fbpx

ফটোগ্রাফি জুলাই ২০১৫

ফটোগ্রাফির পূর্বযুগে ১৮৫৪ সালে ড‍্যানিশ দার্শনিক সোরেন কিয়ারকেগার্ড (১৮১৩-১৮৫৫) নতুন করে জনপ্রিয় হয়ে উঠা আলোকচিত্র গ্রহণ সম্পর্কিত শিল্পের তুচ্ছ অদৃষ্ট সম্পর্কে ভবিষ‍্যৎবাণী করেছিলেন। “ডাগেরোটাইপ (পুরানো ধরণের ছবি যা সিলভার হ‍্যালাইড প্রলেপ ব‍্যবহার করে প্রস্তুত করা হতো) পদ্ধতিতে সকলেই তাদের ছবি পাবেন – যা আগে শুধু নিখুঁত প্রত‍্যক্ষশক্তির মাধ‍্যমে প্রস্তুত করা হতো – এবং এক‌ই সাথে সবকিছুই হুবহু তৈরি করা সম্ভব হবে, কাজেই আমাদের একটাই প্রতিকৃতির প্রয়োজন হবে।”

 এখনকার দিনে আলোকচিত্র শিল্প বিশ্বব‍্যাপী একটি স্থিরচিত্রের বিরক্তিকর রূপে পরিণত হয়েছে। প্রতি মিনিটে লক্ষ লক্ষ ছবি আপলোড করা হচ্ছে। ফলে প্রত‍্যেকেই এখন বিষয়বস্তু, এবং প্রত‍্যেকেই আলোকচিত্র শিল্প জানে। এখন যে কোনো দিন আমরা অরক্ষিত মুহূর্তগুলোকে বিপজ্জনক প্রজাতির তালিকায় যুক্ত করতে যাচ্ছি। পেশাগত ও আনাড়ি প্রত‍্যেক আলোকচিত্র শিল্পীই সুযোগ ও দক্ষতার সম্মিলনে জীবনে একবারের জন্য হলেও একটি মহাকাব‍্যিক মূহুর্তকে ধারণ করতে চান যা একজন আলোকচিত্র শিল্পীকে বহু বিখ্যাত আলোকচিত্র শিল্পীর কাতারে নিয়ে যাওয়ার অর্জন এনে দেবে। উদাহরণস্বরূপ, বিশ্বখ‍্যাত আলোকচিত্র শিল্পী স্টিভ ম‍্যাক্কারির ‘আফগান গার্ল’ এর মতো মহাকাব‍্যিক আলোকচিত্রের উল্লেখ করা যায় যা ১৯৮৪ সালে পাকিস্তানের একটি শরণার্থী শিবির থেকে নেয়া হয়েছিলো। তিনি এখনো জীবিত এবং তার সমগ্র জীবন‌ই কেটেছে আলোকচিত্র শিল্পে। অন‍্য কেউ কি তার কাজ দিয়ে এমন পরিচিত হতে পেরেছেন?

যদিও গত ১৬০ বছরে কিয়ারকেগার্ড-এর দর্শনকে কেউ চ‍্যালেঞ্জ করেনি, তবুও এটা প্রতীয়মান হয়েছে যে কিয়ারকেগার্ড এক‌ই সঙ্গে সঠিক ও ভ্রান্ত। বিভিন্ন পত্রিকা ও সামাজিক মাধ্যমে যে চিত্র প্রকাশিত হয়েছে তা শুধু ‌বিশ্বের এক‌ই চিত্র ফুটিয়ে তোলেনি বরং চমৎকার বৈচিত্র্যকে তুলে ধরেছে। কিন্তু এগুলো ক্রমাগতভাবে সমাজ, প্রজাতি ও প্রাকৃতিক ভূদৃশ‍্যকে পুঁথিগত করেছে যা আমাদের সমমাত্রিক তাড়না দ্বারা হুমকির মুখে পড়ছে।

দর্শন যাই হোক না কেন, আপনার আলোকচিত্র গ্রহণকারী অস্ত্রটি নিয়ে এখন‌ই নেমে পড়ুন আপনার জীবনের মহাকাব‍্যিক মূহুর্তকে বাক্সবন্দী করার অভিযানে।

