পর্বঃ–১
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জানেনা এমন মানুষ মনে হয় পৃথিবীতে নেই। আজকের এই গল্পটির শুরু হয়েছিল বিখ্যাত এই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ই। কাজের সুত্রে একজন ইংরেজ প্রফেসরও বাংলাদেশি এক কর্নেলের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। একজন ইংরেজ যে কতটা দুর্ধর্ষ! এটা কর্নেল এর ছোট মস্তিষ্ক বুঝতে পারেনি। অবশ্য কর্নেলকে এর চরম মূল্য দিতে হয়েছিল। হয়তো তার জীবন দিয়ে। ভাগ্যের লিখনে আমি ও আমার কয়েকজন বন্ধুও এই গল্পের সাথে জড়িয়ে পড়ি। হয়ে উঠি গল্পটির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নানান ঘাত প্রতিঘাত মোকাবেলা করে, শেষ পর্যন্ত আসল রহস্য উৎঘাটন করতে আমরা সমর্থ হয়েছিলাম বটে কিন্তু ট্রাপের চক্রগুহে কয়েকজনের প্রাণ খোয়া গিয়েছিল।
সময়টা ছিল বসন্তকাল। তখন সবে মাত্র কলেজের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রবেশ করেছি। তাও আবার যে সে বিশ্ববিদ্যালয় নয়, সপ্নের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর খুব কম সংখ্যক শিক্ষার্থী এই শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠে পড়ার সুযোগ পায়। তার মধ্যে আমিও একজন। আমি শুধু হার্ভার্ডে পড়ার সুযোগই পাইনি সাথে পেয়েছিলাম শতভাগ শিক্ষাবৃত্তি। সেদিক দিয়ে আমি বেশ সৌভাগ্যবানই ছিলাম। খাওয়া পড়ার ভাবনা নেই; নেই কোনো এক্সট্রা কাজ করার পেরা। শুধু চিল আর চিল। আমার জীবনে তখন সুখের জোয়ার বইছিল, মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল নতুন নতুন স্বপ্ন । খুশি হওয়ার অবশ্য আরও কিছু কারণও ছিল। যাক সেগুলো না হয় আজ নাই-ই বললাম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের মতো অদ্ভুত একটা সাব্জেক্টও পেয়ে গেলাম। অদ্ভুত কথাটা শুনে আপনারা হয়তো সাব্জেক্টার সম্পর্কে কিনা কি ভেবে ফেলেছেন। না ঠিক তেমনটা নয়, সাব্জেক্টা হলো আমার সবচেয়ে পছন্দের একটা সাব্জেক্ট, ক্রিমিনাল সাইকোলজি। সেই ছোটবেলা থেকে আমার মনে ক্রিমিনাল অফেন্সগুলোর রহস্য ভেদ করার উপর একটা আলাদা নেশা কাজ করতো; হকরতো বইকি এখনও করে। এর জন্যই আমার বাবা মা বলতো, দেখিস তুই একদিন অনেক বড় ডিটেকটিভ হবি। আর বাবা মায়ের কথা সত্য হবে না, এটা কি হয়? ক্রিমিনাল সাইকোলজি সাব্জেক্টটা যেদিন পেয়েছিলাম, সেদিনই বুঝেছিলাম যে সত্যি
সত্যি আমি একজন বড় মাপের ডিটেকটিভ হতে চলেছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিন, মনের মধ্যে একটু ভয় কাজ করছিল। আর এটা হওয়াটাও স্বাভাবিক ছিল। নতুন দেশ, নতুন পরিবেশ আর নতুন বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে একটু সময়তো লাগবেই। তবে এখানে কিন্তু র্যাগিংয়ের কোনো বালাই নেই। যাই হোক, জমকালো অনুষ্ঠান আর আনন্দঘন মুহুর্তের মধ্য দিয়েই পার হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিনটি। সাথে ভয়ও কিছুটা কেটে গেল।
ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে রাতে বাসায় ফিরলাম। রুমে প্রবেশ করেই দেখি মার্টিন (আমার ক্লাসমেট ও রুমমেট) পড়তেছে। এই কয়েকদিন হলো মার্টিন আর আমি একসাথে এই মেসে উঠেছি। মার্টিনের পড়ার কথা শুনে আপনারা নিশ্চয়ই ভাবছেন, এখনো তো একাডেমিক লাইফ শুরুই হয় নি, তাহলে পড়ার প্রসঙ্গটা আসলো কিভাবে? হ্যাঁ, সঠিকই ভেবেছেন। তবে, এটা কোনো একাডেমিক পড়া নয়, রহস্যে ভরা গোয়েন্দা গল্প। গোয়েন্দা গল্পের উপর মার্টিনের যে আলাদা একটা নেশা আছে, তা প্রথম দিনেই টের পেয়েছিলাম । গোয়েন্দা গল্পের একগাদা বই ওর টেবিলের ওপর সাজানো। এটা দেখে আমারও বেশ ভালোই লেগেছে কেননা দুজনের নেশা ঐ একটাই, রহস্য উদঘাটন। আজ ও বাসায় একটু আগেই চলে এসেছে। হয়তো একটু রেস্টও নেয়নি, গল্পের বই নিয়ে পড়তে বসে গেছে। আমি রুমে প্রবেশ করা মাত্র মার্টিন আমাকে দেখে একটু মুচকি হাসি দিয়ে বলল, “হেই ব্রো, হাউ ওয়াজ দ্য ডে?” আমি কিছুই বললাম না। আমার এরুপ আচরণ দেখে সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। মনে মনে হয়তো ভাবতেছিল, এ কেমন বাঙালি ব্রো, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে তার উত্তর দিতে হয়, এতটুকু ম্যানারও কি জানা নেই? তারপর, কিছুক্ষণ আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আবার পড়ার ওপর কনসেনট্রেশন করতে চেষ্টা করে মার্টিন।
আমি টাওয়েল নিয়ে সোজা বাথরুমে চলে গেলাম। শাওয়ার নেওয়ার পর রুমে ফেরত এসে দেখি মার্টিন ঘরে নেই। হয়তো কোথাও গেছে এই ভেবে বিছানায় শুয়ে পরলাম। বেশ কিছুটা সময় পর একটা কান্নার আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। একটু বিব্রতবোধ মনে করলাম। কিন্তু তখনো খেয়াল করি নি যে কান্নার আওয়াজটা আমার রুমের বেলকোনি থেকে আসছিল। একেই তো নতুন বাসা সাথে বাসায় মার্টিনও নেই। কে কাঁদছে এটা জানার কৌতূহল আর ভয়ের কারণে গা শিউরে উঠেছে, হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। আমার মন আমাকে বলছে এই তোমার সাহসের নমুনা? তাই ডিটেকটিভ, ডিটেকটিভ ভাব নিলাম। কিছুটা সাহসের সঞ্চয় করে হাতের কাছের ল্যাম্পটার সুইচ অন করতেই দেখলাম একটা অস্পষ্ট ছায়া হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। ওটা কিসের ছায়া ছিল? কেন কাঁদছিল? এসবই ভাবছিলাম, এমন সময় মার্টিন এসে হাজির। মার্টিনের উপর ভীষন রাগ হচ্ছিল। আর একটু দেরি হলে ভয়ের চোটে হয়তো হার্ট অ্যাটাকই হয়ে যেত আমার।
মার্টিন আমার এ অবস্থা দেখে তো একবারে থ হয়ে গেল। উৎকণ্ঠিত স্বরে বলল, “ব্রো, আর ইউ ওকে? ওয়াটস্ রং উইথ ইউ?”
