দ্য মিস্ট্রি ড্রয়ার
পর্ব ১
সেবার গ্রাম থেকে ফিরেছি অনেক কষ্টে। দীর্ঘদিনের বন্যায় পানি বন্দি থাকার পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। নিজের স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে ফিরেছি মফস্বলের বাড়িটিতে।
ও হ্যা, পরিচয় দেয়া হয়নি, আমি…..যা ভাবছেন তাই-ই!
বয়স হয়েছে বেশ।
বেশ কিছু বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাটা সাইন্স নিয়ে মাস্টার্স করেছি। ভাবছেন এখন কি করছি? বেকার বলা যায়, আবার ঠিক তাও না। এখানে নিজের একটা ছোট স্কুল দিয়েছি। বাচ্চা-কাচ্চাদের প্রাথমিক পর্যন্ত পড়াই। দু একটা টিউশনিও করাই। তাছাড়া বর্তমান বাজারে সংসার চালানো খুবই কষ্টকর।
যদিও বিদেশ থেকে চাকুরীর অফার ছিল। কিন্তু বাবা-মা ও ছোট বোনকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করেনি। বিসিএসে ট্রাই করেছি দুবার, কোনো লাভ হয়নি। তারপর থেকেই শিক্ষকতা আর একটা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেছি বই পড়ে। সেটা নাহয় পরেই বলবো।
আর হ্যা, কয়েক বছর আগে বিয়েও করেছি, আর আমার একটা মেয়েও আছে।
বর্ষাকাল, বেলকোনিতে বসে আছি, ঘরে বিদ্যুৎ নেই সামনে ডোবাতে ব্যাঙ গুলো ডাকছে, খুবই বিরক্তকর, ঠান্ডা লাগছে, বউকে বললাম চাদরটা নিয়ে আসতে। চাদর গায়ে জড়িয়ে মাথায় টুপি পড়ে এশার নামাজটা ঘরেই পড়ে নিলাম।
মোমবাতির আলোতে মেয়েকে পড়াচ্ছিলাম, যদিও এখন মানুষ অনেক আধুনিক হয়েছে, সেদিক থেকে আমি আমার পরিবারকে আধুনিকতার ছোঁয়ায় রাখিনি। স্মার্টফোনের যুগে নোকিয়া চালিয়ে, প্রতিদিন কাগজের পত্রিকা পড়েই পুরোনো ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছি।
মেয়েটা এবার ক্লাস ২ তে। ভাবছি শহরের একটা নামি সরকারি স্কুলে এবার ভর্তি করাবো। তারই একটা প্রিপারেশন হিসাবে ওকে দামি একটা কোচিং সেন্টারে ভর্তি করিয়েছি। মেয়েটার ওপর প্রচুর চাপ যাচ্ছে। আমার নিজেরই খারাপ লাগছে, কেনো ওকে এই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় ঠেলে দিলাম?
যাক, পড়াচ্ছিলাম বেলকনিতে, হঠাৎ একজনের ফোন। কল ধরেই আমি বললাম, “কে?”
ওপাশ থেকে ভারী গলায় একজন বলল, “চিনতে পেরেছিস? আমি তমাল।”
সাথে সাথেই আমি, “ও হ্যা তমাল কি অবস্থা? এতদিন পর হঠাৎ?” (তমাল যোগাযোগ করলো প্রায় অর্ধযুগ পর)
ভারী মর্মাহত কন্ঠে তমাল, “আমি একটা বিপদে পরেছি বন্ধু, আমার মেয়ে কিডন্যাপ হয়েছে।”
“কি বলিস! কবে? কখন? কিভাবে?”
“তুই একটু আমার এখানে আসতে পারবি?”
“হ্যা, অবশ্যই, তোর ঠিকানা বল।”
“আমি সাতক্ষীরায় থাকি।”
“ঠিক আছে।” বলে, ফোনটা রাখলাম।
তমালের বিপদের কথা শুনে প্রথম ভেসে ওঠে আমার মেয়ের মুখটা। কত আদরেই না মেয়েটাকে মানুষ করছি। যাক, সে ঘুমিয়ে পড়েছে।
কাল সকালেই রওয়ানা হতে হবে সাতক্ষীরার উদ্দেশ্যে।
ফোন লাগালাম তামিমকে, “তামিম একটা নতুন কেস পেয়েছি। কালকে স্কুলে আসার দরকার নেই। সোজা সাতক্ষীরা। এবার সাতদিনের আগে ফেরা হচ্ছে না বোধহয়।”
তামিমও বলল “ঠিক আছে, আমার আর কি! আমার তো আর ঘর সংসার নেই”।
“তুই যাবি কিনা সেটা বল। এত কথা আমি শুনতে চাইনি।”
“আরে যাব রে ভাই, শুধু ঘুম থেকে উঠতে একটু লেট হবে।”
“ হা হা হা, আচ্ছা ঠিক আছে, রেডি থাকিস।”
বউকে বলে রাখলাম, সাতদিনের ট্যুর।
মেয়েকে বলা যাবে না, তাহলেই কেস খেয়ে যাব।
দু’পক্ষই রেগে আগুন হবে।
যাক, রাতটা খুব সুন্দর একটা ঘুমের মধ্য দিয়ে কাটলেই হলো। …
পর্ব ২
মাঝে মাঝে আমাদের জীবনে কিছু ঘটনা ঘটে যায়, যেটা ঘটার পর মনে হয় সেটি পূর্বে কখনো ঘটেছে, কিন্তু ঘটনাটি যে ঘটেছে তা সম্পর্কে আপনি নিশ্চিত নন।
সাইকোলজির ভাষায় এটাকে বলে, “দ্য জা ভ্যূ”।
আসলে ঘটনা হচ্ছে আজ দুপুর ১২ টায় আমরা রওয়ানা হওয়ার আগে আমার সাথে এমন কিছু ঘটনাই ঘটেছে, যা দেখার পর মনে হচ্ছিল আগেও বোধ হয় এরকম ঘটেছিল। নিজের মেয়েকে রেখে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে দীর্ঘদিনের জন্য বাইরে যাওয়ার ঘটনা কিন্তু আগে কখনোই ঘটেনি, কিন্তু “দ্য জা ভ্যূ” এর ভাষায় ঘটেছে। বিজ্ঞান কতটা আনপ্রেডিক্টেবল।
যাক, ট্রেনে করে খুলনা পর্যন্ত যেতে হবে, রওয়ানা হলাম, রেলগাড়ী চলছে। ……
এবার আসি তমাল কান্ডে। তমাল আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু ছিল। ভাবছেন এ আবার কেমন কথা! বন্ধু ছিল বলে কি এখন নেই?
আসলে সেরকমই, বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুত্বগুলো ঐ পাঁচ বা ছয় বছরেই সীমাবদ্ধ থাকে, পরে আর কেউ কারও ছায়াও মারায় না। দেখছেন না, ছয় বছর পর, খোঁজ নিল, আসলে খোঁজও না, বিপদের বন্ধু।
যাক, কথা কিরকম স্বার্থপরতার দিকে মোড় নিচ্ছে।
সাতটা স্টেশন পাড় হয়ে এসেছি, এখানে ক্রসিং হলো, বেশ কিছুক্ষণ ব্রেকও পেলাম, চা টাও খেলাম। তামিম ঘুমিয়ে পড়েছিল। ওকে আর ডাকলাম না।
কিছুক্ষণ পড়ে একটা ছোট বাচ্চা হাতে কয়েকটা মালা নিয়ে বগির ভিতরে বিক্রি করার জন্য সবার দ্বারে দ্বারে যাচ্ছে। আমার কাছে আসতেই বললাম, ”কি নাম তোমার?”
“রিমঝিম।”
“তুমি স্কুলে যাও না?”
“মাঝে মাঝে যাই, তয় আমার মা আমারে আইজকা ফুলের মালা বানায় দিছে, এগুলা অহন ব্যাচতে হইব।”
“তুমি কি সবসময় এগুলা বিক্রি কর?”
“না, তয় মা যেদিন ফুলের মালা বানায় দেয় সেদিন ব্যাচতে আসি, ঐ যে আমার বাড়ি।”, বলে মেয়েটি দেখিয়ে দিলো রেল লাইনের ধারেই তাদের বাসা। এরা দিন আনে, দিন খায়। অভাবের সংসারে মাঝে মধ্যে অবুঝ সন্তানদেরও কাজে নেমে পড়তে হয়। এটি চরম বাস্তবতা। আপনি চাইলেও শিশুশ্রম নিধন করতে পারবেন না। হ্যা, দু একটা সংস্থা এদের নিয়ে কাজ করছে। কিন্তু তারা তো আর এদের সংসারের হাল ধরতে পারবে না।
মেয়েটাকে ৫০ টাকার একটা নোট দিয়ে বললাম,” আর কিছু টাকা যোগ করে কয়েকটা খাতা আর কলম কিনে নিও। প্রতিদিন স্কুলে যাবে।”
আসলে আমি নিজেও অভাবী। তাই ৫০ টাকার বেশি দিতে পারলাম না।
যাক, মেয়েটি একটু হেসে চলে গেল।
দেখতে দেখতে আবারও ট্রেন ছেড়ে দিল। রেলগাড়ী চলছে নিজ গতিতে..