ক‍্যামেরার ইতিহাস

শুরুরদিকে মানুষের অবয়ব, বিভিন্ন শখের বস্তু, ইমারত ও নৈসর্গিক দৃশ‍্যকে ধরে রাখার জন্য নানা উপায়ে চেষ্টা চালানো হতো। এক পর্যায়ে শুরু হয় কলম‌ ও রঙ-তুলির ব‍্যবহার। তারপর কাপড়, কাগজ ও পাথরের ওপর ছবি আঁকার প্রচলন শুরু হতে থাকে। স্মৃতি রক্ষার্থে মানুষের ছবি, ইতিহাসখ্যাত ইমারত, ঐতিহাসিক বিভিন্ন দৃশ‍্য ও শখের বস্তুকে কলম অথবা রঙ-তুলির সাহায্যে ক‍্যানভাসে ধরে রাখার চেষ্টা চালায় মানুষ। এভাবে ধীরে ধীরে তৈরি হতে থাকে বড়ো বড়ো চিত্রকর, যারা সৃষ্টি করেন ইতিহাসখ্যাত চিত্রকর্ম। এরপর মানুষ ভাবতে থাকে ছবির বিষয়টিকে কীভাবে আধুনিকতার সংস্পর্শে আনা যায়। অর্থাৎ কীভাবে খুব সহজে নিখুঁত ছবি তোলা যায়। চলতে থাকা গবেষণা। আবিষ্কৃত হয় ছবি তোলার জন্য বিভিন্ন ধরনের কেমিক‍্যাল। এর‌ই ধারাবাহিকতায় চলে আসে ক‍্যামেরা তত্ত্বটি।

          ১০২১ সালে ইরাকের এক বিজ্ঞানী ইবন-আল-হাইতাম আলোক বিজ্ঞানের ওপর সাত খণ্ডের একটি ব‌ই লিখেছিলেন আরবি ভাষায়, এর নাম ছিল কিতাব আল মানাজির।‌ সেখান থেকে ক‍্যামেরার উদ্ভাবনের প্রথম সূত্রপাত। ১৫০০ শতাব্দীতে এসে চিত্রকরের একটি দল তাদের আঁকা ছবিগুলোকে একাধিক কপি করার জন‍্য ক‍্যামেরা তৈরির প্রচেষ্টা চালায়। এর ধারাবাহিকতায় ১৫৫০ সালে জিরোলামো কারদানো নামের জার্মানির একজন বিজ্ঞানী ক‍্যামেরাতে প্রথম লেন্সের সংযোজন করেন। তখন ক‍্যামেরায় এই লেন্সের ব‍্যবহার করে শুধু ছবি আঁকা হতো। তখন‌ও আবিষ্কৃত ওই ক‍্যামেরা দিয়ে কোনো ছবি তোলা সম্ভব হয়নি। কারণ ওই ক‍্যামেরাকে সফল রূপ দিতে সময় লেগেছিলো আরও অনেক বছর। ক‍্যামেরার ইতিহাসে একটি মাইলফলক ছিলো ১৯১৪ সাল। ওই সালেই প্রথমবারের মতো আলোকচিত্র ধারণের কাজটি করেন জোসেপ নাইসপোর নিপস। তিনি পাতলা কাঠের বাক্সের মধ্যে বিটুমিন প্লেটে আলোর ব‍্যবহার করে ক‍্যামেরার কাজটি করেন। সে হিসেবে তাকেই প্রথম ক‍্যামেরা আবিষ্কারক বলা যায়। তার ক‍্যামেরা সংক্রান্ত ধারণার ওপর নির্ভর করে ফ্রাঞ্চমেন চার্লেস এবং ভিনসেন্ট ক‍্যাভেলিয়ার প্রথম সফল ক‍্যামেরা আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। ১৮৪০ সালে উইলিয়াম টালবোট স্থায়ী চিত্র ধারণের জন্য নেগেটিভ ইমেজ থেকে ছবিকে পজিটিভ ইমেজে পরিবর্তন করেন। এরপর‌ই বিশ্বব‍্যাপী ক‍্যামেরার প্রযুক্তিগত উন্নয়ন দ্রুতবেগে সম্প্রসারিত হতে থাকে।

