fbpx

বইয়ের নামঃ বিষাদ সিন্ধু

বাংলা সাহিত্যে প্রথম মুসলিম ঔপন্যাসিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে মীর মশাররফ হোসেন ঐতিহাসিক ও মর্মান্তিক কারবালার কাহিনীকে বেছে নেন উপন্যাসের পটভূমি হিসেবে।। পরবর্তীতে সেই ঘটনার উপর ভিত্তি করে কল্পনাশক্তির আশ্রয়ে সৃষ্টি করেন মহাকাব্যিক উপন্যাস।

বইটির ব্যাপারে আমার প্রথম আগ্রহ জন্মে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সেই সময়’ উপন্যাস থেকে , যেখানে উক্ত বই রচনার পটভূমির একটা easter egg দেওয়া ছিলো। মূলত মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার এক চিঠিতে এই কারবালার ঘটনার উপর উপন্যাস বা কাব্যজাতীয় রচনার পটেনশিয়াল এর আলোচনা করেন।

যাইহোক বইটির কথা বলতে গেলে সবার প্রথম কাহিনীর আলোচনাই শ্রেয়। মহানবী (স.) এর দুই নাতি হাসান, হোসেইন, তাঁদের সাথে তৎকালীন শাসকের এর দ্বন্দ এবং উনাদের হত্যার ঘটনার উপর নির্ভর করে মূলত উপন্যাস এর পটভূমি।

“প্রণয়, স্ত্রী,রাজ্য,ধন এই কয়েকটি বিষয়ের লোভ বড় ভয়ানক।এই লোভে লোকের ধর্ম,পুণ্য,সাধুতা,পবিত্রতা সমস্তই একেবারে সমূলে বিনাশ প্রাপ্ত হয়।অতি কষ্টে উপার্জিত বন্ধুত্ব রত্নটিও ঐ লোভে অনেকেই অনায়াসে বিসর্জন দেয়।মানুষ এ লোভে অনায়াসে যথেচ্ছ ব্যবহারে অগ্রসর হইতে পারে।”

অর্থাৎ মূল উপজীব্য টা এই ৪ টি বিষয়ের লোভ এর উপরেই। জয়নব কে পাওয়ার লোভে পরে এজিদ একের পর এক ষড়যন্ত্র করে যায়। হিংসার বশবর্তী হয়ে প্রথমে হাসানকে পরে অন্ধ ঘৃণা ও রাজ্যলোভে হোসেন কে হত্যার ছক কষে। যার ফলে ঘটে হৃদয়বিদারক ঘটনা। ইতিহাস সাক্ষী হয় এক নির্মম নিষ্ঠুরতার।

বই টি ৩ পর্বে বিভক্ত, মহররম পর্ব, উদ্ধার পর্ব ও এজিদ বধ।।

এর মধ্যে মূল পটভূমি মহররম পর্বেই এবং বিষাদ সিন্ধু এর নামের যথার্থতা প্রকাশ পায় ও মহররম পর্বেই। এক বিষাদ মাখা করুণরস আর হতাসার আখ্যান এই পর্ব টিতে।

তবে কেউ উত্তেজনা, ঘটনার নাটকীয়তা, মোড় , সবকিছু পেতে চাইলে ২য় পর্ব টা সেই রসআস্বাদন এর সুযোগ দিবে। মহররম পর্ব ছিল ট্রাজেডি তে ভরপুর , বিষাদ মাখা আখ্যান, পদে পদে বিপদ, প্রতিটি ধাপে বিশ্বাস ঘাতকতা ও ছলচাতুরীর শিকার। সাহিত্যের মাধুর্যে অভিভূত হতে হলেও  ঘটনার ব্যাপারে এখানে বলা যায় যে একই ধরণের কিছু অনুমেয় ঘটনার  পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে।

কিন্তু উদ্ধার পর্বের শুরুটা বিষণ্নতায় শুরু হলেও ধীরে ধীরে কাহিনী আশার সঞ্চার করে, বিশ্বাসঘাতকতার চিহ্ন সেখানে থাকলেও মুক্তি ও সেখানে প্রতীয়মান। নাটকীয় বেশ কিছু মোড় এখানে লক্ষণীয় যা কাহিনী তে পূর্ব-অনুমেয় ছিল না, যা ১ম পর্বে অনুপস্থিত। ফলে মহররম পর্বের চেয়ে এই পর্ব ঘটনা অগ্রগতির দিক থেকে অনেক টাই পরিপূর্ণ।।

এবার যদি উপন্যাসের মান বিচারে আসি তাহলে বলতে হয় যেহেতু এটা সাহিত্যের অনেকটাই প্রথম দিকের উপন্যাস তাই লেখক মহাকাব্যের প্রভাব থেকে আসলে মুক্ত হতে পারেন নি বা চান নি। মহাকাব্যিক ধাঁচে মধুর বর্ণনা উপন্যাস এর পাঠকে আরোও মধুময় করে তুলে যা আমি এই রিভিউ তে তুলতে চাইলে লাইনের পর লাইন খালি বাড়বেই। আর ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসেবে যদি দেখতে চাই তাহলে কিছু টা এর যথার্থতার প্রশ্ন আসে এবং তখনই  এটাকে ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসেবে আর স্বীকৃতি দিতে পারি না কারণ ইতিহাসের চরম বিকৃতি এখানে পরিলক্ষণীয় এবং অনেক আলৌকিক ঘটনাবলির   স্থান এখানে পায়।

তাই ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসেবে বিবেচনা না করে এটাকে সত্য ইতিহাস হিসেবে না মেনে যদি সাহিত্য হিসেবে পাঠ করা হয় তবে  বলবো এটি অনবদ্য এক সৃষ্টি। দুয়েকটি প্রিয় লাইন দিয়ে শেষ করি

১. হুতাশনের দাহন আশা,ধরণীর জলশোষণ আশা,ভিখারীর অর্থলোভ আশা,চক্ষুর দর্শন আশা,গাভীর তৃণভক্ষণ আশা,ধনীর ধন বৃদ্ধির আশা, প্রেমিকের প্রেমের আশা,সম্রাটের রাজ্য বিস্তার আশার যেমন নিবৃত্তি নাই,হিংসাপূর্ণ পাপ হৃদয়ে দুরাশারও তেমনি নিবৃত্তি নাই-ইতি নাই।

২. বিপদগ্রস্ত না হইলে নিরাপদের সুখ কখনোই ভোগ করা যায়না; দুঃখ ভোগ না করিলে সুখের স্বাদ পাওয়া যায়না

৩. যে আমার নয়, আমি তাহার কেন হইবো।

শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশন : ২০১৯ - ২০২০

আদনান করিম চৌধুরী

সেশন : ২০১৯ - ২০২০