fbpx

অক্টোবর ১৬, ২০২৪

শব্দের খোঁজে

(১)

পত্রিকা থেকে মাথা না তুলেই আফজাল সাহেব সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, “নাম কী?”

“জ্বি, মতিউর।”

আফজাল সাহেব ঘড়ির দিকে তাকালেন। ঘড়িতে বাজে সকাল ৯:৪৮ মিনিট। তার মানে মতিউর ১২ মিনিট আগে চলে এসেছে। তাই এখন তার সাথে কথা বলার কোন অর্থই নেই।

আফজাল সাহেব আগের মতোই পত্রিকা পড়ছেন। সামনে যে একজন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই তাঁর।

পত্রিকা উল্টে পাল্টে হেডলাইনগুলো পড়ে শেষ করার পর ঘড়িতে তাকালেন তিনি।  এখন বাজে ১০:০৪ মিনিট।

সামনে তাকিয়ে বললেন, “কী ব্যাপার দাঁড়িয়ে আছো কেন? আরো চার মিনিট আগেই তুমি বসতে পারতে। তা তোমার নাম যেন কী বলেছিলে?”

“জ্বি,  মতিউর।”

“শুধু মতিউর?”

“জ্বি,  মাহবুবুর রহমান মতিউর।”

আফজাল সাহেবের মুখ এবারে শক্ত হয়ে গেল। কিছুটা কড়া সুরে প্রশ্ন করলেন, “এটাই কী প্রথম চাকরীর ইন্টারভিউ নাকি?”

“জ্বি, হ্যাঁ। এর আগে চাকরিতে এভাবে ইন্টারভিউ দেই নি।”

“তা আগের চাকরি ছাড়লে কেন?”

মতিউর মাথা নিচু করে রইলো এবং পা নাড়তে লাগলো।

“তুমি কি জানো তোমার ব্যবহার আমার পছন্দ হচ্ছে না। প্রথমত তুমি ১২ মিনিট আগেই চলে এসেছ। কোথাও আসলে বিশেষ করে ইন্টারভিউ এর জন্য আসলে একদম সঠিক সময়ে আসতে হয়; কিন্ত তুমি এসেছ তাড়াতাড়ি। কী ভেবেছিলে আমি এজন্য বেশ খুশি হয়ে যাব? আজ তাড়াতাড়ি এসেছ কাল দেরি করে আসলে যেন কিছু না বলতে পারি তাই জন্য এই ফন্দি। তুমি যে কাজে এসেছ তাতে সময়মতো আসাটা খুবই জরুরী।”

“স্যার, আসলে বাইরে কেউ আটকালো না তো তাই চলে এসেছি।”

“হ্যাঁ, তোমার কথা বলা ছিল তাই আটকায় নি।”

“জ্বি স্যার, আর কখনো ভুল হবে না।”

১২ মিনিট আগে আসায় আফজাল সাহেবের তেমন কোন মাথাব্যাথা না থাকলেও মতিউরকে বুঝিয়ে দেওয়া উচিত যে তিনি সময় মেনে চলাটা পছন্দ করেন। আর এই পদে চাকুরীর জন্য সাধারণত ইন্টারভিউ এর দরকার হয়না। আর হলেও হাসপাতাল প্রধান তার ইন্টার্ভিউ সাধারণত নেয় না। তবে আফজাল সাহেবের ক্ষেত্রে সেটা ভিন্ন। তিনি সবাইকে পরখ করে নিতে চান। সবার সম্পর্কে ধারণা রাখতে পছন্দ করেন। কে জানে কখন কাকে কোন কাজে লাগতে পারে।

“তা তুমি পা নাচাচ্ছো কেন?”, একটু কড়া সুরেই আফজাল সাহেব প্রশ্নটি করলেন মতিউরকে।

মতিউর পা নাড়ানো বন্ধ করে বললো, “সরি স্যার।”

“পা নাচানোটা হচ্ছে অস্থিরতার লক্ষণ। তুমি কি কোন কিছু নিয়ে চিন্তিত?”

একটু যেন ধাক্কা খেয়েই উত্তরে না বললো মতিউর এবং পুনরায় সরি বললো।

“আচ্ছা, তুমি কাজটা করতে পারবে তো? মানে সাধারণত কাজটা সবাই করতে পারে না। যেহেতু এ ধরনের কাজে সবার অভিজ্ঞতা থাকে না এবং পরে দেখা যাবে দুই দিন যেতে না যেতেই কাজ ছেড়ে চলে যাচ্ছো, সেরকমটা হলে কিন্তু মুশকিল।”

“আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে স্যার। এজন্যই কাজটা করতে এসেছি।”

“তা আগের চাকরিটা ছাড়লে কেন?”

“আসলে সেখানে বেতনটা কম ছিল। আর এজন্য খরচ চালাতে বেশ কষ্ট হয়ে যাচ্ছিলো।”

আফজাল সাহেব প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলেন যে পরিবারে কে কে আছে কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়লো না এদের পার্সোনাল লাইফ সম্পর্কে এত বেশি মাথা না ঘামানোই ভালো; পরে মাথায় চড়ে বসতে পারে। যত দূরে দূরে থাকা যায় ততই ভালো।

“তার মানে বলতে চাইছ ভালো বেতন পেলে কাজটা করতে অসুবিধা নেই, তাই তো?”

মতিউর কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো। সে ভেবেছিল এখন বুঝি পরিবারের কথা জিজ্ঞাসা করবে এবং তাকে আরো কয়েকটা মিথ্যা কথা বলতে হবে; কিন্তু না, সেরকম কিছু প্রশ্ন না করায় খুশি হয়েই মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো মতিউর।

“তা ভূতে ভয় পাও?”

“এ্যাঁ।”

“বলছি ভূত, ভূতে ভয় পাও কিনা?”

একটু ইতস্তত করেই সে উত্তর দিলো, “যে জিনিস জীবনে চোখে দেখিনি সে জিনিসে ভয় পাবো কেন?”

“বাহ! তা বেশ।” এবারে হো হো করে হেসে উঠে বললেন, “রাতে ঘুমিয়ে পড়বে না তো?”

“রাতে এখন এমনিতেও ঘুম আসে না বরং রাতটা জেগে থাকতেই ভালো লাগে আর এর বিনিময়ে যদি হাতে কিছু টাকা আসে তাহলে তো আরো ভাল।”

“আসলে ম্যাক্সিমাম হাসপাতাল নিয়েই কিছু ভিত্তিহীন গুজব থাকে। সেরকমভাবে এখানেও কিন্তু কিছু গুজব রয়েছে, তাই বলে রাখলাম আরকি।”

“স্যার, আমার চাকরিটা কি তাহলে হচ্ছে?”

“হ্যাঁ, তা বলতে পারো।”

“আমি তাহলে কবে থেকে আসবো?”