          ১৮৮৫ সালে জর্জ ইস্টম‍্যান তার প্রথম ক‍্যামেরা ‘কোডাক’-এর জন‍্য পেপার ফিল্ম উদ্ভাবন করেন। বাণিজ্যিকভাবে এটাই ছিলো বিক্রির জন‍্য তৈরি প্রথম ক‍্যামেরা। এর ঠিক এক বছর পরে পেপার ফিল্মের পরিবর্তে সেলুলয়েড ফিল্মের ব‍্যবহার চালু হয়। এরপর আর পেছন ফিরে তাকানো নয়। ১৯৪৮ সালে প্রথম আবিষ্কৃত হয় পোলারয়েড ক‍্যামেরা, যা দ্বারা মাত্র এক মিনিটে ছবিকে নেগেটিভ ইমেজ থেকে পজিটিভ ইমেজে রূপান্তর করা সম্ভব হয়। দীর্ঘ ৭৫ বছর অ‍্যানালগ ক‍্যামেরার রাজত্ব চলার পর ১৯৭৫ সালে কোডেকের স্টিভেন স‍্যাসোন প্রথম ডিজিটাল ক্যামেরা উদ্ভাবন করেন। এভাবেই আজ ক‍্যামেরা মানুষের হাতের মুঠোয়।

ক‍্যামেরা

এই অধ‍্যায়ে কথা বলবো ক‍্যামেরার প্রকারভেদ এবং ক‍্যামেরার মূল অংশগুলো নিয়ে।

          আমরা আলো ধরতে চাই। সেই আলো কোনো একটা পর্দায় প্রক্ষেপণ করতে চাই এবং তারপর‌ পর্দায় প্রক্ষিপ্ত আলো ডিজিটাল মাধ‍্যমে রেকর্ড করতে চাই। এক‌ই সঙ্গে আমরা ছবি তোলার সময় দেখতে চাই প্রেমটা কেমন ধরলাম, নান্দনিক হয়েছে কি না, অথবা ছবিটা ঠিক যেরকম চাই, সেরকম ভাবে এক্সপোজার হচ্ছে কি না। একটা ক‍্যামেরাতে অন‍্যান‍্য অনেক কিছুই থাকতে পারে, কিন্তু এই ব‍্যাপারগুলোকে সাপোর্ট দেয়ার টেকনলজি থাকতেই হবে, এইগুলোকে আমরা বলতে পারি ‘core’ প্রযুক্তি। ঠিক যেমনটা গাড়ির ক্ষেত্রে। একটা গাড়িতে অনেক হাই হাই ব‍্যাপার স‍্যাপার থাকতে পারে, কিন্তু ইঞ্জিন আর ইঞ্জিন কন্ট্রোল গুলো না থাকলে সেটাকে গাড়ি বলা যাবে না।

          তাহলে সব ক‍্যামেরার‌ই কয়েকটা মূল অংশ থাকবে:

          ১. একটা লেন্স, যার মধ‍্যে দিয়ে আলোচনা ঢুকবে, সেটা নিয়ন্ত্রণের ব‍্যবস্থা থাকবে।

          ২. আলোটা ঢোকার পর পর্দায় পড়বে, যেটা এই আলোর তীব্রতা এবং রং এর পার্থক্যকে রেকর্ড করবে। ফিল্মের যুগে এই পর্দা ছিলো ফিল্ম, আর এখন সেটা হলো একটা সেন্সর।

          ৩. একটা মাধ‍্যম যার ভিতর দিয়ে আমরা শাটার প্রেস করার আগে দেখতে পাবো ফ্রেমটা কেমন হলো। এই মাধ‍্যমটা দুই রকম হতে পারে। একটা হলো অ‍্যানালগ, যার মধ‍্যে মূল দৃশ‍্যটা সরাসরিই দেখা যাবে, অনেকটা দূরবীনের মধ‍্যে দিয়ে যেমন দেখি। আর একটা হতে পারে ডিজিটাল, যেখানে ক‍্যামেরার পিছনে একটা পর্দায় দৃশ‍্যটা‌ লাইভ ভিডিওর মতো দেখা যাবে।

ক‍্যামেরা কত রকম

          ক‍্যামেরা অনেক রকম। ডিজিটালের তো হাজার রকম। সবগুলো নিয়ে কথা বলতে গেলে আর‌ও দুটো লেকচার লাগবে। তার চেয়ে যেগুলো সম্পর্কে জানা‌ আমাদের দরকার, সেগুলো নিয়ে আলাপ করি।

