fbpx

ডিসেম্বর ৫, ২০২৪

রাকুলের স্বপ্ন

শ্রাবণের সে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির দুপুরে ১২ বছরের শিশু রাকুল মা’র সাথে অভিমান করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল।পণ করলো সে আর বাড়ি ফিরবে না। বেলা গড়িয়ে বিকেল হয়, সে স্কুলের মাঠে খেলাধুলা করছিল। আস্তে আস্তে রাত হতে থাকে।সবাই বাড়ি চলে যেতে লাগলেও রাকুল আর সে মুখ আর হয় না। মাঠেই খেলা শেষ করে বাড়ি যেতে থাকা তার বন্ধু জসীম তাকে জিজ্ঞেস করলে সে জানায়, সে আর বাসায় ফিরবে না। কারন জিজ্ঞেস করতেই সে কাঁদতে শুরু করে। জসীম তাকে থামাতে চেষ্টা করলেও কোন লাভ হয় না। এদিকে রাত ও হয়ে যাচ্ছিল, তাই আর উপায় না দেখে জসীম বাড়ির পথ ধরে। মাঝে মাঝে পিছুপানে একটু তাকিয়ে রাকুল কে দেখার চেষ্টা করে, তবে একটা সময় সে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। অন্ধকার আরো গভীর হতে থাকে। বাসায় রাকুলের বাবা এসে তার কথা জিজ্ঞেস করলে মা তাকে সব জানায়, এবং সে নিজেও চিন্তায় পড়ে যান। এদিকে বাহিরে মেঘ ঢেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। স্কুলটি ছিল একতলা বিশিষ্ট দালান। ছোট রাকুল স্কুলের একপাশে ছাউনির নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। বৃষ্টির সাথে সাথে আচমকা একটি শব্দ তার কানে ভেসে এলো। সে একটু ঘাবড়ে গিয়ে বামদিকে তাকিয়ে দেখলো একটি বিড়াল বৃষ্টিতে ভিজে তার পাশেই আশ্রয় নিয়েছে। রাকুল অভিমান ও ভয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। চারদিক অন্ধকার হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। এদিকে রাকুলের বাবা-মা তাকে খুঁজতে সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে জিজ্ঞেস করলে জসীমের বাড়ি গিয়ে জানতে পারে, রাকুলকে সে স্কুলের মাঠে দেখেছে। তার বাবা-মা ও জসীম সহ সবাই ছাতা নিয়ে রওনা দেয় স্কুলের মাঠে। তবে অনেক বৃষ্টির হওয়ার কারনে তাদের এগোতে কষ্ট হচ্ছিল। অতঃপর অনেক কষ্টে তারা স্কুলের মাঠে পৌঁছে আসেপাশে রাকুলকে খুঁজতে থাকে। অনেকক্ষন যাবত খোঁজার পরও তাকে পেল না । এদিকে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। স্কুল ছিল চারপাশে বিস্তৃত। এর সর্বশেষ কোনায় এক ছাউনীতে রাকুল বসে বসে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। জসীম রাকুলের বাবা-মা কে ডেকে এক কোণে ইশারা করে দেখানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু বৃষ্টির কারণে জসীমের কথা তারা শুনতে পেল না। শেষমেষ জসীম তাদের হাত দিয়ে ইশারা করলে তারা লাইট সামনে ধরে সেদিকে এগোতে থাকে। পরক্ষনেই রাকুল লক্ষ্য করে বড় বড় দুটো চোখ বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। সে একটু ঘাবড়ে যায়! আস্তে আস্তে যখন খুব কাছে চলে আসে সে ভয়ে চিৎকার করে উঠে,“মা…”। হঠাৎ তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। অন্ধকার আর নিস্তব্ধতা ছেয়ে আছে চারপাশ। হাঁপাতে হাঁপাতে চারপাশে চেয়ে দেখে শুধু অন্ধকার। বাপাশে হাত বাড়িয়ে লাইট অন করলো। কিছুক্ষণ হাঁপাতে হাঁপাতে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল। পাশের রুম থেকে কার আসার আওয়াজ পাচ্ছে সে। কিছুক্ষণ পর আওয়াজ টা দরজার কাছে এসে মিলিয়ে গেল। ওপার থেকে তার ছোটবেলার বন্ধু জসীম দরজা খুলে তার কাছে এসে তাকে জিজ্ঞাস করলো,” তুই আবার স্বপ্ন দেখেছিস