উত্তরে আমি বললাম, “ডোন্ট ওরি, আ’ম ওকে।”
মার্টিন আমার এই অবস্থার কারন ঠিক বুঝে উঠতে পারল না।
সে আবার বলল, “আর ইউ শিওর?”
আমি কিছুটা বিরক্তি ভরা স্বরে বললাম, “হুম।”
আমার কথা মার্টিনের মনে হয় বিশ্বাস হলো না। ও মনে মনে নিশ্চয়ই ভাবছে, কিছুতো একটা হয়েছে। কিন্তু সাহস করে আর কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছে না। ওর মুখ দেখে এটা স্পষ্টই বুঝতে পারলাম। এরপর দুজনেই কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ থাকলাম। কারোর মুখে কোনো কথা নেই। যেন দুজনেই মৌন ব্রত করছি। এভাবে বসে থাকলে তো আর চলে না। রাত অনেক হয়েছে আর পরদিন সকালে ক্লাসে এটেন্ড করতে হবে। মার্টিন আমাকে ঘুমাতে বলে নিজেও ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আমার পড়ার টেবিলে রাখা ল্যাম্পটার হালকা লালচে আলো রুমের শোভা কয়েকগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। আহা! কি এক অপরুপ আভা। আপনারা হয়তো এর আগে এই সৌন্দর্য উপভোগ করেন নি। তবে আমার এ বিষয়ে বেশ অভিজ্ঞতা আছে। রাতে ঘুম ভাঙ্গলে প্রায় তাকিয়ে থাকতাম জাজ্বল্যমান ল্যাম্পটার দিকে।বেজায় ভালো লাগতো। তাইতো সুদূর বাংলাদেশ থেকে আজ আমেরিকায়ও আমার শখের ল্যাম্পটাকে কখনো হাতছাড়া করি নি। এটা যেন আমার জীবনের একটা অংশ হয়ে উঠেছে।
যাইহোক, রুমে আলো থাকলে মার্টিনের আবার ঘুম হয় না। তাই মার্টিন ল্যাম্পটি অফ করে ঘুমাতে যাবে এমন সময় আমি বললাম, “মার্টিন, আজ রাতে ল্যম্পটা নিভিও না।”
“ঠিক আছে, যেমন তুমি বল।” বলেই মার্টিন বিছানায় শুয়ে পরল।
কিছুক্ষণ পর, আমিও শুয়ে পরলাম। ঘুম আসছিল না, ল্যাম্পর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম বেশ কিছুক্ষণ। নানান জল্পনা-কল্পনা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি মনে নেই।
পরদিন সকালে এলার্মের আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গলে দেখি মার্টিন তখনো ঘুমাচ্ছে। তখন সবে মাত্র সকাল ৭ টা ৩৫ মিনিট । নয়টার সময় ক্যাম্পাসের গার্ডেনে মি. পিটারের (ক্রিমিনাল সাইকোলজির প্রফেসর) ক্লাসে অ্যাটেন্ড করতে হবে। তাছাড়া আজ হার্ভার্ডে আমাদের প্রথম ক্লাস। দেরি হলে চলবে না।
তাই, মার্টিনকে ঘুম থেকে উঠে রেডি হতে বললাম।
মার্টিন ঘুমুঘুমু স্বরে বলল, ” লেট মি স্লিপ ব্রো”।
আমি ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে বললাম, ” নো, ইউ কান্ট স্লিপ । উই হেভ টু গো টু ইউনিভার্সিটি সুন। সো, গেট রেডি।”
মার্টিন কিছুটা বিরক্ত বোধ করল ঠিকই কিন্তু না উঠে পারল না। কারন কিছুক্ষণ পরই ক্লাস শুরু হবে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কিছু রুলস ও রেগুলেশনস আছে। তার মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ রুল হচ্ছে সমায়ানুবর্তীতা। ঠিক সময়ে ক্লাসে প্রবেশ করতে না পারলে নাকি শাস্তির পাশাপাশি সিজির উপরও খারাপ প্রভাব পরে, সচরাচর বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেটা দেখা যায়না আরকি। কথাটা শুনেছিলাম আমাদের ডিপার্টমেন্টের এক ইমিডিয়েট সিনিয়র ভাইয়ের কাছে।
খুব অল্প সময়ের মধ্যেই দুজনে রেডি হয়ে বাটার এর সাথে পাউরুটি দিয়ে টুকটাক সকালের নাস্তা সেরে নিলাম। সামনের দেয়ালে টাঙ্গানো ঘড়িটায় তখন সকাল ৮ টা ৪১ মিনিট বাজে। ক্লাসে পৌঁছতে দেরি হবে না। এইতো আমাদের বাসার সামনের হাইওয়েটা ক্রস করলেই ভার্সিটির মেইন গেইট, গেইটের বা দিকে একটু গেলেই গার্ডেন। আর ওখানেই তো আমাদের ক্লাস হবে।
বাসা থেকে বেরিয়ে দ্রুত হাঁটতে শুরু করলাম। ৫ মিনিটের মধ্যেই ক্যাম্পাসের গার্ডেনে উপস্থিত। গিয়ে দেখি মি. পিটার অলরেডি চলে এসেছে। এটা দেখে আমি বেশ অবাক হলাম কিন্তু মার্টিন বলল এটা নাকি এদেশের কালচার। এতোদিন ভাবতাম, বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলো এত উন্নতি করার পিছনে কারন আসলে কি? কিন্তু সঠিক উত্তর খুঁজে পায়নি। তবে একটা ভুল ধারনা মনে ঘুরপাক খেত। ভাবতাম, তাদের টাকার অভাব নেই, উন্নত সুযোগ সুবিধার ঘাটতিও নেই। এজন্যই তারা সবকিছুতে এত এগিয়ে। আমাদের আগেই মি. পিটারের উপস্থিত হওয়া দৃশ্য দেখে আমার সেই ভুল ভেঙ্গে গেয়েছিল। বুঝতে বাকি রইল না যে এদের উন্নতির পিছনে আছে সমায়ানুবর্তিতা আর নিয়মানুবর্তিতার জাদু। সেসব কথা না হয় পরে হবে।