১. এসএলআর (Single Lens Reflex) ক্যামেরা: এসএলআর হলো মোটামুটি আদি ও আসল ক্যামেরা৷ ফিল্মের যুগে বেশিরভাগ ক্যামেরাই ছিলো এসএলআর৷ ডিজিটাল যুগে হলো ডিএসএলআর৷ এসএলআর ক্যামেরাগুলোর মূল বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে:

(ক) এই ক্যামেরায় প্রয়োজন মতো লেন্স খোলা এবং বদলানো যায়৷

(খ) এই ক্যামেরায় একটা আয়না থাকে, যেটা কোনো দশ্যকে প্রতিফলিত করে একটা প্রিজমের মাধ্যমে ফটোগ্রাফার এর চোখে পাঠিয়ে দেয়৷ অর্থাৎ আপনি ছবি তোলার আগে দেখে নিতে পারছেন আপনার ফ্রেমের অবস্থা৷ দেখে নিতে পারছেন আপনার সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ খানার মধ্যে কেউ বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে ঢুকে গেলো কি না, কিংবা আপনার সুন্দরী মডেলের মাথাটাই কাটা পড়লো কি না উল্টো পাল্টা ফ্রেমিং এর কারনে৷ অনেকে হয়তো বলেন, আজকাল তো ক্যামেরার পেছনে একটা পর্দায় ভিডিওর নতো একেবারে প্রিভিউ দেখা যায়, তাহলে আর এই আয়না দিয়ে দেখার দরকার কী?

        উত্তরটা খুব সহজ৷ ধরুন আপনার বাড়ির আয়নাটা সরিয়ে আমি একটা ভিডিও ক্যামেরা বসিয়ে দিলাম, যার মধ্যে আপনি নিজেকে দেখতে পারবেন একটা টিভিতে, মানে একটা ডিজিটাল আয়না আর কি৷ ভালো লাগবে আপনার? ব্যাপারটা অনেকটা এইরকম ডিএসএলআর এর ক্ষেত্রে৷ সত্যিকারের আয়নায় যত নিখুঁত, আর ‘রিয়েল লাইফ’ প্রিভিউ দেখা যায়, সেটা এখন পর্যন্ত কোনো ডিজিটাল স্ক্রিন রিপ্লেস করতে সক্ষম হয়নি৷ আপনি যদি একবার এসএলআর এর ভিউ ফাইন্ডারে ছবি দেখে অভ্যস্ত হয়ে যান, তাহলে আর ডিজিটাল প্রিভিউ আপনার ভালো লাগবে না।

 (গ) সাধারণতঃ এই ক্যামেরার সেন্সর এর সাইজ হয় একটা স্ট্যান্ডার্ড ৩৫ মিমি ফিল্মের সমান। এই অংশের আলোচনা খুব মন দিয়ে পড়ুন, দরকার আছে।

      ফিল্মের যুগে একটু ফিরে যাই। একটা কথা আগেই বলেছি যে, ফিল্ম ক্যামেরাগুলোতে পর্দা ছিল এক টুকরো আলোক সংবেদী আস্তরণযুক্ত ফিল্ম। এই ফিল্মের রোলের প্রস্থ ছিলো মোটামুটি ৩৫ মিলিমিটার। এখন, ওই সময়ের ক্যামেরা এবং লেন্সগুলো এমন ভাবে তৈরি করা হতো যেন এই ৩৫ মিলিমিটার পর্দায় সঠিকভাবে পুরো ছবিটি ধরা পড়ে। যদি পর্দার দৈর্ঘ্য প্রস্থ কম বেশি হয়, তাহলে ক্যামেরা বা লেন্সের আকার এবং অভ্যন্তরিন গঠনেও পরিবর্তন আনতে হবে, তাই না? তো একটা স্ট্যান্ডার্ড সাইজের লেন্স এবং ক্যামেরা তৈরি করতো সব কোম্পানিই।  আজকালকার ইউএসবি/অডিও/ভিডিও পোর্টের উদাহরণ দেয়া যায়।  যেই কোম্পানি যেই জিনিসই তৈরি করুক না কেন, এই পোর্টাগুলো কিন্তু একই রাখে, তা না হলে সেটা ‘কম্পাটিবল’ হবে না অন্য ইন্সট্রুমেন্টগুলোর সাথে। যখন ক্যামেরা টেকনোলোজি ফিল্ম থেকে ডিজিটালে পরিবর্তিত হতে থাকলো, তখন কোম্পানিগুলো চেষ্টা করলো যেন আগের তৈরি লেন্স এবং অন্যান্য আ্যকসেসরিজ এই নতুন প্রযুক্তির সাথে খাপ খায়। তারা ফিল্ম সরিয়ে ডিজিটাল পর্দা বসালো ঠিকই, কিন্তু মাপ রেখে দিলো একই, যাতে পুরানো লেন্সগুলো এই ক্যামেরার সাথে ব্যবহার করা যায়, এবং নতুন করে সবগুলো লেন্সের আকার এবং গঠন পরিবর্তন করতে না হয়।