“কালই চলে এসো। আগের লোকটা হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হওয়াতে জরুরি ভিত্তিতেই লোক লাগবে। তোমার কথা বলে রাখবো। বাইরে যাও, তোমাকে বিস্তারিত বুঝিয়ে দিবে। এখন তুমি তাহলে যেতে পারো।”

“তাহলে আমি আসি।”

“হ্যাঁ, অবশ্যই।”

মতিউর সালাম দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে চলে যেতে লাগলো।

আফজাল সাহেব তার চেয়ার কিছুটা পেছনের দিকে নিয়ে দুলতে দুলতে তার চলে যাওয়া লক্ষ করতে লাগলেন।

নাম মাহবুবুর রহমান মতিউর; বয়স ২৫ বা ২৭ হবে। উচ্চতা ৫ফুট ৬ইঞ্চি। শ্যামলা গায়ের রঙ, একটু হেলেদুলে হাঁটে। শিক্ষাগত যোগ্যতা খুব বেশি না থাকলেও কথাবার্তায় বেশ স্মার্ট। মতিউরকে তার ভালোই লেগেছে। চরিত্রে এক ধরনের লুকানো বলিষ্টতা আছে। সময়ের সাথে সাথে তা বৃদ্ধি পায়। প্রথমে চুপসে থাকলেও শেষে তেমনটা ছিল না।

(২)

মতিউর এখন তার কর্মস্থলে। আজ তার ২য় দিন।

আফজাল সাহেব এই হাসপাতালের প্রধান হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। হাসপাতালটি তেমন বড় না আবার খুব ছোটও না। সকাল থেকে হাসপাতালটি যতই কর্মব্যস্ত থাকুক না কেন রাত বাড়ার সাথে সাথে যেন নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরে। প্রথম দিনেই হাসপাতালের বেশ কিছু নার্স এবং ডাক্তারের সাথে পরিচিত হয়ে গিয়েছে মতিউর। হাসপাতালটি ইংরেজী ও(O) অক্ষরের মতো। হাসপাতালের দ্বিতীয় তলার উত্তরের দিকটায় এই হাসপাতালের মর্গ। মর্গের সাথে আরো একটি রুম আছে সেটি লাশ কাটা ঘর। দুইটি রুম একটি ছোট দরজার সাথে যুক্ত। পাশের ঘরে লাশ কাটাকুটির পর মর্গে নির্দিষ্ট ড্রয়ারে তা রাখা হয়। পরবর্তীতে লাশ হস্তান্তর করা হয় আত্মীয়-স্বজন দের কাছে; আর বেওয়ারিশ লাশ গুলো পাঠিয়ে দেওয়া হয় সরকারি হাসপাতালে। এই মর্গের দেখাশোনার দায়িত্ব এখন থেকে তার। এই লাশগুলো পাহারা দেওয়াই এখন তার প্রধান কাজ।

মর্গের এই বিল্ডিং এর পেছনে একটি বড় বাগান। বাগানটা পার হয়ে আফজাল সাহেবের বাসা। তিনি ওখানেই থাকেন। তিনি ছাড়াও সেখানে আরো কিছু উচ্চপদস্থ ডাক্তারদের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। মর্গের পশ্চিম দিকে বাগান পেরিয়ে নার্সদের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। যাদের রাতে থাকার সমস্যা বা রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয় তাদের জন্য সাময়িক ব্যবস্থা। লাশকাটা ঘরের জানালা দিয়ে তাকালে পেছনের বাগানের কিছু অংশ দেখা যায়। বাগানটাও বেশ অনেকটা বড়। এপাশ থেকে ওপাশটা স্পষ্ট দেখা যায় না। পুরো হাসপাতাল যতই মানুষে পরিপূর্ণ থাকুক না কেনো, রাত বৃদ্ধির সাথে সাথে মর্গের এদিকে এবং তার সাথে পিছনের বাগানের পরিবেশটা আরো অনেকটা নীরব হয়ে যায়। কেমন ভূতুরে ভূতুরে লাগে।

মতিউর হাসপাতালের সিঁড়ি বেয়ে ২য় তলায় উঠে উত্তরের দিকের কোণার ঘরটার দিকে চলে গেলো। বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল মধ্যবয়স্ক একজন। মতিউর কাছে যেতেই লোকটি জিজ্ঞাসা করলো, “আপনার নাম কি মতিউর?”

“জ্বি। আপনি নিশ্চয়ই নিশিনাথ বাবু?”

“হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। আমি গতকাল ছুটিতে ছিলাম। আমারই দায়িত্ব থাকে নতুন কেউ আসলে কাজ বুঝিয়ে দেওয়া। তা আমার অনুপস্থিতিতে আপনাকে নিশ্চয়ই বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে কাজকর্ম?”

“হ্যাঁ, আপনার ব্যাপারেও বলেছে আমাকে আর গতকালই কাজ কিছুটা বুঝিয়ে দিয়েছে।”

“আসলে একদিনে তো আর সবটা বুঝবেন না। আস্তে আস্তে সব কাজটা বুঝে নিতে পারবেন।”

“জ্বি, আচ্ছা।”

“তা আপনাকে দেখে বা কথাবার্তায় তো একদমই এই কাজের জন্য মনে হয়না। আপনাকে আসতে দেখার সময়ই কিছুটা অবাক হয়েছিলাম।”

একটু লজ্জা পাওয়ার মতো করে মতিউর বললো, “এই আরকি। বেশি একটা পড়ালেখা করিনি তো আর এই কাজটা পেয়ে গেলাম তাই করা। এই সময়ে চাকরি পাওয়া তো আর সহজ না।”

“হুম, তা ঠিকই বলেছেন।”

“নিশিনাথ দা, আমাকে আপনি তুমি করেই বলবেন। আপনি আমার থেকে বড়। তাই আপনি করে বলছেন আমাকে সেটা আমার ভাল লাগছে না।”

মতিউরের কাঁধে হাত রেখে নিশিনাথ বাবু বললেন, “আচ্ছা ঠিকাছে, তা নাহয় বললাম। তা তোমার কোন সমস্যা হবেনা তো?”

“আশা করছি হবেনা।”

“কোন সমস্যা হলে অবশ্যই আমাকে ফোন করবে। আর যে কোন ব্যাপারে কিছু জানতে চাইলেও আমাকে অবশ্যই ফোন করবে। ফোন নাম্বারটা সেভ করে রাখো। দরকারে ফোন দিও।”

“জ্বি, অবশ্যই।”

নাম্বারটা সেভ করে নিজের নাম্বারও নিশিনাথ বাবুকে দিয়ে মুচকি হাসল মতিউর।

“আচ্ছা মতিউর, আসি তাহলে। ঠিকঠাক সকল কাজ করবে আশা করি।”

(৩)

বেশ কিছুদিন পার হয়ে গেছে তার এই হাসপাতালে। এখন প্রায় সব ডাক্তার নার্সকেই চেনা তার। এই হাসপাতালেও সে সকলের বেশ প্রিয় হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে তার কথাবার্তা আর সকলের সাথে সুন্দর ব্যবহার অনেকাংশে সাহায্য করেছে। এই হাসপাতালে তাকে কেউ তার পুরো নাম মতিউর বলে ডাকে না। কেউ বা ডাকে মতি ভাই আবার কেউ ডাকে মতি বলে। ভালোই লাগে এখানকার সবাইকে।

আফজাল সাহেবও প্রায়ই সবকিছু নিজে দেখাশোনা করতে আসেন। মানুষটাকে বেশ রহস্যময় লাগে মতিউরের। সকলের সাথে বেশ ভাল করেই কথা বলেন। আবার ক্ষণে ক্ষণে বেশ চটেও যান। এই লোক মনের মধ্যে অনেক কিছুই লুকিয়ে রাখে, এমনটা কেন যেন মনে হয় মতিউরের।

