fbpx

ডায়বেটিস প্রতিরোধে সবাইকে মিলে একসঙ্গে কাজ করতে হবে

বর্তমানে বিশ্বে ৪০ কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। বাংলাদেশে এ সংখ্যা ৮০ লাখের মতো।

বিশ্বে প্রতি ১০ জনে ১ জন ডায়াবেটিসে আক্রান্তদেশে ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, অর্ধেকই নারী। ডায়াবেটিস একটি মেটাপলিক রোগ। ইনসুলিনের পরিমাণ কমে গেলে রক্তে চিনির পরিমাণ বেড়ে যাবে। এজন্য পারিপার্শ্বিক ও বংশগত দুই কারণই থাকে। 

ডায়াবেটিস আর হৃদরোগ এতটাই পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত যে, আমরা যে সকল রোগীদের এনজিওগ্রাম করি, তাদের মধ্যে যাদের ব্লক পাওয়া যায় অথবা রিং পরানো লাগে তাদের বেশির ভাগই ডায়াবেটিসে ভুগতে থাকেন। ডায়াবেটিস রোগীদের করোনারি ধমনিতে ব্লক হওয়ার জন্য তাদের কারো কারো রিং লাগে আবার কারো কারো বাইপাস সার্জারি লাগে। সেজন্য যদি প্রথম চেকেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারা যায় তাহলে হৃদরোগ এড়ানো সহজ হয়। দেখা যাচ্ছে বিশ্বব্যাপী যাদের ডায়াবেটিস আছে, তাদের হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৫ বছরের নিচের যুবকদের নিয়ে একটি গবেষণায় দেখা যায়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যে বয়সে হৃদরোগ হয়, সে বয়সে বাংলাদেশে প্রায় ১৭-২৫ গুণ বেশি হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই আমরা বলছি, যাদের পরিবারে ডায়াবেটিস আছে, তাদের হৃদরোগও বেশি দেখা যায় আর যাদের তামাক জাতীয় দ্রব্য নেওয়ার অভ্যাস আছে। যারা শারীরিক পরিশ্রম কম করে বা হাঁটাহাটি কম করে, চর্বি জাতীয় খাদ্য বেশি খায় এবং কাঁচা শাক-সবজি ও ফলমূল কম গ্রহণ করে তাদের ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ বেশি হয়ে থাকে। সাধারণ হৃদরোগী আর ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে উপসর্গের পার্থক্য আছে। প্রথমত হৃদরোগ যাদের করোনারি ধমনিতে সমস্যা আছে, তাদের হয়ে থাকে। যদি এটি ১০০% ব্লক হয়, তাহলে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। আর যদি ৭০-৯৫% ব্লক হয় তাহলে হাঁটলে বুকে ভার অনুভূত হবে। আর যাদের মধ্যে নিয়ন্ত্রণহীন ডায়াবেটিস থাকে তাদের হার্ট অ্যাটাক হলেও বুকে ব্যথা নাও হতে পারে। যাদের ডায়াবেটিস নরমাল তাদের বুকে ব্যথা, প্রচুর ঘাম যাওয়া আর বমি হলেও যাদের অনিয়ন্ত্রিত তাদের এগুলো নাও হতে পারে। তার মানে যাদের ডায়াবেটিস আছে তারাই বেশি হৃদরোগ ঝুঁকিতে আছেন। অন্যরা যেখানে রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বুকের ব্যথা বুঝতে পারছেন, সেখানে ডায়াবেটিস রোগীরা কিছুই বুঝতে পারছেন না। এটি তাদের জন্য বড় একটি অশনিসংকেত। এই একটি পার্থক্য চিকিৎসকগণ বিশেষভাবে জোর দিয়ে থাকে। তাছাড়া যাদের ডায়াবেটিস আছে, তাদের রক্তনালীতে এমন এমন কিছু ব্লক হয়ে যায় যা একেবারে ডিফিউজ বা খুব খারাপ ধরনের। আর যাদের ডায়াবেটিস নেই তাদের রক্তনালীতে পাওয়া যায় ছোট ছোট ব্লক। তাই তাদের রক্তের শর্করা সুনিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। এতে কোনো কার্পণ্য করা যাবে না। আমরা সবসময় চারটি “ডি” এর কথা বলে থাকি।