      এই উদ্দেশ্য থেকেই জন্ম হলো ৩৫ মিমি ডিজিটাল সেন্সরের, যেটার প্রকৃত মাত্রা হলো ৩৬ মিমি ২৪ মিমি। এই সাইজের সেন্সরকে বলা হয় ‘ফুলফ্রেম’, কেন সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন এখন। একেবারে অতি সহজ করে বলতে গেলে, ক্যামেরার বাইরের সবকিছু একই থাকলো, শুধু ফিল্মের জায়গাটা দখল করে নিলো একটা ‘একই সাইজের’ ডিজিটাল সেন্সর। ব্যাপারটি অবশ্যই এতো সহজ নয়৷ এই ডিজিটাল প্রসেস করার জন্য অনেক সার্কিট যোগ করতে হলো, সেটা আলোচনা না করি৷

     মুশকিল হলো, এই সাইজের সেন্সর এর ছবির মান অনেক ভালো হলেও এটা তৈরিতে খরচ অনেক বেশি। সুতরাং অবধারিত ভাবেই ফুলফ্রেম ডিজিটাল ক্যামেরার দাম অনেক।

গুগলে সার্চ করে দেখুন,বেশিরভাগ কোম্পানির সবচেয়ে দামি ক্যামেরাগুলো হলো ফুলফ্রেম। এই সেন্সরগুলোকে বলে ‘APS (Advanced Photo System) Sensor’। এখন কীভাবে কম মূল্যে এসব ক্যামেরা বানানো সম্ভব, যেটা সবাই কিনতে পারবে? সহজ সমাধান ছোট সেন্সর বানাও, খরচ কম। কিন্তু ছোট সেন্সর বানালে তো সেই মাপের উপর ভিত্তি করে ছোট ছোট লেন্স বানাতে হয়, সে অনেক ঝামেলার ব্যাপার। সম্পূর্ণ নতুন একটা সিস্টেমের জন্যে লেন্স বা লেন্স এর ‘মাউন্ট (Mount)’ পরের লেকচারে আলোচনা করছি মাউন্ট নিয়ে – ডেভেলপ করতে কোন কোম্পানিই প্রথমে চায়নি। 

 কাজেই দামে সস্তা, কিন্তু কাজে মোটামুটি একই ধাঁচের ক্যামেরা বানানোর জন্য তারা সেন্সরের সাইজটা ছোট করে ফেললো, যদিও লেন্স বা অন্য কোন কিছুই বদলালো না। এরফলে কী ঘটলো?   

 এই ব্যাপারটা আমার কাছে খুব সহজ লাগে। কিন্তু যাদের একেবারে ধারণা নেই, তাদের জন্য সহজে বোঝানো মুশকিল। কাজেই আমি একটা উদাহরণের আশ্রয় নেবো। সিনেমা হলে তো মোটামুটি সবাই গেছেন, না কি? সিনেমা হলে কি থাকে? একটা বিশাল পর্দা, যেখানে একটা দৃশ্যকে দর্শকের মাথার উপর দিয়ে একটা লেন্স এর মাধ্যমে প্রজেক্ট করা হয়। তাহলে ক্যামারার সাথে সিনেমা হলের মিল কোথায়? পুরো হলটাকে মনে করতে পারেন ক্যামেরার ‘বডি’, অর্থাৎ লেন্স বাদে বাকি অংশ। সিনেমা হলের পর্দা হল ক্যামেরার সেন্সর। আর যেই লেন্স দিয়ে দৃশ্যকে ক্যামারার পর্দায় প্রতিফলিত করা হয়, সেটাকে তুলনা করুন ক্যামেরার লেন্সের সাথে।(আলোক প্রক্ষেপণের মূল নীতি কিন্তু আসলেই এরকম,শুধু পার্থক্য হল প্রক্রিয়াটা ঠিক উল্টো। ক্যামেরার ক্ষেত্রে একটি বিশাল বড় দৃশ্যকে একটা অতিক্ষুদ্র পর্দায় ধরে ফেলা হয়, আর সিনেমা হলে সেই অতিক্ষুদ্র ধারণকৃত দৃশ্যকে একটা ইয়া বড় পর্দায় পুনরায় প্রক্ষেপণ করা হয়।)