একটা সময় ফটোগ্রাফির খুব শখ ছিল, এখন যে নেই তা নয়। কিন্তু এখন আর হয়ে উঠে না। কোনো এককালে একটা ক্যামেরা কিনেছিলাম, কয়েক বছর পর নষ্ট হলো, আর ঠিক করা হয়নি। ট্রেনে আসার পথের প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলো উপভোগ করছিলাম।
দেখতে দেখতে রাত দশটা বেজে গেল। অবশেষে আমরা খুলনায়, পথিমধ্যে আর কোনো ক্রসিং হয়নি। যে কারনে মনে হচ্ছে তাড়াতাড়িই পৌছালাম খুলনায়। এখন যেতে হবে সাতক্ষীরায়, বাসে করে।
এর মধ্যে তমাল বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছিল। আমরা কোথায়? ঠিকভাবে যাচ্ছি কি না!
খুলনা স্টেশনে নেমেই সামনে এগুলাম ভাতের হোটেল খুঁজতে।
আমি আর তামিম সস্তা দেখে একটা হোটেলে বসে গেলাম।
যাক, এতক্ষণ সব বাইরের চিন্তা ভাবনাতেই সময় কাটালাম, এখন একটু কেসটা নিয়ে ভাবতে হবে। অবশ্য এটাই আমার প্রথম কিডন্যাপিং কেস।
এর আগে দুচারটা চোর- বাটপরের কেস সল্ভ করেছিলাম। তবে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ছিল আনন্দ নগরের কেস টা। যাক সেটাতে পরে আসবো। এখন খাওয়া শেষ, একটু চা খেতে হবে।
পর্ব ৩
চা খেতে খেতে তমালের ফোন, চায়ের কাপটা তামিমের হাতে দিয়েই কানে লাগালাম ফোনটা, তমাল জানালো সে আমাদের জন্য নাকি গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছে, ব্যাক্তিগত গাড়ি, যেটা আমাকে খুবই অবাক করলো, সে কি এমন চাকুরী করে যে ব্যাক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করে।
যাক, ওসব চিন্তা করে কি হবে। আমাদের বাবা ওমন সাধ্য নেই।
গাড়ি আসতে মিনিট তিরিশেক লাগবে তো বটেই, চলুন ততক্ষণ ভিন্ন কিছু গল্প করি।
যখন তমালের সাথে কথা বলছিলাম তখন ভুলবশত আমি মোবাইলটা কানে লাগাই, আপনারা ভুলেও এই কাজটি করবেন না।
কারন ফোন নেটওয়ার্কের রেডিয়েশন পাওয়ার যে কতটা ক্ষতিকর সেটা আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না। শুধু কানে দেয়া না, ঘুমানোর সময় আপনার ঘুমানোর এরিয়ার মধ্যেও ফোন রাখা ক্ষতিকর, শার্টের বুক পকেটে ফোন রেখেছেন, এটির রেডিওয়েভ তরঙ্গ আপনার হৃৎস্পন্দনে প্রভাব ফেলতে পারে।
বেশ কিছুদিন আগে সংবাদে শুনেছিলাম মোবাইল ফোন ব্লাস্ট হয়ে ভুক্তভোগী আহত এমনকি নিহতও হয়েছেন। যদিও এটা আমাদের দেশের না, তবুও আমাদেরকে সাবধান থাকতে হবে।
আপনার যখন ৩ মিনিটের বেশি কথা বলার প্রয়োজন হবে, তখন চাইলে আপনি লাউডস্পিকার দিয়ে কিংবা কানে হেডফোন লাগিয়ে কথা বলুন।
অনেকে তথ্যগুলোকে মানবে না, অনেকে মানবে, কিন্তু কার্যকর করবে না কেউই। অনেকটা ইমান আছে নামাজ পড়ি না, এরকম।
যাক, মানা না মানা সেটা আপনার ব্যাপার!
গাড়ি আসতে আরও ১০ মিনিট বাকি, আকাশে মেঘ করেছে, হালকা হালকা ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে, আমরা একটা মুদি দোকানের সামনে আশ্রয় নিলাম।
হঠাৎ একজন ইয়ং ছেলে(হ্যাংলা পাতলা) আমাদের সামনে এসে বলছে, তার মায়ের অপারেশন হবে কিছু সাহায্য করতে।
আমি আবার একটু জিজ্ঞাসু টাইপ মানুষ, মুদিখানা থেকে একটা রুটি আর কলা নিয়ে খেতে দিলাম।
বেঞ্চে বসে, শুরু করে দিলাম, “ তোমার মায়ের কি হয়েছে?”
“টিউমার”
সে বলল, “পাকস্থলীতে”
“এমনটা হওয়ার কারণ কি ছিল?”
তামিম বলে উঠলো, “তুই কি পাগল, এসব কথা জিজ্ঞেস করছিস ওকে?”
“তুই বেশি কথা বলিস, চুপ থাক। আমাকে জিজ্ঞেস করতে দে।”
তামিম “কোন পাগলের পাল্লায় পড়লাম!”
আমি ছেলেটাকে বললাম” তোমার মা কি সিগারেট, গুল বা মদ খেত?”
তামিম, “আসলেই তুই পাগল, একজন মহিলা কি ওসব খাবে নাকি?”
“এটাই তো বুঝলি না বন্ধু, ভিক্টিমকে কোনো ধরনের সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখা উচিৎ নয়, হোক সেটা মেডিকেল সায়েন্সে কিংবা ক্রিমিনলজিতে।
ছেলেটি বিরক্তিকর মুখ নিয়ে বলল, “না।”
আমি একটু হেসে তার হাতে ৫০ টাকার চকচকে একটা নোট দিয়ে বললাম, “এটা রাখো। আর ডোনেশন লাগলে একটা ফাউন্ডেশনে যোগাযোগ করবে, নাম হলো আস্ সুন্নাহ ফাউন্ডেশন।”
এবার ছেলেটির মুখে খুশির আভা পাওয়া গেল, আমাকে ধন্যবাদ জানালো। কিন্তু এতকিছু করার পিছনে একটা কারণ ছিল আরেকটা প্রশ্ন করার।
“আচ্ছা শোন আরেকটা কথার উত্তর দিবে? তোমার মা কি পান জর্দ্দা খেত?”
ছেলেটি বলল, “ জ্বি।”
আমি বললাম, “তুমিও কি এসবের কিছু খাও, যদি চাও একটা সিগারেট কিনে দিই?”
সে বলল, “না না, আমি সিগারেট খাই না।”
“তাহলে আগে খেতে নাকি? আরে নির্ভয়ে বলো।আমিও তো খাই, তামিমও খায়, কিরে তামিম খাস না?”
তামিম,”ভাই আমাকে জড়াচ্ছিস কেন? তুই ইনভেস্টিগেশনে যে কতটা নিচে নামতে পারিস, তা ভালোভাবেই বুঝতে পারছি।”
“আরে চুপ, ঐ ছেলের কাছ থেকে কথা বেi করে নিতে হবে।”
“তা বলো বাবু, সিগারেট খাবে কি না?”
একজন সিগারেট খোরকে আপনি ফ্রি অফার দিলে, আর তার সাথে ফ্রেন্ডলি আচরন করলে, সে কখনোই অফার ফেলতে পারবে না।
আমি ছেলেটাকে সিগারেট দিলাম তারপর বললাম” শোনো, তুমি তো মনের সুখে সিগারেট খেয়ে বেড়াচ্ছ, তোমার মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে দেখো, তুমি কি চাও তোমারও এমন অবস্থা হোক? তোমার ছেলেমেয়েরাও তোমার জন্য ভিক্ষা করুক?”
ছেলেটা মাথা নিচু করে বলল,”না।”
“তাহলে, এটাই তোমার জীবনের শেষ সিগারেট। কি ছাড়বে তো?”
“জ্বি, ভাইয়া।”
“দেখো, তোমার ডিসিশন তোমার কাছে। আমার আর কি?”