  • ডায়েট
  • ডিসিপ্লিন
  • ড্রাগ
  • ড্রিম বা ঘুম

এই চারটি “ডি” কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে আমরা হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে পারবো।

 ডায়াবেটিস রোগীদের যে বিষয়গুলো হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে তা হলো ডায়াবেটিস বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। আমরা টাইপ-২ ডায়াবেটিস নিয়েই বেশি আলোচনা করেছি। কারণ এই ডায়াবেটিসটাই বেশি হয়ে থাকে এবং যার সঙ্গে হৃদরোগের ঝুঁকিটাও একটু বেশি থাকে। যদি আমরা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, তাহলে ব্রেইন স্ট্রোক হতে পারে, ঘাড়ের রক্তনালীতে ব্লক হতে পারে, হার্টের রক্তনালীতে ব্লক হতে পারে, হাতের রক্তনালীতে ব্লক হতে পারে, কিডনির রক্তনালীতে ব্লক হতে পারে, পায়ের রক্তনালীতে ব্লক হয়ে লেগ অ্যাটক হতে পারে। এর ফলে দেখা গেল রোগীর আঙুল কেটে ফেলতে হয় এবং পা কেটে ফেলতে হয়। তাই চিকিৎসকদের পরামর্শ হলো ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে হার্ট অ্যাটক হবে না আর মস্তিস্কের রক্তনালীতেও কোনো ব্লক হবে না এবং পায়ের রক্তনালীতেও ব্লক হবে না। অর্থাৎ ডায়াবেটিস শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গে আঘাত হানতে পারে যা হার্ট অ্যাটাকের দিকে নিয়ে যায়। হার্টের সংকোচন-প্রসারণের মাধ্যমেই হার্টফেল হয়। সাধারণভাবে আমরা অনেককে বলে থাকি অনেক বড় হৃদয়ের মানুষ। কিন্তু মেডিকেলের ভাষায় এই হার্ট বড় হয়ে যাওয়াকেই বলা হয় কার্ডিওমায়ুপেথি। অর্থাৎ এই বুকের হার্টটা যদি পেটে চলে আসে, হার্ট বড় হয়ে যায়, হার্টের মাংসপেশি বড় হয়ে যায়, তখন তাকে বলা হয়ে থাকে কার্ডিওমায়ুপেথি। আর এর সঙ্গে ডায়াবেটিস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারণ হার্টের সকল রোগের সাথে ডায়াবেটিসের একটা সম্পর্ক আছে।

পেস্টিং ব্লাড সুগার আর এইচবিএ১সি খালি পেটে ৭.১ মিলিমল যদি খাওয়ার দু’ঘন্টা পরে লেভেল ০.১ এর উপরে বা এইচবিঅনসি ৬.৫% এর উপরে থাকে তখন তাকে বর হয় ডায়াবেটিস। কম বয়সীদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে

 ডায়াবেটিস কিন্তু খুব ছোট বয়সে এমনকি জন্মের পরপরও হতে পারে। আর সেটি হলো টাইপ-১ ডায়াবেটিস। যেহেতু তার বয়স কম, সেহেতু তার ডায়েবেটিস সেরকম কিনা যাচাই করতে হবে। আর টাইপ-১ হলো ইনসুলিন নির্ভর ডায়াবেটিস। তাই ট্যাবলেট খেয়ে এটি সমাধান করা যাবে না। ধরুন, ডোজের ক্ষেত্রে যদি সকাল বেলা ১০ ইউনিট আর রাতের বেলা ৮ ইউনিট ইনসুলিন দেওয়া হলো। তখন যদি সকাল বেলা খালি পেটে মাপার পর রক্তে শর্করার মাত্র বেশি থাকে, তাহলে রাতের ডোজটি বাড়াতে হবে। আর খাওয়ার দুই ঘণ্টা পর যদি তার ডায়াবেটিসের মাত্রা বেশি থাকে তাহলে সকালের ইনসুলিনের ডোজ বাড়াতে হবে। এভাবে দুপুরে খাবার আগে আর দুপুরে খাবার পরে, রাতে খাবার আগে আর রাতে খাওয়া পরে এরকম প্রতিদিন অন্তত তিন দিন ছয় বেলা মাপতে পারলে তাহলে তার রোগের প্রোফাইলটি পাওয়া যাবে। তখন চিকিৎসক তার ইনসুলিনের পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দিতে পারি। তাই মনে রাখতে হবে, চিকিৎসক যেভাবে লিখে দেবে, সেভাবে চলবে তা কিন্তু নয়। এখন যেহেতু অনেক আধুনিক যন্ত্রপাতি আছে। তাই সে সকল যন্ত্রের সাহায্যে একজন চিকিৎসক ক্যালরি হিসেব করে পাম্পের মাধ্যমে ইনসুলিনের ডোজটি দিয়ে থাকে। তবে রোগীর উচিত হবে কোন খাবারে কত ক্যালরি আছে তা জেনে নেওয়া। তখনই রোগী তার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে।