 এখন ধরুন পর্দায় চলছে ‘নিঃস্বার্থ ভালোবাসা’ সিনেমাটি। আপনারা মুগ্ধ হয়ে দেখছেন। হটাৎ কয়েকজন এসে সিনেমা হলের পর্দা খুলে নিয়ে গেলো, যদিও আর কোন কিছু বদলালো না। এরপর তারা বসিয়ে দিলো একটা ছোট পর্দা। তাহলে কি ঘটবে?

 এতক্ষণে আশা করি বোঝাতে পেরে। সবকিছু একই রেখে যদি একই রকম ক্যামেরার সেন্সরটা ছোট করে ফেলা হয়, তাহলে সেন্সর ছবিটা ধরবে ঠিক, কিন্তু পুরো ছবিটা ধরতে পারবে না,  μc (Crop) হয়ে যাবে। ছবির বাদবাকি অংশ পড়বে সেন্সরের বাইরে, কাজেই সেই অংশটুকু ডিজিটালি ধারণ করা সম্ভব হবেনা। এই ধরনের ছোট সেন্সরগুলোকে বলা হয় ‘ক্রপ সেন্সর’ বা APS-C (Advanced photo System – Classic) সেন্সর। APS-C সেন্সর এর ‘C’ কিন্তু ক্রপ বোঝায় না, এটা বোঝায় আরো ছোট একধরনের ফিল্ম, যেটা মোটামুটি ২৫মিমি চওড়ায়। APS-C সেন্সরগুলোর আকার হয় সাধারণত এরকমই। আপাততঃ ফুলফ্রেম আর APS-C বুঝলেই চলবে। এই দুই রকমের মাঝামাঝি আর একটা সেন্সর সাইজ (APS-H) আছে, যেটা ক্যাননের বেশ কিছু ক্যামেরায় ব্যাবহৃত হয়।

পয়েন্ট অ্যান্ড শুট ক্যামেরা 

       এই ক্যামেরাগুলো অনেকটা ‘প্যাকেজ’ প্রোগ্রামের মতো। অর্থাৎ, এতে একটা লেন্স ফিট করে দেয়া থাকে, যেটা খোলা সম্ভব নয়। এছাড়াও, এতে এসএলআর ক্যামেরার মতো কোন আয়না থাকে না। আগেই বলেছি, ডিএসএলআর ক্যামেরায় আয়নার কাজ হল কোন দৃশ্যকে ক্যামেরায় ধরার আগে সেটা আপনার চোখে পৌঁছে দেয়া। এই কাজটি পয়েন্ট এন্ড শুট ক্যামেরায় করা হয় সরাসরি ডিজিটাল ‘লাইভ ভিউ’ দিয়ে। আসলে আজকাল সবরকমের ক্যামেরাতেই এই ডিজিটাল ভিউ দেখার ব্যবস্থা আছে। কিছুদিন আগে এসএলআর এ ছিল না; এসএলআরে এখন দুইরকম একসাথে থাকে – মিরর ভিউ এবং ডিজিটাল ভিউ- যেটা খুশি ব্যবহার করতে পারেন।

 পয়েন্ট এন্ড শুট ক্যামেরায় আয়না থাকে না, তুলনামূলকভাবে ছোট একটা সেন্সর ব্যবহৃত হয় এবং লেন্স এর সাইজ হয় ছোট। কাজেই ওভারঅল, এই ক্যামেরাগুলো আকারে এসএলআর এর চেয়ে অনেক ছোট, সহজে বহনযোগ্য । এই কারনে শখের ফটোগ্রাফি বা পারিবারিক অনুষ্ঠানে ছবি তোলার জন্য অনেকেই এই ক্যামেরা কিনে থাকেন। এখন আর বার বছরে যুগ নাই, বছর বছর যুগ পাল্টায়। কাজেই আজকাল দেখবেন ফ্যামিলি ফটোগ্রাফ তোলার জন্যেও অনেকে ডিএসএলআর ই ব্যবহার করছে।   