অবশেষে চলে এলো সেই কাঙ্ক্ষিত মুহুর্ত। মি. পিটার সবাইকে সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে তার বক্তব্য শুরু করলেন।
মি. পিটার ক্লাসে যা বললেন তার বাংলা অনুবাদ কিছুটা এরকম, “প্রিয় শিক্ষার্থী, তোমরা কলেজের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পেয়েছো। তোমরা নিজেদের সাব্জেক্ট সম্পর্কে নিশ্চয়ই ধারনা রাখ। এটা এমন একটি সাব্জেক্ট, যার জ্ঞান তোমাদেরকে অপরাধ সম্পর্কে সীমাহীন জ্ঞানের অধিকারী করে তুলবে। এই জ্ঞানকে সঠিক কাজে ব্যবহার করতে পারলে বিশ্ব তোমাদেরকে নমস্কার করবে আর এর খারাপ ব্যবহার তোমাদের জীবনের একটা কালো অধ্যায় হয়ে উঠতে পারে।” এরকম আরও অনেক কিছু।
সবাই তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। কিন্তু আমি বিরক্তবোধ করছিলাম। বাংলাদেশে বসবাস করাকালীন এরকম অনেক নীতিবাক্য শুনেছি। তাই এসব শুনতে আর ভালো লাগে না। আমি যে ক্লাসে অমনোযোগী সেটা বুঝতে মি. পিটার এর দেরি হয়নি। আর না হওয়াই স্বাভাবিক, ক্রিমিনাল সাইকোলজির প্রফেসর বলে কথা। ক্লাস শেষে মি. পিটার আমাকে ওনার ক্যাবিনে দেখা করতে বললেন। আমি রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলাম। মার্টিন এর কাছ থেকে শুনেছিলাম মি. পিটার এর ব্যাপারে। ভীষণ রাগী আর একগুয়ে স্বাভাবের মানুষ। নিজের জীবন দিয়ে দিবে কিন্তু নিয়ম ভাঙ্গতে দিবে না। তাই বুঝতে বাকি রইল না, আমার কপালে শনি নাচছে।
ক্লাস শেষে আমি ওনার সাথে দেখা করতে গেলাম।
ক্যাবিনের দরজায় নক দিতেই, মি. পিটারের বললেন, “কাম ইন।”
ওনার মুখের এই আওয়াজটা যেন আমার কান ছিদ্র করে প্রবেশ করল। আজ নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে, বাবা মায়ের কথা খুব মনে পরছে। মনের মধ্য উঁকি দিচ্ছে আমার বাবার সেই কথা, ” দেখিস তুই একদিন অনেক বড় ডিটেকটিভ হবি।”
এই বুঝি আমার বাবার স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল। এটা যে কতোটা মারাত্মক ভয়, অনুভব না করলে বুঝতে পারবেন না। আপনারাই বলুন, এত ভয় কি একজন মানুষ সহ্য করতে পারে?
এতটাই ভয় পেয়েছি যে প্রফেসরের ক্যাবিনে প্রবেশ করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। ভয়ে শরীর ঘামছে, হাত পা অবশ হয়ে আসছে। ভাবছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিনটিই বুঝি আমার শেষ দিন হয়ে যায়। একমুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছিলো, আর মনে হয় বাবার স্বপ্ন পুরণ করতে পারলাম না। ভয়ে কান্না চলে এসেছে। মি. পিটার আমার এ অবস্থা দেখে মুচকি হাসলেন। তার মুখে হাসি দেখে মনে হয়, একটা নতুন জীবন ফিরে পেলাম।
আমাকে চেয়ারে বসতে বলে উনি কিছু পেপারস খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছিলেন। আমি তখনো রীতি মতো ঘামছি।
তিনি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন এরপর হুকুম ছাড়লেন, “মি. সুবল, হ্যাঁভ আ সিট। ডোন্ট বি ওরাইড। নাথিং সিরিয়াস।”
আমি বসে পরলাম। এতক্ষণে একটু আশার আলো খুঁজে পেয়েছি। মুহুর্তের মধ্যে সমস্ত ভয়, ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা উবে গেল।
আমি চুপচাপ বসে আছি। প্রফেসরও পেপারস দেখছিলেন খুব মনোযোগ দিয়ে। কারও মুখে কোনো কথা নেই। ক্যাবিনে একটা নিস্তব্ধ পরিবেশ বিরাজ করছে।
হঠাৎ মি. পিটার বলে উঠলেন, “মি. সুবল, হোয়াই ওয়্যার ইউ ডিজাপোয়েন্টেড ইন ইওর ক্লাস? ইউ মে টেল মি ইওর প্রব্লেম। আই উইল ট্রাই মাই লেভেল বেস্ট টু হেল্প ইউ।”
কথাটা শুনে বেশ অবাক হলাম। ইনি এতো ভালো মানুষ আর ওনার ব্যাপারে এ কয়দিন যা শুনেছি।
এখন দেখি এনার ব্যাপারে শোনা কথা গুলোর সম্পূর্ণই মিথ্যা। না না, সব মিথ্যা এটা বলা ঠিক হবে না। উনি সত্যিই একজন পাঙ্কচুলাল মানুষ, সাথে নিয়মনীতিতেও কঠোর। আমার বেলায় কেন এর ব্যতিক্রম হলো, বুঝতে পারলাম না।
আমার ভাবনার অন্ত নেই। ঐ যে বলেছিলাম, আমি ছোটবেলা থেকেই একজন ডিটেকটিভ হতে চেয়েছি ওটারই প্রতিফলন এটা। সব কিছুতেই রহস্য খুঁজি আর আমার ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যায়।
আমার এরূপ ভাবুক ও দ্বিধাগ্রস্ত চেহারা দেখে মিস্টার পিটার বললেন, “মি. সুবল, ওয়াট আর ইউ থিংকিং?”
