অনিশ্চয়তার মেঘে ঢাকা এক একটা দিন। দিনের শুরুতে বোঝার উপায় নেই দিনটা কেমন কাটবে। একই অনুভূতি হয় বৎসরের প্রথম ক্ষণটি দেখে। সব শুভেচ্ছা কি সত্যি হয়? এমনকি, একটা পূর্ণ জীবন ধরেও কি সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যায়? জীবনটা কেমন কাটলো?
আমার কাছে প্রতিটি দিনই মোহময়। সেই ভোরের আজানের ধ্বনি যখন অনুরণন তোলে চতুর্দিকে, ঘুম ভেঙ্গে যখন ভোরের প্রথম আলোটুকু জানালার পর্দার ফাঁক গলে ঘরের মেঝেতে রেখাচিত্র আঁকে, হঠাৎ ভালোলাগায় মনটা ভরে যায়। মনে হয় শুধু বেঁচে থাকাটাই কি আনন্দের। একটা একলা পাখির কূজন, একটা গাছের পাতার দুলুনি, দূর থেকে ভেসে আসা দু’এক কলি গানের ছন্দ, মনটাতে এক অপরূপ আর অপার্থিব আনন্দে বিশুদ্ধ কোন রাগিণীর মতই টঙ্কার তোলে। সেই আনন্দটুকু নিয়েই সারাদিনের ক্লান্তি আর অবসন্নতার সঙ্গে নিরন্তর যুদ্ধ করি। দিনের সেই প্রথম অনুভূতিই আমাকে আশাবাদী করে রাখে, খুব নরোম আর গভীর গোপন মমতায় আমাকে পূর্ণ করে রাখে। আমি খুবই আশাবাদী একজন মানুষ। হতাশার চরম যন্ত্রণাময় অনুভূতির মধ্যেও আমার মনের আকাশে একটু সুর, একটু ছন্দ আর একটু ভালোলাগা বার বার আমাকে উজ্জীবিত করে।
মনের অনুভূতি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি প্রতিনিয়ত। কিন্তু শুধুই অবাক হতে হয় নিরন্তর। অনেক আপাতদৃষ্টিতে বড় ঘটনার খুঁটিনাটি মনে কোন অভিঘাত ফেলেনি, কিন্তু অনেক ছোট ছোট দৃশ্য- কি অপরূপ মহিমায় ভাস্বর হয়ে আছে কালোত্তীর্ণ হয়ে। জামালপুরের নিভৃত এক গ্রামের কোন এক উদাস দুপুরে বিলম্বিতলয়ের ঘুঘুর ডাক এখনও তেমনই বিষণ্ণ করে মনটাকে। দিনাজপুরের কোন এক ছুটির দিনের শীতের সকালে গোল হয়ে বসে আগুনের উষ্ণতায় যে অলস প্রহর তা এখনও কেন উন্মনা করে? রুহিয়ার আখ বোঝাই গরু গাড়ীর কি প্রলম্বিত বিধুর চাকার শব্দ ভাওয়াইয়া গানের সুরের মতই হাহাকার তোলে নিধুয়া পাথারে। গ্রামের বাড়িতে বাঁশপাতার চিরল শব্দের লহরী মৃদুমন্দ বাতাসে কি দুখ জাগানিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে যায় আজও। সজনে গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে আলোর লুকোচুরি কত যুগ পরেও শাশ্বত সৃষ্টির মতই যেন বা অমলিন হয়ে আছে। দেওয়ানগঞ্জ স্টেশন থেকে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের পাড় ধরে বিচ্ছিন্ন চরের বসতি পেরিয়ে গ্রামের দিকে হেঁটে যাওয়া, ঝিরিঝিরি পানির স্রোত পেরিয়ে, এমন অকিঞ্চিৎকর দৃশ্য মনের ক্যানভাসে চিরকালের মহিমা নিয়ে কি বর্ণিল! আজও কেন, কোন বিধুর সন্ধ্যায় হঠাৎ করেই সেই কোন যুগের চন্দ্রা থেকে পিকনিক শেষে ফেরার সময় বার বার অনুরণন তোলা ‘রবি অস্ত যায়, অরণ্যেতে অন্ধকার, আকাশেতে আলো, সন্ধ্যা নত আঁখি, ধীরে আসে দিবার পশ্চাতে’ মনটাকে আচ্ছন্ন করে রাখে? কেনইবা হঠাত করে তারুণ্যের ঘুম ভাঙ্গানিয়া সেই ইফফাত আরা দেওয়ানের গান, ‘যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে রইবো কত আর’ অবিকল একই সুরে তিনযুগ ধরে বেজে বেজে যায়, মনের গোপন অলিন্দে। সবার অজান্তে। কিংবা শাহনাজ রহমতুল্লাহর শাদামাটা অভিমানী কণ্ঠের ‘আমিতো আমার গল্প বলেছি, তুমি কেন কাঁদলে’ এখনও নদীর ঢেউয়ের মতো প্রশ্ন করেই যায়, যখন তখন।