ডায়াবেটিস যে কারো হতে পারে। তবে পরিবারের যদি বাবা-মায়ের যে কোনো একজনের ডায়াবেটিস থাকে, তাহলে সন্তানদের হওয়া সম্ভাবনা ৪০ শতাংশ আর যদি দু’জনেরই থাকে তাহলে ৮০ শতাংশ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে বাবা-মায়ের থাকলে যে সন্তানদের হবে তা কিন্তু ঠিক নয়। আবার কেউ যদি অল্পতেই মোটা হয়ে যান তাহলে, সেটা ডায়াবেটিসের কারণ হতে পারে। আবার অনেকে বলে থাকে মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয়। এটি ভুল ধারণা। তবে ডায়াবেটিস হলে সুগার খেতে বারণ করা হয় যাতে রক্তের শর্করা হঠাৎ করে বেড়ে না যায়। আরেকটি বিষয় হলো, কেউ যদি ছোটবেলা থেকেই খাদ্যাভাস মেনে চলেন, হাঁটাহাঁটি করেন বা কায়িকশ্রম করেন, তাদের পরিবারের ঝুকি থাকলেও তা প্রতিরোধ করতে পারবেন। বিশেষ করে জর্দা, তামাক, সাদাপাতা ইত্যাদি যদি ব্যবহার না করেন, তাহলে তার ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে মহিলাদের যখন মাসিক চলে, তখন হৃদরোগের আশংকা কম থাকে। কিন্তু পুরুষদের ঝুঁকি বেশি থাকে। আবার মাসিক বন্ধ হওয়ার পরে নারীদের হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তবে দেখা যাচ্ছে এখন সকল বয়সের নারী-পুরুষদের ডায়াবেটিস হচ্ছে।

ডায়াবেটিস বা অ্যাজমা বা রক্তচাপ যেটি বলুন না কেন এগুলো একবার হলে সারা জীবন থেকে যায়। ঠিক তেমনি হৃদরোগ একবার হলে, সারা জীবন থেকে যায়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ডায়াবেটিস বা হৃদরোগ হয়েছে, তাই জীবন শেষ হয়ে গেল। আধুনিক চিকিৎসায় এগুলো প্রশমন করা সম্ভব হচ্ছে। আর অবশ্যই অনুমিত নিয়ম-কানুনগুলো ঠিকমত পালন করলে এগুলো থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব।

 ডায়াবেটিস রোগীরা হৃদরোগ এড়াতে প্রথমে অবশ্যই খাদ্যাভ্যাস মেনে চলতে হবে। কাঁচা ফলমূল বেশি খেতে হবে। ভাত, চিনি, লবণ- এই তিন সাদা জিনিসকে পরিহার করতে হবে। আর অবশ্যই আঁশ জাতীয় খাবার বেশি খেতে হবে এবং সিম্পল কার্বোহাইড্রেট ও চর্বিযুক্ত খাদ্য পরিহার করতে হবে। হাঁটাহাঁটি, জগিং, সাইক্লিং, সাঁতারকাটা ইত্যাদি করা যেতে পারে। কারণ এগুলো খুব উপকারী অভ্যাস। বিশেষ করে হাঁটাহাঁটির অভ্যাস থাকলে যে কেউ একসঙ্গে ডায়াবেটিস আর হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। সর্বেশষ বলবো, আপনি হাঁটুন, হাঁটুন এবং হাঁটুন। ডায়াবেটিস যত তাড়াতাড়ি শনাক্ত করা যাবে, সেই রোগীর জন্য সেটা ততো ভালো। তাতে তিনি যেমন রোগটির চিকিৎসা দ্রুত শুরু করতে পারবেন, পাশাপাশি তার জীবনযাপনও একটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে আসবে।