এমনিতে আফজাল সাহেব হাসিখুশি একজন মানুষ কিন্তু কখনো কখনো তাকে অনেক রাগান্বিত অবস্থায় দেখা যায়। এইতো মাত্র কয়েকদিন আগের ঘটনা, হঠাৎ তাকে বেশ রাগান্বিত হয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে যেতে দেখেছিল মতিউর। ফেরার পথে মতিউর সালাম দিলেও তার কোন জবাব না দিয়েই হনহন করে চলে গিয়েছিলেন তিনি। কী হয়েছে জানার কৌতূহল জাগলেও জানার চেষ্টা করেনি সে। খুব বেশীদিন হয়নি এখানে এসেছে, এক্ষুণি এত কৌতূহল হয়তো ভাল হবে না। ভেবেছিল পরে জিজ্ঞাসা করা যাবে কারো থেকে। তবে এর পরদিনই তিনি আবার বেশ সহজ স্বাভাবিক ভাবেই এসেছিলেন হাসপাতালে।রাগ হয়তো বেশিক্ষণ ধরে বসে থাকেন না। এটা একজন মানুষের অনেক বড় একটা গুণ বলেই মনে হয় মতিউরের।

এছাড়াও আফজাল সাহেবের আরো ভাল দিক আছে। কেউ ভাল কাজ করলে তাকে প্রশংসা করতেও ভোলেন না তিনি। কখনো কখনো রুমে ডেকে নিয়েও বেশ আলাপ আলোচনা করেন তিনি। যদিও মতিউরের সেই সৌভাগ্য এখনো হয়নি। সবার থেকে শোনা এসকল কথা। যেমন এইতো আজকেই আফজাল সাহেবকে বেশ হাসিখুশি লাগছিলো। পরিদর্শনে এসে সবার সাথেই বেশ ভাল ভাবেই কথা বলেছেন। মতিউরকেও কাজ কর্মের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলেন। সময়মতো সব কাজ করার পরামর্শ দিলেন। আর এদিক ওদিক না ঘুরে মর্গটাও দেখাশোনা করতে বললেন। যদিও এই কথা বলার দরকার ছিলো না। মতিউর তার কাজে বেশ যত্নশীল।

এখন ঘড়িতে বাজছে রাত ১২:০০ টা।

মর্গের বাইরে রাখা চেয়ারে বসে আছে মতিউর। খুব দ্রুত সময় পার হয়ে যাচ্ছে। মতিউরের জীবন এখন সহজ স্বাভাবিক। হয়তো এজন্যই বলা হয় খারাপ সময় শেষে একদিন ভাল সময় আসেই। মতিউরের কি তবে ভাল সময় এসেছে? মনে মনে ভাবতে লাগলো আচ্ছা একটা সিগারেট ধরালে কেমন হয়! সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস তার একদমই ছিলো না। মর্গে কাজ নেওয়ার পর থেকেই অভ্যাসটা হয়েছে তার। ভয় থেকেই হোক কিংবা একাকীত্বের সঙ্গী সিগারেটের মধ্যে এখন এক অন্যরকম আনন্দ খুঁজে পায় সে।

মতিউর জানে এখন তাকে কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে। অলস মস্তিষ্কে ভর করে অনেক কিছু, তখন সেগুলো মনে একবার গেঁথে গেলেই সমস্যার আবার শুরু। আস্তে আস্তে সিগারেট টানতে টানতে অন্যমনস্ক হয়ে অপরদিকে মানুষের তাড়াহুড়ো দেখতে লাগলো। চিকিৎসা নিতে আসা রোগী, রোগীর সাথের লোকজন, ডাক্তার নার্স সকলেই বেশ ব্যস্ত আছে নিজ নিজ কাজে, যদিও রাত বাড়ার সাথে সাথে ব্যস্ততা কমে যায়। এইতো আর কিছুক্ষণের মধ্যেই একদম সুনসান হয়ে যাবে চারিদিক। বাগানের ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজও একদম স্পষ্ট শুনতে পাওয়া যাবে। এই হাসপাতাল থেকে কেউ বা চলে যায় সুস্থ হয়ে বাড়ির পথে আবার কারো স্থান হয় এই মর্গের লাশের ভিড়ে। এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ যেন খট্‌ করে একটা শব্দ শোনা গেলো।

শব্দটা কানে আসতেই নড়েচড়ে বসলো সে। কেউ এদিকে আসছে ভেবে সিগারেটটা ফেলে চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো শব্দের উৎসের। নাহ কিছুক্ষণ পেরিয়ে গেলেও কাউকে এদিকে আসতে দেখা যাচ্ছে না। তাহলে শব্দটা কিসের ছিল?

উঁহু, এসব শব্দের অন্য কোনো অর্থ বের করা যাবে না এবং মাথায় এ ধরনের চিন্তা প্রবেশ করানোই যাবে না। এসব প্রশ্রয় দেওয়া মানে নিজেই নিজের ক্ষতি নিজে করা।

আবারো একটি সিগারেট ধরিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বেশ আরাম করে বসে সিগারেটে টান দিয়ে কিছু একটা ভাবতে লাগলো মতিউর।

মোটামুটি নতুন পরিবেশ, নতুন জায়গা, তাই পুরানো সব ভুলে যাওয়াটাই শ্রেয়। তবে চাইলেই তো আর অতীতকে এত সহজে ভোলা যায় না। সময় বদলালেও কিছু জিনিস থাকে যা মনের কোণে উঁকি দিয়েই যায়। সময়ের সাথে সাথে সেসব চাপা পড়ে থাকলেও একেবারে ধুয়ে মুছে যায় না কখনোই। এখানে তার পূর্বের চেনা কেউই নাই, তবে নতুন করে চিনে নিতে হচ্ছে সবাইকে। এভাবেই হয়তো আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে মনের সকল দ্বিধাবোধ।

(৪)

মর্গে কাজ করা মতিউরের এই প্রথম না। যদিও সেটি ছিল তার গ্রামের একটি হাসপাতালে। দিন ভালোই যাচ্ছিলো। পরিবারের আপনজন বলতে তেমন কেউ নেই তার। ছোটবেলাতেই মা-বাবা মারা যায়। মা-বাবার মৃত্যুর পর সে বড় হয় তার চাচার কাছে। চাচার ছিল তিন ছেলে। চাচাতো ভাইদের সাথেই মানুষ হতে থাকে সে। চাচার সংসারে সে ছিল অবহেলিত। চাচাতো ভাইয়েরা কখনোই তাকে তাদের একজন ভাবতে পারতো না। প্রথমে কিছুদিন পড়াশোনা করালেও পরবর্তীতে থাকতে দেওয়া ছাড়া আর কোন খরচ বহন করতে রাজি হয়নি বাড়ি থেকে।

চাচার বড় ছেলে রমিজ। রমিজ মতিউর থেকে প্রায় তিন বছরের বড়। বাড়ি থেকে পড়ালেখার জন্য নেওয়া টাকার সবটাই খরচ করতো কুপথে। এ ব্যাপারে তার কোনো জুড়ি নেই। কেউ পায় না আবার কেউ পেয়েও তার সঠিক ব্যবহার করে না। যদিও তার বাবা অর্থাৎ মতিউরের চাচা এসব বিষয়ে কিছু জানতেন না আর অশান্তির ভয়ে মতিউরও কিছু বলতো না।

