fbpx

পদক্ষেপ – শেষ পর্ব

প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

দ্বিতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

পরের দিন সকালবেলা। ওসি ইন্সপেক্টর দুইজনই শকড। ওসি তার পনের বছরের চাকুরী জীবনে কখনও এই ধরনের কেসের সম্মুখীন হয়নাই। তার সামনে এখন কেসটা পুরোপুরি ক্লিয়ার। কারণ এই কেসে যাকে ভিক্টিম মনে করা হচ্ছিল সেই আফসানা এখন ওসির সামনে বসে। আর তার হাতে অজ্ঞাত লাশ আর ভ্রুণেরর ডিএনএ টেস্টের রিপোর্টও হাজির। এখন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যুগে ডিএনএ টেস্টের মতো কাজ গুলোও অনেক তাড়াতাড়ি করা যায়। নীরবতা কাটিয়ে আফসানা হককে প্রশ্ন করে ওসি, “আপনি দুইদিন কোথায় ছিলেন?”

“সামিয়ার বাসায়,”  শান্তস্বরে জবাব আফসানা হকের।

ওসি ইন্সপেক্টর দুইজনই মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। একটু থেমে এবার ইন্সপেক্টর আফসানা হককে প্রশ্ন করে। “এসব কি আপনাদের প্লান ছিলো?”

“না স্যার। কাকতালীয় ভাবে হয়ে গেছে।”  মাথা নিচু করে জবাব দেয় আফসানা।

“না না না। আপনি মাথা নিচু করবেন না। আপনি যাই করেন না কেন, মনে রাখবেন আপনার কারণে দুইটা ভয়ংকর জিনিসের সমাধান হয়েছে। আপনি এখন পুরো ঘটনাটা খুলে বলেন তো।” দ্রুত বলে ওঠে ওসি।

“স্যার, আপনারা তো জানেনই; মেহেদী স্যার আমায় পছন্দ করতো। উনি অন্য মেয়েদের সাথে হয়তো খারাপ কিছু করেছে। তবে আমার সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার করেন নাই। উনি শুধু আমাকে বারবার নিষেধ করা স্বত্বেও বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে যাচ্ছিলেন। আরও যখন জানতে পারলেন পাভেলের কারণে  আমাদের সন্তান হচ্ছিল না তখন তো বাড়াবাড়ি শুরু করে দিলেন। বেবির বিষয়ে আমায় দুর্বল করার চেষ্টা করতেন। বলতেন বিয়ের এক বছরের মধ্যেই আমাকে মা বানিয়ে দিবেন। কিন্তু আমি পাভেলকে অনেক ভালোবাসি স্যার। শুধুমাত্র একটা সন্তানের জন্য ওকে কখনোই ছাড়তে পারতাম না।”

“তাহলে আপনাদের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ কেনো যাচ্ছিল?”  আফসানা হকের কথার মাঝেই প্রশ্ন করে ওসি।

“বলছি স্যার। আসলে আমার একটা ভুল ছিল। মেহেদী স্যারের ব্যাপারটা কখনো পাভেলকে আমি জানাই নাই। ভাবছিলাম নিজে থেকেই সব ঠিক করে ফেলতে পারবো। কারণ ও জানলে আমায় জবটা ছাড়তে হতো। একদিকে স্যারের ইমোশনাল ব্লাকমেইল, অন্যদিকে পাভেলের স্মোকিং এর প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল, যা আমি নিতে পারছিলাম না স্যার। ও এমন ছিল না। হঠাৎ করেই প্রচুর স্মোকিং করা শুরু করে দেয়। নিষেধ স্বত্বেও শুনত না। যার কারণে একটু ঝগড়া-ঝাঁটি হত। এই যা।”

“কই? দুই দিন হলো আমরা তো পাভেলকে স্মোকিং করতে দেখলাম না।” প্রশ্ন করে ইন্সপেক্টর শরাফত।

“স্যার, ইদানীং ওকে আমি ইগনোর করা শুরু করি। তাই স্মোকিং একটু কমে গেছে।”

“দেখলে শরাফ, পাভেল সাহেব কিন্তু আমাদের কাছে স্মোকিং এর জন্য ঝগড়ার ব্যাপারটা পুরোপুরি এড়িয়ে গেছে।”

“তাইতো দেখছি স্যার।”