টাইপ-২ ধরণের ডায়াবেটিসের ৭৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই আগেভাগে সতর্ক থাকলে, শারীরিক পরিশ্রম করলে এবং খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপনে নিয়ন্ত্রণ আনলে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব। কিন্তু একবার ডায়াবেটিস হয়ে গেলে আর এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না।

যে সব লক্ষণ দেখলে সতর্ক হতে হবে:

  • চামড়ায় শুষ্ক, খসখসে ও চুলকানি ভাব
  • দুর্বল লাগা,  ঘোর ঘোর ভাব আসা
  • ঘনঘন প্রস্রাব হওয়া ও পিপাসা লাগা
  • ক্ষুধা বেড়ে যাওয়া
  • মিষ্টি জাতীয় জিনিসের প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যাওয়া
  • সময়মতো খাওয়া-দাওয়া না হলে রক্তের শর্করা
  • কমে হাইপো হওয়া
  • বিরক্তি ও মেজাজ খিটখিটে হয়ে ওঠা
  • চোখে কম দেখতে শুরু করা
  • কোন কারণ ছাড়াই অনেক ওজন কমে যাওয়া
  • শরীরে ক্ষত বা কাটাছেঁড়া হলেও দীর্ঘদিনেও সেটা না সারা

মনে রাখবেন :

  • করলা, চিরতা এসব খেলে উপকার হয় কি না সেটি এখনো তেমনভাবে আবিষ্কার হয়নি। তবে আসল কথা হলো অনেকে চিরতা বা করলাতেই চিকিৎসা মনে করেন। মনে রাখতে হবে, এসবে কিছুটা উপকার পেলেও আহার নিয়ন্ত্রণ, ব্যায়াম ও ওষুধ গ্রহণ চালিয়ে যেতে হবে।
  • আজকাল যে আধুনিক সিরিঞ্জ বের হয়েছে তাতে ব্যথা হয় না বললেই চলে, আর রোগী যদি ইনসুলিন নেওয়ার ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে খাবার গ্রহণ করেন তবে হাইপোগ্লাইসিমিয়া হওয়ার আশঙ্কা থাকে না।
  • ডায়াবেটিস একটি সারা জীবনের রোগ। তাই নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করতে হবে সব সময়, আর নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করলে তিনিই বলে দেবেন, ওষুধের ডোজ কমাতে বা বাড়াতে হবে, কিংবা ওষুধ ছাড়া জীবনযাত্রার মান নিয়ন্ত্রণ করলেই চলবে কি না।
  • ইনসুলিন অনির্ভরশীল ডায়াবেটিসে ট্যাবলেট খাওয়া যেতে পারে; কিন্তু ইনসুলিন নির্ভরশীল ডায়াবেটিসে এটাই একমাত্র চিকিৎসা।
  • শরীরে ইনসুলিন কমার ফলেই তো ডায়াবেটিস হয়। তাই সরাসরি ইনসুলিন দেওয়াই উত্তম। আর মুখে খাওয়ার ওষুধগুলো নিজেরা ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না। তারা অসুস্থ অগ্ন্যাশয় থেকে চুইয়ে চুইয়ে ইনসুলিন বের করে। তাই প্রথমদিকে অসুস্থ অগ্ন্যাশয়কে বিশ্রাম দেওয়ার জন্যও ইনসুলিন দেওয়া প্রয়োজন।
  • ডায়াবেটিস ছোঁয়াচে রোগ নয়।কারো বাবার ডায়াবেটিস থাকলে তার ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা অন্যদের তুলনায় ছয়গুণ বেশি। মায়ের ডায়াবেটিস থাকলে এ আশঙ্কা বাড়বে তিনগুণ আর বাবা-মা উভয়ের থাকলে এ আশঙ্কা ২০ গুণ বেড়ে যাবে। সুতরাং ডায়াবেটিসে বংশগত প্রভাব কিছুটা তো আছেই।
  • চিনি খেলে কখনো ডায়াবেটিস হয় না; তবে ডায়াবেটিস হয়ে গেলে অবশ্যই চিনি কম খেতে হবে বা একেবারে খাওয়া যাবে না।