পড়ালেখা খুব বেশিদূর করতে না পারলেও পড়ালেখার বেশ ইচ্ছে ছিলো তার। তার ভাই রমিজ পড়ালেখা না করলেও তার বই খাতাগুলো কাজে লাগতো মতিউরের। সময় পেলেই রমিজের বইগুলো পড়ে নিত মতিউর। কিছু আবার নিজের রুমেও নিয়ে আসতো। পড়া শেষ হলে আবার টেবিলে যথাস্থানে রেখে দিত। রমিজ পড়ালেখা করতো না বলে এসব কিছু টেরই পেতো না সে। তাই স্কুলের পর কলেজে পড়ার সু্যোগ না পেলেও পড়াশোনাটা একেবারেই বাদ যায় নি মতিউরের। আর বাসা থেকে চাচা যখন নিজের খাবারের ব্যবস্থা নিজেই করতে বলেন তখন বাধ্য হয়েই কাজ খুঁজতে হয় তাকে। সে কাজ খুঁজতে থাকে এবং খুঁজতে খুঁজতে তার চাকরি হয়ে যায় গ্রামের হাসপাতালের মর্গে। মূলত মর্গের দেখাশোনা করাই তার কাজ ছিলো। যদিও কাজটা তার পছন্দের ছিলো না, তবে এই কাজটা করে বেতনের টাকা জমিয়ে পরবর্তীতে অন্য কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয় সে। তাই বাধ্য হয়েই কাজ করতে থাকে আর সময় পেলেই পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকে।

এই কাজ থেকে পাওয়া বেতনে তার বেশ ভালোই চলে যাচ্ছিলো। কিন্ত কে জানতো যে সামনে কী অপেক্ষা করছে তার জন্য! যেটি বদলে দিতে পারে তার জীবন; যেখানে তছনছ হয়ে যায় সকল চিন্তা ভাবনা।

(৫)

ঘটনাটি এখানে আসার কিছুদিন আগের।

রাত প্রায় সাড়ে বারোটা। গ্রামাঞ্চলে এই সময়টাই বেশ গভীর রাত। কাজ শেষে টর্চ লাইট হাতে হাঁটছিল মতিউর, বাড়ির দিকে। বাড়ির পথে একটি বাগান পড়ে। সময় তখন গ্রীষ্মকাল, তাই পাশের আম বাগানের মুকুলের একটা কাঁচা গন্ধ বেশ ভালোই লাগছিল তার। এদিকটায় সন্ধ্যার পর থেকেই সচরাচর কেউ আসে না। গা ছমছমে জায়গা একটা। তাই টর্চ এর আলো ফেলে মতিউর সাবধানে হাঁটতে থাকে বাড়ির উদ্দেশ্যে। শেষ সময়ে একটা নতুন লাশ আসায় আনুষঙ্গিক সব কাজ শেষ করে বেরোতে আজ বেশ দেরি হয়ে গিয়েছিল। বেশ ক্ষুধাও লেগেছিল, তাই একটু দ্রুত পা ফেলেই হাঁটতে থাকে সে। ফেরার পথে হঠাৎ পাশের আম বাগান থেকে ধস্তাধস্তির আওয়াজ কানে ভেসে আসলো তার। প্রথমে ভাবল দ্রুত হাঁটার জন্যই এমন শব্দ শোনা যাচ্ছে কি! কিন্তু না, হাঁটা বন্ধ করতেই শব্দটা শোনা গেলো। একেই তো বেশ রাত, চারিদিক নীরব; তাই আওয়াজ মোটামুটি স্পষ্টই আসছিলো। সে আওয়াজের উৎসের দিকে টর্চ মেরে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে কিছুটা এগোতে থাকল সেদিকে। আর চিৎকার করে বলতে লাগল, “এই কে? কে ওখানে?”। একটু যেতেই একটি মানুষের অবয়ব দেখতে পেল। অবয়বটি বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ালো। এখন মতিউর দৌড়ে পালাবে নাকি সামনে এগোবে বুঝতে পারছিলো না। এটা কি ভূত নাকি মানুষ! মনে মনে সূরা পড়তে থাকল এবং দৌড়ে পালাবে ভাবার সময়েই একটা মেয়ে কণ্ঠের গোঙানির আওয়াজ পেল। টর্চ মারতেই মতিউরের বুঝতে বাকি রইলো না যে অবয়বটি একজন মানুষ এবং এই অবয়বের পেছনে ছিল অন্য একটি নারী অবয়ব।

মতিউর এবারে টর্চ হাতে কাছে গিয়ে অবয়বের চেহারার উপর মারতেই যে দৃশ্য দেখতে পেল সেটি যে সে দেখবে তা সে ভাবতেও পারেনি। তার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল তার চাচাতো ভাই রমিজ এবং পাশে হাত মুখ বাঁধা অবস্থায় পড়ে একটি অপরিচিত মেয়ে। তার আর বুঝতে বাকি রইলো না এখানে কী ঘটছিল বা ঘটতে চলেছিল।

“রমিজ ভাই তুমি এখানে? কী করছো?”

“তার আগে ক তুই বাড়িত না গিয়া এইখানে কি করোস?

“আমাকে আগে বলো মেয়েটা কে? এভাবে হাত মুখ বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে কেনো?”

“এমনেই। তুই যা এইখান থাইক্যা। কেউ বাইন্ধা রাইখ্যা গেছে মনে হয়। আমি মাইয়াডারে বাড়িত পৌঁছায় দিয়া আসবো। যা তুই।”

“আচ্ছা ভাই, তুমি বাড়ি চলে যাও। আমি পৌঁছে দিয়ে আসবো।”

“তুই ম্যালা কাম কইরা ফিরতাছোস। বাড়িত গিয়া ভাত খাইয়্যা ঘুম দে যা। কথা বাড়াইস না।”

“না, আমার সমস্যা হবেনা। তুমি বাড়ি ফিরে যাও।”

“ওই কচি পোলা তুই! বুঝোস না কিচ্ছু! কইছি না বাড়িত যাইতে; যা ভাগ।”, বলেই কিছুটা ধাক্কা দিলো মতিউরকে।

মতিউর এবারে তীব্র ক্রোধে রমিজের কলার চেপে ধরে বললো, “ভাই এসব কী করছো তুমি? আমি জানতাম যে তুমি টাকা পয়সা কুপথে উড়াও; কিন্ত তাই বলে তোমার চরিত্রটাও যে এত খারাপ সেটা আমি কল্পনাও করতে পারিনি। আমি এক্ষুণি চাচাকে গিয়ে সব বলবো।”

রমিজ হো হো করে তার কুৎসিত হাসি দিয়ে মতিউরের গাল চেপে ধরে বললো, “তুই কইবি আর সক্কলে হেই কথা বিশ্বাস যাইবো তাইনা?”

“হ্যাঁ, করবেই তো। না করার কী আছে? আমি সব নিজের চোখে দেখেছি।”

“আমি তো ম্যালা ভয় পাইয়া গেলাম রে মতি!”

“রমিজ ভাই, ভাল হচ্ছে না বলছি।”

“তা তুই এত রাইতে এইখানে এই মাইয়্যার কাছে কী করোস শুনি?”

“মানে?”

