fbpx

জানুয়ারি ২১, ২০২৫

আটচালা

দুটো শাল গাছের ছায়ায় অটল নানার  আটচালা ; উত্তরদিকটায় লেবুর চারা লাগিয়েছেন রহিমা বেগম। আর মেহেদী গাছের পাশেই তার রসুই খানা। বারান্দার সামনের খালি জায়গায় দিব্যি ঝুলে আছে পুইঁশাকের মাছা। তন্মধ্যেই রহিমা বেগম হকচকিয়ে উঠলেন মিনুকে দেখে৷ আদরের মিনু তারঁ বত্রিশখানা দাঁত বের করে উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। এই আটচালা তার বহু আবেগের জায়গা৷ এ আবেগ মখমলে চাদরের মতো জড়িয়ে আছে মিনুর গোটা জীবন। আটচালার ফাঁকে বৃষ্টিস্নাত জানালার শিকলের শিশির, কুয়াশাজগল্পঃ আটচালা

 ~মেহরীন

 সাল ২০১২। হেমন্তের তপ্ত দুপুরে সুয্যিমামার কি নিদারুণ ঝলসানি। শরীরের চামড়া বিদীর্ণ হবে হবে প্রায়। আশেপাশে লোকবহরের সংখ্যাটা আদতে ঠাহর করা যাচ্ছে নাহ। নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নের চিরচেনা শ্বাশত রূপ যাকে বলে। বৃক্ষরাজির ডালে নিদ্রাচ্ছন্ন বিছানার স্বাদ নিচ্ছে পক্ষিরা। গৃহস্থের উঠোনে নবান্নের ধুম লেগেছে৷ বাঙালিয়ানা ভোজের আদ্যোপান্ত শেষ করে কর্তা গিন্নিরাও ঝিমুচ্ছে। মহেশখালী পাড়ার  নবান্নের গুটিকয়েক মধ্যাহ্নের নিত্যদিনের চিত্র এসব। মেঘনার পলিমাটিতে গড়ে ওঠা একটা ছোট্ট জনপদ এই মহেশখালী। সাহিত্যের কাব্যিক রস সাধনার উদ্দেশ্যে তাকে ছোট সম্বোধন করা আদতে মেঘনার উত্তর-পশ্চিম, পূর্ব-দক্ষিণ কোনো কিছুতে কস্মিনকালেও মহেশখালীর ছিটেফোঁটাও নাই। মহেশখালী মূলত ছদ্মনাম৷ এককালে বারো ভূইয়ার নেতা ঈসা খাঁ এর ব্যবসা বাণিজ্যের রাজধানী ছিলো এখানে…. উল্লাসকর দত্তের বাড়ির ধ্বংসাবশেষের নামমাত্র দেখা মেলে।  বিখ্যাত ক্ষুদিরাম বসুর নানাবাড়ি এই মহেশখালীতেই। মহেশখালীর মধ্যভাগে বালুর চরের পূর্বদিকেই মিনুর বাড়ি। তপ্ত মধ্যাহ্নে ঘড়ির কাটা ৩টার স্টেশনে থামলো প্রায়। শুধু থামছে নাহ মিনুর দুরন্তপনা গতি। কখনো বাইসাইকেল আবার কখনো এ গতি লাগামহীন ঘোড়া। চোখের চাহনি  এখন তার সন্ধ্যার হারিকেন; যে হারিকেন একসের তেলে পরিপূর্ণ… দহনের প্রারম্ভ মাত্র তার৷ মিনুর চোখদুটোতেও এখন লেলিহান শিখার ন্যায় এক শিহরণমূলক উত্তেজনা ; তাকে যেতে হবে দু মাইল পথ। পেছনে দৃষ্টি ফেলার অবকাশ নেই তার। লাগামহীন ছুটে চলার কোনো এক অন্তে এসে মিনু ভাবতে বসলো এই বুঝি তার মা পেছনে সুদীর্ঘ লাঠি হাতে তাড়া করবে তাকে। শিমুল তুলোর ওম জড়ানো বালিশের ঘুম পরিত্যাগ করে স্টিমরোলারের মতো টগবগ করে দৌড়ে বেড়ানোর শাস্তিসমেত ১০ খানা বেতের বাড়ি ছাড়া আজ তার রক্ষে নেই। তাই যত দূর দিগন্তবিস্তৃত খোলা মাঠ ; দৃষ্টি তার সেই পানেই৷ গন্তব্য তার মাধু জমিদারের বাড়ি। মিনুর নানা আজাদ মিয়ার মরহুুম বাবার নাম মাধু জমিদার। ছোট থেকেই মিনু সগর্বে অবহিত তার নানাবাড়ি এককালে জমিদারের অবাধ বিচরণস্থল ছিলো৷ গোলা ভরা ধান, গোয়ালভরা গরু। বাড়ির পশ্চিমপাশে সুদীর্ঘ বহমান দীঘি।পশ্চিমে রবির সোনালি কিরণ দীঘির ফেনার সজল আস্তরণে খেলা করে। পথিমধ্যে হলুদ অলকানন্দা কুড়ায় মিনু। মিনুর ফুল খুব পছন্দের। অন্যসবাই কাঠের ঘোড়া,রঙছটা হাঁড়িপাতিল, ম্যাজিক বল দিয়ে খেললেও মিনুর খেলার সাথী ফুল-পাতা। কোঁচ ভর্তি করে অলকানন্দা নিয়ে রওনা দেই সে। মারওয়ার জন্যও ভর্তি করে ফুল নিয়েছে মিনু। মারওয়া হলো মিনুর মামাতো বোন। বড় মামার তিন সন্তান। মারওয়া, সাফওয়ান আর মাহনাজ। ঘন্টার কাটাঁ ৫ এর ঘর পেরোলে রবির লাল আভার পর্দা ধোলাতে ধোলাতে হাজির হয় তার প্রিয় নানাবাড়ি। বাড়ি থেকে পালিয়ে অবশেষে প্রিয় গন্তব্য। কলাবাগান পেরিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে সুউচ্চ ড়ানো সকাল, দীঘির স্বচ্ছ জল, বাড়ির উঠোনের শেষপ্রান্তে বড়ই গাছ, নলকূপের গভীর জল শুষে নেয়া একটা হলদিয়া উঠোন সবই মিনুর হৃদয় নিঙড়ানো আবেগ। হলদিয়া উঠোনে শীতলপাটি বিছিয়ে তারাদের অধিকৃত আকাশ দেখা আর রহিমা বেগমের হাতের বানানো তেলে ডোবানো গোলগোল্লা (আর্বানরা যাকে বনরুটি বলে) সবই মিনুর জীবনের এক জীবন্ত সাতকাহন। দীঘির উত্তর-পশ্চিমে দিব্যি  দাঁড়িয়ে আছে মস্ত বটগাছটা, সাদা বকের ঝাঁক উড়ে যায় বাড়ির পেছনে।গ্রামের ছেলেপুলেদের ঘুড়ি উড়ানোর প্রাণপিয় জায়গা এই বটগাছের পাটাতন। রাতের বেলা হলদিয়া উঠোন ছেয়ে যায় জোনাকির সবুজ আলোয়৷ কাঠের দরজার পাশের কোনায় জ্বলতে থাকে একখান লালবাতি।