ছেলেটা ইমোশনাল হয়ে গেল এবং আমাকে সব খুলে বলল, সে শুধু সিগারেট না, গাঁজাও খায় এবং আমাকে কথা দিলো, সে আর কোনোদিন খাবে না।
আসলে এই জিনিসটাও ঠিক ইমান আছে নামাজ পড়ি না টাইপ।
সবাই জানি ক্ষতিকর, কিন্তু ছাড়তে চাই না।
আপনারা হয়তো এরই মধ্যে বুঝে গেছেন পাকস্থলীর টিউমার কেন হয়েছিল। অবশ্য ডাক্তাররা ভালো বলতে পারবে বিষয়টা।
যাক, অবশেষে ড্রাইভার ফোন দিল, গাড়িটা আমাদের এখানে নিয়ে আসতে বললাম, বৃষ্টি এখনো থামেনি। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে এলো, গাড়িতে বসলাম,”বাহ্ এসিও আছে দেখছি।”
ড্রাইভারের সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে যাচ্ছিলাম, সাতক্ষীরার পথে…….
পর্ব ৪
ড্রাইভারের সাথে কথা বলতে বলতে জানতে পারলাম তমাল সরকারী কর্ম কমিশনের একজন কাস্টমস ক্যাডার। কিন্তু আমি এটা ভেবে পাচ্ছি না, পুলিশকে না জানিয়ে সে আমাকে কেন ডাকলো?
অবশ্য খেলার ছলে আমরা অনেক সময় এসব বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছিলাম, কি জানি ঐসব দিনের কথা ভেবেই হয়তো আমাকে ডেকেছে।
দেখতে দেখতে সাতক্ষীরায় চলে আসলাম। যাক, ১২ ঘন্টার একটা জার্নি শেষে আমারা সাতক্ষীরায় তমালের বাসভবনে চলে আসলাম।
তমাল ঘরেই ছিল|
সালাম দিলাম| অনেকদিন পর দেখা| তমালকে অনেক বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল।
বললাম, “কবে ঘটেছিল ঘটনাটা?”
“সাতদিন আগে।”
“পুলিশকে জানাসনি?”
“জানিয়েছি, ইনভেস্টিগেশন চলছে, ওরা কিছুই করতে পারছে না।”
“তুই আমাকে পুরো ঘটনাটা খুলে বল।”
তমাল বলতে লাগলো, ”সাধারনত আমি আমার মেয়েকে নিজেই স্কুলে নামিয়ে দিয়ে আসি, স্কুল ছুটি হলে আমার ড্রাইভার ওকে পিক করে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যায়। সেদিনI আমি নামিয়ে দিয়ে এসেছিলাম, কিন্তু একটা মিটিং থাকার কারনে আমি ড্রাইভারকে নিয়ে চলে যাই জেলা পরিষদে এবং আমার স্ত্রীকে বলি মেয়েকে নিয়ে আসতে। ও গিয়ে মেয়েকে খুঁজে পায়নি। তারপর আমাকে ফোন দিয়েছিল। কিন্তু আমি মিটিং এ থাকার কারনে ফোন ধরিনি। ২ ঘন্টা পর যখন ফোন ব্যাক করলাম, তখন ওপাশ থেকে কান্না জরিত কন্ঠে ভেসে উঠলো আমার মেয়ে স্কুলে নেই। আমি দ্রুত নেমে গাড়ি নিয়ে স্কুলে যাই। প্রধান শিক্ষকের রুমে গিয়ে, সি সি টিভি ফুটেজ দেখার জন্য অনুরোধ করলাম। কিন্তু সিসিটিভি ফুটেজের এরিয়ার মধ্যে যতক্ষণ ছিল ততক্ষণ দেখতে পেলাম। কিন্তু একসময় ও হেঁটেই এরিয়ার বাইরে চলে গেল। কোথায় গেল কিছুই জানলাম না আমরা। এরপর পুলিশকে জানাই। ওরা ঐ দিনই ইনভেস্টিগেশন শুরু করে দেয়।”
আমি একটু ভেবে বললাম, “আচ্ছা, কোনো ফোন কল আসেনি?”
“নাহ।”
“তোর কোনো ব্যক্তিগত শত্রু আছে?”
“না, নেই।”
“তাহলে কি হতে পারে বিষয়টা? আচ্ছা চল।”
তমাল, “কোথায়?”
“তোর মেয়ের স্কুলে।”
“হুম, যাবো, তার আগে তোরা একটু খেয়ে নে।”
“আচ্ছা, তুই কি অফিস করছিস?”
“হ্যা, আজ ছুটি নিয়ে চলে এসেছি।”
“আচ্ছা, তুই রেস্ট নে, একটু পর কথা হচ্ছে।”
একগ্লাস পানি মুখে দিয়ে, ভাবতে লাগলাম, একটা আট বছরের মেয়েকে কেন কেউ কিডন্যাপ করবে? যদি না কোনো পার্সোনাল শত্রু না থাকে?
আবার টাকার জন্য কোনো ফোন কলও আসেনি। বিষয়টা মোটেও সিম্পল মনে হচ্ছে না। তমাল নিশ্চয়ই, আত্মীয় স্বজনকে জানিয়েছে।
কি হতে পারে বিষয়টা। ভাবতে হবে, অনেক ভাবতে হবে…
পর্ব ৫
একটি বাচ্চাকে কনভিন্স করতে হলে আপনাকে একজন বাচ্চার মতই আচরণ করতে হবে, যেমনটা আমরা করে থাকি সদ্য ভূমিষ্ট কিংবা খুব ছোট্ট বাচ্চাদের সাথে। তাদেরকে হাসিখুশি রাখতে গিয়ে আমরা নিজেরাও যেন বাচ্চা হয়ে যাই। কিডন্যাপিং এর ক্ষেত্রেও অবশ্যই ব্যাপারটা লক্ষনীয়।
কিন্তু স্কুলের সিসিটিভি ফুটেজে আমি এমন কোনো বিষয়ই খুঁজে পেলাম না। তনিমাকে ( তমালের মেয়ে) কেউ ডাকলো বলেও মনে হলো না।
তবে তমাল আমাকে একটা তথ্য জানিয়েছিল, তনিমা খুব চঞ্চল। অপরিচিত কাউকে অ্যাভয়েড করার বিষয়ে সে ওয়েল ট্রেইনড।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক আমাদেরকে এমন কিছু তথ্য দিলেন যা আমাদের কেইসটার সূচনা হিসেবে আবির্ভাব হলো।
তিনি জানালেন চার বছর আগে একজন ব্যবসায়ীর মেয়েকে শত্রুতার জেরে স্কুলের সামনে থেকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল, পরে অবশ্য পুলিশ তাদেরকে ধরতে সক্ষম হয়, প্রফেশনাল কিডন্যাপার দিয়ে কাজ করানো হয়েছিল।
পরে নাকি ব্যবসায়ী এবং তার শত্রুপক্ষ উভয়কেই জেলে যেতে হয়েছিল কর ফাঁকির দায়ে।
আমাদের এখন প্রধান কাজ পুলিশ ষ্টেশনে যাওয়া, পুরনো ফাইল ঘেটে দেখতে হবে যে করেই হোক। কিন্তু, পুলিশ আমাকে দেখাবে কেন?
আমিতো রেজিস্টারড কেউ নই। আমরা তমালের সাহায্য নিতে পারতাম, কিন্তু সে আগেই পুলিশকে কেইসটা ইনভেস্টিগেশনে দিয়ে দিয়েছে। পুলিশ চাইবে না, তাদের কাজ কোনো এক আগন্তুক করুক।
শেষ পর্যন্ত একটি উপায় পেলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেটা সায়েনস নিয়ে গবেষণা করার সময় অপরাধীদের তথ্য কালেক্ট করতে গিয়ে সেইসময় আমাদেরকে ঢাকার কয়েকটা পুলিশ স্টেশন থেকে তথ্য কালেক্ট করার একটা সুপারিশপত্র দেয়া হয়েছিল। সেটার একটা লিখিত সার্টিফিকেট আমার কাছে আছে। দেখি সেটা দিয়ে কাজ চালানো যায় কি না!
