“সহজ কথা কইতে আমায় কহ যে, সহজ কথা যায় না বলা সহজে” – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উক্তি ধার করে বলতে শুরু করেছি। হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টিকর্ম প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বক্তব্যটি প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় রবীন্দ্রনাথকেই সঙ্গী করলাম। হুমায়ূন আহমেদের সহজাত জাদুকরী গল্প উপস্থাপনের ভঙ্গিতে কখনো মনে হয়নি যে, সহজ কথা অনায়াসে কিংবা অবলীলায় বলা যায় না। আনন্দ-বেদনার কাব্য হুমায়ূন আহমেদ অবলীলায় বলে গেছেন তাঁর রচিত ও পরিচালিত নাটকগুলোতে।
বিটিভি-তে নতুন ধারার ঈদের নাটক দেখার মধ্য দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের নাটকের সাথে আমার পরিচয়। পরবর্তী সময়ে প্রতি বছর ঈদের নাটক ছাড়াও ধারাবাহিক নাটক, খণ্ড নাটক, টেলিফিল্ম, উন্নয়নমূলক স্পট, শিক্ষামূলক ধারাবাহিক নাটক, একক নাটক প্রভৃতি দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। মহাপুরুষ ও নৃপতি নামে মঞ্চায়িত দু’টি নাটকের মধ্যে মহাপুরুষ দেখেছি। বাংলাদেশ বেতার থেকে প্রচারিত শঙ্খনীল কারাগার, নন্দিত নরকে, আমার আছে জল- এর শ্রুতি অভিনয় শুনেছি।
হুমায়ূন আহমেদের নাটকের একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে সহজ কথায় বলতে পারি যে, অধ্যাপনাকে পেছনে ফেলে এসে তিনি যে কাজেই হাত দিয়েছেন সেখানেই সোনা ফলিয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদ নিজের লেখা গল্প কিংবা নাটক যা-ই বলি না কেন একটি নিজস্ব ধারা তৈরি করেছেন। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক বলেছিলেন, “মানুষ তাঁকেই মনে রাখে, যিনি বাঁক নিতে জানেন বা নতুন পথের সন্ধান দেন”। হুমায়ূন আহমেদের যে কোন সৃষ্টির ক্ষেত্রেই কথাটি খাটে। তাই তো তিনি স্মরণীয়-বরণীয়।
তাঁর নির্মিত বা লিখিত নাটক দেখতে গিয়ে প্রথমেই যে বিষয়টি বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেছি তা হলো তাঁর রচিত নাটকের সব চরিত্রই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ইতিবাচক-নেতিবাচক যে কোন পেশার চরিত্রের গল্পকে তিনি এমন ভাবে মনোযোগী হয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন বিভিন্ন সময়ে যে মনেই হয়নি এটি একটি পার্শ্বচরিত্র। হুমায়ূন আহমেদের ‘বহুব্রীহি’ ধারাবাহিক নাটকের চাকর চরিত্র হিসেবে ‘সৈয়দ’ বংশের ‘কাদের’ এবং কাজের মহিলা হিসেবে ‘রহিমা’র মা’র কথা বলা যায় এক্ষেত্রে। এ দু’টা চরিত্রকে হুমায়ূন আহমেদ পরম যত্নে এমন ভাবে তুলে ধরেছেন যে অভিনয় শিল্পী দর্শকের মনে মূল নামের পরিবর্তে চরিত্রের নামে সুপরিচিত হয়েছেন। এভাবে কত অগভীর চরিত্রকে তিনি গভীর পর্যবেক্ষণে দর্শক মনে স্থায়ী দাগ কাটানোর চরিত্রে তুলে নিয়ে আসতে পেরেছেন।