“মানে বুঝতে পারতাছোস না?”, আবারো সেই কুৎসিত হাসি দিয়ে বলল রমিজ। আরও বললো, “শোন মতি যা দেখছোস দেখছোস। এই কথাডা যেন পাঁচ কান না হয়।”

“কেন? কী করবে তুমি?”

এবারে মতির গাল ছেড়ে দিয়ে পড়ে থাকা লুংগি ঠিক করতে করতে রমিজ বললো, “কী করুম এক্ষনো বুঝবার পারতাছোস না?”

“না আমি বুঝছি না, আর বুঝতেও চাচ্ছিনা।”

“এই চুপ। একদম চুপ। শোন এত রাতে এইখানে আসছোস, তাই তোরে এই কামের মইধ্যে ফাঁসায় দিতে আমার এক সেকেন্ডও সময় লাগবোনা বুঝছোস? এর চাইতে এক্ষনই এইখান থেইক্যা চুপচাপ চইল্যা যা। আমার এখনো ম্যালা কাম বাকি আছে।”

মতি ঘৃণার সুরে বললো, “ছিহ ভাই!”

“আরে ধুরো। যা তো তুই এইখান থাইক্যা। আর যা দেখছোস ভুইল্যা যা। তুই না আমার ছোট্ট ভাই।”, সেই কুৎসিত হাসিটা দিয়ে কথাটা বলল রমিজ।

অত্যন্ত ঘৃণার দৃষ্টিতে রমিজের দিকে তাকিয়ে রইলো মতিউর। কিন্তু মতিউর জানত যে তার আসলে কিছুই করার নাই। তাই সব কিছু জানা সত্ত্বেও তাকে পিছু হটতেই হবে।

মতিউর এবারে ঘুরে তাকাল মেয়েটির দিকে; অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে মতিউরের দিকে। চোখের দৃষ্টিতে ছিল বেঁচে থাকার প্রচণ্ড আকুলতা। চোখ থেকে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছিল। মেয়েটির চোখ থেকে পড়ে যাওয়া প্রত্যেক ফোঁটা জল যেন তার পিছু হটে যাওয়ার পথকে পিচ্ছিল করে দিচ্ছিল। কিন্তু তার কিছুই করার ছিল না। এই পৃথিবীতে তার আপনজন বলতে কেউ নেই। তাই নিজের বেঁচে থাকার তাগিদেই হয়তো তাকে পিছু হটতেই হবে। কিন্তু তাই বলে এই অন্যায়টাও মেনে নেওয়া যায় না। এখান থেকে সে ফিরে গিয়ে যে কারো কাছে সাহায্য চাইবে সেই উপায়ও ছিল না। আশেপাশের সব বাড়ি বেশ দূরে। এত রাতে সবাইকে বিশ্বাস করিয়ে এখানে নিয়ে আসতে আসতেই সব শেষ হয়ে যাবে। আবার এটাও ভাবল যে এই কথা জানাজানি হলে তার চাচার সম্মানও শেষ হয়ে যাবে। অসহায় অবস্থায় এই চাচাই তাকে আশ্রয় দিয়েছিলো। আবার মেয়েটির জন্যও কষ্ট হচ্ছিল তার। কী করা উচিত তার এখন?

“এই, তোরে না কইলাম যাইতে এইখান থেইক্যা।”

“ভাই, ওকে ছেড়ে দাও। আমি ওকে নিয়ে ওর বাড়িতে পৌঁছে দেই। আমি কথা দিচ্ছি কেউ কিছু জানতে পারবে না। আমি বা ও কেউ কাউকে কিছু বলবোনা।”

“এই তোরে কিন্তু যাইবার কইছি। ম্যালা প্যাঁচাল পারছোস, এক্ষন তাড়াতাড়ি সইরা যা এইখান থেইক্যা।”

“ভাই, আল্লাহর ওয়াস্তে তুমি দয়া করো। এমন কাজ করো না।”

“বুঝছি তোর যাইচ্যা বিপদে পড়নের অনেক শখ জাগছে মনের মইধ্যে। শোন এই শ্যাষবারের মতোন কইতাছি যা এইখান থাইক্যা, যাইয়া নিজের কাম কর।”

মতিউর আবার কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু ওকে থামিয়ে দিয়ে রমিজ বললো, “এই শোন, মুখ দিয়া আর একখান শব্দও যদি বাইর করছোস তাইলে কিন্তু আমার চাইতে খারাপ কেউ হইব না বইল্যা রাখলাম। এমনেই আমার ম্যালা দেরি করায় দিছোস।”

যাওয়ার আগে শেষবারের মতোন তাকালো মেয়েটির দিকে। হাত-মুখ বাঁধা থাকায় কথা বলতে না পারলেও মাথা নাড়িয়ে মতিউরকে যেতে মানা করেছিল সে। চোখ মুখ জুড়ে সেই আকুলতা, সাহায্যের প্রার্থনা। কিছু করতে না পারায় অবশেষে চলে আসতে হয়েছিলো সেখান থেকে সেদিন, কারণ এই পৃথিবীতে দূর্বলের কোনো জায়গা নেই।

সারারাত বাড়ির বারান্দায়ই বসেই কাটিয়ে দিল মতিউর। ভোরে অবশ্য রমিজ বাড়িতে আসার পরপরই মেয়েটির খোঁজে গিয়েছিলো কিন্তু সেখানে কাউকে পায়নি মতিউর। রমিজ সব চিহ্ন মুছেই সেখান থেকে বেড়িয়ে বাড়িতে ফিরেছিলো। কী অবলীলায় থাকতে পারে মানুষ! চোখাচোখি হলেও হাই তুলতে তুলতেই রমিজ প্রশ্ন করলো, “কীরে ঘুমাস নাই সারা রাইত?”

 ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কোন জবাব দেয়নি মতিউর।

“যাই, আমি ঘুমাইতে যাইগা। দেখি সর সামনের থেইক্যা।”

যেন কোন কিছুই হয়নি এমন এক ভঙ্গিতে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়লো রমিজ। সে রাতের ঘটনার মানব সাক্ষী ছিল কেবল মতিউর নিজেই, তাই মেয়েটিকে কোনো সাহায্য না করতে পারায় ঘটনাটি ঘুম কেড়ে নিয়ে গেলো  মতিউরের।

 পরদিন বিকেলে রাতের সেই মেয়েটি এসেছিল গ্রামের হাসপাতালে, কিন্তু সেটা মর্গে, লাশ হয়ে। মেয়েটির শরীরে কাপড়ের ছিটে ফোঁটা অবশিষ্ট ছিল। চুলগুলো এলোমেলো, ধুলোতে মাখামাখি। নাক মুখ ফোলা আর চোখটি খোলা, যেন একদম স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল তার দিকে। সেই দৃষ্টিতে কোন আকুলতা ছিল না, ছিল প্রচণ্ড ঘৃণা।

লাশটি বেওয়ারিশ হিসেবেই ছিল বেশ কিছুদিন। মেয়েটির আপন কেউ ছিল না। তাই পুলিশের ভয় না থাকায় খুব সহজেই পার পেয়ে  গিয়েছিল তার ভাই রমিজ।

কিন্তু ঐ যে মানুষের নিজের একটা অপরাধবোধ নামক জিনিস আছে যা শান্ত থাকতে দেয় না, ক্ষণে ক্ষণেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। প্রতি মুহুর্তেই মনে করিয়ে দেয় নিজের ভুলগুলো। আর তাই রমিজ দিব্যি ঘুরে বেড়ালেও মতিউরকে ঘুমোতে দেয়নি তার অপরাধবোধ, আত্মগ্লানি।