তমালকে না জানিয়ে আমরা পুলিশ ষ্টেশনে গেলাম। সেখানকার ওসির সাথে দেখা করে জানালাম, “আমরা বাংলাদেশ স্ট্যাটিসটিকস ব্যুরো থেকে এসেছি, আপনার পুলিশ স্টেশনের কিছু পুরোনো অপরাধীর তথ্য কালেক্ট করার জন্য।‘’ তিনি আমার সম্বন্ধে জানলেন এবং অনেক খুশি হলেন বললেন, “তিনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন ছাত্র।”
আমরা ফাইল খোঁজার মূল কারন গোপন রেখে ওনার সহযোগিতায় চার বছর পুরোনো ফাইলগুলো দেখা শুরু করলাম। এক্ষেত্রে অনেক পুলিশ ভাই আমাদের সহযোগিতা করেছিলেন।
স্কুলের প্রধান শিক্ষকের ভাষ্যমতে, কিডন্যাপার জেল থেকে ছাড়া পেয়ে এলাকা ছেড়েছিল। কিন্তু সমস্যা হলো তৎকালীন সময়ের সাতটা কিডন্যাপিং কেইস আমরা খুঁজে পাই, যার মধ্যে পাঁচটিরই ভিক্টিম ছিল শিশু।
আমরা ঐ কেইসটার বিষয়ে অসম্পূর্ণ তথ্য পেয়েছি। কাজেই এটা নিয়ে আর বেশি দূর এগোনো যাবে না।
আমি তামিমকে কেইসের ফাইল গুলোর ছবি তুলে নিতে বললাম। কিন্তু একজন কনস্টেবল এসে বলে গেল, ফাইলের ছবি নেয়া নিষিদ্ধ।
কি আর করার, সেদিনের মতো ফাঁকা হাতে ফিরে আসতে হলো……
পর্ব ৬
পুলিশ ষ্টেশন থেকে সোজা তমালের বাড়ি। এবার আসার পর খুব ভালোভাবে বাড়িটা লক্ষ করলাম, দোতালা একটা বাড়ি। সামনে বড় গেইট, খুব দৃঢ় প্রাচীর, হাই প্রোটেকশন। চোর ডাকাতদের প্রোফেশন যে এখানে খাটবে না, সেটা হলফ করেই বলতে পারি। নিচে ডাইনিং এর পাশে একটা পরিত্যক্ত টিভি, বোধহয় কেউ ব্যবহার করে না বহুদিন।
বাড়িতে ছয়জন কর্মী কাজ করেন। ২জন রান্নাবান্না – ঘর বাড়ির দায়িত্বে। একজন মালি ( ও হ্যাঁ ছোটখাটো ফুলের বাগানও রয়েছে), ২ জন গেটম্যান, একজন ড্রাইভার।
বাসাতে প্রবেশের প্রাক্কালে কিছুটা চিৎকার – চেঁচামেচি শুনতে পেলাম।
বাসায় না ঢুকে টঙের দোকানে চলে আসলাম। হালকা নাস্তা আর চা খেতে খেতে তামিমকে বললাম-
“আচ্ছা তুই কি লক্ষ্য করেছিস, তমাল একজন চেইন স্মোকার।”
“কিভাবে?”
“তখন স্কুলের হেড স্যারের সাথে কথা বলার সময় হাতে কলমটা ধরার ধরনটা দেখেছিস। আর ঠোঁটের অবস্থা দেখলে সাধারনভাবেই বুঝা যায় যে সে স্মোকার।”
“কিন্তু এটার সাথে আমাদের কি সম্পর্ক কি?”
“সম্পর্ক আমাদের নেই, কিন্তু ঝগড়ার রয়েছে। চেইন স্মোকাররা উগ্র টাইপের হয়, আর চিন্তিত থাকলে স্মোক করাটাই তাদের কাছে মেডিসিনের মতো মনে হয়।”
“কিন্তু এসব তথ্য জেনে কেইসের লাভ কি ভায়া!”
“এটুকু বুঝলে আমি তোর এ্যাসিস্ট্যান্ট হতাম, তুই না।”
“ওকে ভাইজান, কাইন্ডলি একটু ঝেড়ে কাশবেন, প্লিজ!”
“তমালের এই উগ্রতার প্রভাব নিশ্চয়ই তনিমার উপর ছিল!”
“তার মানে তুই বলছিস, তনিমা নিজেই নিজেকে গায়েব করেছে?”
“কোনকিছুই অসম্ভব নয়।”
“তাই বলে ওইটুকু বাচ্চা?”
“হ্য, সেটা ঠিক বলেছিস, কিন্তু প্রেডিকশন আমাদেরকে করতে হবে। কেউ সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়।”
“হুম, বুঝলাম।”
দোকানদারকে বললাম, “ভাই, একটা খেলনা হবে ছোট বাচ্চাদের জন্য?”
দোকানদার একটা ছোট বেলুন, পেঁ পোঁ বাঁশি ছাড়া কিছুই দিতে পারলো না।
তামিম, “মেয়ের জন্য নিলি? এত তাড়াতাড়ি না নিলেও পারতিস, বাইরে ভালো জিনিস পেতিস।”
“বাহ্! তুইও প্রেডিকশন করা শুরু করছিস? কিন্তু এটা এখনই লাগবে আমার।”
“কি করবি? নিজে খেলবি নাকি?”
“হা হা হা, চল।”
বাসায় ঢোকার সময় দেখলাম ড্রাইভার আর দারোয়ানের মধ্যে কোলাবোরেশান চলছে। অবাক হলাম না। কোথায় জানি শুনেছিলাম, বাড়ির লোকজনদের খবরাখবর জানতে চাইলে বাড়ির ড্রাইভার, কাজের লোকদের জিজ্ঞেস করুন, কারন, তাদের থেকে ভালো ভিতরের খবর কেউ দিতে পারবে না। আমরাও সেই স্ট্র্যাটেজি ফলো করতে যাচ্ছি।
বাড়ির ভিতরে যে বুয়া আছে, তার ছোট একটা ছেলে আছে। সারাদিন মায়ের আঁচলের নিচেই থাকে।
বাবুটাকে ডাকলাম, আর খেলনা গুলো দেখালাম। সে আসলো না। কিন্তু ওর মা যখন সম্মতি দিল তখন সে দৌড়ে আসলো। খেলনা গুলা পেয়ে খুব খুশি হলো।
“আচ্ছা, আপনার নামটা কি বলুনতো?”
“জ্বি, রহিমা।”
“আপনি কতদিন থেকে এখানে কাজ করছেন?”
“প্রায় বছর পাঁচেক।”
“তমালতো এখানে দুই বছর আগে আসে। তার মানে আপনি শুরু থেকেই তমালদের সাথে আছেন, তাইতো?”
“জ্বি”
“আচ্ছা, আজকে আসার সময় চেঁচামেচি শুনলাম, ওদের স্বামী – স্ত্রীর কি কোনো সমস্যা?”
“ঝগড়া তো ওদের প্রতিদিনই লাগে।”
“ও আচ্ছা।”
আরও কিছুক্ষণ কথা হলো রহিমার সাথে। যেটা বুঝলাম, এদের স্বামী স্ত্রীর ঝগড়া নতুন কিছু নয়। দুজনেই চাকুরীজীবি হওয়ার এটাই এক সমস্যা।
আরও অনেক চিন্তাভাবনা মাথায় নিয়ে, তমালের রুমে প্রবেশ করলাম।
বিষন্ন হতাশ চোখে তাকিয়ে সে বলল, “কিছু পেলি?”….
পর্ব ৭
আপনাকে কোনো একটা রহস্যের সমাধান করতে হলে এই কেস রিলেটেড পূর্বের কোনো কেসকে সামঞ্জস্যতায় আনতে হবে। ঠিক এই লক্ষ্যে পরদিন তনিমার স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে তদানীন্তন কিডন্যাপারের মোটামোটি ফুল প্যাকেজের একটা প্রোফাইল নিয়ে পুলিশ ষ্টেশনে যাই এবং তার সেই পুরোনো কেস ফাইল খুঁজে পেলাম। অবাক করার বিষয় হচ্ছে নাজিমুদ্দিন (এলাকার যে কিডন্যাপারের কথা বলা হয়েছিল) রিলেটেড আরও ছ’খানেক ফাইল খুঁজে পেলাম। মেইনলি নাজিমুদ্দিন প্রথমের দিকে একটা গ্যাঙের মামুলি সদস্য ছিল, পরে গ্যাঙ লিডারের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে গ্যাঙ থেকে বেরিয়ে এসে নিজেই গ্যাঙ তৈরি করেন। তারা মূলত ছিনতাই, চাঁদাবাজি করতো। তবে মোটা অঙ্কের অর্থের লোভে সেবার কিডন্যাপিং এ জড়িয়ে ছিল। যে কারনে মাস ছ’এক জেল খাটেন এবং একবছর পর পুরোনো লিডারের প্রভাব সইতে না পেরে এলাকাচ্যূত হন।
পুরো কেস ফাইলটা ঘাটার পর আমাদের যেটা লাভের লাভ হলো তা হলো কয়েকটি নাম মুখস্থ করা। এরা মেইনলি নাজিমুদ্দিনের সহযোগী।
ওসি সাহেবের সাথে বসে কনভারসেশন শুরু করলাম।
-আচ্ছা ওসি সাহেব নাজিমুদ্দিনের যে সহযোগিরা, তারাও কি ওর সাথে এলাকা ছাড়া হয়েছিল।
– আসলে ওর গ্যাঙে কিছু মীর জাফর ছিল, যারা নতুন গ্যাঙ লিডারের তথ্য পুরনো গ্যাঙের লিডারকে সাপ্লাই দিতো। তবে কিছু লয়্যাল ছিল, তারাই নাজিমুদ্দিনের সাথে চলে গিয়েছিল। আর বাকিরা পাশার (নাজিমুদ্দিন যে গ্যাঙে প্রথম ছিল তার লিডার) সাথেই আছে।
– তার মানে পাশার প্রভাব এখনো এই এলাকায় রয়েছে।
– জ্বি, তবে এখন আর চুরি ডাকাতি হয় না। চাঁদাবাজি হয়, তবে গোপনে। সাধারন পাবলিক ভয়ে এতটাই তটস্থ থাকে যে আমাদেরকে জানানোর পর্যন্ত সাহস পায় না।
– ওসি সাহেব আমি একটু বাইরে থেকে আসছি।
বলে একটু তাড়াহুড়ো করেই বাইরে আসছি। ওদিকে তামিম দৌড়ে আসছে আর বলছে
– এই কই যাস, দাঁড়া………
পর্ব ৮
দেখুন কিডন্যাপিং কে আমরা মোটামুটি কয়েকটা ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।
যেমন : পারিবারিক, শত্রুতাবশত, কোনো কারন ছাড়াই টাকার জন্য, আরেকটা রয়্যাল ভার্সন আছে সেটা হলো শিক্ষা দেয়ার জন্য।
কিন্তু আমাদের কেস কোনো ভার্সনেই এখন পর্যন্ত পড়লো না। হয়তো নতুন কোনো ক্যাটাগরি আবিষ্কার করতে যাচ্ছি।
যাক মজা করলাম।
আসলে তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে আসার কারন একটা ফোন কল। যেটা দিয়েছে আমার মেয়ে। স্বাভাবিকভাবেই বাবাকে কাছে না পেয়ে মন খারাপ। কিছু কনভার্সন শুনবেন —চলুন।
মেয়ে —তুমি কবে আসবা?
