজ্ঞেস করলাম কোন দোকান থেকে কিনেছিস? বলল, “পিছনে রেখে আসছি।”
একটু সামনে আরেকটা দোকান পেলাম, এটাও লেবু মাখানো। নিজে কিনে খাওয়ার দেখি পুরাই অখাদ্য।
বুঝলাম না আরেকজনের টা খেলাম দেখে এত ভালো লাগলো নাকি আমিই কিনে ঠকেছি?
শপিং ও স্নো ফল (তুষারপাত)
সকালে তুষার দেখতে যাবার সময় যাদের রেডি হতে দেরি হচ্ছিলো, বিকেল বেলা তারাই সবার আগে শপিং চলে গেছে।
লোক খুঁজে পাচ্ছি না কাদের সাথে যাবো। শপিং কাজ হয় ছোট ছোট দলে। মনের মত দল না পেলে শপিং করা কঠিন।
মার্কেট দুই আড়াই কিলোমিটার দূরে। হেঁটেই আসলাম। মার্কেটের কাছকাছি যেতেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
বৃষ্টির পানি খুবই ঠান্ডা। মোটা মামুন দেখি ট্রাফিক পুলিশের মত বড় একটা সাদা ছাতা মাথায় দিয়ে ঘুরছে। জিজ্ঞেস করলাম, “ছাতা কোথায় পেলি?”
দোকান দেখিয়ে বলল, “ওই দোকানে ভাড়া দেয়। ৫০০ রুপি জমা নিবে, ছাতা ফেরত দিলে রুপি ফেরত দিয়ে দেবে।”
বললাম, “চার্জ নিবে না কোনো?”
বলল, “না। এটা মার্কেট এর সার্ভিস। তাড়াতাড়ি যা ছাতা শেষ হয়ে যাবে।”
যেতে যেতেই আসলেই ছাতা শেষ। অন্যান্য দোকানেও শেষ। ছাতা খুঁজতে খুজেতেই ভিজে গেলাম, ছাতা পেলাম না। ভিজা শরীরেই শপিং করতে গেলাম। ঠান্ডা সূচের মত গায়ে বিঁধছে।
হালকা ভিজা শরীর নিয়েই শপিং নেমে পরলাম। এখানেও চাদরের কারবার। কুল্লুর চাইতে দাম কম। মান কেমন এটা আমাদের বিবেচ্য বিষয় না, দামই আসল।
চিন্তা করলাম এই সুযোগে বাড়ির সবার জন্য চাদর কিনে ফেলবো। কিন্তু একটা চাদর কেনার পর শারমিন ফোন দিলো।
গিয়ে দেখি শীতে কাঁপতেছে। কাঁপতে কাঁপতে বলল, “আর সহ্য করতে পারছি না। আমাকে একটু হোটেলে দিয়ে আয়। কাউকে পাচ্ছি না যে হোটেলে যাবে।”
কারো যাবার কথাও নয়। কারণ এখন ফিরে গেলে আর ফিরে আসতে পারবে না। শপিং ভেস্তে যাবে। বললাম, “কয়েকটা চাদর কিনবো। একটু পরে যাবো।”
বলল, “আমার আর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি নেই। আমাকে একটা অটো ম্যানেজ করে অন্তত।”
রাস্তায় বৃষ্টি আগের চেয়েও বেশি। অটো ম্যানেজ করতে ভিজতে হবে৷ অটো হোটেলের রাস্তায় তেমন যায় না। আর আমি ভিজলে আমারও শপিং শেষ।
কিন্তু বুঝলাম বিকল্প পথও খোলা নেই। এই অবস্থায় না বলার ক্ষমতা আমার নেই। আমি না বলে দিলে বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিন্ন করে একাই হোটেলে ফিরতে হবে তাকে।৷
শপিং এর মায়া ত্যাগ করতে হলো। ভিজে অটো ম্যানেজ করলাম। অটোতে আসতে আসতে আরেক দফা ভিজলাম। হাতের কব্জির অংশ অবশ হয়ে গেছে। কোন বোধ পাচ্ছি না।
হোটেলে এসে টের পেলাম আমার রুমের চাবি নিয়ে আসিনি। রিসিপশন থেকে জানালো ডুপ্লিকেট চাবি নেই। রাব্বানীকে ফোন দিচ্ছি যাতে চাবি নিয়ে দ্রুত চলে আসে।
এখন রওনা দিলেও আধা ঘন্টার আগে আসতে পারবে না। আর যদি দেরি করে তাহলে তো কথাই নেই।
এক মিনিটও ঠান্ডা সহ্য হচ্ছে না এতক্ষণ কি করবো? আর পুরো হোটেলে আমরা ছাড়া কেউ নেই।
এখন শারমিনের রুমেই ফ্রেশ হতে হবে। কিন্তু হোটেলে ফিরেই শারমিন অকৃতজ্ঞের মত আচারণ করছে। তার রুমে ঢোকা নিষেধ। তার ভয় কেউ যদি দেখে ফেললে তো বিপদ।
বিপদ এড়াতে আমাকে বলল, “তুই বাইরে দাড়া আমি ফ্রেশ হয়ে আসি তারপরে তুই যাবি।“
শুনেই মেজাজটা গরম হয়ে গেলো। বাইরে কোথায় দাড়াবো?