সে হয়তো বাঁচাতে পারতো মেয়েটিকে। আর যাই হোক প্রাণে বেঁচে যেতে পারতো মেয়েটি; কিন্তু সেই সময়ে সে স্বার্থপরের মতোন কেবল নিজের কথাই ভেবেছিল। কে জানে কতই না কষ্ট পেয়ে মারা যেতে হয়েছিল মেয়েটিকে।

সেই লাশ বেশ কিছুদিন পর মর্গ থেকে নেয়া হয়ে গিয়েছিল; কিন্তু সব লাশের মধ্যেই মতিউর সেই মেয়েকে দেখতে পেত। মাঝে মাঝে চিৎকার করে জেগে উঠত। মর্গে থাকলে খট্‌ খট্‌ আওয়াজে যেন লাশের ড্রয়ার থেকে শুনতে পেত সেই গোঙানির শব্দ, সেই চাঁপা আর্তনাদ। তাই ঐ হাসপাতালে থেকে  চাকুরী করা মতিউরের জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে গিয়েছিলো। এখান থেকে পালালে এই পিছুটান থেকে বাঁচা যাবে, এই ভেবে চাচার কাছ বিদায় নিয়ে এবং তার সামান্য কিছু জমানো টাকা নিয়ে সে পাড়ি দেয় অজানার পথে। এরপর মতিউর চলে আসে এখানে, সব কিছুকে পেছনে ফেলে। এখানে তার চেনা জানা কেউ নাই আর তাই কোনো পিছুটানও নেই। এমনটা ভেবেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সিগারেটে টান দিতে থাকে মতিউর।

(৬)

রাত প্রায় ১:০০ টা।

দেয়ালে হেলান দিয়ে তৃতীয় সিগারেটটা ধরালো মতিউর। চারপাশ এখন একদম নীরব। ঝিঁঝিঁপোকার ঝিঁঝিঁ শব্দটা এখন আরও স্পষ্ট। কিন্তু এর মাঝেও  আবারও সেই শব্দ। শব্দটা যে কোথা থেকে আসছে সেটা বুঝতে পারছে না মতিউর। ক্রমশ শব্দের মাত্রা যেন একটু একটু করে বাড়ছে। কারো হাঁটার শব্দ বলে মনে হচ্ছে না। একটা খট্‌ খট্‌ শব্দ। এবারে করিডোরে পায়চারি করতে লাগলো সে।

সামনে গিয়ে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালো মতিউর। শব্দটা যেন হাতুরি পেটা করছে তার মগজে। না এভাবে থাকা যায় না। পরিস্থিতির সম্মুখীন না হলে সেখান থেকে বেড়িয়ে আসা অসম্ভব এটা বুঝতে পারে সে। আর তাই কোন কিছু না ভেবে এবারে গিয়ে সোজা ঢুকে গেলো মর্গের ভেতরে। হ্যাঁ, তার ধারণাই ঠিক ছিলো। শব্দটা মর্গের ভেতর থেকেই আসছিলো। তবে কি সে যার ভয় পাচ্ছিলো সেটাই আবার ঘটতে যাচ্ছে তার সাথে! সে মর্গের ভিতরে গিয়ে লাশ রাখার ড্রয়ারগুলোর কাছে চলে গেলো। চোখ বন্ধ করেই আনুমানিক একটা ড্রয়ার খুললো। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলো ড্রয়ারটিতে গতকাল মারা যাওয়া এক কিশোরীর লাশ। সে নিজেই রেখেছিল এই ড্রয়ারে। এখন যদি ড্রয়ার খুলে দেখতো যে লাশটা নেই তাহলে একটি ভয় পাওয়ার ব্যাপার ছিলো। হালকা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে। কিন্তু শব্দটা তাহলে আসছে কোথা থেকে? মর্গের ভেতরটা এখন অস্বাভাবিক শীতল লাগছে তার কাছে। এখনি হয়তো কোন অশরীরী হাত রাখবে তার ঘাড়ে কিংবা নিঃশ্বাস ফেলবে তার কাঁধে। নাহ এমন আজগুবি কথা মাথায় আনা উচিত হচ্ছে না। এসব সিনেমাতেই মানায়, বাস্তবে না। এখানে যারা আছে তারা সকলেই মৃত।

চাকুরীর সময় স্যার এজন্যই জিজ্ঞাসা করেছিলো যে ভূতে ভয় পাই কিনা! ভেবে মৃদু হাসল মতিউর। এখন সে আবার সেই ভয়ই পাচ্ছে। হয়তো কোন ইঁদুর এমনটা শব্দ করছে। সে ভেতরে আসায় ইঁদুরগুলো পালিয়েছে তাই আর কোন শব্দ হচ্ছে না। অযথাই সে এমন ভূতের ভয় পেয়ে যাচ্ছে। মনকে এভাবেই সান্ত্বনা দিয়ে পকেট থেকে আরেকটা সিগারেট বের করতে যাবে ঠিক তখনই আবার সেই খট্‌ শব্দ। এবারে একটু সন্দেহের চোখে ফিরে তাকালো সে। স্পষ্ট যেন শুনতে পেলো কোন ড্রয়ার থেকে শব্দটা আসছে। সে তাড়াতাড়ি করে লাশ রাখার ড্রয়ারটি খুলে তাকালো। তার চোখ গুলো যেন ছিটকে বেরিয়ে আসবে এমন অবস্থা। এতদিন সে ড্রয়ারের ভিতরের পড়ে থাকা লাশগুলোর দিকে তাকালেই সেই রাতের সেই অজানা মেয়েটিকে দেখতে পেতো কিন্তু আজ এই ড্রয়ারে থাকা লাশটি তার চেনা একজনের। ড্রয়ারে থাকা লাশের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে পিছনে সরে দাঁড়ালো মতিউর।

যে ড্রয়ারটা সে সকালেই ফাঁকা দেখেছিল সেটিতেই এখন লাশ শুয়ে রয়েছে। লাশের চোখ দুটো খোলা, চুলগুলো এলোমেলো, হাতটা যেন ভেঙ্গে গেছে এমন ভাবে বেঁকে রয়েছে। আর সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো লাশটি তার অতি পরিচিত। লাশটি আর কারো নয়, এই হাসপাতালের নার্স রাহেলার।

রাহেলা হাসিমুখো একটি মেয়ে। ঠোঁটের কোণে যেন হাসি লেগেই থাকে তার। রোগীদের দেখাশোনা অনেক মন দিয়ে, যত্ন করে করে রাহেলা। তাই রোগীদের কাছে এবং সহকর্মীদের কাছেও বেশ পছন্দের সে।  এইতো আজ সন্ধ্যাতেও কথা হলো রাহেলার সাথে। এদিক দিয়ে যেতেই সালাম দিয়ে রাহেলা বললো, “কী মতি ভাই কেমন আছেন?”

“হ্যাঁ, ভালোই। তুমি?”

“এইতো খারাপ না।”

“তা রোগীর চাপ কি বেশি নাকি?”

“তা একটু আছে। আজ আবার নতুন এক রোগী ভর্তি হলো। বয়স অনেক। হাফ প্যারালাইজড।”

“ওহ! আচ্ছা যাও। দেখাশোনা করো।”

“আচ্ছা যাই তাহলে। তা আপনার এখানে সব ঠিকঠাক তো?”