ডায়াবেটিস যেহেতু অসংক্রামক ব্যাধি তাই এর সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ জানা যায়নি। তবে পারিবারিক ইতিহাস, অধিক মাত্রায় খাদ্যগ্রহণ, কায়িক শ্রমের ঘাটতি, শরীরের অতিরিক্ত ওজন, পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়স, রক্তে ক্ষতিকর চর্বি বেড়ে যাওয়া, গর্ভাবস্থা, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, বিষণ্নতা তথা সার্বিক জীবনযাপনের ধরনের সঙ্গে ডায়াবেটিসের যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া গিয়েছে।কথায় আছে রোগ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। ডায়াবেটিস রোগ-প্রতিরোধ বলতে তিনটি ধাপে বা পর্যায়ে প্রতিরোধ করা বোঝায়। প্রথম ধাপটি হচ্ছে ডায়াবেটিস হওয়ার আগেই একে প্রতিরোধ করা। একে প্রাথমিক প্রতিরোধ বা প্রাইমারি প্রিভেনশন বলে। নিয়ন্ত্রিত এবং সুশৃংখল জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে খুব সহজেই একে অনেকাংশে প্রতিরোধ করা যায়। অধিক ক্যালরিযুক্ত খাবার, ফাস্টফুড, কোমল পানীয়, প্রক্রিয়াজাত খাবার, চকোলেট, আইসক্রিম ইত্যাদি পরিহার করতে হবে।প্রচুর পরিমাণে সবুজ শাকসবজি, ফলমূল, মাছ, কম চর্বি ও কম শর্করাযুক্ত খাদ্য গ্রহণে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। কায়িক শ্রমের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। শিশুদের ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এজন্য চাই সামাজিক সচেতনতা।

প্রতিরোধের দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে দ্রুত রোগ শনাক্তকরণ ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদান।

ডায়াবেটিসের জটিলতাগুলো রোগের প্রাথমিক ধাপ থেকেই শুরু হয়। সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় তাই ডায়াবেটিসের চিকিৎসা ও জটিলতা প্রতিরোধের অন্যতম পূর্বশর্ত। বয়স ৪৫ বা তার বেশি হলে, ওজন বেশি হলে, রক্ত সম্পর্কীয় নিকটাত্নীয়ের ডায়াবেটিস থাকলে, শারীরিক পরিশ্রমের ঘাটতি, মহিলাদের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বা অধিক ওজনের সন্তান প্রসবের পূর্ব ইতিহাস থাকলে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা জরুরি।

পরিমিত খাদ্য, সুশৃংখল জীবন ও নিয়মিত ওষুধ সেবন এই তিনটি নীতি ডায়াবেটিসের রোগীরা সঠিকভাবে পালন করলে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবেন। প্রতিরোধের তৃতীয় ধাপ হচ্ছে ডায়াবেটিসজনিত জটিলতার শনাক্তকরণ ও এর সঠিক চিকিৎসা। ডায়াবেটিস নীরবে রোগীর চোখ, রক্তনালি, হার্ট, কিডনি ও স্নায়ুতন্ত্রের ভয়ানক ক্ষতি করে থাকে।

অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসকে প্রয়োজনীয় ওষুধের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা এবং ডায়াবেটিসজনিত জটিলতাগুলো এড়াতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। জটিল রোগীদের সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত করা ও পুনর্বাসন করাও ডায়াবেটিস চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

ডায়াবেটিসের কারণ, নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ও প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। কার্যকর স্বাস্থ্য শিক্ষার মাধ্যমে ডায়াবেটিস-এ আক্রান্ত ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম, ওজন নিয়ন্ত্রণ তথা সুশৃংখল জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও চিকিৎসা একটি সমন্বিত, সামাজিক পদক্ষেপ।

সরকার, চিকিৎসক, কোনো প্রতিষ্ঠান বা কারও একার পক্ষে কখনও এই বিপুল কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব নয়। একে প্রতিরোধ করার জন্য সমাজের সকল স্তরে, পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পর্যন্ত সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

মেডিসিন আউটডোর - ইন্টার্ন শিক্ষার্থী | ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল