fbpx

প্রাণের বঙ্গবন্ধুঃ উত্থানের গল্প

সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত দীপ্যমান। তাঁর বজ্র কণ্ঠের আহ্বান ও বিচক্ষণ নেতৃত্ব আমাদের জাতিকে পরাধীনতার শিকল ভাঙ্গার সাহস জুগিয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে শেখ মুজিবুর রহমানকে অনেকেই আদর্শ বলে অনুসরণ করেন। এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কিন্তু একদিনে তৈরি হয়নি। তিনিও আর দশজন মানুষের মতই কারো ছেলে, কারো ভাই, কারো বন্ধু হয়ে এক রঙিন শৈশব ও আনন্দময় কৈশোর জীবন কাটিয়েছেন। সে সময়ের পারিপার্শ্বিকতা ও অভিজ্ঞতা তিলে তিলে গড়ে তুলেছে আমাদের দেশপ্রেমী বঙ্গবন্ধুকে।

১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুনের ঘর আলো করে দুই কন্যা সন্তানের পর জন্ম হয় এক পুত্র সন্তানের। বাবা মা আদর করে ছেলেকে খোকা ডাকতেন। চার ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয় খোকা ছোটকাল থেকেই ছিলেন দুরন্ত। মধুমতী নদীর পারে টুঙ্গিপাড়া গ্রামে প্রকৃতির কোলে বেড়ে উঠছিলেন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা। বংশের বড় ছেলে বলেই বাড়ির সবার চোখের মণি ছিলেন তিনি। খোকার যত আবদার ছিল তাঁর বাবার কাছে। বাবার গলা জড়িয়ে না ঘুমালে যেন ঘুমই আসত না। প্রতি সপ্তাহের শেষ দিন ছিল বাবার ঘরে ফেরার দিন। ছোট্ট খোকা নদীঘাটের হিজল গাছের নিচে বাবার নৌকার জন্য অধীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতেন। কোন সপ্তাহে যদি বাবা কাজের চাপে না আসতেন খোকার সে কী অভিমান! তবে খোকার মাঝে ছোটকাল থেকেই বেশ কিছু অনন্য চারিত্রিক গুণাবলীর উন্মেষ দেখা যায়। একান্নবর্তী পরিবারে নিজের বোন আর বাড়ির অন্য ছেলেমেয়েদের সাথে বড় হচ্ছিলেন তিনি। সমবয়সীদের কাছে তিনি ছিলেন নির্ভরতার জায়গা। সবাই তাঁকে সম্মান করে মিয়াভাই বলে সম্বোধন করত। মা সায়েরা খাতুন তাঁর আদরের ছেলেকে মাখন খাওয়াতেন—এতে তাঁর পাতলা শরীরের খোকা যদি একটু শক্তিশালী হয়ে ওঠে। কিন্তু খোকা কখনো তা একা খেতেন না। বাড়ির আর সব ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে একসাথে খেতেন। একটু একটু করে খোকা শিখছিলেন কিভাবে সবাইকে নিয়ে একসাথে এগুতে হয়, সবার সাথে নিজের আনন্দটুকু ভাগাভাগি করে নিতে হয়। এভাবেই যেন “খোকা” থেকে ধীর পদক্ষেপে “বঙ্গবন্ধু” হওয়ার প্রাথমিক স্তর পার করছিলেন তিনি।

mujib in teenage

শেখ মুজিবুর রহমানের শিক্ষাজীবন অনেক বৈচিত্র্যময়। একদম ছোটকালে মৌলবি সাহেবের কাছে ধর্মশিক্ষার মাধ্যমে তাঁর শিক্ষাজীবনের শুরু। খালাতো-ফুফাতো-মামাতো-চাচাতো ভাইবোন তেরজন খালপাড়ে হাত মুখ ধুয়ে সবাই মিলে পড়তে বসাটা ছিল প্রতিদিনের কাজ। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়  গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত তিনি এই স্কুলে পড়াশোনা করেন। চতুর্থ শ্রেণিতে তিনি গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে এসে ভর্তি হন। তখন তাঁর বয়স মাত্র নয় বছর। আকস্মিকভাবে তাঁর জীবনে এক দুঃখজনক ঘটনা ঘটে যায়। ১৯৩৪ সালে চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর দেহে বেরিবেরি রোগ সনাক্ত হয়। শুধু তাই নয়, এই রোগের ফলে তাঁর হৃৎপিণ্ডে দুর্বলতাও দেখা দেয়। রোগ যেন তাঁর পিছু ছাড়ছিল না। কিন্তু তিনিও হার মানেননি। ১৯৩৬ সালে দুর্ভাগ্য আবার তাঁকে আক্রমণ করে। এবার তাঁর চোখে গ্লুকোমা ধরা পড়ে। এরপরও তিনি মাদারীপুর হাই স্কুলে পড়াশুনা চালিয়ে নেয়ার জন্য ভর্তি হন। চোখের চিকিৎসার জন্য এবার তিনি কলকাতা যান। ডাক্তার দেখেই বলে দিলেন জরুরি ভিত্তিতে অপারেশন না করলে শেখ মুজিব অন্ধ হয়ে যাবেন। তাই দেরি না করে দ্রুত তাঁর দুই চোখের অপারেশন করা হল এবং সৃষ্টিকর্তার অসীম কৃপায় তিনি সঙ্কটমুক্ত হলেন। সেই ১৯৩৬ সাল থেকে চশমা হল তাঁর আজীবনের সঙ্গী। কিন্তু এতকিছুর মাঝে একটি অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল—লেখাপড়া সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে বাধ্য হলেন বঙ্গবন্ধু।

