এক
আগষ্ট ২২, ২০১৫। সকাল ৯ :৫০। আমি স্টক কাংরী পর্বত (৬, ১৫৩ মি: / ২১,০০০ ফিট) আরোহন সম্পন্ন (সামিট) করে গভীর চিন্তায় মগ্ন। আমার সাথে আরো দুজন বাংলাদেশী পর্বতারোহী রয়েছেন, আবু তালেব মিয়াজী সাগর এবং সালমান হোসেন। তাদের মধ্যে সাগর বেশ আনন্দিত, সালমানকেও আমার মতো চিন্তিত বলে মনে হলো। চিন্তিত না হয়েও উপায় নেই।
গত রাত ১১টা থেকে হাঁটা শুরু করেছি, সারারাত হেঁটে স্টক গ্লেসিয়ার পার করেছি, তারপর প্রায় চার ঘন্টা খাড়া উপরের দিকে উঠে পিক সামিট করেছি এবং এই মুহুর্তে শরীর বিন্দুমাত্র শক্তি অবশিষ্ট নেই। গতরাত পানি ও খেতে পারছি না কারন বোতলের পানিও বরফ হয়ে গেছে।
একবার বরফ চুষে খাবার চেষ্টা করে দেখেছি, সেটাও কঠিন। আমার চিন্তিত হবার মূল কারণ আমি ভেবে পাচ্ছি না যে, আমি নামবো কীভাবে। চিন্তিত অবস্থায় আমি আমার দলকে কঠিন নির্দেশ দিলাম যে, আমি এখন পিকের উপর ঘুমাবো কেউ যেন আমাকে ১০ মিনিট কোনো বিরক্ত না করে। আমার দলের সবাই ছবি তুলছে, আমি ঘুমাচ্ছি, অত্যন্ত আনন্দের ঘুম!
দুই
স্টক কাংরি পর্বত মূলতঃ লাদাখে (জম্মু কাশ্মির) অবস্থিত। লেহ্ শহর থেকেই দেখা যায় বরফে মোড়ানো স্টক কাংরি পিক। স্টক কাংরি অভিযান করার পরিকল্পনা আমাদের অনেক দিনের, সময় আর সুযোগের অভাবে হয়ে উঠছিলো না। এইবার হঠাৎ করে ভারতে একটি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে মনে হলো, ঘুরেই আসি। বিশাল এক যাত্রা শেষ করে আমরা লেহ্ শহরে পৌঁছালাম ১৬ আগষ্ট। শুধুমাত্র মানালী থেকে লেহ্ পৌঁছাতেই লেগে গেল দুইদিন। লেহ্ পৌঁছেই খুঁজে পেলাম গ্রীনল্যান্ড রেস্টহাউস। এটি মূলত একটি বাসা যেখানে ট্যুরিষ্টরা গেলে থাকতে পারে। লাগেজ রেখেই বেরিয়ে পরলাম আমাদের ট্যুর অপারেটর এর খোঁজে। লেহ্ তে অনেক ট্যুর অপারেটর রয়েছে যারা কম খরচে আপনার জন্য সকল কিছু ব্যবস্থা করে দেবে। লাদাখে পাহাড়ে উঠতে হলে আপনার ক্লাইম্বিং পারমিট লাগবে। আমরা পারমিটের জন্য আবেদন করে রেষ্ট হাউজে ফেরত আসলাম। পরদিন সকালে আমাদের জানানো হলো যে, বাংলাদেশীদের জন্য লাদাখ উন্মুক্ত নয়। প্রায় তিন দিনের যুদ্ধ শেষে, ইন্ডিয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ফেডারেশন আমাদের অনুমতিপত্র অনুমোদন করলো। এখন থেকে লাদাখ ভ্রমণে, বাংলাদেশীদের আর কোনো সমস্যা হবে না।
১৯ তারিখ সকাল সাতটায় আমাদের অভিযাত্রীর দল যাত্রা শুরু করলো স্টক গ্রামের উদ্দেশ্যে। অভিযাত্রী দলে আমরা তিনজন বাংলাদেশী আর দুজন ব্রিটিশ অভিযাত্রী। প্রথমদিন আমাদের পৌঁছাতে হবে ক্যাম্প – ১ (চাংমা) – তে। সহজ রাস্তা। সকাল ১০টা স্টক গ্রাম থেকে হাঁটা শুরু করলাম। ক্যাম্প – ১ প্রায় ১৩, ০৮৭ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত। এখানকার পাহাড় অনেকটাই রুক্ষ। গাছপালা প্রায় নেই বললেই চলে। স্টক গ্লেসিয়ার থেকে যে নদী নেমে এসেছে, সেটি ধরেই উপরে ওঠার রাস্তা। এখানে অক্সিজেন মাত্রা অনেক কম। ধীরে ধীর হাঁটতে হয়।তবে এই রাস্তাটার আলাদা একটা সৌন্দর্য আছে, যা এখানে না আসলে বোঝা যাবে না। সহজ রাস্তা বলে আমরা ক্যাম্প -১ এ না থেকে সরাসরি ১৪, ২০০ ফিট উপরে ক্যাম্প -২ তে পৌঁছে গেলাম।
