fbpx

পথ হারিয়ে পপি বাগানে

~হিম শীতল নির্ঘুম রাত

আজ পহেলা ফাল্গুন! বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। আমাদের এক্সপিডিশনের ৩য় দিন। এই এক্সপিডিশন টি মূলত চালানো হয়েছিল ৮ দিন ব্যাপি বান্দরবান এর সাঙ্গু-মাতামুহুরি সংরক্ষিত বনাঞ্চলে।

গেলো দুইদিন ট্রেক করে আমরা বান্দরবান এর অনেক গহীনে চলে এসেছি, যেখানে ফোনের কোনো নেটওয়ার্ক নেই, পর্যাপ্ত খাবার পানি নেই।

গত রাত আমরা কাটিয়েছিলাম একটি জুম ঘরে; আজকের গন্তব্য ভূমি থেকে প্রায় ২১০০ ফুট উপরে একটি গ্রামে। পার্বত্য জেলায় একেক টি গ্রাম কে “পাড়া” নামে ডাকা হয়। অনেক গুলো ঘর মিলে একটি পাড়া হয়।

01

ঘুম থেকে উঠে আয়েশ করে সকালে যখন বের হচ্ছি তখন বেলা ১১ টা! হাটতে হাটতে যখন একটি পাড়ায় পৌঁছাই তখন ঘড়িতে ৫টা বাজে। সেখান থেকে আমাদের গন্তব্যে যেতে আরো ৩/৩.৫ ঘন্টার মত লাগবে, কিন্তু সমস্ত পথ টাই হচ্ছে ঝিরিপথ! সেই হিসেবে আমাদের রাত ৯টার মধ্যে পাড়ায় পৌঁছে যাওয়ার কথা!

খানিক্ষন বিশ্রাম নিয়ে একটু শুকনা খাবার খেয়ে আবার হাটা শুরু করি সবাই, ঝিরিপথ দিয়ে হাটতে হাটতে টুপ করেই অন্ধকার নেমে আসলো। হেডল্যাম্প বের করে আবার ও হাটা শুরু!

বিপত্তি টা ঘটে একটা Y Junction এ এসে, দুইদিকে রাস্তা চলে গেছে, আমরা বাম পাশের রাস্তা ধরে হাটা ধরি, আমাদের ন্যাভিগেশন+লোকাল দের কথা – সব ই বলছিল বামের রাস্তা টা ধরেই আমাদের কাঙ্ক্ষিত পাড়া।

৮টা বেজে গেলো, ঝিরিপথ দিয়ে হাটতেসি তো হাটতেসিই! কাধে ১০/১১ কেজির ব্যাগটাও তখন অভিশাপ মনে হচ্ছিল নিজের কাছে। পথের শেষ নাই, তার উপর শীত লাগা শুরু হয়। সোয়েটার, হুডি বের করে পড়ে নিলাম!

রাত ৯টা বেজে যায়, ১০টা বেজে যায়। পথ আর শেষ হয় না, ঝিরি থেকে উপরে উঠার কোনো রাস্তাও পাই না।

৩ঘন্টার রাস্তা ৫ ঘন্টা হেটেও যখন কোনো কুল কিনারা পাচ্ছিনা, তখন নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়, আমরা মাঝ জঙ্গলে রাতের বেলা হাটু সমান ঝিরিতে পথ হারিয়ে ফেলেছি!

এই রাতে আর কোনো উপায় নেই, হয় ঝিরির পাশে ক্যাম্প করা লাগবে, নয়ত উপরে উঠার কোনো রাস্তা খুঁজা লাগবে। প্রচন্ড শীতে সবার অবস্থা আসলে নাজেহাল, ঝিরির ঠান্ডা পানির জন্য শীত আরো বেশি লাগতেছিল, তাই ঝিরির পাশে আগুন জ্বালিয়েও রক্ষা হবেনা ভেবে এখন টার্গেট উপরে উঠার রাস্তা খোঁজা। টিমের একজন হঠাৎ করে ডানে একটা রাস্তা ধরে উপরে গিয়ে দেখলো বিশাল বড় এক বাগান, যেটা কিনা একটি জুম! ব্যাস! ৫ঘন্টা পর সবাই আকাশ দেখতে পেরে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম!

আমরা এই মূহুর্ত টায় অনেক কিছু ভেবেই ভয় পাচ্ছি আসলে! বান্দরবান এর গহীনে বিভিন্ন সন্ত্রাসী বাহিনীর চলাফেরার কথা সবার ই জানা।

02

আর আমরা যেই জুম টায় ছিলাম, সেইটা আসলে যেনো তেনো ফসলের জুম না! বাংলাদেশে চাষ নিষিদ্ধ এমন একটি ফসল, যার নাম “পপি”। যার ফুল ই কিনা নিষিদ্ধ মাদক “আফিম” এর প্রধান কাচামাল। বাংলাদেশে এই পপি’র চাষ বান্দরবান এর অনেক গহীনে যেখানে সেনাবাহিনী’র যাতায়াত নেই সেসব জায়গায় হচ্ছে। এত রিস্ক নিয়ে এত কোটি কোটি টাকার ফসলের চাষ যে কেও যে করতেছে না সেটা আমাদের ততক্ষনে বুঝতে বাকি নেই। তখন একবার ধরেই নিলাম আমাদের ফোন, জামা কাপড় সব গায়েব হয়ে যাবে আজকে রাতেই, যদি আমরা ধরা পড়ি জুম এর মালিকের কাছে। আর ভাবছি, আল্লাহ যদি কপালে লিখে রাখে তাহলে বেঁচে ফিরলেও ফিরতে পারি এযাত্রায়!

সে যাইহোক,

আজকে সারাদিন ভারি কিছুই আমাদের পেটে পরে নাই। বিস্কুট, খেজুর দিয়ে পার হইছে দিন! আমাদের ব্যাগে গত রাতের কষানো পাহাড়ি মুরগির মাংস আছে, খুদায় পাগল হয়ে সবাই তখন ওই কষানো মুরগির মাংসের দুই টুকরা করে খেয়ে যা শক্তি গেইন করা পসিবল তা করে নেই। ঠান্ডায় জমে থাকা মাংসও এখন খোদার পাঠানো অমৃত এক আশীর্বাদ!

আমাদের রাত কাটাতে হবে এই জমিতেই, ১৪° এর শীতে জমে যাচ্ছি। মাটিতে একটা চাদর বিছানো হলো, তার উপর যে যা পারছে তা দিয়েই শুয়ে পড়ি। নিচে পাথর এর টুকরার গুতা খাচ্ছি অনবরত, তাও কিছু করার নেই! পিঠ লাগানো গেছে এটুক ই অনেক।

আগুন জালানো সম্ভব না, পাশেই জুম, আগুনে ফসলের ক্ষতি হবে ভেবে আগুন জালানো হয় নাই+যাদের জুম তারা এসে আমাদের দেখলে অনেক কিছুই হতে পারত।

03

সারা রাত কাপতে কাপতে পার হয়ে গেলো। খোলা আকাশের নিচে ইয়া বিশাল চাঁদ টা কে মাথার উপর থেকে সরতে সরতে ধীরে ধীরে পাহাড়ের ওই পারে হারিয়ে যেতে দেখলাম পুরা রাত ধরে।

জীবনে এই প্রথম একটা রাত জলদি শেষ হওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে দুয়া করতেছি…

১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়