আমি বললাম, “নাথিং স্যার”.
“আর ইউ বেঙ্গলি?” মিস্টার পিটার বললেন।
আমি বললাম, “ইয়েস স্যার।”
আমি আবারও অবাক হলাম। মনে মনে ভাবছি, আমি যে বাঙ্গালি এটা ইনি কিভাবে বুঝলেন? আমি যথেষ্ট সুন্দরভাবে ইংরেজিতে কথা বলি। আমার কথা শুনে বাঙালি ভাবার কোনো উপায় নেই। শুধু ভাবনা আর ভাবনা, এই ভাবনার চক্করে পরে না জানি জীবনটাই কখন শেষ হয়ে যায়। অবশেষে এই ভাবনারও অবসান হলো। বুঝতে পারলাম কেন উনি আমাকে বাঙালি বললেন। আসলে উনি যে গুরুত্বপূর্ণ পেপারস গুলো দেখছিলেন ওগুলোতে আমার ডিটেইলস ছিল।
ওয়াটেভার, লেটস্ টক ইন বাংলা, এটা বলেই মি. পিটার বাংলায় কথা বলা শুরু করলেন। ওনার বাংলায় কথা বলার ধরণে আমি নিমিষেই অভিভূত হয়ে গেলাম। একজন ইংরেজ প্রফেসর যে এত সুন্দর করে বাংলায় কথা বলতে পারে তা এনাকে না দেখলে কখনোই বিশ্বাস করতাম না। প্রফেসরের সাথে যতই কথা বলছি, ততই ওনার মাঝে নতুনত্ব খুঁজে পাচ্ছি। কি এক আজব মানুষ!
কিন্তু তখনো বুঝতে পারলাম না, আমি ভুল করার পরেও, কেন উনি আমার সাথে এখনো হেসে হেসে কথা বলছেন? এমনটা হওয়ার তো কথা নয়।
তাহলে কি উনি আমার উপর একটুও রাগ করেন নি? না এটা ঝড় শুরু হওয়ার আগের সেই শান্ত অবস্থা? আমার জানামতে উনি তো মাফ করার মানুষ না। সামান্য ভুলও যিনি ক্ষমা করেন না, তিনি আমার এত বড় একটি ভুল ক্ষমা করে দিলেন!
একবার ভাবছি, যাক বাবা, উনি কেন আমাকে মাফ করে দিয়েছেন, ওটা আমার জেনে কাজ নেই। কিন্তু পরক্ষণেই অনেক প্রশ্ন মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।
সাহস করে মি. পিটারের কাছে জানতে চাইলাম, “স্যার, আপনি কিভাবে এত সুন্দর বাংলা বলা শিখলেন? কেন বাঙালির প্রতি আপনার মনে এত সফ্টনেস?”
মি. পিটার বললেন, “তুমি যে এমন প্রশ্ন করবে তা আমি আগেই জানতাম। শোনো তাহলে, আমি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার হিসেবে যোগদান করি ১৯৮৫ সালের শেষের দিকে। তুমি হয়তো তখন জন্মগ্রহণই করনি। যোগদানের একবছর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের কতৃর্পক্ষের আদেশে আমাকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়, ক্রিমিনাল সাইকোলজির উপর বিস্তর এক গবেষণা করার জন্য। ইউ.এস গভার্নমেন্টের সহযোগিতায় বাংলাদেশে খুব সহজেই পৌছে যাই। বাংলাদেশ আর্মির একজন কর্নেল আমাকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে আসেন। কর্নেল সাহেব নিতান্তই ভালো মানুষ ছিলেন। আমার জন্যই অকালে প্রাণ দিতে হয়েছিল তাকে।
আমি বললাম, “কেন স্যার, কিভাবে?”
- “বলছি, বলছি, তোমরা বাঙালি দের এই একটা দোষ, কোনো কিছুতেই ধৈর্য রাখতে পার না”
বলেই মি. পিটার করুণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলেন, “হয়েছিল কি, আমি বাংলাদেশে রিসার্চ করার সময় কাজের সূত্রে কর্নেল সাহেবের সাথে আমার বেশ বন্ধুত্ব হয়ে যায়। রিসার্চটি কম্প্লিট হতে প্রায় দু বছর সময় লেগেছিল। রিসার্চের শেষদিকটা ছিল গ্রীষ্মকাল গভার্নমেন্ট থেকে কর্নেল সাহেবকে প্রায় এক মাস ছুটি দেওয়া হলো গ্রীষ্মের অবকাশ যাপনের জন্য। এটা শুনে, আমি ওনাকে আমার সাথে হার্ভার্ড ঘুরে আসতে বলি এই ভেবে যে, এতে করে কর্নেল সাহেবকে কিছুটা হলেও আতিথেয়তা করার সুযোগ পাব। আমি ওনাকে বলতেই উনি একবাক্যে রাজি হয়ে যান। ওনার সাথে বেশ বন্ধুত্ব ছিল বলে হয়তো উনি না করেননি।
ওনার স্ত্রী আমাকে বললেন, “ভাই, ওনি কখনোই ঘুরতে বেড়াতে পছন্দ করেন না, সারাদিন শুধু কাজ আর কাজ। কাজের বাইরেও যে একটা জগৎ আছে, সেটা উনি কখনোই বুঝতে চান না। কতদিন বায়না করেছি, কত অভিমান করেছি তবুও উনি আমাদের কখনো ঘুরতে নিয়ে যান নি। আমাদের কথা না হয় বাদ ই দিলাম। নিজেও তো একদিন ঘুরতে বেরোয় না। আজ হঠাৎ, আপনার কথায় ঘুরতে যেতে রাজি হয়ে গেল। আমি স্বপ্ন দেখছি নাতো!”