এরপরই বলতে হয়, অসামান্য পরিমিতি বোধ ছিলো তাঁর। দর্শক টানতে তাঁকে কখনও ভাঁড়ামির, অশ্লীলতার, অযথা বাক্য-ব্যয়ে দর্শক হাসানোর অপচেষ্টা, তথাকথিত বাংলা বাণিজ্যিক ছায়াছবিতে প্রেম-ভালোবাসার রূপায়নে যেসব দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয় সেরকম কোন দৃশ্য সংযোজনের আশ্রয় নিতে হয়নি। তারপরও নাটকের চরিত্রের পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা, দায়বদ্ধতা, সহযোগী মনোভাব, সহমর্মিতা, স্নেহের প্রকাশ বুঝতে আমাদের সমস্যা হয়নি। মূলতঃ একজন দক্ষ কথাশিল্পী ছিলেন বলেই টিভি নাটকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্ত জীবনের চালচিত্র উপস্থাপন করতে গিয়ে প্রকাশভঙ্গিতে সরলতার আশ্রয় নিয়েছেন। একই সঙ্গে সংলাপের সংযম ও তীক্ষ্ণতা এবং ‘উইট’ বা ‘হিউমার’ স্বচ্ছভাবে প্রকাশ পাওয়ায় দর্শক মুগ্ধচিত্তে দেখেছে, শুনেছে। প্রবল রসবোধ এবং একই সঙ্গে সমাজের বেশির ভাগ দর্শক আসলে কী দেখতে চায়, সে কথা মাথায় রেখে নাটক বানিয়েছেন বলেই স্থূল ভাঁড়ামোর তিলমাত্র স্থান ছিলো না তাঁর নাটকে।
যদিও হুমায়ূন আহমেদ নিজেই বলে গেছেন যে, কালজয়ী অমর সৃষ্টি তাঁর উদ্দেশ্য নয়। তিনি লেখেন আনন্দ পেতে ও দিতে; সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে নয়। কিন্তু এ কেবল কথার কথা! কারণ, আপতদৃষ্টিতে হালকা হাসির নাটক মনে হলেও এর অন্তর্নিহিত অর্থ বিচার করতে গেলে প্রখর কোন সত্যের প্রচ্ছন্ন অবস্থান সহজেই উপলব্ধি করা যায়। শুধু তাই বা বলছি কেন, ‘বহুব্রীহি’ ধারাবাহিক নাটকে টিয়া পাখির মুখের বুলি ‘তুই রাজাকার’ কি আমরা ভুলে গেছি? যে সময় যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে কেউ প্রকাশ্যে সোচ্চার হতে দ্বিতীয়বার ভাবতো। এই ‘অন্তর্গত সত্য’-কেই সামান্য রসিকতার ছলে বা নতুন কোন উপস্থাপন ভঙ্গিতে তিনি নাটকের মধ্য দিয়ে বলে গেছেন। অনেক সময় এই বাহ্যিক কৌতুকের আবরণে বেদনাবাহী গভীর মর্মকথা বা নির্মম সত্য সহজবোধ্য করে প্রকাশের সুবিধার্থে হুমায়ূন আহমেদ নির্জলা সংলাপ এবং নাটকীয় আচরণ ব্যবহার করেছেন।
বিশেষত্বমণ্ডিত হুমায়ূনের নাটকের আরেকটি দিক হলো নাটাকের প্রয়োজনে বিবেচ্য হলে তিনি কোন কারণে চরিত্র নির্বাচন, স্থান নির্বাচন, প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ, খাবার, পোষাক-পরিচ্ছদ, দ্রব্যাদি, দালান-কোঠা এমন কি পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ (জীবিত কি মৃত) – কোন কিছুতেই ছাড় দিতেন না। নাটকের প্রয়োজনে তাঁকে টিয়া পাখি, হাতি, ঘোড়া এমন কি জীবন্ত সাপও ব্যবহার করতে দেখা গেছে।
যদিও হুমায়ূন আহমেদের প্রিয় নির্দিষ্ট কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী ছিলেন, তারপরও তাঁর নাটকের হাত ধরে অভিনয় করে পরবর্তী সময়ে কত কুশীলব যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