— এইতো দুদিনের মধ্যে মা।
–না, এখনই চলে আসো।
–আচ্ছা, যাচ্ছি।
–কই?
— আকাশের দিকে তাকাও। ওই যে আমি উড়ে উড়ে আসছি মেঘের ভেলায় চড়ে।
এটুকু শুনেই হাসিতে ফেটে পড়লো।
আমি— তোমার জন্য কি নিয়ে আসবো?
–মিষ্টি, দই, আইসক্রিম, চকলেট উমহ সব।
— আচ্ছা ঠিক আছে।
— কিন্তু তুমি কালকেই আসবা।
— আচ্ছা মা, যাবো।
–প্রমিস?
— ওকে, প্রমিস।
ওদিকে তামিম ভেবেছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে আসলাম।
— কিরে, এরকম ভাবে দৌড়ে এলি যে।
–কোনো ক্লু পেলি নাকি।
— আরেহ না, মেয়ের সাথে কথা বলালাম।
—ধুর, আমি ভাবলাম কি না কি!
–আমার কাছে এটা সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট কল।
— স্যরি।
— এজন্যই বলি বিয়েটা করে ফেল।
আমরা আবারও ওসি সাহেবের দ্বারস্থ হলাম।
— আচ্ছা ওসি সাহেব, পাশার ঠিকানা টা পেতে পারি।
— আসলে ওরা সন্ত্রাসী লোক, কখন কোথায় থাকে তার কোনো ঠিক নেই।
— তবুও চাইলে আপনি ফাইলের ঠিকানাগুলো ঘুরে আসতে পারেন।
আমরা র ভাবে কয়েকটি ঠিকানা পেলাম আর এই জায়গাগুলোতে যাওয়ার জন্য একজনের প্রয়োজন যারা এই জায়গাগুলো চেনে।
তামিমের ভাষ্য অনুযায়ী তমালের ড্রাইভারকে আমরা সাথে নিতে পারি।
তমালকে ফোন দিলাম, খুবই বিষন্ন কন্ঠে আমাদের সাথে একমত হলো এবং ড্রাইভারকে আমাদের এখানে পাঠিয়ে দিতে চাইলো।
এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটে গেল। যে পুলিশগুলো এই কেসটা হ্যান্ডেল করছে তারা পুলিশ স্টেশনে এলো এবং ওসি সাহেব আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো।
এতে আমাদের লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হলো বলে আমি মনে করি।
কিন্তু চাইলেই আমরা এটাকে পজিটিভ ওয়েতে কাজে লাগাতে পারি।
আমরা ওসি সাহবের থেকে বিদায় নিলাম।
বাইরে এসে ড্রাইভারের অপেক্ষায় রইলাম……..
পর্ব ৯
বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণের জেলা সাতক্ষীরা, আদি নাম ছিল সাতঘরিয়া, সেখান থেকে সাতক্ষীরা। শুনেছিলাম সাতক্ষীরা চিংড়ির জন্য বিখ্যাত, যদিও এখন পর্যন্ত খাওয়া হয়নি। এই শহরের একটা বিষয় খুব ভালো লেগেছে, শহরে ১০/২০ তলার ইমারত খুব কমই রয়েছে। ছোট ছোট দালানকোঠা, অনেকটা প্রাচীন কলকাতার মতো। কিন্তু, সুন্দরবনের জেলা হিসেবে পরিচিত হলেও শহরের পরিবেশ বেশ নোংরা। পুরো শহর দেখতে দেখতে ড্রাইভার একটা কলনির সামনে দাঁড় করালো। এটাই সেই বিখ্যাত পাশা সাহেবের এলাকা।
সামনেই একটা টঙের দোকানে চা খেতে গেলাম। টঙের দোকানে একজন ভালোই বক্তৃতা দিচ্ছেন। দেখে শিক্ষিতই মনে হলো। চায়ের অর্ডার দিয়ে মন দিয়েই ওনার বক্তব্য শুনতে লাগলাম। বেশ জ্ঞানের কথাই বলছেন। ভাবলাম এনাকে কাজে লাগানো যায়। বক্তৃতা শেষে সালাম জানালাম….তারপর পরিচয় জানতে চাইলো…..
আমি- জ্বি, আমি রংপুর থেকে, ইনি তামিম সাহেব আর উনি আমাদের ড্রাইভার। আমরা মূলত ঘুরতে এসেছি।
উনি-আমি রাজন, এখানকার স্থানীয় স্কুলের একজন শিক্ষক।
— আসলে আমিও একজন শিক্ষক, আমার নিজস্ব একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
–ওহ গ্রেট! কিন্তু আপনাদের দেখে মনে হচ্ছে না যে আপনারা ঘুরতে এসেছেন।
–কিন্তু, এমনটা মনে হওয়ার কারন, রাজন সাহেব?
–দেখুন, প্রথমত এই শহরে কেউ ঘুরতে আসে না, ঘুরতে গেলে সুন্দরবনই যায়, দ্বিতীয়ত ঘুরতে আসার ড্রেসআপ এমন অদ্ভুত হতেই পারে না। তৃতীয়ত আপনাদের দেখে মনে হচ্ছে কোনো একটা কাজে এসেছেন।
আপনার বন্ধুর আর আপনার আচরণ দেখেই বুঝে গেছি। আপনারা তো মশাই দোকানে আসার পর থেকে শুধু আমাকেই ফলো করছেন, অন্য কাউকে না। তো বলুন কি জানতে চান?
–বাহ্! বেশ স্মার্ট আপনি। আসলে একটা কেস সল্ভ করতে এসেছি আমরা।
— ওহ! তাহলে আপনারা ডিটেকটিভ?
–আপনার কেন এমনটা মনে হলো? আমরা তো পুলিশও হতে পারি।
–পুলিশরা বেপরোয়া হয়।
— বাহ্! ভালোই গোয়েন্দা বই পড়েন তাহলে।
— ধরে ফেলেছেন দেখছি, দেখি চলুন, আপনাকে কিছু হেল্প করা যায় কি না!
–আসলে আমরা এসেছি তমাল সাহেবের মেয়ের কিডন্যাপিং কেসের ব্যাপারে। তমাল সাহেব, ইউ নো?
–ওহ্ হ্যা। কাস্টমস অফিসার, বেশ জনপ্রিয় আমাদের শহরে। মেয়েটাকে এখনো পায়নি তাহলে।
— না, আসলে আমরাও ২ দিন ধরে কেসটার পিছনে ঘুরছি।
— তো, এই এলাকায় যে?
–পাশা সাহেবকে চেনেন নিশ্চয়ই?
–হ্যাঁ, দাগি আসামি। এলাকায় খুব কমই থাকে। তবে এই কেসে কি সে সম্পৃক্ত নাকি?
— সেটাতো তার সাথে কথা বললেই বুঝতে পারবো।
— কিন্তু উনি তো গন্য মান্য জঘন্য ব্যক্তি, ওনার বদনের দর্শন পাওয়া বড়ই দুষ্কর।
–ওনার বাসায় যেতে চাই, একটু হেল্প করবেন?
–স্যরি, এখনি আমার একটা কাজ আছে, একটু যেতে হবে।
–ওকে, আপনার কনট্যাক্ট নম্বর টা পেতে পারি?