মিররলেস ইন্টারচেঞ্জেবল লেন্স ক্যামেরা 

            ক্যামেরাগুলোকে বলা হয় কম্প্যেক্ট পয়েন্ট এন্ড শুট এবং ডিএসএলআর এর মাঝামাঝি একটা অপশন। এই ক্যামেরাগুলোর সেন্সর সাইজ হয় পয়েন্ট এন্ড শুটের চেয়ে বড়। কিছু আছে যেগুলো অচঝ-ঈ সেন্সর ব্যবহার করে, আর কিছু আছে যেগুলোতে তার চেয়ে ছোট সেন্সর। ( ছবিতে micro four-third সেন্সর সাইজটি দেখুন)। এই ক্যামেরাতে ডিএসএলআর এর মতো মিরর নেই, কাজেই অপটিকাল ভিউফাইন্ডারের সুবিধা পাবেন না, যদিও লাইভ প্রিভিউ থাকবে। আর ডিএসএলআর এর মতোই অনেক লেন্স এর অপশন আছে, যেটা খুটি (কিনে আর কি) ক্যামেরার বডিতে লাগাতে পারবেন। সহজে বহনযোগ্য, আর সেন্সর বড় বলে তুলনামূলকভাবে ছবির কোয়ালিটি পয়েন্ট এন্ড শুট ক্যামেরার চেয়ে ভালো।  

হাইব্রিড ক্যামেরা 

              সময়ের সাথে সাথে ইঞ্জিনিয়াররা চেষ্টা করছেন কীভাবে নানারকম অপশন একসাথে জুড়ে দিয়ে ফটোগ্রাফারদের মন জয় করা যায়।এখন অনেক ক্যামেরা আছে, যেগুলো ছোট হলেও, একটা অপ্টিক্যাল ভিউফাইন্ডার এবং লাইভ ভিউ, দুটোই থাকে। কীভাবে? খুব সহজ। ডিএসএলআর এর মিরর নেই এর ভিতরে, কিন্তু ক্যামেরার উপর দিকে একটা ‘ওপেনিং’ থাকে, যেটা দিয়ে আপনি সরাসরি ফ্রেমটাকে দেখতে পারবেন। এসএলআর এর মতো ‘থ্রো দ্য লেন্স’ হবে না যদিও, তারপরেও অনেকে এই অপশনটা পছন্দ করেন। ফুজিফিল্ম X100 বা X100S এই ধরনের হাইব্রিড ক্যামেরা। 

সেন্সর এর আকার নিয়ে কিছু কথা

           লেম্যানদের জন্যে একটা সহজ সূত্র – ‘ যত বড় সেন্সর, ছবির কারিগরি মান তত ভালো’। তো এই ছবির মান জিনিসটা কী? আসুন বিশ্লেষণ করি। 

                 ১. ছবি হবে ঝকঝকে। আপনি বাস্তবে এটা দেখছেন, ছবি হবে অনেকটা তার কাছাকাছি। আলোর সূক্ষ্ম কারুকাজগুলোর ডিটেইলস ছবিতে স্পষ্টভাবে আসবে। 

               ২. ছবিতে ‘নয়েজ’ থাকবে খুবই কম। আমার ধারণা সবাই দেখেছেন কতভাবে অল্প আলোতে ছবি তুললে ছবিতে ছোট ছোট লাল নীল বিন্দু দেখা যায়। এই জিনিসটাকে বলে নয়েজ। এই জিনিস বেশি বোঝা যায় অল্প আলোয় ছবি তুললে, কিংবা ছবির তুলনামূলক অন্ধকার অংশগুলোতে। 

              ৩. ছবির খুব উজ্জ্বল অংশগুলো একেবারে সাদা হয়ে যাবে না, সেখানে ডিটেইলস দেখা যাবে। একইভাবে ছবির অন্ধকার অংশগুলো একেবারে কালো হয়ে যাবে না। 

