fbpx

প্রসঙ্গঃ ভিভা ভোচে!

বহুদিন আগের কথা। আমার একজন সন্মানিত শিক্ষক পিএসসির সদস্য হিসেবে বিসিএস এর মৌখিক পরীক্ষা নিচ্ছেন। আমার ছোট ভাইয়ের পরীক্ষা পড়েছিল তার বোর্ডে। ছোট ভাই পরীক্ষা উতরে নিয়োগ পেয়েছিল পরিসংখ্যান এর প্রভাষক হিসেবে।

সে ঘটনার বহু বছর পর সেই শিক্ষকের সঙ্গে ভিনদেশে দেখা। স্যারকে বললাম উনার মনে আছে কিনা যে আমার ভাই উনার বোর্ডে পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল। স্যার বললেন, মনে থাকবেনা মানে? ও তো সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিল। শেষে ওকে জিজ্ঞেস করেছিল যে দোয়া কুনুত মুখস্থ পারে কিনা। ও তাও পেরেছিল।
দীর্ঘদিন পর সম্প্রতি আবার সেরকম একটা বিসিএস মৌখিক পরীক্ষার গল্প শুনলাম। গল্প বলছি এজন্যে যে এটা আমার সরাসরি জানা ঘটনা নয়। এক পরীক্ষার্থীর ভাষ্য অন্যের মুখে শোনা। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল – বাংলাদেশে প্রহসনমূলক নির্বাচনের একটি উদাহরণ দিন। স্বভাবতই হাল আমলের একটি নির্বাচনের কথা মূখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল প্রার্থীর। তারপরের ঘটনা বিবৃত না করাই শ্রেয়!

সরকারী চাকুরীতে মৌখিক পরীক্ষাকে রাজনৈতিক আনুগত্য নির্ণয়ের ব্যারোমিটার হিসেবে ব্যবহারের সংস্কৃতি আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়। দোয়া কুনুতের সঙ্গে পরিসংখ্যান পড়ানোর কি সম্পর্ক তা পরিসংখ্যান এবং দোয়া কুনুত উভয়ের স্রষ্টাই বোধ করি ভাল বলতে পারবেন। তবে এটা বুঝতে অসুবিধা হবার কথা না যে দোয়া কুনুতের মত নামাজের সবচেয়ে কঠিন দোয়াটা জানা থাকলে ইসলামের প্রতি আনুগত্যটা কিছুটা হলেও আঁচ করা যায় বৈকি! আবার প্রহসনমূলক নির্বাচনের উদাহরণ হিসেবে আপনি ১২ই ফেব্রুয়ারী না ৫ই জানুয়ারী বেছে নেবেন তার উপর নির্ভর করবে সরকারী চাকুরীতে আপনার ভবিষ্যৎ। আপনি কতটা মেধাবী বা আপনার অন্যান্য যোগ্যতা তখন আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়ে আসতে পারেন। আপনাদের মনে হয় স্মরণে থাকতে পারে এইচ টি ইমামের সেই বিখ্যাত উক্তি – ছাত্রলীগের ছেলেরা চাকরি পাবে না তো কারা পাবে, অথবা এরকম গোছের কিছু একটা।

এ তো গেল সরকারী চাকুরীর কথা। ভাইবা ভোচি বা ভিভা ভোচে (Viva Voce, Latin origin) শব্দটির সঙ্গে পরিচিত নন, এমন ছাত্রছাত্রী বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। আর যদি খুঁজে পাওয়া যায় তাকে এ কোর্সটিতে নিঃসন্দেহে শুন্য দেয়া যেতে পারে। ফি বছর ভিভা ভোচে নামের এই যন্ত্রণাদায়ক একটা কোর্সের মুখোমুখি হতে হয় কমবেশি সকল অনার্স এবং মাস্টারস পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের। ল্যাটিন এ শব্দটির কাছাকাছি বাংলা হলো মৌখিক পরীক্ষা। লিখিত পরীক্ষায় আপনি যা উগরে দিয়েছেন, তার কতটুকু বুঝতে পেরেছেন, তা শিক্ষকমন্ডলী (পরীক্ষা কমিটি) খতিয়ে দেখবেন আপনাকে সরাসরি প্রশ্ন করে, এই যা!
আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, মন্দ কি? জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যই তো হলো জানা। আপনি কি জানেন সেটা ঝালিয়ে দেখাটা শিক্ষকদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে বইকি। কিন্তু আমার ব্যাক্তিগত অভিমত হল ফি বছর এই মোখিক পরীক্ষা নামক কোর্সটি বেশীর ভাগ শিক্ষার্থীদের জন্যই একটা অপরিসীম যন্ত্রণার উৎস হয়ে দাঁড়ায়।

নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমাদের সময়ে তিন বছরের স্নাতক এবং এক বছরের স্নাতকোত্তর ডিগ্রীর প্রচলন ছিল। প্রতি বছর ভিভা ভোচেতে একটা টেবিলের তিন পাশ ঘিরে থাকা তিন কি চারজন সাক্ষাৎ যম অধ্যাপক-এর সামনে পড়তে হত। একজন আবার এলিয়েন, মানে অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা অধ্যাপক। আশ্চর্যের বিষয় হল, সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিলেও ভিভা ভোচে কোর্সে সর্বোচ্চ নম্বর মিলত ৬৪%। ছাত্ররা কেন সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েও সব নম্বর পাবেনা, সে রহস্য এখনো আমার অজানা। আমার মাঝে মধ্যে মনে হতো, নম্বর শিক্ষকদের নিজস্ব সম্পত্তি, ছাত্রদের প্রদান করলে নিজের টান পড়বে, সেজন্য হয়তো!

শিক্ষকরা ছাত্রদের চেয়ে বেশী জ্ঞানী হবেন সম্পৃক্ত বিষয়ে, এটাই স্বাভাবিক। তার উপর চারটা মাথা একত্র হলে তো কথাই নেই। তাই ওই টেবিলের তিনপাশে বসা তিন চার জন শিক্ষককে প্রতি বছর মনে হত সাক্ষাৎ যমদূত। এ ধরণের যমদূতীয় অনুভূতির জন্য অবশ্য তৎকালীন ছাত্রশিক্ষক সম্পর্কের বিপ্রতীপ দূরত্বকেও দোষারোপ করা যায়। আপনি ক্লাসের ফার্স্ট বয় হোন আর লাস্ট বয় হোন, ওই টেবিলের সামনে বসে আপনাকে ঘামতেই হবে। দোয়া কুনুত জানা না জানা বা প্রহসনমূলক নির্বাচনের উদাহরণ আনুগত্যের ব্যারোমিটার হলেও ভিভা ভোচের যমদূতদের সামনে নিসৃত ঘামের পরিমাণের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়ে জ্ঞ্যানের পরিধির কোন সম্পর্ক আছে বলে আমার মনে হয় না। এ বিষয়ে সংশ্লেষাঙ্ক (correlation coefficient) দিয়ে একটা পরিসংখ্যানিক গবেষণা করা যেতে পারে।