বুঝি?” রাকুল “হ্যাঁ” বললে জসীম টেবিল থেকে পানির বোতলটা এনে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,”এবার না হয় বাড়ি গিয়ে ঘুরে আয়, ভালো লাগবে। সেই তো চাচাকে কে দেখতে গেলি প্রায় বছরখানেক হয়ে গেল। আমি বাড়ি গেলে চাচি-নানা সবাই তোর কথা জিজ্ঞেস করে। আমাকে তখন মিথ্যে বলতে হয়। আমি বলি কি, এবার না হয় সামনাসামনি সব জিজ্ঞেস কর,চাচিকে নিয়ে আয় “। রাকুল মাথা নিচু করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,” কাল ভেবে দেখা যাবে এখনও সময় হয়নি, আর তো মোটে কিছু বছর; এইটুকু না হয় অপেক্ষা করি”। একথা শুনে জসীম বললো,”তা যখন শুনবিই না, তখন আর বলে লাভ কি! তুই তাহলে শুয়ে পর আমি পাশের রুমেই আছি; প্রয়োজন হলে ডেকে নিস” এই বলে জসীম দরজা দিয়ে চলে গেল। রাকুল মাথা ঘুরিয়ে দেয়ালের ঘড়ির দিকে চোখ যেতেই দেখলো রাত তখন প্রায় দুটো বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। একটুখানি নিস্তব্ধ থেকে লাইট অফ করে শুয়ে পরলো। অনেকক্ষন হয়ে গেল, এপাশ-ওপাশ করার পরও তার ঘুম আসছে না। বিছানা থেকে উঠে গিয়ে রুমের মধ্যেই কতক্ষন পায়চারি করার পর বারান্দার এক পাশে টেবিলে গিয়ে বসলো। জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে বাইরের গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়তে দেখছে। চোখের এক কোণে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। পুরনো কিছু স্মৃতি আজও তাকে ভেতর থেকে যন্ত্রণা দিয়ে চলছে। সেসব স্মৃতি আজও তাকে ঘুমাতে দেয় না । আধো আলোতে সেসব কথা আজ তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে।মূলত রাকুল ছিল মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা-মায়ের একমাত্র আদরের সন্তান। তার বাবা বাজারে ছোট একটা মুদির দোকান চালাতেন। তা দিয়েই তাদের পরিবার চলতো। তার বাবার পরিবার মধ্যবিত্ত হলেও তার মা’র পরিবার ছিল সে গ্রামের সবচেয়ে ধনী পরিবার। তার মামারা ছিল সে গ্রামের প্রভাবশালী ব্যাক্তিবর্গ। রাকুলের নানা ছিল তাদের গ্রামের তিনবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান। রাকুলের বাবা-মা নিজেদের মধ্যে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু রাকুলের নানা তা মেনে নিতে পারেনি। কারন রাকুলের বাবা ছিলেন কৃষক পরিবারের সন্তান। তাই রাকুলের বাবা-মা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেন। রাকুলের নানার অমতে বিয়ে করার পর থেকে সে বাড়িতে যাওয়ার পথ তাদের জন্য চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। তবে রাকুলের মা-বাবার উপর রাকুলের নানার ক্ষোভ থাকলেও রাকুলকে তার নানা খুবই ভালোবাসতেন। বাজারে দেখা হলে এটা-সেটা কিনে দিতেন, বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে যেতেন, ঘুরতে নিয়ে যেতেন, সব মিলিয়ে নানা-নাতির মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। রাকুল ছোটবেলা থেকেই খুব চঞ্চল স্বভাবের ছিল। বন্ধুদের সাথে সারাদিন এক গ্রাম-অন্য গ্রাম ঘুরে বেড়াতো, গাছে ওঠা, সবাই মিলে বিলে গোসল করা সব মিলিয়ে সুখে-শান্তিতে জীবন যাচ্ছিল তাদের। তবে বিধাতার হয়তো অন্য কোন ইচ্ছাই ছিল। তার বয়স যখন তেরো বছর, তখন তার বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। গ্রামে ডাক্তার দেখানো হলেও তেমন ভালো ডাক্তার না থাকায় কেউ তার রোগ ধরতে পারলো