fbpx

শ্রদ্ধেয় আতাহার স্যারঃ আমার আদর্শ, প্রেরণা ও অভিভাবক

আমার সৌভাগ্য হয়নি ক্লাসরুমে বসে স্যারের কাছে পরিসংখ্যান শিখার, তবে আমার জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পেয়েছি স্যারের কাছ থেকেই। স্যার আমার একজন অভিভাবক, আমার বাবা-মা-আতাহার স্যার এই তিনজন মানুষ আমার জন্য একই। মা-বাবা আমাকে জন্ম দিয়ে লালন পালন করেছেন, আতাহার স্যার আমাকে জীবন, পরিসংখ্যান, গবেষণা ও সর্বপরি নৈতিকতার যে শিক্ষা দিয়েছেন, সেটি আজ এবং আমার বাকি জীবনের বেঁচে থাকার পাথেয় । আমি সত্যিই অসম্ভব সৌভাগ্যবান, আমার ক্ষুদ্র কর্মজীবনের শুরুটাই করতে পেরেছিলাম স্যারের সান্নিধ্যে এবং আমি স্যারের স্নেহধন্য খুব কাছের একজন শিষ্য হয়ে উঠতে পেরেছিলাম। স্যারের সাথে আমার এত অগনিত স্মৃতি আর বুকভরা কৃতজ্ঞতা, তা প্রকাশ করার ভাষা আমার নেই।

আতাহার স্যারের সাথে প্রথম কথা হয়েছিল ডিপার্টমেন্টে, আমি তখন ৪র্থ  বর্ষের ছাত্রী । ডুসডা আয়োজিত প্রথম আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে আমরা ৪র্থ বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম আর আমি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা করবার জন্য নির্বাচিত হয়েছিলাম। সেই প্রথম স্যারের সঙ্গে কথা বলা, কাজ করা। ঐ এক সপ্তাহেই স্যারকে মুগ্ধ হয়ে দেখেছি, জ্ঞান ও বিনয়ের এমন নিখুঁত সংমিশ্রণ আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় আগে দেখিনি।

২০১৩ সালের  আগস্ট মাসে আমি ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পরিসংখ্যান বিভাগে প্রভাষক পদের জন্য ইন্টারভিউ প্রেজেন্টেশান দিতে গিয়ে আবার স্যারের সাথে দেখা হল। এর পরে আমার জীবনের প্রথম চাকরী শুরু করলাম ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পরিসংখ্যান বিভাগে । এটি আমার জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ শিক্ষা পেতে সাহায্য করেছে। প্রতিদিন স্যারের সাথে অসংখ্য বিষয়ে আলাপ করেছি, মুগ্ধ হয়ে শুনেছি স্যারের অভিজ্ঞতার কথা, শিখেছি গবেষণা করতে, বুঝেছি পরিসংখ্যান এর প্রকৃত অর্থ। স্যারের সাথে কাজ করতে গিয়ে, স্যার কে সহায়তা করতে গিয়ে আমি যে কতকিছু শিখেছি তা প্রকাশ করবার ক্ষমতা আমার নেই। তবে যারাই স্যারের সাথে সময় কাটিয়েছেন ছাত্র-ছাত্রী বা সহকর্মী হিসেবে তারা সবাই যে আমার সঙ্গে একমত হবেন, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।

২০১৩ থেকে ২০১৭ এর আগস্ট পর্যন্ত আমি স্যারের সবথেকে কাছের কিছু শিস্যদের মধ্যে একজন ছিলাম। আমার ২০১৭ তে পি এইচ ডি এর জন্য অস্ট্রেলিয়া তে আসা, তার আগের পরিকল্পনাড় প্রয়োজনীয় শিক্ষা সবটাই পেয়েছি স্যারের কাছ থেকেই। স্যার শুধু পুঁথিগত শিক্ষা দেন নি, ঘন্টার পর ঘন্টা আমরা জীবন, দেশ, সমাজ, মানবজাতি, নৈতিকতা নিয়ে যে কথোপকথন করেছি তার সবটুকুই আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে, উদ্বুদ্ধ করেছে। এতটা নিঃস্বার্থ, নিষ্ঠাবান, সৎ একজন শিক্ষক, মেন্টর, অভিভাবক পেয়ে আমি চিরকৃতজ্ঞঢ়