বিকাল তিনটা অভিযাত্রী দল কিচেন টেন্টে বসে আছে খাবারের জন্য। খাবার খুবই সাধারণ। নুডুলস্ এবং সুপ। বিকাল বেলা ক্যাম্প এলাকা ঘুরতে বের হলাম। আকাশে একটু মেঘ করেছে। একটু অবাক হলাম। লাদাখে বৃষ্টি প্রায় হয় না বললেই চলে। মনে মনে একটু ভয় পেলাম, বৃষ্টি হলে পিক সামিট করা আর হয়ে উঠতে নাও পারে। মানকারমা ক্যাম্প ঘুরে দেখলাম। নীল আকাশ, স্বচ্ছ নদীর পানি আর বরফাচ্ছাদিত পাহাড়ের সারি, মানকারমার সৌন্দর্যকে স্বর্গের সাথে তুলনীয় করে তুলেছে। মানকারমার সুর্যাস্ত দেখে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। পরের দিন আমাদের যেতে হবে বেসক্যাম্প – এ ১৬, ৩০০ ফিট। মানকারমায় আমাদের জন্যে তাবু টানানো হয়েছে। প্রচন্ড ঠান্ডা। কোনোমতে স্লিপিং ব্যাগের ভিতর ঢুকে পরের দিন কী হবে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
মানকারমা থেকে বেসক্যাম্পে যাওয়ার রাস্তা সহজ। মাত্র দুই ঘন্টার পথ। সকাল সাতটায় ঘুম থেকে উঠে পড়লাম। নাস্তা খেয়ে আমাদের যাত্রা শুরু করলাম। পথ যদিও সহজ কিন্তু বেশ পাথুরে। বেশ ব্যালেন্স করে হাঁটতে হয়। সাথে ব্যাকপ্যাক তো আছেই। রাস্তা মূল সমস্যা নয়, সমস্যা হলো বাতাসে অক্সিজেনের পরিমান কমতে শুরু করছে। আমরা সকাল ১০টায় স্টক কাংরির বেসক্যাম্পে পৌঁছে গেলাম। বেসক্যাম্পটা তেমন সুন্দর না, অনেক রুম এবং বেশ অপরিষ্কার। বড় নড় দুটি কিচেন টেন্ট। বিভিন্ন দেশের অভিযাত্রীরা এসে জড়ো হয়েছে। বড় পাহাড়গুলোর বেসক্যাম্পে না গেলে বোঝাই যাবে না কতো মানুষ পাহাড়ে আসে। আজকে সারাদিন বেসক্যাম্পে থাকবো। রাতে আমরা স্টক কাংরী পিক সামিট করার উদ্দেশ্যে বের হবো।
সকাল ১১টায় আকাশে কয়েক গোছা মেঘ দেখা গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হলো তুষারপাত। তীব্র তুষারপাতের সাথে ঝড়ো হাওয়া কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো বেসক্যাম্পটা তুষারে ঢেকে দিলো। তাপমাত্রা এমনিতেই শুন্যের তিন ডিগ্রি নিচে নেমে গেলো। আমাদের কাপড় চোপড় যা এনেছি তাতে শুন্যের নিচে পাঁচ ডিগ্রি পর্যন্ত সামলাতে পারবো, এর নিচে গেলে কষ্ট হবে। বেলা একটায় আমরা বরফাচ্ছাদিত তাঁবুর ভিতরে থর থর করে কাঁপতে লাগলাম। এরকম চলতে থাকলে আজকে সামিট পুশ করার সম্ভাবনা প্রায় শুন্য। বিকেল চারটায় তুষার ঝড় কমে এলো, কিন্তু পুরো এলাকা তুষারে ঢেকে দিয়ে গেলো। সন্ধ্যায় স্যুপ,নুডলস খেয়ে চেষ্টা করলাম একটু ঘুমিয়ে নিতে। কিছুক্ষণ ঘুমানোর পরই আমাদের ডাক পড়লো তৈরি হয়ে নেবার জন্যে। রাত ১১টায় আমরা কিছু পরিজ খেয়ে আমাদের যাত্রা শুরু করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই খাড়া একটা রাস্তা সামনে পড়লো। রাতের অন্ধকারে শুধুমাত্র হেডল্যাম্প সম্বল করে হাটা।কিছুদূর যেতেই আমাদের গাইড বললো ক্র্যাম্পন পরে নিতে। এমনিতেই স্নোবুটের অনেক ওজন তার উপর ক্র্যাম্পন পড়লে সেটা পড়ে হাঁটতে অনেক কষ্ট হবে। প্রচণ্ড ঠান্ডার ভয়ে পাঁচ ভাজ কাপড় পরেছি, সাথে North Face Gi Summit Series জ্যাকেট। তাতেও ঠান্ডা কমছে না। হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি তাপমাত্রা শুন্যের ১৪ ডিগ্রি নিচে। রাত ১টা থেকে শুরু হলো আমাদের অন্ধের মত হাঁটা। প্রথমে আইস এক্স বরফে করি আবার এক পা এক পা করে এগিয়ে যাই।