আঞ্চলিক গান বা নিজ অঞ্চলের ভালো যা কিছু আছে তা-ও তিনি নাটকে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘সুখী নীলগঞ্জ প্রজেক্ট’-এর মাধ্যমে তিনি আদর্শ গ্রাম কেমন হতে পারে সে ধারণা দিয়ে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ, হাসন রাজা, শাহ আবদুল করিম এবং পরবর্তী সময়ে নিজের লেখা গানও নাটকে ব্যবহার করে তিনি দৃশ্যায়নের খাতিরে গানকে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছিলেন।
মানবিকতা তাঁর প্রায় প্রতিটি নাটকেই প্রধান উপজীব্য ছিলো। ‘নিমফুল’ নাটকে ডাকাতের চোখ তোলা হবে বলে সমস্ত নাটক জুড়ে সে কী আয়োজন আর কর্মজজ্ঞ! অথচ শেষ দৃশ্যে ঠিকই চোখ না তুলে ডাকাতকে পুলিশের মুখোমুখি করা হলো।
হুমায়ূন আহমেদেরে নাটকে যৌথ বা বড় পরিবার দেখা গেছে বেশি। যেমন, ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘আজ রবিবার’ নাটকে যৌথ পরিবারের বন্ধনকে তুলে ধরা হয়েছে চমৎকারভাবে। ক্ষ্যাপাটে চরিত্র, সরল বোকা, মূলতঃ জ্ঞানীয় কিন্তু প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে বোকা-বোকা আচরণ করা চরিত্রের সমাবেশ বেশ কিছু নাটকেই আছে। বাড়ির গৃহকর্তা যিনি কথায় কথায় রেগে যান, তিনিই প্রয়োজনে সবার চেয়ে বেশি মানবিকরূপে ধরা দেন। এমনই আমরা দেখেছি ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে। নাটকের জন্য অপরিহার্য নাটকীয় সংঘাট তাঁর নাটকেও অবশ্য ছিলো। কিন্তু বিন্যাস ও উপস্থাপন ভঙ্গিমার কারণে এমন ‘জলবৎ তরলং’ লেগেছে যে, মনে হয়েছে এমনই তো হয়ে থাকে বা এমনটা হলেই জীবনটা আরো উপভোগ্য হতো। দেখতে দেখতে নিজেকে কোন না কোন চরিত্রে প্রবেশ করিয়ে ভাবতাম – চরিত্রটি তো আমারই মনের কথা বলছে! কী গভীর পর্যবেক্ষণ শক্তি ছিলো তাঁর!
আজকাল নাটকের ক্যামেরা পাত্র-পাত্রীর চোখ-মুখেই ধরা থাকে বেশির ভাগ সময়। দৃশ্যের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সজ্জা আর অপ্রয়োজনীয় সংলাপে নাটককে দীর্ঘ করার প্রয়াস নেয়া হয় আজকালকার নাটকে। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ তা করতেন না। বাক্সবন্দী কিছু তার নাটকে দেখছি বলে মনে হতো না। যদিও একই সেটে একাধিক দৃশ্য দৃশ্যায়ন হয়েছে কিন্তু কখনই দর্শক হিসেবে এক ঘেয়েমিতে ভোগেনি কেউ। ‘কোথাও কেউ নেই’ এর বাকের ভাই-এর আড্ডাস্থল কিংবা ‘অয়ময়’ নাটকের মির্জার আবাসস্থল এর কথা বলা যায় এক্ষেত্রে।
‘এইসব দিনরাত্রি’ দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের ধারাবাহিক নাটকের শুরু। নির্জলা সত্যের আড়ম্বরহীন উপস্থাপন ছিলো এই নাটকে। ভনিতা নেই। যা বলার, তাই বলেছেন এতো সহজে ব্যাখ্যা করে যে, ছেলে-বুড়ো, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই বুঝতে পারতো সহজেই। পারিবারিক বন্ধন, পারিবারিক মূল্যবোধ, পারষ্পরিক শ্রদ্ধা বিষয়গুলো কী তা সহজেই তাঁর নাটক দেখে শেখা যেতো আজকাল যা নেই বললেই চলে। সমাজ নিয়ে প্রবীণদের চিন্তা যে জরুরি এবং নবীনদের দৃষ্টি খুলে দিতে পারে তা আমরা দেখেছি ‘বহুব্রীহি’ ধারাবাহিক নাটকে।