এই বলে কর্নেল সাহেবের স্ত্রী নিজের শরীরে চিমটি কাটলেন। ওনার এরকম ছেলেমানুষী দেখে আমি ও কর্নেল সাহেব দুজনেই হেসে ফেললাম।
পাশেই কর্নেল সাহেবের পাঁচ বছরের ছেলেটি আনন্দে চিৎকার করে বলতে লাগল, “আব্বু ঘুরতে যাবে। কি মজা! আব্বু ঘুরতে যাবে!”
আজ কর্নেল সাহেবের পরিবারের সবাই খুশি। যেন ওনার পরিবারের স্বর্গীয় সুখ বিরাজ করতেছে।
সবার খুশিভরা মুখ দেখে কর্নেল সাহেব আমাকে বললেন, “মি. প্রফেসর, জীবনে অনেক মিশনে গিয়েছি, সারাক্ষণ শুধু কাজের মধ্যেই ডুবে থেকেছি, নিজের জন্য, নিজের পরিবারের জন্য যে সময় রাখা দরকার সেটা একরকম ভুলেই গিয়েছিলাম।”
আমি বললাম, “মি. কর্নেল, ভুলে যান ওসব কথা। নতুন ভাবে বাঁচতে শিখুন। জীবনকে উপভোগ করুন এক নতুন আঙ্গিকে।”
কর্নেল সাহেব বললেন, “ঠিক বলেছেন, আজ থেকেই না হয় শুরু হোক আমার নতুন এক জীবন। যেখানে থাকবে না কোনো যান্ত্রিকতার ছোয়া, থাকবে শুধু কৃত্রিমতা বিবর্জিত আনন্দের পরশ। এখন থেকে এভাবেই জীবনের প্রত্যেকটা মুহুর্তকে সৌন্দর্যের রঙে রাঙিয়ে দিতে চাই। কি বলেন মনোবিজ্ঞানী?” তিনি কথাটা হাসতে হাসতে বললেন।
কিন্তু, এই আনন্দ তার জীবনে বেশিদিন সইল না।
আমি উৎসুক কন্ঠে জানতে চাইলাম, “কিভাবে স্যার?”
প্রফেসর বললেন, “পরদিন কর্নেলের কথামতো আমি প্লেনের দুটো টিকেট কেটে ফেললাম। টিকেট কাটতে আমাদের কোনো সমস্যা পোহাতে হয়নি বটে। কারণ আমরা দুজনই ভি.আই.পি। আর বাংলাদেশে ভি.আই.পি দের কতটা কদর তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
দিনটি ছিল মঙ্গলবার, বাংলাদেশের সময় অনুযায়ী সকাল ৬ টায় আমাদের প্লেনটি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে যাত্রা শুরু করল। রাত ঠিক ১.৫২ (আমেরিকার সময়ে) মিনিটে প্লেনটি আমেরিকার Boston Logan International Airport এ ল্যান্ড করে। তখন আমেরিকায় রাত গভীর । চারদিকের পরিবেশ নিস্তব্ধ, মানে পিনপতন নিরবতা। এয়ারপোর্টে আমার ড্রাইভার সেই রাত নয়টা থেকে আমাদের অপেক্ষায় ছিল। এই অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে দ্রুতই প্রস্থান করলাম। তখন রাত প্রায় দুটো বেজে গেছে। আমেরিকার শুনশান রাস্তা দিয়ে চলছি, রাতের জনমানবহীন এই রাস্তা দেখতে বেশ ভয়ংকর। দেখলে মনে হবে রাতের নিস্তব্ধতা যেন ঘিরে ধরেছে রাস্তাটিকে।
আমার ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছিল আর বলছিল, “স্যার, এত রাতে বাসায় যাওয়া সেইফ হবে না।”
কারণ, এয়ারপোর্ট থেকে আমার বাসা যেতে প্রায় তিন ঘন্টা লাগে। বাসা যেতে যেতে ভোর হয়ে যাবে। তুমি হয়তো এটা ভাবছো, যেখানে আমেরিকায় এত সেইফটির ব্যবস্থা, সেখানে ড্রাইভারের এরকম কথা বেশ বেমানান। তোমার ভাবনাটা নিরর্থক নয় বটে কিন্তু ড্রাইভারও এক্ষেত্রে ভুল কিছু বলে নি। এত নিরাপত্তা ব্যবস্থার পরেও দিনদিন আমেরিকায় ক্রাইম রেট ঝড়ের গতিতে বেড়েই চলেছে। এর যেন কোনো অন্ত নেই।
