মে ১৩, ২০২৫

সাঁইত্রিশ নম্বর কবুতর

ঘড়ির কাঁটা সন্ধ্যা আটটার স্টেশনের হাঁক দিচ্ছে। সায়াহ্নের অস্তমিত আলোর পরশে প্লাটফর্মের আদ্যোপান্ত ঝিকঝিক করা শুরু করেছে সেই দু’ঘন্টা আগেই। আশেপাশে মৃদুমন্দ হাওয়া তালগোল পাকিয়ে ছাতি ভেদ করার উপক্রম। আট দশটা দিনের মতো আজকেও উপচে পড়া ভিড়। বছরের এই সময়টায় প্লাটফর্মগুলোতে আসা মানুষগুলো কালো পিঁপড়ার আকার ধারণ করে। পিলসুজে জোছনার পিদিম আর বাঁকা চাঁদের হাসি লাস্যময়ী হয়ে ধরা দিচ্ছে। তাও মানুষগুলো থামছেনা। ছুটছে নিরন্তর নাড়ির টানে; ঘরে ফেরার দায়ে। আমিও ফিরছি কোনো এক টানে, মায়ায়। বলা যায় বাড়ির উঠোনের জালালি কবুতরের মায়ায়।আদতে সবচেয়ে প্রিয় সেই সাইত্রিশ নম্বর কবুতরটার মায়ায়৷

চট্টলার এক্সপ্রেস আসতে এখনো আধঘন্টা বাকি৷ বরাবরের মতো এবারও সে ব্যাকবেঞ্চার। ঠিক সময়ে আসার অদ্যাবধি ইতিহাস আমার অবশ্য জানা নেই। কস্মিনকালে ছিলও নাহ৷ যাই হোক আমি লাবণ্য। নামটা আব্বার রাখা। বোধহয় উনার রবীন্দ্রনাথ এর শেষের কবিতা খুব পছন্দের তাই সেই চরিত্রেই কন্যার নামকরণটা তিনি সেরেছেন৷ আব্বার আরও পছন্দের জিনিস আছে। এই যেমন: গোমতী নদীর চর, সন্ধ্যার শীতলপাটি, আধভাঙ্গা সাইকেল, স্পোরাডিক রেইন, নয়নতারা, একটা বাতা শালিক আর পিতামহীর ভিটেখান। সেইবার বলে দিয়েছিলেন ঢাকা থেকে আসার সময় নয়নতারা নিতে নার্সারি থেকে। তাই আমিও বেছে বেছে চারটে নয়নতারার চারা নিয়েছি এবার। দেখলে খুশিতে আকাশ ভেঙে পড়বে তার। ঈদের ছুটির একটা ঝামেলা হলো তল্পিতল্পা গুছিয়ে বাড়ি যাওয়া যায় নাহ। কোনোরকম প্রাণে বেঁচে নাড়ির টানে বাড়ি যাওয়া। আড়মোড়া ভেঙে ঘুমঘুম চোখে টের পেলাম ব্যাকবেঞ্চার সাহেব এটেন্ডেন্স দিচ্ছেন। ব্যস্ হাঁকডাক শুরু বগিতে ওঠার। কপাল গুণে পেলাম উইন্ডো সিট৷ ভালোই হলো বসন্তের হিমেল হাওয়ায় নিশ্চিন্তে ট্রেন যাত্রা উপভোগ করতে করতে স্বপ্ন আজ বাড়ি যাবে।

কানে বেজে চলেছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গান। একটা নীল পর্দার ওপারে আমি দেখছি নিস্তব্ধতা কত ভয়ংকরভাবে ডুবে গেছে অন্ধকার দিগন্তের আড়ালে৷ হুশ ফিরলো পাশের এক দম্পতির কথোপকথনে। ভদ্রলোক -ভদ্রমহিলা ঢাকা থেকে ফিরছেন ঈদের শপিং করে। অবশ্য আমিও আব্বার জন্য টিউশনির টাকা জমিয়ে একখান সাদা পাঞ্জাবি কিনেছি। মানুষটার ইদানীং সাদা রং পছন্দের। সাদা রঙ ঘাড়ে ভূত হয়ে বসেছে তার। মানাবেও খুব। পড়লে মনে হবে আব্বা যেনো আতর মেখে এক আস্ত ধবল বেলীর বাগান হয়ে বসে আছেন। ঘন্টা তিনেক পর ফিরলাম চেনা স্টেশনে৷ হৃদয় নিঙ্ড়ানো একটা জায়গা। কতদিন পর ফিরলাম!