এই সময়টুকু পুঁথিগত বিদ্যা থেকে দূরে থাকলেও জীবনবোধ শিক্ষার পথে চলা শুরু করেছিলেন তিনি। তখন ভারতীয় উপমহাদেশে চলছে স্বদেশী আন্দোলন। ইংরেজদের এই উপমহাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করতে অর্থনৈতিকভাবে তাঁদের ক্ষতিগ্রস্ত করার রণকৌশল ছিল এই আন্দোলন। মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জেও এসে পৌঁছে গিয়েছে এই আন্দোলনের ছোঁয়া। কিশোর শেখ মুজিব তাঁর এই সাময়িক পড়ালেখার বিরতির সময়টুকু কাজে লাগান। বিকেলবেলা নিয়মিত সভাতে যোগ দেয়া শুরু করেন। তিনিও বুঝতে পারেন যে ব্রিটিশ হটাও আন্দোলন তখন সময়ের দাবী। তিনি ধীরে ধীরে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ও তাঁর আদর্শ সম্পর্কে জানতে শুরু করেন এবং কিছুটা আকৃষ্টও হন। সভায় যেতে যেতেই বিভিন্ন মানুষের সাথে তাঁর পরিচয় হতে শুরু করে। বলা চলে, কৈশোরের এই সময়টাতে বঙ্গবন্ধুর মনে রাজনৈতিক চেতনার বীজ বপন হয়। নিজের অধিকারের জন্য ঘরে বসে সমালোচনা করে নয় কিংবা চায়ের কাপে ঝড় তুলেও নয়, মাঠে নেমে জনগণের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলার মূলমন্ত্র এখান থেকেই পাওয়া।

১৯৩৭ সালে তিনি আবার প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনায় ফেরত আসেন। তিনি গোপালগঞ্জে মাথুরানাথ ইন্সটিটিউট মিশন স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন। বাবা শেখ লুৎফর রহমান ছেলের জন্য একজন গৃহশিক্ষককে বাসায় থাকার ব্যবস্থা করে দেন। কাজী আব্দুল হামিদ নামের এই শিক্ষকের প্রভাব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চরিত্রে ব্যাপকভাবে পরবর্তীতে লক্ষ্য করা যায়। মাস্টার সাহেব গরীব ছেলেদের সাহায্যের জন্য “মুসলিম সেবা সমিতি” গঠন করেন। শেখ মুজিবুর রহমান অন্য ছেলেদের সাথে মুষ্টিভিক্ষার চাল সংগ্রহ করতেন এবং তা বিক্রির টাকা দিয়ে অসচ্ছল ছাত্রদের সহায়তা করতেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস—কাজী আব্দুল হামিদ সাহেব অকালে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পরও শেখ মুজিব সে সমিতির নানা কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন।   

young mujib

সময়ের স্রোত এভাবেই বয়ে চলল। শেখ মুজিবুর রহমান এই সময়টুকুতে সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন না। তিনি খেলাধুলায় বেশ ভাল ছিলেন। শারীরিক অসুস্থতা  তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারে নি। ফুটবল, ভলিবল ও হকি খেলায় তিনি পারদর্শী ছিলেন। শুধু পাঠ্যবই নয়, বাইরের পৃথিবীতে কী চলছে তা নিয়েও বঙ্গবন্ধুর অপার আগ্রহ ছিল। আনন্দবাজার, বসুমতী, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাত পত্রিকার সাথে শৈশব থেকেই বঙ্গবন্ধুর পরিচয় ঘটে। ফলে শুধু টুঙ্গিপাড়া নয়, সমগ্র বিশ্বে কী চলছে তা নিয়ে বঙ্গবন্ধু জ্ঞান রাখতেন।