 সালটা ২০২৪। দেখতে দেখতে গত হয়েছে একযুগ। এই এক যুগে সূর্যকে পৃথিবী গুটিকয়েকবার প্রদক্ষিণ করে আবার ফিরে এসেছে নিজের অবস্থানে।শুধু ফিরে আসেনি মিনুর শৈশব। বসন্ত এসেছে ; চলেও গেছে৷ আটচালা ভিজেছে কতশতবার ঝুমবৃষ্টির কণায়। আটচালার পরতে পরতে ধরেছে ঝং। হলদিয়া উঠোনে পড়েছে মিলিয়ন মৃত্তিকার আস্তরণ ; মস্ত উঠোনটা সংকীর্ণ মৃতপ্রায়। শীতলপাটি পড়ে আছে নিভৃতে যত্নে রাখা টিনের সুটক্যাসে।ম্লান আলোয় হারিকেনের অন্তময় দহনের মতোই শেষ হয়ে গেছে একটা জীবন্ত শৈশব। শিলাবৃষ্টির ন্যায় ঝড়ে পড়েছে সব ।  কৈশোরের আড়ালে জীবন্মৃত হয়ে আছে নারিকেলপুলি আর পাটিসাপটার স্বাদ, সন্ধ্যার ব্যাটমিন্টন। কানামাছির কাপড়ে চোখ বেঁধে আছে শৈশবের প্রিয় আটচালাখানা। একযুগ পর মিনু দিব্যি ঠাঁই দাঁড়িয়ে বার্ধক্যে শুকিয়ে যাওয়া বড়ইগাছটার নিচে। মার্বেল আকৃতির চোখদুটো তাকিয়ে আছে প্রিয় আটচালার দিকে। কাঠের দরজার খিলে মরিচা পড়ে যাওয়া তালা ঝুলছে। এই ক্ষয়ে যাওয়া তালা রাক্ষসের মতো গিলে খেয়েছে দুরন্তপনা শৈশবের একশো আটখান স্মৃতি। জঙ্গল আর বুনো লতায় ছেয়ে গেছে চারিধার। স্বর্গীয় বাগানখানা আজ নিস্তব্ধ শ্মশান যেথায় কাফনের মোড়কে দাফন হয়েছে গোটা একটা যুগ৷ নিমিঃশেষ হয়ে আছে বিলি কেটে দেয়া রাতের ঘুম, বিকেলের কানামাছি কিংবা কোনো এক জুম্মার দিনের চড়ুইভাতি। ডাবর চোখদুটো সিক্ত হয় পরক্ষণেই। হয়তো কোনো এক চৈত্রের দুপুর এসে চুরি করেছে সব ; সওদা করেছে কোনো হাটে। একটা শান্ত বাতাস ভেদ করে যায় মিনুর ছাতি। এ বাতাস যেনো রহিমা বেগমের ওম জড়ানো শীতল হাতের মাখানো আদর। মিনু ঘুরে তাকায় পিছুটানে। এই বুঝি নানুমণি হেঁকে বসবেন ” কিরে  এলি তুই! কতদিন দেখিনা তোকে”, তারপর জড়িয়ে ধরবেন প্রাণপণে। পরক্ষণেই ভ্রম ভাঙে মিনুর৷ সে বুঝতে পারে পড়বেনা কারো পায়ের চিহ্ন এই ঘাটে……………

0512 Faria writers photo
শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়