তবুও ছোট্ট হৃদয়ে কোথাও একটা টান পড়তেছে। মনে হচ্ছে কারো বিনে সুতোর টানে পুতুল নাচের মতো দুলে ওঠছে হৃদয়। আব্বা দেখলেই বলবেন: “এতদিনে আসার সময় হলো! কাল ঈদ আর তুই পাড়ি জমালি আজ।” অভিমানে আহ্লাদে আটখান মুখটা কালো করে কিছুক্ষণ বকেও বসবেন। ব্যাগ-বস্তা সব নিয়ে উঠে পড়লাম তিন চাকার গাড়িতে। স্টেশন থেকে তিন কিলোমিটার পথ। এ শহরের বাতাসের প্রত্যেকটা ধূলিকণা ততক্ষণে নস্টালজিয়া হয়ে চোখের সামনে জলছবি আকঁছে৷ ডাগর চোখে পানতোয়ার মতো ভেসে আসছে স্মৃতি৷ মিনিট দশেক এর মত চোখদুটো বন্ধ করে এলোচুলে নীরব শহরটাকে অনুভব করছিলাম৷ নিকোটিন গিলে খাওয়া ফুসফুসটা অনেকদিন পর নির্মল বাতাসের ঘ্রাণ পাচ্ছে। হুট করেই টের পেলাম রিকশা ঠাকুরবাড়ির মোড়ে পৌঁছে গেছে।

রাত তখন বারোটার কাঁটায়৷ নির্মলা এসে দরজা খুলে দিয়ে গেছে৷ আমাকে দেখে বেচারার ততক্ষণে চক্ষু চড়কগাছ৷ উঠোনে পা ফেলতেই নাকে কড়া করে হাসনাহেনার ঘ্রাণ এসে লাগলো৷ উঠোনে দাঁড়িয়ে লালবাতির আলোয় বাড়িটাকে দেখছি৷ কতদিন পর ভিটেমাটির ঘ্রাণ৷ ভেবেছিলাম এসেই আব্বাকে হাঁক দিবো। কিন্তু অতন্দ্র রজনীর নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটাতে মন সায় দিলো নাহ। ব্যাগপত্তর রেখে ফ্রেশ হয়ে চেয়ার নিয়ে রোয়াকে বসলাম৷ আজ রাতটা জ্যোৎস্নার আলোতেই কাটিয়ে দেবো। দক্ষিণ-পূর্ব দিকের রুমে আম্মা নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছেন। আব্বাও ঘুমাচ্ছেন কিন্তু তার ঘুমটা সাড়ে তিন হাত মাটির ছোট্ট ঘরটায়। একই জ্যোৎস্নার চাদরের নিচে আমি আর আব্বা। উঠোনের ওপারে পুকুরঘাট পেরিয়ে পূর্বদিকে আব্বার ঘর৷ আচ্ছা আব্বা কি জেগে আছেন? বোধহয় নাহ! জ্যোৎস্নার আলো কি চিকন রেখা হয়ে আব্বার কবরের মাটি ফাকঁ করে ঢুকে পড়ে? সকাল হলেই কবরের চারকোণায় ঢাকা থেকে আনা চারটে নয়নতারা গুজে দিয়ে আসবো। এটাই অভিমান ভাঙানোর পায়তারা। আমার আব্বা সাঁইত্রিশ বছর বয়সেই উড়ে গেছেন কবুতর হয়ে; যে উড়ানে ফিরে আসার পিছুটান নেই। বানের জলের মতো ভেসে গেছে সব। শুধু পড়ে আছে কর্দমাক্ত হৃদয়ে একটা পাখি, শান্ত পাখি, আমার সাঁইত্রিশ নম্বর কবুতরখানা। হুট করেই ভোরের আলো এসে ঝলক দিলো চোখে। সকাল হয়েছে। একটু পর মহাধুম। চেয়ার গুছিয়ে উঠে আসতেই মনে হলো আব্বা দূর থেকে ডেকে বলছেন “আমার জন্য সাদা পাঞ্জাবি আনতে গেলি কেন? আমার তো দিব্যি সাদা কাফনটা আছে৷ এবছরও এটা দিয়ে কোনোরকম চালিয়ে দেবো না হয়!”

0512 Faria writers photo
শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়