এরপর প্রফেসর বলতে লাগলেন, “হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই এক বাংলোর ম্যানেজারের নাম্বার আমার কাছেই ছিল। ওনাকে ফোন দিয়ে দুটি ভি.আই.পি রুম রিজার্ভ করলাম। কর্নেল সাহেব এক রুমে আর আমি অন্য রুমে। ড্রাইভার গাড়িতেই শুয়ে পরেছে। রাতের খাওয়া শেষ করে দুজনে নিজ নিজ রুমে ঘুমিয়ে পড়লাম। রাত আনুমানিক ৩.৫৬ মিনিটে কর্নেল সাহেবের করুন আর্তনাদে আমি সহ বাংলোর প্রায় সবারই ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমরা বিন্দুমাত্র দেরি না করে ততক্ষনাৎ ওনার রুমের সামনে উপস্থিত। আমি ওনার রুমের দরজায় বেশ কয়েকবার নক দিলাম, ডাকলাম কিন্তু কোনো সাড়া নেই। ম্যানেজারকে ফোন দিতেই উনি ওখানে দ্রুত উপস্থিত হয়ে মাস্টার কি দিয়ে রুমের দরজা খুললেন। ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। দেখি, কর্নেল সাহেব আর বেঁচে নেই। শুধু তার রক্তাক্ত শরীর মাটিতে পরে আছে। দেহ একদিকে, মাথা আরেকদিকে। এত বিভৎসভাবে কেউ কাউকে হত্যা করতে পারে! ওনার নিথর দেহ দেখে আমি ঠিক থাকতে পারলাম না। মাটিতে লুটিয়ে পরলাম। পরদিন সকালে স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে জানতে পারলাম, ঐ এলাকায় নাকি এর আগেও এরকম ঘটনা ঘটেছে। তবে সেটা অনেক বছর আগে সান ফ্লাওয়ার নামের অন্য একটি বাংলোয়। সবার ধারনা, ওখানে নাকি এক অতৃপ্ত আত্মা ঘুরে বেরায়। রাতে ওই আত্মার অস্তিত্ব টের পায় অনেকেই। বাংলাদেশের ইনটেলিজেন্স টিম ও বাংলাদেশ আর্মির স্পেশাল ব্রান্স অনেক তদন্ত করেছে কিন্তু কোনো প্রমাণ মেলেনি। ইউ.এস পুলিশ দীর্ঘদিন যাবৎ মার্ডারের তদন্ত করেও কোনো প্রমাণ না পাওয়ায় মামলাটা ডিসমিস করে দেয়। আমিই এই মামলার প্রধান সাস্পেক্ট ছিলাম কিন্তু ইউ.এস এর সুপ্রিম কোর্টে আমি নির্দোষ প্রমাণিত হই। কর্নেল সাহেবের ছেলে, স্ত্রী ও পরিবারের কাছে আমি এখনো এক অপরাধী। ওনার মৃত্যুর পর সেই পাঁচ বছরের শিশুটির প্রশ্নটি আমাকে এখনো নির্বাক করে দেয়। প্রশ্নটি ছিল, ” আঙ্কেল, আমার বাবা কই? আমার বাবা কি আর আমার সাথে কথা বলবেন না?”
এই বলে প্রফেসর কেঁদে ফেললেন। এমন মর্মান্তিক ঘটনা শুনে আমার চোখেও জল চলে এসেছে।
প্রফেসরের কথা শুনে বুঝতে পারলাম এই জন্যই হয়তো উনি বাংলাদেশিদের প্রতি একটু দুর্বল।
প্রফেসরকে বললাম, “স্যার, পৃথিবীতে আসলেই কি আত্মা বলে কিছু এক্সিস্ট করে? একজন বিজ্ঞানী হয়ে এটা আপনি কিভাবে এটা বিশ্বাস করতে পারেন?”
উনি বললেন, “আমি বিশ্বাস করি পারফেক্ট ক্রাইম বলতে কিছুই নেই আর এত নিখুঁত মার্ডার একজন মানুষ করতেই পারে না। হয়তো স্থানীয়দের কথাই ঠিক। এটা একটা আত্মার কাজ।”
প্রফেসরের সাথে সাথে গল্প করতে করতে কখন যে দুপুর হয়ে গিয়েছে খেয়ালই করি নি। কেবিনের আলমিরার উপর দেয়ালে টাঙ্গানো ঘড়িটার এলার্মের টুংটাং শব্দ জানান দিল, এখন দুপুর ১২ টা। প্রফেসরের লান্সের টাইম হয়েছে, আর আগেই বলেছি নিয়মনীতিতে প্রফেসর খুবই কঠোর। তাই ১২ টা বাজার সাথে সাথেই খাবার নিয়ে একজন পিয়ন প্রফেসরের কেবিনে হাজির। প্রফেসর আমাকে ওনার সাথে লান্স করতে বললেন।
কিন্তু আমি বললাম, “না স্যার, আমি খেয়ে এসেছি। তাছাড়া আমার খিদেও পায়নি। আপনি খান।”
যদিও আমারও প্রচুর খিদে পেয়েছিল। তবুও নিজেকে কন্ট্রোল করলাম। উনি আমার অপরাধ ক্ষমা করেছেন এটাই অনেক। আর তার সাথে খেতে বসা নিতান্তই বেমানান। তাই ওনার কাছে থেকে অনুমতি নিয়ে কেবিন থেকে কেটে পরাই আমার কাছে শ্রেয় মনে হলো।
আমি প্রফেসরকে উদ্দেশ্য করে বললাম, “স্যার, তাহলে এবার আমি আসি?”
প্রফেসর বললেন, “মি. সুবল, আমি একাই খাচ্ছি। আর তুমি বসে আছো, এটা ঠিক হচ্ছে না। তুমি আমার সাথে খেলেও পারতে।”
আমি বললাম, “না স্যার, ঠিক আছে। আমার খিদে পায়নি আর আপনি আমাকে খেতে বলেছেন এতেই আমি ধন্য। এখন তাহলে আসি স্যার?”