“আচ্ছা এখন আপনি সেদিন রাতের কথা বলুন। কী এমন হলো যে আপনি লুকিয়ে বন্ধুর বাসায় গেলেন?” আফসানা হককে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করে ওসি।

“স্যার, মূল ঘটনাটা শুরু হয় সেদিন বিকেলে। অফিস শেষ হওয়ার পর যখন আমি ফিমেইল ওয়াশরুমে যাই, তখন একটা অনাকাঙ্খিত ঘটনা চোখে পড়ে। মেহেদী স্যার সামিয়াকে হ্যারেজ করছে। আমাকে দেখে অনকেটা বিব্রতবোধ করে ওখান থেকে উনি চলে যান। পরে সামিয়ার থেকে শুনি অনেকদিন হলো স্যার ওকে নানাভাবে দূর্বল করার চেষ্টা করছিল। তখন স্যারের প্রতি আমার প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হয় এবং ওনার রুমে গিয়ে অনেক খারাপ বিহেভও করি।”

“তারপর?” আফসানা হককে থামতে দেখে বলে ওঠে শরাফত।

“সামিয়ার দিকে দেখে আমার প্রচুর খারাপ লাগে। ও এখানে একাই থাকে। ভাবলাম ওকে সঙ্গ দেওয়া দরকার। আর মেহেদী স্যারকেও একটা উচিত শিক্ষা দেওয়া দরকার। এজন্য সামিয়ার সাথে প্লান করার ছিল। আর বাড়িতেও পাভেলের সাথে ঝগড়া করে হাফিয়ে উঠেছিলাম। ভাবলাম এই সুযোগে পাভেলকেও একটু শিক্ষা দেই। বুঝুক একটু আমি না থাকলে ওর কী হাল হয়। তাই ও ঘুমানোর পর আমি লুকিয়ে সামিয়ার বাসায় যাই। অবশ্য দুই দিনের জন্য গিয়েছিলাম। পরের দিন যখন আপনারা অফিসে যান তখন সামিয়া আমায় ফোন দিয়ে সব কিছু জানায়। তারপর আমিই  ওকে বলি যে তুমি থানায় গিয়ে আগুনের ভিতর আর একটু ঘি ঢেলে দিয় আসো।”

সবাই নীরবতা পালন করে। ওসি নিজের চেয়ারে হেলান দিতে দিতে আবারও প্রশ্ন করে আফসানা হককে-

“আপনার জন্যই কি মেহেদী তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে মেরে ফেললো?”

“আমি শিওর না স্যার। তবে অনেকদিন হলো ওনার ওয়াইফকে উনি ডিভোর্স দিবেন বলছিলেন।”

“আচ্ছা এই হলো ব্যাপার। শরাফ!  চলো বেঁজিটার থেকেই বাকিটা শুনি।” চেয়ার থেকে দাড়াতে দাড়াতে বললো ওসি।

“স্যার আমি কি এখন পাভেলকে নিয়ে যেতে পারি?”জানতে চাইলো আফসানা।

“অবশ্যই।” জবাব দিল ওসি।

___________________

“তোর খেলা শেষ। আর কী রে তুই? নিজের লম্পটগিরির জন্য বউকে মেররেছিস, বুঝলাম। তাই বলে নিজের সন্তানকেও?” তাচ্ছিল্যের স্বরে জানতে চাইলো ওসি।

“স্যার আমি ওকে মারতে চাইনি। মাথাটা খুব গরম ছিল। বিকেলেে আফসানার অপমানটা আমি মেনে নিতে পারি নাই।এমনিতেই ও রাজি হচ্ছিলো না তারউপর ঔ ঘটনার জন্য তো আরও সম্ভাবনা থাকলো না। কিন্তু আমার ওকে চাই স্যার।যেকোনো মূল্যে। এই কারণে আমি আমার স্ত্রীকে ডিভোর্স দেওয়ার প্লান করেছিলাম। কিন্তু সেদিন রাতে যখন হাসি হাসি মুখে বলল যে ও কনসিভ করছে। বিশ্বাস করেন স্যার, ওর হাসিটা আমার কাছে বিষের মত লাগছিল। রাগের মাথায় ওর গলাটা….”

“চেপে দিলি? আর লাশটা যেন কেউ চিনতে না পারে তার জন্য রেল লাইনটা ইউস করলি। বাহ সুদির ভাই বাহ। কিন্তু একবারও ভাবলিনা তোর ওয়াইফের বাবা মাকে কি জবাব দিবি?”