–অবশ্যই, নিন।
ওনাকে বিদায় জানিয়ে তামিমকে বললাম-
–একটা বিষয় লক্ষ্য করেছিস? যখন থেকে পাশার কথা বলা শুরু করি তখন থেকেই উনি কেমন আনইজি ফিল করছিলেন।
— হুম, বেশ দাপট আছে এলাকায়।
–সেটাতো আর কয়েকজনের সাথে কথা বললেই বোঝা যাবে।
সত্যি সত্যিই আমরা টঙের দোকানদারসহ আশপাশের বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম, এলাকার মানুষ পাশা সাহেবের দাপটে তটস্থ।
অনেক কষ্টে তার বাড়িতে যাওয়ার দিকনির্দেশনা পেলাম, কিন্তু সেখানে যাওয়াটাই বড় দুঃস্বাহস।
যেটা তামিম বার বার বলছিল। ড্রাইভার তো পুলিশ ছাড়া রিস্ক নিতেই চাচ্ছিল না। ড্রাইভার চলে আসতে চাইছিল, আমিও বিষয়টা নিয়ে একটু ভাবতে বসলাম…….
পর্ব ১০
অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ পেরিয়ে পাশা সাহেবের বাসা খুঁজে পেলাম। নাম শুনে ছোট- খাটো চোর ছ্যাচর মনে হলেও বাড়ি দেখলে কোনো নেতা মানুষের চেয়ে কম মনে হবে না। বেশ পেল্লায় দর্জা সামনে একজন সিকিউরিটি গার্ড, কে বলবে এই বাড়ির মালিক একদিন চাঁদাবাজ ছিল।
ভিতরে প্রবেশের সময় গার্ডকে বললাম আমি এই পাশা সাহেবের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী, তৎক্ষনাৎ উনি ভিতরে গেলেন, কিছুক্ষন পর
— কি চাই পাশা সাহেবের কাছে?
–বলবেন ওনার মুখদর্শন করতে এসেছি, শুনেছি এলাকায় খুব সুনাম। ভিতরে ঢুকতে দিলে, আমি আপনার বেতন বাড়ানোর জন্য সুপারিশ করবো। পাশা আমার ছোটবেলার বন্ধু।
–সত্যি স্যার! তাহলে স্যার আপনারা ভিতরে যান, আর স্যার আমার ব্যাপারটা একটু দেখবেন।
— আরে, হ্যা অবশ্যই, হাত ধরতে হবে না, তুমি এখানেই থাকো।
বাহ্! ভিতরে তো একদম চমৎকার ব্যাপার স্যাপার, অসাধারন পরিবেশ, উনি একজন সন্ত্রাসী না হলেও পারতেন।
— কি চাই? (একজন কাজের লোক বলল)
–একটু, পাশাকে ডেকে দিতে পারবেন? বলবেন ওর ছোটবেলার বন্ধু এসেছে।
— আইচ্ছা স্যার।
বলে ভিতরে গেল এবং কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদেরকে ভিতরে নিয়ে গেল।
তামিম মোটামুটি ভয় পেয়েছে, আমাকে বলল,
–আচ্ছা তুই যে এরকম ভাবে মিথ্যা বলছিস, ভয় করছে না?
— ধূর ব্যাটা, ভয় করলে হবে?
আমরা ভিতরে একদম পাশা সাহবের সাথে সাক্ষাৎকারে গেলাম।
ভিতরে ঢুকে ওনাকে কিছু বলে ওঠার আগেই, পাশা সাহেব বলে উঠলেন
— ভালোই দাও মেরেছেন মশাই, ডিরেক্ট আমার ছোটবেলার বন্ধু!
–তা না বললে কি আপনার মুখদর্শন পেতাম?
–হুম বুঝলাম, বেশ চালু আছেন। তা বলুন কি সাহায্য করতে পারি?
–নতুন শহর, আপনাকেই তো এই শহরে দরকার।
— দেখুন, আপনারা কি জন্য এসছেন সেটা আমি জানি। এলাকায় আমার চ্যালা চামুণ্ডার তো আর অভাব নেই।
— আরেহ্ উত্তেজিত হচ্ছেন যে?
— মোটেও না, তো বলুন আপনাদের কোন উপকারে আসতে পারি?
–ভূমিকায় আসবো নাকি সোজা আলোচনায়?
— দেখুন, আজ আটটি বছর হয়ে গেল আমি অন্যায় কাজ ছেড়ে দিয়েছি। গতবছর হজ্বও পালন করে এসেছি। আপনি আশেপাশে খোঁজ নিয়ে দেখেন, আমি মিথ্যে বলছি নাকি!
— হুম বুঝলাম, আসলে আমরা পুলিশের কেউ নই, নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। এনাকে চিনেন?
আমি নাজিমুদ্দিনের একটা ফটো পাশাকে দেখালাম
— হুম, ও একটা মীর জাফর।
— ইনি একটা মেয়েকে কিডন্যাপ করেছে। কোথায় পাবো একে?
— আমি কি জানি? ওকে আমি দু’চোখে দেখতে পারি না।
— আপনি হয়তো জানেন, একটা লোক তার বন্ধুর চেয়ে শত্রুর খবর বেশি রাখেন।
— কিন্তু, আমি রাখি না।
— আপনিও রাখেন, নাহলে কয়েকদিন আগে আপনার লোকজন নাজিমুদ্দিনের লোকজনের সাথে ঝগড়ায় জড়ালো কেন?
— দেখুন, আমার কোনো লোকজন নেই, পরিবারের সদস্য আর কাজের লোকেরাই আমার সব।
— তা বললে কি হবে ভাই। বাদ দেন, দেখুন, আমি আপনার শত্রুর খবর চেয়েছি, বন্ধুর না। নাকি এখনো একসাথেই আছেন? সমাজকে ফাঁকি দিয়ে?
— দেখুন, আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন। আমি জানি ও কোথায় আছে। কিন্তু মোটেও ভাববেন না, সে আমার বন্ধু।
— এটা আমি আগে থেকেই জানতাম, তো ঠিকানাটা বলে দিবেন, প্লিজ?
–হুম, বক্সীবাজারের একটা গ্যারেজে ওরা আন্ডারগ্রাউন্ড হয়ে থাকে।
–আপনার গুপ্তচরের নম্বর টা পাওয়া যাবে?
— না। কেন বলুনতো?
— না মানে, এক প্লেট বিরিয়ানি খাওয়াতাম। এতবড় উপকার করলো। (তামিমতো হেসেই ফেলল)
–রসিকতাও করেন বেশ।
–তো আজকে ওঠা যাক।
— সে কি! খেয়ে যাবেন না?
–আসলে, আপনাদের মাস্টারমশাই এমন খাওয়ালো পেট ভরে গেছে।
–বেশ, আরেকদিনের দাওয়াত রইলো।
–আচ্ছা, একটা কথা…
–জ্বি, বলুন।
–এই কিডন্যপিং এ আপনার কোনো হাত নেই তো।
— দেখুন, আমি আগেও আপনাকে সব বলে দিয়েছি।
— সেটাতো আপনার শত্রুর কাছে গেলেই বুঝতে পারবো, কারণ শত্রুই বন্ধুর চেয়ে শত্রুকে বেশি চিনে।
এই বলে আমরা বেরিয়ে আসলাম।
বাইরে দারোয়ান সালাম দিলো।
–স্যার আমার বিষয়টা কি বলছেন?
–তোমার নামটা জানি কি?
— জ্বি, আক্কাস আলী।
— দেখো, আক্কাস, মানুষ সময়ের সাথে বদলে যায়। পাশা আমাকেই চিনলোই না, তোমাকে কি চিনবে?
— কি বলেন স্যার? (দুঃখ ভারাক্রান্ত আক্কাস)
–তুমি, এক কাজ করো, এই চাকুরীটা ছেড়ে দাও।
— বাঁচবোনা স্যার, ঘরে দুইটা ছোট বাচ্চা, আপনি এভাবে বলবেন না স্যার।
–শুনো, তুমি নিজে একটা ব্যাবসা শুরু করো, অথবা অন্য কোথাও কাজ নাও। স্যরি, তোমার জন্য কিছু করতে পারলাম না।
— স্যার (আর কিছু বললো না)
— এই চাকুরীটা ছেড়ে দাও। তোমার ভালোর জন্যই বলছি।
এই বলে চলে আসলাম। তামিম খানিকটা রেগে।
–তুই লোকটাকে সত্যিটা বললেও পারতিস? আর চাকুরী করছে করুক বাদ দিতে বলিস কেন?
–তুই কি ভেবেছিস পাশা সুবিধার লোক? আর এমনিতেও ওর চাঁদাবাজির টাকায় বেতন নেয়া হারাম হবে।
–তুই কিভাবে বুঝলি ও এখনো চাঁদাবাজি করে?
–এলাকার মানুষের বিহ্যাভ কি ভুলে গেলি?
— কিন্তু, এতেই কি প্রমাণ হয়?