১৯৩৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমান অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। খবর আসলো তৎকালীন বেঙ্গলি প্রেসিডেন্সির মুখ্যমন্ত্রী শের-এ-বাংলা এ .কে. ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী  গোপালগঞ্জ পরিদর্শনে আসবেন। চারিদিকে সাজ সাজ রব পড়ে গেল। ঠিক হল স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করা হবে। পড়াশুনায় পিছিয়ে যাওয়ার দরুন শেখ মুজিব ক্লাসের অন্যদের চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন, তাই তাঁর উপর দায়িত্ব পড়ল স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করার। তিনি কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আকাঙ্ক্ষিত অনুষ্ঠানের দিন চলে এল। পুরো অনুষ্ঠান খুব সুচারু রূপে সম্পন্ন হল। অনুষ্ঠান কার্যক্রমের এক পর্যায়ে হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী  মিশন স্কুল পরিদর্শনে গেলেন। সে স্কুলের শিক্ষার্থী হওয়ায় বঙ্গবন্ধুর কাঁধে তাঁকে সংবর্ধনা দেয়ার দায়িত্ব অর্পিত হল। তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করলেন। এক ফাঁকে সুযোগ বুঝে তিনি হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দীর কাছে গেলেন এবং অতি বিনয়ের সাথে বললেন,  “স্যার আমাদের একটা আবেদন আছে।” তিনি খুলে বললেন কিভাবে স্কুলের ক্লাসরুমের ছাদে ফুটো থাকার কারণে ক্লাস করতে সমস্যা হয় এবং আর্জি জানালেন যাতে এর মেরামত করে দেয়া হয়। হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী  বঙ্গবন্ধুর অকুতোভয় বলিষ্ঠ কণ্ঠ, এত কম বয়সে নিজের দাবির জন্য লড়াকু মনোভাব ও বিনয়াবনত ব্যবহারে মুগ্ধ হলেন। তাঁর দাবি মেনে নিলেন এবং যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যবস্থা করলেন। বঙ্গবন্ধুর মুখচ্ছবি হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দীর মনে স্থায়ী ছাপ ফেলে দিল। তিনি পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুকে ধন্যবাদ দিয়ে চিঠি দেন এবং তাঁর সাথে যোগাযোগ রাখার অনুরোধ করেন। এভাবে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের সুউচ্চ দালানের প্রথম ভিত্তি স্থাপিত হল। এরপর কী হল? বাকি ইতিহাস তো সবারই জানা—এক টুকরো বাংলাদেশের জন্মের গল্প এর রচয়িতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি।

আজকের নতুন প্রজন্মের অনেকেই রাজনীতিতে আসার আদর্শ রূপে বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ করে। কিন্তু আমরা যে বঙ্গবন্ধুকে চিনি তা নানা ঘাত-প্রতিঘাতে তৈরি। বাবা-মার আদরের খোকা, সমবয়সীদের নির্ভরতার মিয়াভাই, মুসলিম সেবা সমিতির শেখ মুজিব—এমন অনেক ভূমিকায় তাঁকে অবতীর্ণ হতে হয়েছে। জীবনের সকল রঙ তিনি দেখেছেন। মানুষের কাছে গিয়ে তাঁদের দুঃখ ও আনন্দ দুটোকেই নিজ অন্তর দিয়ে অনুভব করেছেন। তিনি বিনয়ের সাথে বলিষ্ঠতার অনন্য উদাহরণ। তাই তাঁকে অন্তরে ধারণ করতে শুধু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে নয়, মানুষ শেখ মুজিবকে চিনতে পারা এবং সেই আদর্শকে আলোকবর্তিকা করে সাথে নিয়ে এগিয়ে যাক আমাদের তরুণ প্রজন্ম এটাই আমাদের কাম্য।

তথ্যসূত্রঃ

  • অসমাপ্ত আত্মজীবনী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
  • শেখ মুজিবের ছেলেবেলা, বেবী মওদুদ।
  • শেখ মুজিবুর রহমান, উইকিপিডিয়া।
প্রভাষক | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশনঃ ৬১ তম ব্যাচ

তাসমিয়াহ সাদ সুতপা

সেশনঃ ৬১ তম ব্যাচ