২০১৭ এর ১৭ আগস্ট আমি কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলোজীতে পি এইচ ডি শুরু করার পরেও সবসময় স্যারের সাথে যোগাযোগ ছিল। আমি যখন শুরুর দিকে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা অনুভব করছিলাম নতুন দেশে আর নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে, জানি না কিভাবে স্যার নিজে থেকেই বুঝে ফেলতেন। স্যার আমাকে সেই সময়টা তে ফোনে সময় দিয়েছেন, সাহস জুগিয়েছেন, অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। যখনই কোন নতুন কাজ করতে যাব, স্যারের সাথে কথা না বলে কখনো শুরু করিনি। স্যার আমাকে জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শন করেছেন। এমনকি স্যারের অসুস্থতার সময়েও স্যার আমাদের নিয়ে ভেবেছেন। ফেসবুকে আমার একটি সফলতার গল্প শেয়ার করার সাথে সাথে স্যার তার কন্যা আমিয়ার মাধ্যমে আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন, এমন একজন অভিভাবক সত্যিই বিরল।

স্যারের সাথে শেষ দেখা হল ২০১৯ এর ডিসেম্বর মাসে, আমি তিন সপ্তাহের জন্য দেশে গিয়েছিলাম। স্যারের বাসায় গিয়ে স্যারের সাথে দেখা করলাম। স্যার উনার কঠিন অসুখের কথা আর কষ্টের সময়গুলোর কথা কি সহজে আর অবলীলায় বর্ণনা করলেন। কী অপার শক্তি আর মনোবল ছিল স্যারের! স্যার হেসে হেসে বললেন, “ফারজানা, সব কিছুরই পজিটিভ দিক আছে, আমি অসুস্থ হবার পর মনে হচ্ছে জীবন কে নতুন করে জানতে শুরু করছি।“ আমি অবাক বিস্ময়ে স্যারের কথাগুলো শুনছিলাম। স্যারের প্রতি টা শব্দ, প্রতিটা বাক্য আমার জন্য শিক্ষণীয়। সেদিন স্যার উনার প্রথম কবিতার বই এর পাণ্ডুলিপি দেখালেন আর আমি স্যারের কবি সত্তার পরিচয় পেলাম!

জানুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়া ফেরত আসার পরেও যোগাযোগ ছিল স্যারের সাথে। শেষ কথা হয়েছে ফেসবুক মেসেঞ্জার এ, ১৩ নভেম্বর ২০২০। স্যারের শেষ দিনের কিছু কথা মনে পড়ছে আজকে। স্যার বলেছিলেন, “Life is too short, try to make use of this life, meaningfully.” স্যার কে বলেছিলাম, কোভিডের ইস্যু শেষ হলে দেশে যেয়ে অনেক কথা বলতে চাই, আরও অনেক শিখতে চাই। এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না যে আর সেই মহৎ মানুষ এর সাথে কথা হবে না, দেখা হবে না। নিজেকে অনেক একা লাগছে, অনেক একা। স্যার নেই এ কথা আমি মানতে পারছি না। কত কথা বুকে জমাট বেঁধে আছে, প্রকাশ করতে পারছি না। তবে যতদিন বেচে থাকব স্যার এর আদর্শ আর শিখানো নীতির চর্চা চালিয়ে যাব। স্যার আছেন, থাকবেন আমাদের মত সহস্র গুনমুগ্ধদের হৃদয়ে। আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে চিরকৃতজ্ঞ আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে এমন একজন মহৎ মানুষের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়েছি বলে, আর স্যারের কাছে আমি চিরঋণী। ওপারে ভাল থাকবেন স্যার।

সেশনঃ ২০০৬-০৭

পি এইচ ডি ক্যান্ডিডেট (পরিসংখ্যান), কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলোজী, ব্রিসবেন, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া

ফারজানা জাহান

পি এইচ ডি ক্যান্ডিডেট (পরিসংখ্যান), কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলোজী, ব্রিসবেন, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া