ঠান্ডা কল্পনার বাইরে। এতক্ষন ব্যস্ততার মধ্যে ছিলাম তাই ঠান্ডা ততটা লাগে নি। এখন সহ্য সীমার বাইরে। তাপমাত্রা জিরোর কাছাকাছি।
রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছি। চাবি ফেলে আসার দায় তো শারমিনকে দিতে পারি না। কিন্তু মন সেই লজিক মানতে নারাজ। তার মতে ওরে নিয়ে আসতে না গেলে তো ভিজতে হতো না, চাবিও ফেলে আসতে হতো না।
বাইরে দাঁড়িয়ে এক এক মিনিটকে কয়েক হাজার ঘন্টা মনে হচ্ছে। সে হিসেবে আমার ট্যুর বাকিদের চাইতে অনেক লম্বা।
শত সহস্র বছর পরে শারমিন বের হলো। ভেতরে গিয়ে গিজারের গরম পানির নিচে হাত জোড়া সঁপে দিলাম। সেই পানির স্পর্শ মনে হচ্ছে প্রেয়সীর নরম হাতের চাইতেও কোমল, আরোও বেশি উষ্ণ। জীবন ফিরে পাওয়ার পরশ।
আমি ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে দেখি সেই বৃষ্টি আর বৃষ্টি নেই, তুষার পাত শুরু হয়ে গেছে।
জীবনে দেখা প্রথম তুষারপাত আমাকে স্পর্শ করতে পারল না। কারণ শীত আমার অস্থিমজ্জায় ঢুকে গেছে। ভারী কিছু গায়ে চাপতে না পারলে যে কোনো সময় সেন্সলেস হয়ে যেতে পারি।
কিছুক্ষণ পর রতন বালা আসলো। দেখেই মনে হচ্ছে যেন প্রাণ ফিরে পেলাম।
রতনদের রুমে গিয়ে টুপ করে কম্বলের নিচে ঢুকে গেলাম। এর চাইতে পরম আনন্দ জীবনে আর কিছু হতে পারে না। তুষারপাত তো সেখানে অতি তুচ্ছ বিষয়।
রব্বানী মনে হয় সবার শেষে আসলো। বাকি যারা আগে আগে চলে আসছে সবাই ভিজে আসছে।
সারারাত ধরে বৃষ্টি হলো। DJ Party গোল্লায় গেলো। ফায়ারিং এর কেনা কাঠ সারারাত ধরে বাইরে ভিজতে থাকলো।
এক এক দল ফিরে আসে আর সাথে ঠান্ডা পানিতে ভিজে যাওয়ার গল্প নিয়ে আসে।
সেই গল্পের আড্ডা জমলো পৃথ্বীদের রুমে। সবাই কম্বলের নিচে পা ঢুকিয়ে গোল হয়ে বসার দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছে সকলেই আনেক আপনজন হয়ে গেছে এত দিনে। এভাবে বাড়িতে বৃষ্টির দিনে অলস সময় কাটাতাম।
চিকনা মামুন, আকাশ সাহাদের দলে ছিল তৃণা, স্বর্ণালী, নবনীতা। এরা সবাই বৃষ্টিতে ভিজে অটোর জন্য দাঁড়িয়ে আছে।
কিন্তু মেয়েদের মধ্যে ঝগড়া, তারা একসাথে আসবে না। এইদিকে মামুনরা অটো পাচ্ছে না, আর তারা গোঁ ধরেছে এক অটোতে আসবে না।
অটো না পেয়ে একটা ক্যাব ভাড়া করেছে। কিন্তু মেয়েরা উঠবে না।
জোর করে গাড়িতে তোলার পর দেখে গাড়িওয়ালা পাঞ্জাবী লোক। মাথায় বিশাল পাগড়ী। সেই পাগড়ী দেখেই তৃণা, স্বর্ণালী দুই জন একসাথে এই পাঞ্জাবীর উপরে ক্রাশ খেয়েছে (প্রেমে পড়ার প্রথম ধাপ)।
তুমুল ঠান্ডায় যেখানে প্রাণ বাঁচানো দায়, সেখানেও তাদের প্রেমে পড়া বন্ধ নাই। শাফকাত রাজস্থান থেকে একটা বিশাল পাগড়ী কিনেছিলো। ওকি আসলে জানতো যে কিছু মেয়ে পাগড়ী দেখে ক্রাশ খায়?