প্রফেসর দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে সম্মতি জানাল।
আমি চেয়ার থেকে উঠে পরলাম। কেবিনের দরজা খুলতেই যাব এমন সময় প্রফেসর বলে উঠলেন, “মি. সুবল, তোমাদের সাথে তো কালকেও আমার ক্লাস আছে। টাইম এন্ড লোকেশন তোমাদের সি.আর এর কাছ থেকে জেনে নিও।”
আমি বললাম, “জি স্যার। কালকে ক্লাসে দেখা হবে।”
প্রফেসর মৃদু স্বরে বলল, “হুম।”
প্রফেসরের কেবিন থেকে বের হয়ে আবার অবাক হয়ে গেলাম। আজ শুধু অবাকই হচ্ছি। মনের ভিতরটায় নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কিছু প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছি তো কিছু প্রশ্ন ধোয়াশাই থেকে যাচ্ছে।
আপনাদের মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগছে, এই বারবার আবাক হওয়ার কারণটা আসলে কি? হ্যাঁ সেটাও বলছি। কেবিন থেকে বের হয়েই দেখি, দরজার সামনে মার্টিন তখনো আমার জন্য অপেক্ষা করছে। অপেক্ষা করার জন্য ওয়েটিং টেবিল আছে কিন্তু মার্টিন সেখানে না বসে দাড়িয়েই আমার জন্য অপেক্ষা করছে। না, না, শুধু মার্টিন নয় ওর সাথে আরও দুজনকে দেখতে পেলাম।
মার্টিন যে আমার জন্য এতক্ষণ অপেক্ষায় থাকবে ভাবতেই পারিনি। কারন ক্লাস সেই কত আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে। আর বাংলাদেশে যেখানে দুই মিনিটই কেউ অপেক্ষা করে না সেখানে মার্টিন আমার জন্য কয়েক ঘন্টা অপেক্ষায় আছে। অবাক হওয়াটা স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক এই প্রশ্নের উত্তর না হয় আপনারাই দিলেন। আপনাদের মধ্যে অনেকেই বলবেন মার্টিন আমার রুমমেট ও ক্লাসমেট, তাই আমার অপেক্ষায় আছে। এতে অবাক হওয়ার কি এমন আছে? হ্যাঁ, আপনাদের কথা মেনে নিলাম কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো বাকি দুজন কেন আমার অপেক্ষায় নিজেদের সময় নষ্ট করছে? যাদের আমি চিনিও না।
ওদেরকে তো ক্লাসেও দেখলাম না। তাহলে ওরা দুজন কে? দেখে তো বাংলাদেশি মনে হচ্ছে কিন্তু ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। এই রহস্যে গুলো ভেদ করতেই যদি আমার এরকম অবস্থা হয় তাহলে কীভাবে আমি একজন নামকরা ডিটেকটিভ হবো? নিজেকে প্রশ্ন করলাম কিন্তু মন আমাকে কোনো উত্তরই দিল না।
আমার এরকম বিস্মিত চেহারা দেখে মার্টিন বলে উঠল, “হেই সুবল, ইউ আর লুকিং সো কনফিউসড। ওয়াট আর ইউ থিংকিং?”
মার্টিনের সাথে যে দুইজন ছিল তাদেরও ঐ একই।
প্রশ্নগুলো, “কি হয়েছে? স্যার তোমাকে কি বললেন? উই হোপ যে, খারাপ কিছু হয়নি।”
ছেলে দুটোর মুখে বাংলা কথা শুনেই বুঝতে পারলাম যে ওরা বাঙালি। এর আগে অবশ্য ওদের চেহারা দেখে ওরা যে বাঙালি তা কিছুটা ঠাওর করতে পেরেছিলাম। তার মানে আমার ধারনাই ঠিক। তখনো আমার মুখে কোনো কথা নেই। মনে ভাসছে নানা প্রশ্ন আর সাথে পেটে ছুচো কামড়াচ্ছে। আমি বাঙালি বলে কথা। সকালের ঐ সামান্য নাস্তাতে কি চলে? আপনারাই বলুন।
যাইহোক আমার ক্লান্তিভরা মুখ দেখে ওরা এবার উদগ্রীব হয়ে উঠল। মার্টিনতো মনে হয় রীতিমতো ভয় ই পেয়ে গেছে। ওরা মনে হয় ভাবতেছে, মি. পিটার হয়তো আমাকে ইউনিভার্সিটি থেকে রাসটিগেট করে দিয়েছে। আর মি. পিটারের কাছে এটা নতুন কিছু নয়ও। এর আগে উনি অনেক স্টুডেন্টকেই রাসটিগেট করেছেন নিয়ম অমান্য করার জন্য।
মার্টিনের এবার ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে গেল। সে করুন স্বরে বলল, “সুবল, সে সামথিং! উই আর গেটিং ওরিড।”
আমি এবার উত্তর দিলাম, “নাথিং সিরিয়াস। এ্যাভরিথিং ইজ ওকে।”
মার্টিন যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো।
এখন প্রশ্ন, “আমার এই ঘটনার ব্যাপারে এ দুজন কিভাবে জানতে পারলো? এরা তো আমার ক্লাসমেট নয়। কারণ আজকের ক্লাসে আমার সকল ক্লাসমেট উপস্থিত ছিল। আর ওদের সাথে আমার পরিচয়ও হয়েছে।”
যাইহোক, ওরা কিভাবে জানতে পেরেছে ওটা জেনে আমার কাজও নেই। ওরা যে বাঙালি, এটা জেনেই অনেক শান্তি পেলাম।
এবার সবাই হাটতে শুরু করলাম লিফটের দিকে। কারণ সিড়ি দিয়ে নামার জন্য যে শক্তি ও মানসিকতার প্রয়োজন, তার কোনোটাই এখন আমার মধ্যে নেই। আর মি. পিটারের অফিস ১৬ তলায়। তাই সিড়ি বেয়ে নামা উচিতও হবে না। বলতে না বলতেই লিফটের সামনে হাজির হলাম। লিফটে তেমন কোনো জ্যামও নেই। তাই গ্রাউন্ড ফ্লোরে নামতে কোনো সময়ই লাগল না।
আর হ্যাঁ, আপনাদের একটা কথা বলে রাখি, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর বিল্ডিংয়ে যে লিফ্টগুলো দেখা যায় তা শিক্ষার্থীদের জন্য যথেষ্ট নয়, সাথে ধারনক্ষমতাও অনেক কম। তাই সেখানে সবসময় ভিড় লেগেই থাকে। যা হার্ভার্ডে আপনি কখনোই দেখতে পারবেন না। ইউ.এস.এ যেমন উন্নত তার থেকেও অনেক উন্নত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি। সবদিক থেকে এগিয়ে আছে বলেই তো হার্ভার্ড সেই অতীতকাল থেকে এখনো বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর মধ্যে রাজত্ব করছে।