“হ্যাঁ, ঠিকই আছে সব।”

“আচ্ছা আসি তাহলে।”

সেই সময়ের পর থেকে এখন এভাবে রাহেলার লাশ ড্রয়ারে আসার কোন প্রশ্নই আসেনা। আর রাহেলা মারা যাবে আর সে জানবে না এমনটাও হতে পারে না। সে হয়তো ভুল দেখছে, এই ভেবে চোখ কচলে আবার তাকালো মতিউর। নাহ, এতো সত্যিই রাহেলার লাশ।

খুব বেশিদিন হয়নি তাই রাহেলার নাম্বার নেই মতিউরের কাছে। কখনো সেভাবে প্রয়োজনও পড়েনি।

 দ্রুত মতিউর তার পকেট থেকে ফোন বের করে কললিস্ট থেকে কল করলো নিশিনাথ বাবুকে। ওপাশ থেকে ফোন ধরে নিশিনাথ বাবু বললো, “হ্যাঁ বলো মতি, এত রাতে? কী দরকার?”

“নার্স রাহেলা কোথায়?”

“একি মতি? এই রাত ১২টায় মর্গে তোমার রাহেলাকে কি দরকার?”

“যা জিজ্ঞাসা করছি তাই বলুন না।”

“নতুন পেশেন্ট এসেছে তার দেখাশোনার কাজেই আছে হয়তো। আবার কোয়ার্টারেও যেতে পারে ঠিক নাই।”

“আপনি ঠিক বলছেন কি? ও তাহলে মারা যায়নি?”

“সে কী গো মতি? তোমাকে তো ভাল ছেলেই ভাবছিলাম। কিছু খাইছো টাইছো নাকি?  এই রাত্রে বেলা কী কইতেছ এইসব? যাইয়া ঘুম দেও পারলে। রাত তো ম্যালা হইলো।”

“কোন উত্তর না দিয়েই ফোন কেটে দিলো মতিউর।”

নাহ, লাশটি এখনো রয়েছে ড্রয়ারে। যদি ভুলও দেখতো তাহলে এখন ফোনে কথা বলার পর লাশটি এখানে থাকার কথা না।

দ্রুত মর্গ থেকে বের হয়ে তালাবদ্ধ করে দৌড়ে গেলো রাহেলার খোঁজে। নিজের চোখে ওকে জীবিত না দেখলে সংশয় কাটবে না তার।

মতিউর আগের হাসপাতালটিও ছেড়েছিলো ঠিক একই কারণে। এরকম ভাবেই সেই মারা যাওয়া মেয়েটিকে সে তার সামনে দেখতো। আর সেজন্যই সে একরকম সব ছেড়েই চলে আসে এখানে কাজ করতে। সেই যন্ত্রণা আর নিতে পারছিল না মতিউর। অন্য কোন চাকুরীর যোগ্যতা তার আপাতত নেই তাই তাকে এখানে এসেও একই কাজ করতে হচ্ছে। সে ভেবেছিলো নতুন জায়গায় হয়তো পিছু ছাড়বে সেই লাশ। কিন্ত এখন সেটি আরো ভয়ানকভাবে সামনে এসেছে। জীবন্ত লাশ দেখতে হচ্ছে তাকে। কিন্তু এর কারণ কী! এতদিন সে মৃত সেই মেয়েটিকে দেখলেও  এখন সে কেন জীবিত মানুষকে দেখছে এর উত্তর জানতে হলে রাহেলাকে চোখের সামনে দেখতে হবে তাকে।

হাসপাতালে ঢুকতেই রিসেপশনে বসে থাকা মিনু তাকে জিজ্ঞাসা করলো, “আরে মতি ভাই, এখানে এই সময়ে?”

কাছে এসেই রাহেলার কথা জিজ্ঞাসা করলো মতিউর।

“রাহেলাকে কী দরকার?”

“বলছি তো দরকার আছে। কোথায় ও?”

“এইতো এখানেই ছিলো। সারাদিন কাজ করে বেরিয়ে গেলো কোয়ার্টারের দিকে।”

“কখন বের হয়েছে?”

“এইতো একটু আগেই।”

আর কিছু না বলে হাসপাতাল থেকে নেমে কোয়ার্টারের দিকে দৌড়ে যেতে লাগলো মতিউর।

যাওয়ার আগে একটি কাগজে রাহেলার নাম্বার লিখিয়ে নিলো।

দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেতে যেতেই যেন দেখলো রাহেলাকে। কিন্তু বেশ অনেকটা দূরে থাকায় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো না। সে মোবাইলটা বের করে কাগজ থেকে নাম্বার তুলে ফোন করলো কিন্ত আওয়াজ ভেসে আসছে, “আপনার ডায়াল্কৃত নাম্বারটি এই মুহুর্তে ব্যস্ত আছে। ভয়েস এসএমএস পাঠাতে…”

অর্থাৎ রাহেলা মোবাইলে কারো সাথে কথা বলছে। এবারে তাই লাইন কেটে নিঃশব্দে হাঁটতে লাগলো। যতক্ষণ না কোয়ার্টারের ভেতর রাহেলা ঢুকছে ততক্ষণই এখানে দাঁড়িয়ে পাহারা দেবে সে। কারণ কোয়ার্টারের ভেতরে ঢুকে গেলে ধীরে সুস্থে কল দিয়ে ফোনে কথা বলা যাবে রাহেলার সাথে এই ব্যাপারে। আর এখন হুট করে বললে তাকে হয়তো পাগল ভেবেও বসতে পারে। রাহেলা যেহেতু ঠিক আছে তাই পাহাড় সমান এক বোঝা নেমে গেল তার বুক থেকে। কিন্তু এই চিন্তায় ছেদ পড়লো যখন হঠাৎ সে লক্ষ্য করলো রাহেলার পিছু নিয়েছে একটি ছায়া। চমকে উঠল মতিউর। এই গরমের দিনেও মোটামুটি চাদর জড়ানো যেন ছায়াটির পুরো শরীরে। রাহেলা বা কাউকেই কিছু টের পেতে না দিয়ে আবার দ্রুত নিঃশব্দে এগিয়ে চলতে থাকে মতিউর। কী উদ্দেশ্য ছায়াটির! মতিউর আবার চলতে লাগলো ছায়াটিকে উদ্দেশ্য করে করে।