ময়মনসিংহ শহরে গেলেই ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে যেতাম, সেই স্মৃতি এখনও কি অমলিন। হাছন রাজার শহর সুনামগঞ্জের সুরমা নদীর পাড়েই ছিল আমার জুবিলী স্কুলের হোস্টেল। আমাদের তিনজনের জন্যে বরাদ্দ ছিল মূল স্কুল ভবনের স্কাউট রুম। স্কাউট রুমের জানালা দিয়ে দেখা যেতো সুরমা নদী, পালতোলা নৌকা, একঘেয়ে লঞ্চের ইঞ্জিনের শব্দ। সেই সুরমা নদীর স্রোতের ধ্বনি আজও শুনি, কোন ঘুমহীন রাতে। কার্পেন্টারের করুণ বিধুর আর্তির মতোই গানের লয়ে বেজে বেজে যায়, সব বোধ লুপ্ত করে।
সমুদ্রের প্রতি ছিল দুর্নিবার আকর্ষণ। কৈশোর তারুণ্যের কবিতায় সমুদ্রের ঢেউ ছিল কত বাস্তব। কিন্তু পুরোটাই ছিল কল্পনায়। বই পড়ে পর্যটক হওয়ার মতোই তারুণ্যের স্বপ্নময় ইচ্ছের বাগানে ফুল ফোটানো। কক্সবাজারে সমুদ্র দেখার আগেই ওয়াহু দ্বীপের ওয়াইকিকি, হানুমা বে আর নর্থ শোরের সমুদ্রের সেই মহাকালের গভীর অন্তহীন পরম্পরা এখনও শুনি। তারপর কক্সবাজার, হনলুলু, পেনাং আর লংকাউয়ি দ্বীপের সমুদ্র একসময় একাকার হয়ে যায়, মনের গভীর বিশাল আর অতীন্দ্রিয় জগতে নিজেকে খুব বেশী একা মনে হয়, বিশ্ব চরাচর জুড়ে জেগে থাকে শুধু কিছু অনুভূতির ঢেউ, সুখ আর দুঃখের, নিরন্তর ক্লান্তিবিহীন।
(লেখাটি ২০০৩–২০০৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাসফর–২০০৮ এর স্মরণিকা ‘স্বপ্নযাত্রী’-তে প্রকাশিত।)
সেশন : ১৯৭২-৭৩
- এম. আতাহারুল ইসলামhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%aa%e0%a6%95-%e0%a6%8f%e0%a6%ae-%e0%a6%86%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%81%e0%a6%b2-%e0%a6%87%e0%a6%b8%e0%a6%b2%e0%a6%be/বৃহস্পতিবার, আগস্ট ১৩, ২০২০
- এম. আতাহারুল ইসলামhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%aa%e0%a6%95-%e0%a6%8f%e0%a6%ae-%e0%a6%86%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%81%e0%a6%b2-%e0%a6%87%e0%a6%b8%e0%a6%b2%e0%a6%be/বৃহস্পতিবার, সেপ্টেম্বর ১০, ২০২০
- এম. আতাহারুল ইসলামhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%aa%e0%a6%95-%e0%a6%8f%e0%a6%ae-%e0%a6%86%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%81%e0%a6%b2-%e0%a6%87%e0%a6%b8%e0%a6%b2%e0%a6%be/বৃহস্পতিবার, অক্টোবর ৮, ২০২০
- এম. আতাহারুল ইসলামhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%aa%e0%a6%95-%e0%a6%8f%e0%a6%ae-%e0%a6%86%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%81%e0%a6%b2-%e0%a6%87%e0%a6%b8%e0%a6%b2%e0%a6%be/বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ১২, ২০২০