যাই হোক সেসব কথা। আমারা চার জন এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছায়াঘেরা, শান্ত-স্নিগ্ধ পথ দিয়ে হাঁটছি দক্ষিণা বাতাস বইছে। গাছের মগডালে পাখির কিচিরমিচির, পাশের ফুলবাগানে ফুটন্ত ফুলের মিষ্টি মধুর ঘ্রাণ আমার প্রাণকে আকুল করে তুলছে। আহা! কি শান্তি! যেন মন-প্রাণ ভরে গেল এক স্বর্গীয় সুখ আর আনন্দের কল্লোলে।
আমার ঘুম আসতেছ। মার্টিনকে বললাম, “চলো একটু ওই গাছটার নিছে গিয়ে একটু বসি।”
মার্টিন না করল না। অন্য দুজন আমাদের সাথে সাথে চলল। গাছের নিচে থাকা চেয়াগুলোতে সবাই বসে পরলাম।
গাছটির পাশেই মিস লরার ক্যান্টিন। চিকেন পকোড়া আর বিশেষ এক ধরনের জুসের জন্য তার ক্যান্টিনটির বেশ সুনাম। হার্ভার্ডে পড়তে আসা প্রত্যেকটি শিক্ষার্থী এমনকি শিক্ষকও তার প্রশংসায় নাকি পঞ্চমুখ। এই মহিলার হাতে নাকি জাদু আছে। মার্টিনের কাছে কথাটি শুনেছিলাম বেশ কিছুদিন আগে। তার ক্যান্টিনের পাশেই বসে আছি আর সেই বিশেষ চিকেন পকোড়া আর জুস খাবো না এটা কোন কথা।
মার্টিনকে ২০ ডলার বের করে দিয়ে বললাম কিছু পকোড়া আর পাঁচটি জুসের গ্লাস আনতে। মার্টিন প্রথমে টাকা নিতে চাচ্ছিল না কিন্তু আমি জোরাজুরি করায় সে রাজি হল। মার্টিন গেল পকোড়ার আর জুস জানতে। ততোক্ষণে আমি, বাকি দুজনের সঙ্গে পরিচিত হলাম। তাদের কথায় যা বুঝলাম, তারাও এবার আমার মতই স্কলারশিপ নিয়ে হার্ভার্ডে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। একজনের নাম উৎপল চন্দ্র সরকার আরেকজনের নাম তৌফিক। দুজনই নটরডেমের শিক্ষার্থী ছিল। উৎপল জানালো সে হার্ভার্ডে ফলিত রসায়ন ও রসায়ন প্রকৌশল আর তৌফিক কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং সাবজেক্টে ভর্তি হয়েছে। আমেরিকায় সাবজেক্ট দুটির বেশ ভ্যালু। একবার গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে বেরোতে পারলে চাকরির অভাব নেই।
আমি জিজ্ঞেস করলাম যে আমার বিষয়ে তারা কিভাবে জানতে পারল?
উত্তরে ওরা আমাকে জানালো দুজনেরই প্রাকটিক্যাল ল্যাব মিস্টার পিটারের অফিসের পাশেই। আমি যখন মিস্টার পিটারের অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তখন নাকি ওরা আমাকে দেখে কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিল যে আমি বাংলাদেশী। ল্যাব শেষে যখন তারা মিস্টার পিটারের অফিসের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, তখন অফিসের বাইরে ভিড় দেখতে পায়। আসলে তখন হয়তো আমার ক্লাসমেটেরা অফিসের সামনে এসেছিল ঘটনাটি অবলোকন করতে। তারা মার্টিনের কাছে কি হয়েছে জানতে চাইলে, মার্টিন তাদেরকে আমার সম্পর্কে বলে। তাই তারা আমার জন্য অপেক্ষা করছিল নিজের দেশের লোক বলে। নিজের দেশের মানুষের প্রতি যে একটা আলাদা ভালোবাসা কাজ করে, বিশেষ করে যখন কেউ দেশের বাইরে থাকে। তা এদের দেখেই বুঝতে পারলাম।
যাই হোক এসব গল্পগুজব করতে করতে মার্টিন হাজির। হাতে মিস লড়ার সেই বিখ্যাত পাকড়ার প্যাকেট আর জুসের গ্লাস। মার্টিন এর ফিরে আসতে প্রায় আধা ঘন্টা সময় লেগেছিল। এত সময় লাগার কথাতো নয়। তাই মার্টিনকে বললাম, “এত সময় লাগলো যে? কোন সমস্যা হয়েছিল নাকি?”
সে বলল মিস লরার পকোড়ার আর জুসের জন্য বিশাল লাইনে দাঁড়াতে হয়।
একথা শুনে বুঝতে বাকি রইল না যে মিস লরার এই বিশেষ ডিশ এর কতটা কদর।
পকোড়ার প্যাকেট খুলতেই আহা কি সুন্দর ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে সাথে পকোড়া গুলোর দেখতেও বেশ সুন্দর। দেখতে যদি এত সুন্দর হয় না জানি খেতে কতটা সুস্বাদু হবে এই ভেবেই জিভে জল চলে এসেছে। আমরাও ছিলাম ক্ষুধার্ত। সবাই খাওয়া শুরু করলাম। খেতে খেতে ফরমাল, ইনফরমাল অনেক গল্পই হলো। খাওয়া শেষে সবাই নিজ নিজ মেসের দিকে প্রস্থান করলাম।
চলবে……..
- হাবিবুল বাসার সুমনhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%ac%e0%a7%81%e0%a6%b2-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%b8%e0%a7%81%e0%a6%ae%e0%a6%a8/বৃহস্পতিবার, মার্চ ১৪, ২০২৪
- হাবিবুল বাসার সুমনhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%ac%e0%a7%81%e0%a6%b2-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%b8%e0%a7%81%e0%a6%ae%e0%a6%a8/বৃহস্পতিবার, জুন ১৩, ২০২৪
- হাবিবুল বাসার সুমনhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%ac%e0%a7%81%e0%a6%b2-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%b8%e0%a7%81%e0%a6%ae%e0%a6%a8/বৃহস্পতিবার, জুলাই ১১, ২০২৪
- হাবিবুল বাসার সুমনhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%ac%e0%a7%81%e0%a6%b2-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%b8%e0%a7%81%e0%a6%ae%e0%a6%a8/সোমবার, আগস্ট ১২, ২০২৪
- হাবিবুল বাসার সুমনhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%ac%e0%a7%81%e0%a6%b2-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%b8%e0%a7%81%e0%a6%ae%e0%a6%a8/বৃহস্পতিবার, সেপ্টেম্বর ১২, ২০২৪