ছায়াটিও দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে রাহেলার দিকে। মতিউর পৌঁছানোর আগেই রাহেলার কাছাকাছি চলে গেল ছায়াটি। হয়তো আগেই ঘাপটি মেরে বসে ছিলো কোথাও একটা। রাহেলাকে কাছাকাছি দূরত্বে পেয়ে যাওয়ার পর ছায়াটি পিছু নেয় রাহেলার। মতিউর দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু পৌঁছানোর আগেই ছায়াটি রাহেলাকে পিছন থেকেই কিছু একটা দিয়ে বাড়ি দিলো এবং হাতটা বেশ জোরে টান দিয়ে চেপে ধরলো। ঘটনার আকস্মিকতা রাহেলা টের পায়নি কারণ সে মোবাইলে কথা বলতে বলতেই হেঁটে যাচ্ছিলো। আঘাত পেয়ে রাহেলা বেশ জোরে শব্দ করার আগেই মুখ চেপে ধরলো ছায়াটি। কিন্ত ছায়াটি তার পেছনে আসা মতিউরকে লক্ষ্য করলো না আর সেই সুযোগে তৎক্ষণাৎ মতিউরও পৌঁছে গেলো কাছাকাছি। কাছে যাওয়ার আগে সাথে করে মাটিতে পড়ে থাকা গাছের ভাঙা ডাল নিয়েছিলো সাথে আর সেটা দিয়েই পেছন থেকে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে বাড়ি দিয়েই জাপটে ধরলো ছায়াবেশী লোকটাকে। লোকটি যেন ভাবতেই পারেনি এরকম কিছু একটা ঘটতে পারে। মতিউরকে ধাক্কা দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যেতে থাকে কিন্তু দ্বিতীয় বাড়ি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে যায় লোকটি। পরক্ষণেই মতিউর একটান দিয়ে চাদরটা সরিয়ে ফেলে।

রাহেলা তখনও সম্পূর্ণ জ্ঞান হারায়নি। বেশ দূরে সরে গিয়ে বসে পড়লো মাটিতে। এদিকে মতিউর চাদরটা সরাতেই দেখলো এ আর কেউ না তার স্যার মোঃ আফজাল সাহেব। মতিউর তখন স্তম্ভিত। রাহেলার দিকে তাকাতেই দেখলো সে গাছের সাথে হেলান দিয়ে হাতটা চেপে ধরে রেখে তাকিয়ে আছে এদিকে। রাহেলা এবং মতিউর দুইজন দুইজনের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ।

(৭)

হাসপাতালে নতুন স্যার এসেছে।

সেদিনের ঘটনায় ড্রয়ারে দেখা লাশটির মতো করে রাহেলার হাতটি ভেঙে গিয়েছিলো। তার সুস্থ হতে আরো বেশ কয়েকদিন সময় লাগবে। তবে এছাড়া আর কোন ক্ষতি হয়নি তার। সময়মতো মতিউর গিয়ে বাঁচিয়েছে রাহেলাকে। আগের মতো আর তার চাকুরী হারাবার ভয়ে পিছু হটে যায়নি সে।

রাহেলার কথায় তক্ষুনি ফোন দিয়ে নিশিনাথ বাবুসহ কয়েকজনকে ডেকে আনা হয়েছিলো। কেউই বিশ্বাস করতে পারছিলো না যে আফজাল সাহেব পিছু নিয়েছিলো এবং আঘাত করেছিলো রাহেলাকে। উদ্দেশ্য সম্পর্কে আঁচ করতে পারলেও সবটা পরিষ্কার হয় রাহেলার কথায়। আফজাল সাহেব বেশ কিছুদিন ধরেই নাকি অস্বাভাবিক আচরণ করছিল রাহেলার সাথে। কিছুদিন আগেই যেদিন আফজাল সাহেব রেগে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে যায় তার প্রধান কারণ ছিল আফজাল সাহেবকে তার অন্যায় আচরণে বাঁধা দেয় রাহেলা। কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি যাতে না হয় এজন্য কাউকেই কিছু জানায় নি। তাছাড়া এভাবে বললে কেউ বিশ্বাসই করতো না, উল্টো তাকেই দোষারোপ করতো। প্রশংসার নামে রাহেলাকে নিজের  রুমে ডেকে নিয়ে কখনোই তার সাথে ভাল করে কথা বলেনি আফজাল সাহেব বরং দিয়ে গেছে কুপ্রস্তাব। প্রত্যাখ্যান করায় চটে গিয়েছিল আফজাল সাহেব কিন্তু আর কেউ যাতে বুঝতে না পারে তাই বাকি সকলের সাথে ভাল মানুষের মতোই আচরণ করে যাচ্ছিল; যাতে সন্দেহের তীর তার দিকে না যায়। এদিকে মতিউরকে কেউ সন্দেহ করেনি কারণ সে সেই সময়ে নিশিনাথ বাবু এবং রিসেপশনে মিনুর সাথেও রাহেলাকে নিয়ে কথা বলেছিলো। খারাপ কোন উদ্দেশ্য থাকলে অবশ্যই সেরকমটা করতো না মতিউর। যদিও মতিউরকে এই ঘটনার সময় সেখানে থাকার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করায় সে মিথ্যা বলেছিলো। সে বলেছিলো মর্গের ভিতরে সব কিছু পর্যবেক্ষণের সময় জানালা দিয়ে রাহেলার মতো কারো পিছু নিতে দেখে ছায়াবেশী কাউকে। আর এজন্যই রাহেলার খোঁজ করতে থাকে। 

পরিশেষে রাহেলার জবানবন্দীতে মোঃ আফজাল সাহেবের শাস্তি হয়। আর হাসপাতালের অন্যান্য  কর্মচারীরাও রাহেলার কথা বিশ্বাস করে এবং সবচেয়ে বড় কথা সেখানে সেদিন রাতের বেলা মোঃ আফজাল সাহেবের উপস্থিতিই সব প্রমাণ করে দিয়েছিলো।

সেদিন মর্গে ফিরে এসে ড্রয়ারে রাহেলার সেই লাশ আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। বেশ কয়েকদিন গেলো মতিউর আর কোনো শব্দ শোনে না। সে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। এতগুলো দিন আত্মগ্লানি কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিলো তাকে। যে কোন শব্দতেই চমকে উঠতো মতিউর। যেন শব্দগুলো কোন অশনি সংকেত দিতো তাকে। সেদিনের সেই নিষ্পাপ মেয়েটিকে না বাঁচানোর অপরাধবোধ তাকে শেষ করে দিচ্ছিলো তিলে তিলে।

রাহেলাকে বাঁচানোর পর যেন সেই অপরাধবোধ চিরতরে ঘুচে গিয়েছে। সে জানেনা সেদিনের সেই ঘটনা  বিজ্ঞানের ভাষায় হ্যালুসিনেশন না কী যেন বলে সেটা ছিলো, নাকি কোন অতিপ্রাকৃত শক্তি যা তাকে আগে থেকেই কিছু ঘটনা ঘটার আভাস জানান দিয়ে গিয়েছিলো।

(পরিশিষ্ট)

চেয়ারে হেলান দিয়ে সিগারেট ধরায় মতিউর। পরম আনন্দে এবং শান্ত মনে টান দেয় সিগারেটে। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিগারেট খাওয়া বাদ দিয়ে দিবে। এটাই আজ তার খাওয়া শেষ সিগারেট। বেশ আরাম করেই ধীরে ধীরে ফুঁক দিচ্ছে সিগারেটে। রাত শেষ হতে এখনো অনেকটা বাকি। ভালোই কাটছে এখানে। জানাশোনা বেড়েছে, সাথে পরিচিত লোকের সংখ্যাও। পুরানো স্মৃতি আর তাড়া করে বেড়ায় না তাকে। রাত বাড়তে থাকে, সেই সাথে হালকা ঝিমুনিও ধরে মতিউরের। হঠাৎ আবারও শব্দ! শব্দ শুনে রীতিমতো ধাক্কা খায় মতিউর। সিগারেট ফেলে দ্রুত ছুটে যায় শব্দের খোঁজে।

( সমাপ্ত )

তানজিন তামান্না হ্যাপি
শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশনঃ ২০১৬ - ২০১৭