সেই রাতে আমরা সবাই মিলে সিনথিয়ার জন্মদিন পালন করলাম। মেয়েটা ভাগ্যবতী। ট্যুরটা আমাদের সবার জীবনেই স্পেশাল। তার জন্মদিনটাও স্পেশাল হয়ে গেছে।
মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে দেখি বাইরে তুষারপাত চলছে।
সকালে মানালির চেহারা পাল্টে গেলো। সাদা রঙে ছেয়ে গেলো। সকালের শুভ্রতা দেখে মন ভরে গেলো। সব কষ্ট ভুলে গেলাম।
এই দৃশ্য সচক্ষে দেখার সৌভাগ্য সকলের হয় না। পরে জানলাম গতকালই ছিলো এবছরের প্রথম তুষারপাত। সেক্ষেত্রে আমরা যথেষ্টই সৌভাগ্যবান।
রাস্তাঘাটের বরফ গলে গাড়ি চলাচলের উপযোগী হতে আরো সময় লাগবে। আর আমাদের River Rafting এর প্রোজেক্টও ক্যান্সেল।
এত শীতে পানির কাছাকাছি যাওয়ার সাহস আমাদের কারো নেই। যারা কালকে ভিজছে তাদের তো আরো নেই। হাতে সময় আছে কিন্তু করার কিছু নেই।
হোটেলের পিছনে বাগানে ঢুকে বুঝতে পারি এটা আপেল বাগান। কিন্তু সিজনের আপেল শেষ হয়ে গেছে। গাছগুলো খালি।
এর মধ্য থেকেও দু একজন আপেল খুঁজে বের করলো। কপাল কি আমারই মন্দ? গাছ থেকে আপেল তো ছিড়তে পারলামই না, গাছে আপেল আছে এরকম একটা দৃশ্যও দেখতে পারলাম না।
শেষ পর্যন্ত মানালিতে চারটি প্লানের মধ্যে মাত্র দুইটা সফল করতে পেরেছিলাম। সেটা নিয়ে কারো কোন আফসোস নেই।
কারণ শপিংটা তারা কোন মতে করতে পেরেছিলো। শপিং করতে না পারলে তাদের আফসোসের সীমা থাকতো না। শপিং ঠিক তো সব ঠিক।
রোল- শহ-৩৪
সেশন-২০১৪-১৫
ড। মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হল
- মো: আজমির হোসেনhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%ae%e0%a7%8b-%e0%a6%86%e0%a6%9c%e0%a6%ae%e0%a6%bf%e0%a6%b0-%e0%a6%b9%e0%a7%8b%e0%a6%b8%e0%a7%87%e0%a6%a8/বৃহস্পতিবার, জুলাই ১৪, ২০২২
- মো: আজমির হোসেনhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%ae%e0%a7%8b-%e0%a6%86%e0%a6%9c%e0%a6%ae%e0%a6%bf%e0%a6%b0-%e0%a6%b9%e0%a7%8b%e0%a6%b8%e0%a7%87%e0%a6%a8/বৃহস্পতিবার, আগস্ট ১১, ২০২২
- মো: আজমির হোসেনhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%ae%e0%a7%8b-%e0%a6%86%e0%a6%9c%e0%a6%ae%e0%a6%bf%e0%a6%b0-%e0%a6%b9%e0%a7%8b%e0%a6%b8%e0%a7%87%e0%a6%a8/বৃহস্পতিবার, ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২৩
- মো: আজমির হোসেনhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%ae%e0%a7%8b-%e0%a6%86%e0%a6%9c%e0%a6%ae%e0%a6%bf%e0%a6%b0-%e0%a6%b9%e0%a7%8b%e0%a6%b8%e0%a7%87%e0%a6%a8/বৃহস্পতিবার, জানুয়ারি ১১, ২০২৪