না। জানা গেল, তার বাবা এক বিরল রোগে আক্রান্ত হয়ে পরেছে। গ্রামে কোন ভালো ডাক্তারের সাথে সাথে ভালো হসপিটালও ছিল না। গ্রামের এক ক্লিনিকে নিয়ে গেলে সবাই পরামর্শ দিল শহরে নিয়ে যেতে কিন্তু টাকা? টাকা কোথায় পাবে? ঘরের একমাত্র কর্মক্ষম মানুষটিই তো আজ বিছানায় পরে আঠে। চিকিৎসা তো অনেক খরচের বিষয়, এত টাকা তো তাদের কাছে নেই, কোন সঞ্চয়ও নেই। এভাবে দিন চলতে লাগলো, কিন্তু টাকার যোগান আর হলো না। এদিকে রাকুলের বাবার অবস্থারও অনেক অবনতি হলো। বিছানা থেকে উঠতে পারে না, কিছু মুখে তুলতেও পারে না। অনবরত শরীর ব্যাথায় চিৎকার করতে থাকেন। লোকটা যেন একটা জীবন্ত লাশ হয়ে পড়ে আছে। কোন উপায় না দেখে রাকুলের মা তার বাবার বাড়িতে গিয়ে তার কাছে টাকা চাইলে, তিনি তা দিতে অস্বীকৃতি জানান। এমনকি নিজের মেয়ে বলেও তাঁকে পরিচয় দিতে চাননি। রাকুলের মা তার বাবা ও ভাইদের পায়ে ধরে অনেক আকুতি মিনতি করলেও সেদিন কারও এতটুকুর জন্যও মন গলেনি। এমনকি তার ভাইয়েরা তার দিকে ফিরেও তাকায় নি। সেদিন শুকনো মুখ নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে আসতে হয়েছিল রাকুলের মাকে। কিছুদিন পর এভাবেই বিছানায় পরে থাকতে থাকতে রাকুলের বাবা তার জীবনের সবচেয়ে দামি শেষ নিঃশ্বাস টুকু নিয়ে ইহকালের মায়া ত্যাগ করলো। চোখের সামনে নিজের স্বামীর এমন বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু রাকুলের মা সেই যে নিজের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে এবং আজও সে একটি ঘরে বন্দি হয়ে পড়ে আছে। রাকুলের মামারা এসে তখন তার মা’কে ও তাকে নিয়ে গিয়েছিল।রাকুলের মাকে এক ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছে সেখানে তার চিকিৎসাও চলছে বটে, তবে চিকিৎসা দিয়ে কি আর ভালোবাসা ভুলানো যায়? রাকুল খুব ছোট থাকায় কিছু তখন কিছু বুঝতে পারেনি। সে অবুঝ শিশু আজ প্রায় ঊনত্রিশ বছরের যুবক। তার বয়স বাড়লো, সে সব বুঝতে শুরু করে এবং তাই এসব থেকে দূরে যেতে সতেরো বছর বয়সে তার বন্ধু জসীমের সাথে শহরে চলে আসে। এরপর সে তার নানা বাড়ি আজও যায়নি। এমনকি তাঁকে আদর করা তার নানার মৃত্যুতেও না। মনে সে বড্ড কষ্ট পেয়েছে। কে জানতো হয়তো ভালো চিকিৎসা পেলে হয়তো তার বাবা সুস্থ হয়ে উঠতো। সে আবারও বাবা বলে তাকে ডাকতে পারতো। রাত হলে বাড়ি ফেরার সময় তার জন্য চকলেট নিয়ে আসতো। রাতে বাড়ি ফিরে তাকে কোলে তুলে নিত, আবারও হয়তোবা সে বাবার পাশে ঘুমোতে পারতো। আজও তার বাবা রোজ তার স্বপ্নে আসে। তাকে রাকুল বলে ডাকে, সেই মায়াভরা মুখখানি আজও তার চোখের সামনে ভেসে উঠে প্রতি মূহুর্তে। অনেক বছর পেরিয়ে গেছে এখন সে একটি ভালো মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করছে, তার স্বপ্ন সে একজন ভালো ডাক্তার হবে এবং একদিন সেই গ্রামে ভালো হসপিটাল দিবে। যেন কেউ আর টাকার অভাবে তার বাবার মতো বিনা চিকিৎসায় মারা না যায়।আজও সে সেই স্বপ্ন দেখে, তার বিশ্বাস স্বপ্ন মানুষকে বড় হতে সাহায্য করে। তাই সে তার স্বপ্নে বিভোর হয়ে ছুটে চলছে, তাকে পূর্ণতা দেওয়ার আশায়। রাকুল তার স্বপ্ন পূরণ করবেই অন্যের বাবার জন্য হলেও, যাদের মধ্যে সে তার মৃত বাবাকে দেখতে পাবে। তার মা’কেও ওই বাড়ি থেকে নিয়ে আসবে। এটিই তার স্বপ্ন, এবং এটিই তার লক্ষ্য।

0211 মোঃ ফেরদৌস হোসাইন নাঈম new writer
শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়