“স্যার, বললাম তো রাগের মাথায় করে ফেলছি। আর ওর বাবা মা বেঁচে নেই। শুধু একটা ভাই আছে। ওনাকে কিছু একটা বলতাম। আর বেশি কিছু বললে হাতে কিছু গুজে দিতাম।”

“হায়রে বোকারদল! তুই যেভাবে প্লান করবি সেভাবেই সব হবে? তাহলে উপরে একজন আছে কেন? মনে রাখিস, গেম প্লানার উপরে বসে আছে তোর মতো লম্পটের প্লান ভেস্তে দেওয়ার জন্য। এখন জেলে বসে পঁচে মর।”  রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বললো ওসি।

“স্যার, কাল যখন আপনারা আমার ডিএনএ টেস্টের  স্যাম্পল নিলেন তখনই বুঝে গিয়েছিলাম, আমার খেলা শেষ।”

“তা তো অবশ্যই। কিন্তু আমি এখনও সেই দিন রাতের ফোন দেওয়ার কারণটা বুঝতে পারলাম না।”

“স্যার ওকে মারার পর কি করবো বুঝতে পারতেছিলাম না। চিন্তায় ছটফট করছিলাম। ভাবলাম ওর ভয়েসটা শুনলে একটু শান্তি শান্তি লাগবে। তাই আর কি! আর স্যার একটা অনুরোধ। আফসানা কে একটু বলবেন আমার সাথে যেন একটু দেখা করে যায়।”

“শালা সাইকো।” অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো ওসি।

মেহেদী এখন পুলিশ হেফাজতে। পুলিশ তাদের কাজটা করেছে। এখন বাকি কাজ করবে আদালত। এদিকে সামিয়া ছাড়াও তার বিরুদ্ধে আরও চারজন মেয়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সমিয়ার মতো প্রতিটি মেয়েকেই প্রথমে প্রেমের ফাঁদে ফেলতে চেয়েছিলো। পাত্তা না পেয়ে বিভিন্নভাবে হ্যারেজ করার চেষ্টা করে।এতদিন সবাই চুপ ছিল চাকুরী বাঁচানোর জন্য। চাকুরী বাঁচানোর জন্য চুপ থাকায় ওসি সোহরাবের সে কী রাগ! শুধুমাত্র চাকুরী বাঁচানোর জন্য এতো বড় একটা অপরাধ গোপন করাও বড় ধরনের অপরাধ। হ্যা, এটা ঠিক অনেক সময় মেয়েরা বিচার চাইতে গেলে পুলিশের কাছে প্রহসনের শিকার হয়। সেজন্য কি চুপ করে থাকতে হবে? দেশে যেমন খারাপ পুলিশ আছে তেমনি ওসি সোহরাবের মতো ভালো পুলিশ ও আছে। ওসি প্রত্যেক মেয়েকেই একটা মেসেজ দিয়ে দিলেন। জীবনে যে পর্যায়েই এই ধরনের হ্যারেজের শিকার কার হোন না কেনো, আপনার পাশের প্রিয় মানুষটিকে জানান। তাকে সাথে নিয়ে বিচারের জন্য লড়াই করেন। একা কিছু করতে যাবেন না। নিজের ভিতর কিছু লুকিয়ে রাখবেন না। মনে রাখবেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধের পথটা মসৃণ নয়। আর অমসৃণ পথেই হেঁটে অন্যায়কে রুখতে হবে। চাকুরী হারানোর ভয় আপনি কেনো করবেন? ভয় করবে অন্যায়কারীরা। সাহসী হোন। নিজেকে একা ভাববেন না।

প্রতিটা কেস সলভড করার পরেই ওসি তার সহযোদ্ধাদের রিওয়ার্ড দেন। রিওয়ার্ড হিসেবে পিকনিকের আয়োজন করেন।মুরগির রোস্ট মুখে দিতে দিতে সবার উদ্দেশ্যে বললেন,”দেখলে সবাই। আফসানা হকের ছোট্ট একটা পদক্ষেপ কত বড় দুইটা সমস্যার সমাধান করে দিলো। সব থেকে বড় উপকার হলো সমাজকল্যাণ অফিসের মেয়ে কলিগদের।”

সমাপ্ত