–তুই কি পাশার হয়ে ওকালতি করছিস।
–মোটেও না, কিন্তু তুই কোন যুক্তিতে বলছিস এসব।
— ব্যাস্, দেখতে রাহো মিস্টার তামিম।
তোহ্, মিস্টার তামিম, যাওয়া যাক।
-মিশন বক্সীবাজার, তাইতো?
-তোর ডিটেকটিভ হওয়া আটকায় কে।
চলুন বক্সীবাজার থেকে ঘুরে আসি…..
পর্ব ১১
দেখুন, এপর্যন্ত যা যা হয়েছে কোথাও আমরা এই কেসের কোনো হদিস খুঁজে পাইনি। শেষ ভরসা নাজিমুদ্দিন অথবা বক্সীবাজার। এর মধ্যে তমালের ফোন, আমরা কোথায়, কি করছি না করছি তার খোঁজখবর। এদিকে বক্সীবাজার গিয়ে খবর পাওয়া গেল, নাজিমুদ্দিন মাদক চোরাচালান মামলায় ঢাকায় জেলে আছে। বিষয়টা ওখানেই থেমে থাকলে পারতো, কিন্তু নাজিমুদ্দিন ধরা পরে আরও দুই সপ্তাহ আগে অর্থাৎ কিডন্যাপিং এরও আগে।
শেষ ভরসাটাও নিভে গেল। মনে হয় কেসটা ফসকে যায় হাত থেকে।
–তামিম, কোনো কিছুই তো আর বাকি রইল না। বাচ্চাটাকে কি আমরা পাবো না?
–না বস্, এই কেস আমরা অবশ্যই সল্ভ করবো। আমাদের একটা কাজ করা দরকার।
— কি?
— তমাল আর তার পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের সাথে কথা বলা।
— হুম, তাদের সাথে আমাদের ভালো মতো কথা বলা হয়ে ওঠেনি।
হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। ওপাশ থেকে…
–বাবা, কি কর?
— এই তো মা, কাজ করছি।
— কালকে আসবে তো?
— হ্যা মা, যাবো।
–প্রমিস?
–প্রমিস।
— আমার জন্য খেলনা নিয়ে আসবে?
— চকলেট, আইসক্রিম সব।
— আচ্ছা মা।
— ওক্কে বাবা।
— বাই বাই মা।
এরপর বক্সীবাজার থেকে সরাসরি তমালের বাসায় চলে আসলাম। বাসায় তমাল ছিল না।
ফোন দিলাম।
— কই তুই?
–অফিসে।
— ইমিডিয়েট আসতে পারবি?
— আমি অফিসটা শেষ করে আসি?
— মানে বুঝলাম না, তোর মেয়ে নিখোঁজ হয়েছে আজ প্রায় দশ দিন হয়ে গেল। কোনো চিন্তা নেই মনের মধ্যে, এত কেয়ারলেস? আমি হলে তো সাতদিন না খেয়ে থাকতাম।
–আমি আসছি।
এদিকে শুনলাম তার স্ত্রীও নাকি কর্মস্থলে। মানে একটা পরিবার কতটা কান্ডজ্ঞানহীন হলে এরকমটা হয়।
যাহোক ঘন্টাখানেকের মধ্যে দুজনেই চলে আসলো।
— দেখ তমাল, আমরা অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও কোনো ক্লু খুঁজে পেলাম না। শেষ ভরসা, তোর পরিবারের কোনো সদস্যের উপর কোনো সন্দেহ আছে? ধর, যেকোনো ধরনের কাজের লোক, আয়া থেকে শুরু করে দারোয়ান?
— নাহ্। আমার শুধু ক্ষোভ একজনের ওপরেই, সেটা হচ্ছে ও।
তমালের স্ত্রী — আমি কি করেছি, তুমিই তো সেদিন ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং এ সময় দিয়েছিলে। আমার মেয়ের জীবনের থেকেও তোমার মিটিং বেশি ইম্পর্ট্যান্ট।
তমাল — হ্যাঁ, সব দোষ তো এখন আমার, সেদিন টাইমলি ড্রাইভারকে নিয়ে গেলে এত কিছু হতো না।
আমি– আহ্! তোরা থাম। তোদের ঝগড়া শুনতে আমি ডাকিনি।
এরপর আমি প্রত্যেকটা কাজের লোকের সাথে কথা বলে দেখলাম, তারা কেউই কোনো ক্লু দিতে পারলো না।
আমি– তমাল, তোর মেয়ের জন্য কোনো পড়ার রুম বা অন্য কোনো রুম আছে?
— হ্যা আছে।
— একটু দেখতে পারি।
— হুম চল।
আমরা তনিমার রুম দেখতে লাগলাম, মেয়েটা পড়ালেখায় ভালো ছিল।
তামিম আর আমি রুমের প্রত্যেকটা কোণা দেখতে লাগলাম।
— বাহ্! টেবিলটা সুন্দর! ও এখানে পড়তো নাকি?
— হ্যা।
— আচ্ছা, ওর খেলনা গুলো কোথায়?
— ওই ঝুড়িতে।
— ও কি একাই খেলতো?
–মোস্ট অফ দ্য টাইম একাই খেলতো।
— আর বাকি সময়?
— ও সবসময় একাই খেলতো।
–আচ্ছা, তোর মেয়ে কি করতে পছন্দ করে।
— আঁকিবুঁকি।
আমি টেবিলটা পর্যবেক্ষণ করে, হঠাৎ করে ড্রয়ারটা খুললাম।
— আচ্ছা, এই ড্রয়ারে তো দেখছি অনেক কিছু।
— ওগুলো সব ওর ফেবারিট।
— বাপরে! এত সুন্দর একটা খেলনা কিনে দিয়েছিলি?
— এটা হয়তো ওর কোনো বন্ধুর হবে।
— আচ্ছা! ওর বন্ধু? তো তাদের সাথেও তো কথা বলা উচিৎ। এখানে দেখছি বেশ কয়েকটা আঁকা ছবিও আছে।
আমরা ৫/৬ টা ছবি দেখলাম- বিভিন্ন ফলমূল, পাখি; বাচ্চা মানুষ, এগুলিই তো আঁকবে। শেষেরটাতে দেখলাম, পরিবারের সদস্যদের ছবি এঁকেছে। কিন্তু ওরাতো তিনজন, এখানে চারজনের ছবি কেন?
— আচ্ছা, তোরা তিনজন, কিন্তু এখানে চারজন কেন?
–হয়তোবা, ওর কোনো বন্ধু হবে।
— কিন্তু, এরকমভাবে ক্রস করে কেটে দিয়েছে কেন ছবিটার ওপর?
–সেটা কিভাবে বলি?
— আচ্ছা, তনিমার মাকে একটু ডাকতে পারবি।
–হ্যা, ডাকছি।
…..
অন্তিম পর্ব
তমালের স্ত্রী আর তমালকে জিজ্ঞেস করা শুরু করলাম
— আচ্ছা, তোরা আমাকে একটা কথা বল, তোরা তোদের মেয়েকে কি সময় দিস?
তমালের স্ত্রী– আমি যা সময় পাই ওর পিছনেই ব্যয় করে থাকি। কিন্তু ওর বাবা তো কোনো সময়ই দেয় না।
তমাল– তুমি সময় দিলে আমাদের এই অবস্থা হতো না।
আমি– তোরা থাম। আচ্ছা ভাবী, লাস্ট কয়েকদিনে কি কোনো বাচ্চা তনিমার সাথে ছিল? মানে একসাথে খেলাধুলা করেছিল?
–হ্যাঁ, ড্রাইভারের মেয়ে। ওকে মাঝে মাঝেই নিয়ে আসতো আর ও তনিমার সাথে খেলতো।
— ছবির এই মেয়েটাই কি সেই বাচ্চা?
— সেটা বলতে পারছি না?
–ক্রস দেয়া কেন?
— তনিমাই এসব আঁকিবুঁকি করে।
— আচ্ছা, সেদিন তনিমাকে আনতে যেতে আপনার লেইট হয়েছিল কেন?
— আসলে আমি একটা কাজ করছিলাম অফিসের।
–ড্রাইভার কি এসে বসেছিল?
— খেয়াল রাখিনি।
–তমাল, তোর অফিস থেকে বাসা আসতে কত সময় লাগে?
তমাল– এই …. ১০ মিনিট?
— সেদিন তমাল ফোন দেয়ার কতক্ষণ পর আপনি তনিমাকে আনার জন্য বের হন?
তমালের স্ত্রী –প্রায় আধাঘন্টা।
— তমাল, ড্রাইভারকে ফোন লাগা!
— ও তো ছুটি নিল।
— হোয়াট? ঘন্টাদুয়েক আগেও আমাদেরকে সার্ভিস দিয়েছিল।
— ফোন অফ। ও বলেছে ওর গ্রামের বাড়িতে যাবে।
— দ্রুত! ( দৌড়াতে দৌড়াতে)
তমাল– কোথায় যাব?