একবার চেষ্টা করলাম একটু বিশ্রাম নেয়ার, কিন্তু কাঁপুনি ধরে যায় ঠান্ডায়। হাঁটলে তাও শরীর একটু গরম থাকে। পরবর্তী চার ঘন্টা মহা বিরক্তিকরভাবে উপরে উঠে চলেছি। ভোর চারটায় আমাদের ব্রিটিশ অভিযাত্রীরা বমি করা শুরু করলো। ভোর পাঁচটায় তারা ঠিক করলো সে তারা ফিরে যাবে। ভোর ৫টায় আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম গ্লেসিয়ার এর মাঝখানে। পানি খাবার জন্যে বোতলটা নিয়ে দেখি জমে বরফ হয়ে গেছে। আরো ঘণ্টা খানেক হাঁটার পর গ্লেসিয়ারের মাথায় উঠে এলাম। এ জায়গাকে স্টক কাংরীর কাঁধ বলা হয়।
সবাই রোসাহারনেস পরে নিলাম। একজন পরে গেলে এখন সবাই মিলে পরবো। পরবর্তী দুই ঘন্টা একদম খাড়া উঠে যেতে হবে। আইস এক্স ধরে ধরে উঠে পরতে লাগলাম। শেষ দিকে আর শরীর চলছে না। বিশ হাজার ফিট উপরে অক্সিজেনের পরিমাণ অনেক কম। প্রচণ্ড কষ্ট হতে লাগলো। এখন একটু না ঘুমালেই নয়। স্বাভাবিকভাবেই বাকি অভিযাত্রীরা আমার এই আহ্বানে সাড়া দিলো না। বাকী ১০০ মিটার আমি প্রায় চোখ বন্ধ করেই উঠে পরলাম। আমার গ্লাস পুরো বরফ হয়ে গেছে। কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না।
তিন
সকাল ১০:১০, আমরা স্টক কাংরী পর্তের চূড়া হতে নামা শুরু করলাম। পর্বতে ওঠার চেয়ে নামা অনেক কঠিন, একবার পা ফসকে গেলে প্রায় চার হাজার ফিট নিচে গিয়ে পরবো। গত সপ্তাহে একজন পরে গিয়েছে। ইসরাইলি একজন পর্বতারোহী। মন্থর গতিতে নেমে চলেছি। মাঝে-মাঝে বসে একটু জিড়িয়ে নিচ্ছি। শরীরের অনেক জায়গার কোন অনুভূতি নেই। শুধু নামতে হবে বলে নেমে চলা। প্রায় চার ঘন্টা হেঁটে পৌছালাম ফ্রোজেন লেক। প্রায় ১৮ ঘন্টা পেটে কিছু পড়েনি। পানিও খেতে পারছি না। ফ্রোজেন লেক পার হয়ে সামনে রাস্তা উঠে গেছে উপরের দিকে। বিষন্নতায় মনটা ছেয়ে গেল। আবার উঠতে হবে।
বিকাল ৪:৩০, শরীরটাকে কোনমতে টেনে একটা টিলার চূড়ায় উঠিয়েছি। এখন আমার চিন্তা শক্তিও বেশ লোপ পেয়েছে। হাটঁতে হাঁটতে ঘুমিয়ে পড়ছি। হাঁটতে হাঁটতে ঘুমানো যায় এটা আমদের ধারণার বাইরে ছিল। টিলার চূড়ায় উঠে বসে পড়লাম। চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগলাম। বিভিন্ন চিন্তা মাথায় ঘুরতে লাগলো। মনেমনে কঠিন শপথ করে নিলাম, অনেক হয়েছে আর না। আর কোনদিন পাহাড়ে আসবো না। সবকিছুর একটা সীমা আছে! দুনিয়াতে করার অনেক কিছু আছে। পাহাড়ে আসতে হবে কেন?
কিছু সময়ের বিশ্রাম শরীরে আবার একটু শক্তি ফিরিয়ে দিল। আবার নামা শুরু করলাম। মিনিট দুয়েক হাঁটার পরেই বেসক্যাম্পটা চোখে পড়লো। আর মিনিট দশেকের রাস্তা। যাক এযাত্রা বেঁচে গেলাম। আরও মিনিট দুয়েক হাঁটার পর মনে হতে লাগলো জায়গাটা একদম খারাপ ছিল না। আরো মিনিট দশেক হাঁটার পর বেসক্যাম্পে পৌঁছে গেলাম। সবাই অভিনন্দন জানাচ্ছে। এক কাপ চা হাতে সবার সাথে আড্ডা দিচ্ছি মনেমনে ভাবছি, পর্বতারোহণ বিষয়টা একদম খারাপ না। মাঝে-মাঝে আসাই যায়!
রাতে ঘুমুতে যাবার সময় মনে হতে লাগলো, আহা অভিযাত্রা শেষ, আবার যে কবে আসতে পারবো!………….
প্রাক্তন শিক্ষার্থী
সেশনঃ ২০০০ - ২০০১
- This author does not have any more posts.