এ ব্যাপারটি এ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলেও মেনে নেয়া যেত। কিন্তু ভিভা ভোচে নামের এ যমদূতীয় কোর্সটিকে বিভিন্নভাবে ব্যাবহার করে আসছেন কিছু কিছু ক্ষমতাসীনরা। এই ক্ষমতাসীন যে কারা তা যেমন নির্ভর করে বিভাগীয় নেতৃত্বের সাদা, নীল, বা গোলাপী (অধুনাবিলুপ্ত) বর্ণের উপর, তেমন আবার নির্ভর করে যে ব্যাচের ভিভা ভোচে পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে তার উপরও। সে ব্যাচের যে সমস্ত (দোষ-) গুণাবলী বিবেচনায় আসতে পারেঃ
১) সে ব্যাচে বিভাগের কোন (বর্ণ-)দলবাজ শিক্ষকের কোন সন্তানাদি আছেন কিনা। যদি থেকে থাকেন, তবে সে শিক্ষকের পছন্দের যমদূতেরা অধিষ্টিত হবেন পরীক্ষা কমিটিতে, এবং সে সুবাদে ভিভা ভোচের টেবিলে। এমন কি এলিয়েন সদস্যও নির্বাচিত হবেন সে অনুযায়ী।
২) ব্যাচে ‘বেয়াদব’ ছাত্র-ছাত্রী আছে কিনা। বেয়াদবের সংজ্ঞা স্থান-কাল-পাত্র বিশেষে পরিবর্তন হয়। যেমনঃ ক্লাসের বোর্ডে শিক্ষক নিজের নোট থেকে কপিরত অবস্থায় পেছন থেকে ছাত্রের প্রশ্ন করা, পেছনে বসে পারষ্পরিক কথা বলা, একে অপরের প্রতি মুচকি হাসি প্রদর্শন, প্রেমিক-যুগলের ক্লাসে বা লাইব্রেরীতে সহাবস্থান, পা উঁচিয়ে বসে গল্প করা অবস্থায় শিক্ষকের আগমন, ইত্যাদি! (ছাত্রীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য) পোষাকের কোথাও ঘাটতি আছে কিনা, মটর সাইকেল চালায় কিনা, রাতে-বিরাতে ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা দেয় কিনা।
৩) (দ্বিতীয় বর্ষ বা তার উপরের দিকের জন্য প্রযোজ্য) ক্লাসের উপরের দিকে এক থেকে তিনের মধ্যে যারা আছে তাদের ধর্ম, বর্ণ, বিশ্বাস, আনুগত্য!
সাধারণত অন্য সকল বিষয়ের পরীক্ষার ফলাফলে পরীক্ষা কমিটির হাত থাকে না। দুটো বিষয়ে সমমনা পরীক্ষা কমিটি চাইলে কাউকে টেনে উঠাতে পারে বা নামাতে পারে। ভিভা ভোচে, এবং থিসিস। থিসিস পরীক্ষক নিযুক্ত করেন পরীক্ষা কমিটি।
পরীক্ষা কমিটির ‘বিশিষ্ট ছাত্র – বান্ধব’ যমদূতেরা ‘বিশিষ্ট’ ছাত্রটিকে ‘উপযুক্ত’ প্রশ্নগুলো করতে পারেন ভিভা ভোচেতে যেন ‘বিশিষ্ট ছাত্র’টি সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে নির্দ্বধায়।
পরীক্ষা কমিটির ‘সংক্ষুব্ধ’ যমদূতেরা ‘বেয়াদব’ ছাত্র-ছাত্রীদেরকে উপযুক্ত ‘শিক্ষাদানে’র নিমিত্তে ‘উপযুক্ত’ প্রশ্ন করতে পারেন ভিভা ভোচেতে, যে প্রশ্নের উত্তর তারা জানেন যে কোন ছাত্রই সঠিকভাবে দিতে পারবে না। করো ‘বেয়াদবি’!

পরীক্ষা কমিটির যমদূতেরা আনুগত্যহীন, ভিন্ন বর্ণ, ধর্ম, বা বিশ্বাসের শিক্ষক হতে প্রত্যাশী প্রথম দিকের ছাত্র/ছাত্রীটিকে ভিভা ভোচেতে ভয়ানক সব প্রশ্ন করে অথর্ব প্রমাণ করতে পারেন নিমেষেই।

ফার্স্ট বয়টা মাইনরিটি? আপনি দোয়াকুনুত জানা লোক চান শিক্ষক হিসেবে? পাঠিয়ে দিন ওর থিসিসটা আরেকজন ‘দোয়া কুনুত-পরীক্ষা’য় বিশ্বাসী বন্ধুকে! ফার্স্ট গার্লটার থিসিস এডভাইজরের দল/বর্ণ আপনার মত না? শিক্ষক হলে দলভারী হবে না? পাঠিয়ে দিন ওর থিসিসটা আরেকজন বর্ণবাদী বন্ধুকে! ব্যাস! ল্যাঠা চুকে গেল!
এটা মনে হতে পারে একটা দুটা কোর্সে এরকম একটু এদিক সেদিক করে কি কিছু হয়? ভিভা ভোচেতে আমাদের সময় অনার্সে তিন বছর মিলিয়ে মোট ২০০ নম্বর ছিল। মাস্টার্স-এর থিসিসেও তাই। উপরের দিকের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে নম্বরে পার্থক্য থাকে খুব কম। কাজেই এই নম্বরগুলো কাজ করতে পারে তুরুপের তাস হিসেবে। আগে শিক্ষকরা শুধু শিক্ষকই ছিলেন, সে সময়ে পড়াশুনার বাইরের বিষয় প্রভাবিত করত না থিসিস বা ভিভা ভোচে পরীক্ষাকে। কিন্তু সময় পাল্টেছে। শিক্ষকদের এখন নানা রূপ। সাদা, নীল। এ পন্থী, ও পন্থী। এ পরিষদ, সে ফোরাম! এসবের ভিড়ে তারা কেমন করে নিরপেক্ষ থাকবেন ছাত্রদের কাছে?
করণীয় কি?

বিষয়-ভিত্তিক যোগ্য থিসিস পরীক্ষকদের একটা তালিকা (Examiner Bank) বানান। সেখান থেকে থিসিস পরীক্ষক নিযুক্ত করুন। ভিভা ভোচে তুলে দিন সিলেবাস থেকে।

অসীম যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিন ছাত্রদের!