— ড্রাইভারের বাসা। ড্রাইভারই তনিমাকে কিডন্যাপ করেছে।
–কিন্তু কেন করবে সে এটা?
— সেটা গেলেই বুঝতে পারবি।
আমরা সবাই দ্রুত গাড়িতে উঠলাম, তমাল নিজেই ড্রাইভ করলো।
১০ মিনিটের মধ্যে ড্রাইভারের বাসায়। গিয়ে দেখলাম বারান্দায় তনিমা আর ড্রাইভারের মেয়ে টুসি খেলা করছে। তনিমার বাবা- মা হতবিহ্বল হয়ে ওদের মেয়ের কাছে গেল। তমাল তো ড্রাইভারের কাছে গিয়ে রীতিমত মীর জাফর বলে মারতে গেল। আমি থামালাম।
আসার আগে তমাল, পুলিশকেও খবর দিয়েছিল আমি মানা করা সত্যেও। পুলিশও এসে গেল। ড্রাইভারকে কোনো বলার সুযোগ না দিয়েই গ্রেপ্তার।
আমি পুলিশদেরকে থামালাম। ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলাম।
— কেন করলে এটা?
— দেখুন স্যার, আমি ভালো মানুষ নই। মন চাইছে তাই করছি।
–মিথ্যে বলো না।
— আমি হাছাই কইতাছি।
— তুমি মিথ্যে বলছো। সত্যিটা কি? আমি তোমাকে একমাত্র সহযোগিতা করতে পারি।
তমাল– ও আমার মেয়েকে কিডন্যাপ করছে আর তুই ওকে সহযোগিতা করছিস?
ড্রাইভার — এ্যাহ্! কয়দিন নিজের মেয়েরে সময় দিছেন!
তমাল — মুখ সামলে।
আমি– তমাল, লেট হিম টক! তুমি বল।
ড্রাইভার–আমার মেয়ে টুসি, ও এখানকার একটা ছোটখাটো স্কুলে পড়াশোনা করে। আমার স্বপ্ন ছিল ওকে একটা বড় স্কুলে ভর্তি করানোর কারণ ওর মেধাও খুব ভালো ছিল। একদিন আমি ম্যাডামের কাছে যাই মেয়েকে বড় একটা স্কুলে ভর্তি করানোর আবেদন নিয়ে। কিন্তু, উনি যা বলল তাতে নিজেকে মানুষই মনে হলো না।
আমি– কি বলল?
ড্রাইভার — উনি বলল মেয়েকে এত পড়িয়ে কি হবে? প্রাইমারিটা কোনোমতো পাশ করিয়ে কাজে দিয়ে দাও এখানে। তারপর কিছুদিন পর তো বিয়ে দেয়াই লাগবে। বলুন, এরপর কোন বাবার মন ভালো থাকে!
আমি — আর এই রাগের বসে তুমি ম্যাডামের মেয়েকে কিডন্যাপ করলে?
ড্রাইভার — না
আমি — তো?
ড্রাইভার — এই ঘটনার পর একদিন আমার মেয়েকে নিয়ে যাই ওখানে। ও বেশ ওখানে তনিমা মা-মনির সাথে খেলছিল। আমার মনটাও খুশি হয়ে গেল। এরকমভাবে বেশ কয়েকদিন নিয়ে গেলাম। একদিন, ম্যাডাম তনিমাকে বুঝাচ্ছে যে আমার মেয়ে ড্রাইভারের মেয়ে পঁচা, নোঙরা, আমাদের সাথে মেশা যাবে না। বলুন, এরপর কোন মানুষ ভালো থাকে!
আমি– এটার জন্যই কিডন্যাপ করেছিলে, নাকি আরও কারন আছে?
ড্রাইভার– আমি তনিমাকে কিডন্যাপ করিনি।
তমাল — চুপ, মীরজাফর। তোকে আমি জেলের ভাত খাওয়াবোই।
আমি — আহ্, চুপ কর! তুমি বলো।
ড্রাইভার–উনি যে এভাবে তেড়ে আসছেন। ওনাকে বলুনতো কয়দিন মেয়েকে সময় দিয়েছে। কয়দিন আদর করেছে। কয়দিন খেলেছে মেয়ের সাথে। নিজের মেয়েকে একটু সময় দিন। ম্যাডামকেও বলছি। সময় দিন।
আমি– এবার কাহিনীতে আসো।
ড্রাইভার — তনিমা মা আমাকে বেশ কয়েকদিন বলেছিল ও টুসির কাছে যাবে। ম্যাডামকে বললে কখনোই আসতে দিত না। সেদিন একটা সুযোগ পেলাম। তনিমাকে টুসির কাছে নিয়েও আসা হবে, আর ওনাদেরকে শিক্ষাও দেয়া হবে। আমার মনে হয় ওনারা শিক্ষা পেয়ে গেছেন। বিশ্বাস করেন স্যার, টুসি এখানে হাসি খুসিই ছিল। ও যদি একটুও কাঁদতো তাহলে ওকে আমি দিয়ে আসতাম। ভাবুন, একটা বাচ্চা কতটা বাবা- মায়ের আদর না পেলে বাবা মাকে ছাড়া থাকতে পারে খুশি মনে।
আমি– আর কিছু বলার আছে?
ড্রাইভার — না।
আমি– দেখো, তুমি যা করেছ, সেটা ঠিক করেছ আমার মতে, ওদের শিক্ষা হওয়া দরকার। কিন্তু, কাজটা করেছ রং ওয়েতে। কাজেই তোমারও শাস্তি হওয়া দরকার।
ড্রাইভার– আমি শাস্তির জন্য প্রস্তুত।
আমি– তোদেরও ড্রাইভারের কাছ থেকে শিক্ষা নেয়া উচিৎ । (তমাল ও তার স্ত্রীর উদ্দেশ্যে)
পুলিশ ড্রাইভারকে নিয়ে চলে গেল, তমাল ড্রাইভারের স্ত্রীকে কিছু টাকা দিয়ে তনিমাকে নিয়ে চলে আসলো। আমি আমার মেয়ে আর তনিমার জন্য সেইম গিফ্ট নিলাম। তনিমাকে দিলাম,
আমি — এগুলো তোমার জন্য।
তনিমা — থ্যাঙ্ক ইউ, চাচ্চু।
— তোমার মতো আমার বাড়িতেও একটা ফুলটুসি আছে। যাবে আমার সাথে?
— আব্বু, আম্মু গেলে যাবো।
— এইত্ত ব্রিলিয়ান্ট মেয়ে।
— তোমার আব্বু আম্মুকে বলে দিচ্ছি, ওদের সাথে আসবে। কেমন?
–হুমম, চাচ্চু।
আমি — ( তমালের উদ্দেশ্যে) কাল সকালে আমরা চলে যাচ্ছি।
— আর কটা দিন থেকে যা?
— না, মেয়েকে কথা দিয়েছি, যেতে হবে। তোরা আসিস সময় করে।
— হ্যাঁ, অবশ্যই।
–আর কোনো ধরনের সমস্যা হলে আমাকে জানাবি।
ওই রাতে সারারাত ওদের সাথে আড্ডা দিয়ে পরের দিন আমরা চলে আসলাম।
তামিম– তুই কিভাবে বুঝলি ড্রাইভারই কিডন্যাপিং টা করেছে?
আমি– স্ট্যাটিস্টিকস এর ভাষায় প্রবাবিলিটি নামে একটা টার্ম ছিল। সবকিছু অ্যানালাইসিসের পর আমাদের হাতে শুধু ড্রাইভারই বাকি ছিল। তখনও প্রবাবিলিটি ১ এর কাছাকাছি যায়নি, কিন্তু যখন সে তমালের বাসায় আসতে দশ মিনিটের রাস্তা তিরিশ মিনিটে আসে, তখন তার প্রবাবিলিটি ১ হয়ে যায়।
তামিম– আমাকে প্রবাবিলিটি শেখাবি?
আমি — হোয়াই নট?
বাড়িতে ফিরলাম।স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে, মেয়েকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে খুশি করতে হলো।
খুব ভালো ভাবেই দিন কাটাচ্ছি। পরিবারকে সময় দিচ্ছি, স্কুলে বাচ্চাদের কে পড়াচ্ছি, কত সুখের জীবন! অথচ ওদের জীবনে অশান্তি দুজনই চাকুরীজীবি হওয়ার পরেও।
সপ্তাহখানেক পরের কথা, ঘরে বিদ্যুৎ নেই, বেলকনিতে মোমবাতির আলোয় মেয়েকে পড়াচ্ছি। হঠাৎ, নোকিয়া ফোনের সেই বিখ্যাত রিংটোন বেজে উঠলো।
এপাশ থেকে, আমি– কে বলছেন?….
সমাপ্ত
- This author does not have any more posts.