              ৪. ছবির ‘detail’ হবে ভালো, অর্থাৎ ছবির প্রত্যেকটি ছোটখাটো বিষয়বস্তুর ভিতর রঙ এবং কন্ট্রাস্ট এর পার্থক্য থাকবে। একটার সাথে আরেকটা মিশে যাবে না। 

ছবির মান ভালো হওয়ার এই শর্তগুলো মানতে হলে দুটো জিনিস বিবেচ্য। প্রথম হচ্ছে ক্যামেরার সেন্সরের আকার, আর দ্বিতীয় হচ্ছে যেই লেন্স এ ছবি তুলবেন, সেই লেন্স এর মান। সেন্সরের সাইজ কীভাবে ছবির মানকে প্রভাবিত করে? প্রতিটা সেন্সরের থাকে হাজার হাজার আলোক সংবেদী বিন্দু, বা পিক্সেল (চরীবষ)। এই পিক্সেলগুলোর কাজ হলো লেন্স থেকে আসা আলোকে ধারণ করা। একটা সহজ ও কাল্পনিক উদাহরণ দেয়া যাক। ধরুন, একটা বড় সেন্সরে মোট বারটি পিক্সেল আছে। যেহেতু সেন্সরটি বড়, এর পিক্সেলগুলোও অনেক বড় হবে, এবং হবে অনেক বেশি মাত্রায় আলোক সংবেদী (Light Sensitive)। এখন একটি ছোট ক্যামেরার জন্যে একই ধরনের একটি সেন্সর তৈরী করা হলো ১২টি পিক্সেল সহ। যেহেতু এই ক্যামেরাগুলোর লেন্স ছোট, কাজেই এদের জন্যে তৈরি সেন্সরও ছোট হতে হবে। কিন্তু ছোট একটা সেন্সরে এতোগুলো পিক্সেল আটানোর ফলে, স্বাভাবিকভাবেই পিক্সেলগুলোর আকৃতি ছোট হয়ে যাবে। পিক্সেল ছোট হলে কী হবে? এরা হবে কম আলোক সংবেদী। যেই পরিমাণ আলো একটা বড় সেন্সরে যথেষ্ট সংবেদনশীলতা তৈরি করতে পারতো, সেই একই পরিমাণ আলো দিয়ে একই পরিমাণ সংবেদনশীলতা এই ছোট সেন্সরে তৈরি করা যাবে না। তাহলে কী করণীয়? সহজ উত্তর। জোর করে এদেরকে sensitive করতে হবে, অর্থাৎ পিক্সেলগুলোর ইলেক্ট্রনিক গেইন (Gain) বাড়িয়ে দিতে হবে। এই বাড়ানোর ব্যাপারটাকে বলা হয় ‘ISO’, যেটার সম্পর্কে ‘আলো এবং এক্সপোজার’ অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। 

সেন্সরের ইলেকট্রনিক গেইন বাড়ালে একটা সমস্যা আছে, প্রচুর তাপ উৎপাদন হয় এবং ফলস্রুতিতে সেন্সরের ‘নয়েজ’ বেড়ে যায়। সেই নয়েজ ছবিতে ধরা পড়বে, লাল নীল সর্ষেফুল আরকি! আর যদি অল্প আলোতে ছবি তোলেন, তাহলে এই নয়েজ আরো প্রকট আকার ধারণ করবে। কাজেই সেন্সর ছোট হলে, ক্যামেরা ছোট হবে ঠিকই কিন্তু একই সাথে পাল্লা দিয়ে আপনার ছবির ‘কোয়ালিটি’ খারাপ হতে শুরু করবে। জীবনটাই আসলে আপোষরফার ব্যাপার, সব সুবিধা একইসাথে কখনই পাওয়া যায় না! 

ভেবেছিলাম লেন্স নিয়ে আলোচনা করবো এই পর্বেই। কিন্তু এটা ওভারলোড হয়ে যাবে। এইজন্যে ক্যামেরা নিয়ে আলোচনা করেই ক্ষান্ত দিলাম। সবধরনের ক্যামেরা নিয়ে আলোচনা হয়নি, যেমন মিডিয়াম ফরম্যাট নিয়ে কোন কিছু বলিনি। মনে হয় আপাততঃ দরকারও নেই। খুব শীঘ্রি আসছে লেন্স নিয়ে একটি পর্ব।