আপাত নেতিবাচক চরিত্রেরও যে কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে তা হুমায়ূন আমেদ তাঁর নাটকে আমাদের দেখিয়েছেন। পড়ালেখা না করা, পরিবারে অযত্নে বড় হওয়া ছেলে মানেই যে বখে যাওয়া নয় তা হুমায়ূন আহমেদ আমাদের দেখিয়েছেন ধারাবাহিক নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’ এর বাকের ভাই-এর মাধ্যমে। আর তাই একটি চরিত্র ‘বাকের ভাই’ এর ফাঁসি ঠেকাতে পুরো বাংলাদেশের মানুষ স্লোগান দিয়ে মিছিল করেছে। এই ইতিহাস কি আর রচিত হবে? মনে হয় না।
‘নক্ষত্রের রাত’ ধারাবাহিক নাটকে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন – আমরা অনেক সময় অনেক তুচ্ছ-সামান্য ঘাটতি বা দুঃখকে বড় করে দেখে প্রকৃত আনন্দ উপলব্ধি থেকে নিজেদেরিই বঞ্চিত করি। ফলে, এ-কূল ও-কূল দু’ কূলই হারাই।
মিসির আলী, হিমু এবং শুভ্র – হুমায়ূন আহমেদ নিজেই যেন ছিলেন চরিত্রগুলোর প্রতিরূপ। রহস্যের বেড়াজালে ছিন্ন করা অথবা দু’ একবার অমীমাংসিত রহস্যই থেকে যাওয়া ছিলো মিসির আলী চরিত্রকে প্রধান করে ফুটিয়ে তোলা নাটকের বৈশিষ্ট্য। আমাদের মনের ভেতর যে আরেক মন বাস করে – যার কিছুতে কিছু যায় আসে না, যে শতভাগ স্বাধীন, সমাজ-ধর্ম-দেশ তাকে বাঁধতে পারে না, আত্মাকে কলুষিত হতে যে দেয় না; সেই আপনার চেয়ে আপন জন যে, রূপসাগরে ডুব দিয়ে অরূপ রতন খুঁজে ফেরে – শুভ্র আর হিমু যেন সেরকমই কেউ। সাদা চোখে হয়তো ওরা সমাজে মূল্যহীন কিন্তু বাস্তব জীবনে যা করা সম্ভব নয় অথচ ইচ্ছে-স্বাধীন মন যা করতে চায়, করুক না হয় দু’ একজন এরকম কিছু। জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়ের অপূর্ব দৃশ্যায়ন বা চিত্রায়ন তো বেশির ভাগ নাটকেই তিনি করেছেন। ইতিবাচক দিক দেখাতে গিয়ে সমাজের প্রচলিত নেতিবাচক দিক যে তিনি একেবারে উপেক্ষা করে গেছেন তা কিন্তু নয়। ‘তারা তিনজন’, ‘চোর’ নাটকেও একটু আতিশয্য বা বাড়াবাড়ি ছিলো, তবে ওরাও তো সমাজের বাইরের কেউ নয়। মিথ্যাবাদী-প্রতারক তো আমাদের আশেপাশেই বর্তমান।
নাটককে বলা হয় সমাজের দর্পনস্বরূপ। একজন নাট্যকার এবং নাট্যনির্মাতা তথ্য-শিক্ষা-বিনোদনের মধ্য দিয়ে সারসত্য তুলে ধরেন, পরিশ্রম ক্লান্ত হতোদ্যম সাধারণ জনগণকে নির্মল বিনোদনের মাধ্যমে উজ্জীবিত করতে। যখন দর্শক আপন মনে নিজেকে সেখানে আবিষ্কার করে হাসে-কাঁদে, প্রাণশক্তি ফিরে পায় জীবনযাপনের প্রাত্যহিকতায়; তখনই দর্শক বারবার ফিরে যায় বিশ্বাসযোগ্য করে ফুটিয়ে তোলা নাটকীয় ঘটনার কাছে আর এখানেই হুমায়ূন আহমেদ আজও সমভাবে প্রাসঙ্গিক। পুনঃ প্রচারিত নাটকগুলো দেখতে আমরা এখনো সমান আগ্রহী। কারণ, তিনি যে আমাদেরই লোক।
- This author does not have any more posts.