কাল নবান্নোৎসব। ছেলে-মেয়েরা হৈ-হুল্লোড় করতে করতে লাঠির আগায় দাঁ লাগিয়ে কলাগাছের পাঁতা কেটে নিয়ে গেল। পুকুরপাড়ের কলাগাছগুলো এই ভেবে গর্বিত হয় যে তাদের পাতাগুলো ছাড়া কোন অনুষ্ঠানই সম্ভব হয় না। পুকুড়ের পাড় থেকে শুরু করে পূর্বে খোলা প্রান্তর এবং তারপর শ্বশান। মাঠে কেটে রাখা আমনধান ঘরে নিয়ে আসা প্রায় শেষের দিকে। দূরে শ্বশানের পাশে সারি সারি বেলগাছ ও বিক্ষিপ্ত প্রকান্ড আমগাছের বাগানটায় কিছু গৃহপালিত পশু ও দুটি সাদা ঘোড়া প্রতিদিনই চোখে পরে। পুকুড়ের পাশ দিয়ে শ্বশানের দিকে চলে যাওয়া রাস্তাটা দিয়ে নন্দ্য তার ঘোড়াগুলোকে শেষ বিকেলে বাড়ি নিয়ে আসে। ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ প্রান্তর যেন এক জনশুন্য মায়াক্ষেত্রে পরিণত হলো৷ পাশে খোলা উঠানে ধাঁনের শেষ বোঝাটা নামিয়ে ক্ষেতমজুরেরা আজকের মত কাজের ক্ষ্যান্তি দিলো। পাড়ের আশপাশ থেকে শুরু করে সমগ্র প্রান্তর কুয়াশার চাদরে ঢেকে গেল। সমস্ত এলাকা যখন নিস্তব্ধ হয়ে এলো, তখন পুকড়ের পশ্চিমপাড়ে অর্জুন গাছটার নিচে এক মূর্তির আগমন ঘটলো। সূর্যের সমস্ত আলোকরশ্মি ধীরে ধীরে পৃথিবীর অপর প্রান্তে আটকা পরে গেল। দূরে শ্মশান প্রান্তে এক শৃগালের উচ্ছ্বসিত চিৎকার সূর্যকিরণের সমাপ্তি ঘোষণা করে শেষ কার্তিকের এক দীর্ঘ হিমশীতল রাত্রিরং আগমনকে অভ্যর্থনা জানালো। পাতা ঝরে যাওয়া কঙ্কালসার শিমুল গাছটার নিচে এখনো কিছু ছাই ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। স্বল্পদৈর্ঘের এক নাটকের সমাপ্তি ঘটেছে। দর্শকেরা নিজস্ব জীবনে ফিরে গেছে। একজোড়া পাথরের চোখ অপলক তাকিয়ে রইল দূরে শিমুল গাছের পাশে সেই সাদা নিশানটার দিকে। সমস্ত ঝিঁ ঝিঁ পোকার দল সম্মোহিত হয়ে স্তব্ধ হয়ে আছে।
সহসা অপড় প্রান্তে এক অবয়বের আবির্ভাব হলো। অবয়বটি পাড়ের শেষ প্রান্ত ও সমতলের সঙ্গমস্থলে এসে স্থির হয়ে দাড়ালো। এপাড় থেকে আবছা আলোয় দেখা গেলো এক যুবক, পড়নে ধুতি ও খালি গায়ে সাদা শাল জড়ানো।
এ প্রান্তের প্রস্তরবৎ মূর্তি সামান্য দুলে উঠল এবং প্রশ্ন ছুড়ে দিল,
-কে তুমি? কোথা থেকে এলে?
হৃদয়কে প্রস্তরশীতল করে এক নির্মোহ শব্দতরঙ্গ ওপাশ থেকে ভেসে এলো,
“আমি হেমন্ত”৷
পাশের ক্ষতবিক্ষত অর্জুন গাছটি অতি সন্তর্পণে এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সমস্ত প্রশ্নের অবসান হলো। পাথরের চোখদুটোয় সামান্য নির্মলতা দেখা দিলো।
দুজনই শ্বশান অভিমুখের রাস্তাটায় একি দিকে হাটা শুরু করল। দুটি ছায়া ধীরে ধীরে একটি ছায়া ও ক্রমে প্রান্তরের অপর পাশে মিলিয়ে গেল। ক্রমে ঝিঁ ঝিঁ পোকাগুলোর কন্ঠে আবার স্বর ফিরে এলো।
- This author does not have any more posts.