জ্ঞানতাপস বৈচিত্র্যময় প্রতিভার অধিকারী ড. কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন অধ্যবসায়ী ও সময়ানুবর্তী। ১৯৭৬ সনের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ১৯৮২ সনের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের ছাত্র থাকার সুবাদে ড. কাজী মোতাহার হোসেনের সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছিলো আমার বহুবার। বিশেষ করে বিভাগীয় বিভিন্ন ধরনের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, অভ্যন্তরীণ ও আন্তঃ বিভাগীয় বিভিন্ন খেলাধুলা ও ক্রীড়ানুষ্ঠান আয়োজনও সমন্বয় করে থাকতাম আমি। তাছাড়া প্রতিবছর বনভোজনের আয়োজনও করতাম। ঐ সময় অনেকেই আমাকে বলতো,”ফরহাদ, এতো দিকে মনোনিবেশ না করে, এতো সমাজ সেবা না করে ‘নিজের চরকায় তেল দাও’, পড়াশুনা করো নিজের লাভ হবে। “আমার বন্ধুরা বলতো, “যে তেল দেয় সে চরকা পেলেই তেল দেয়, নিজ-পরের চরকার বাছবিচার করে না। ফরহাদের স্বভাব চরকা দেখলেই তেল দেয়া, নিজের খেয়ে বনের মোষ তারানো, ওকে ওর পথ থেকে সরানো যাবে না। “যাই হোক এই চরকায় তেল দেয়ার পর্যায়েই বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজক হিসেবে ড. কাজী মোতাহার হোসেনের সংস্পর্শে আমার আসা হয় বহুবার। আমাদের বিভাগের তিনজন ছাত্র এবং একজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের আত্মদান রয়েছে ১৯৭১ সনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে, তাদের অন্যতম হচ্ছেন শহীদ লেঃ আসফাকুস সামাদ, যিনি একজন অনারারি লেফটেন্যান্টও হয়েছিলেন। আমার পরিসংখ্যান বিভাগের ছাত্রত্ব লাভের পূর্বেই আমাদের অগ্রজরা শহীদ লেঃ আসফাকুস সামাদের নামে বিভাগীয় একটা অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার বাবস্থা করেছিলেন এবং প্রতিবছর নিয়মিত এ অনুষ্ঠানটি হতো। আমি যখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্র সে বছর ঐ অনুষ্ঠানটির সাথে আরও দু’টি অনুষ্ঠান সংযোজনের ব্যবস্থা করি তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান সৈয়দা রিজিয়া বেগম ম্যাডামের অনুপ্রেরণায় ও সহযোগিতায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সহায়তায়। এ দু’টি অনুষ্ঠান হচ্ছে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রথম প্রস্তাবক শহীদ স্বপন কুমার চৌধুরীর নামে বিতর্ক প্রতিযোগিতা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধভিত্তিক শহীদ মুনিরুজ্জামান রচনা প্রতিযোগিতা। আমি জানি না এ অনুষ্ঠানগুলো পরিসংখ্যান বিভাগে এখনও নিয়মিত হয় কি না? উল্লিখিত অনুষ্ঠানগুলোর পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আমরা সবসময় প্রধান অতিথি হিসেবে মনোনয়ন ও গ্রহণ করতাম ড. কাজী মোতাহার হোসেনকে।বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, এমনকি কখনও কখনও মন্ত্রীও যদি অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেন তবুও প্রধান অতিথি হিসেবে মনোনীত হতেন ড. কাজী মোতাহার হোসেন। শহীদ সমাদ স্মৃতি টুর্নামেন্টের বিজয়ীদের সনদপত্রে প্রধান অতিথি হিসেবে সর্বদা স্বাক্ষর থাকতো ড. কাজী মোতাহার হোসেনের এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে স্বাক্ষর থাকতো শহীদ লেঃ আসফাকুস সামাদের পিতার। কাজী স্যারকে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে দাওয়াত দেয়ার জন্য তাঁর সেগুনবাগিচার বাসায় যাওয়ার দায়িত্বটা থাকতো সর্বদা আমার উপর। যখনি বাসায় তাঁকে দাওয়াত দিতে যেতাম তখনি দেখেছি পরিসংখ্যান বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শুনলেই তিনি বিচলিত হয়ে উঠতেন। কাজী স্যার ঐ সময়ে কানে কম শুনতেন, তাকে অনুষ্ঠানের কথা বুঝাতে বেশ একটু বেগ পেতে হতো কিন্তু যদি একবার বুঝাতে পারতাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অনুষ্ঠান এবং তাকে সেখানে যেতে হবে তারপর আর কোন ভাবনা ছিলো না, যথাসময়ে তিনি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতেন, কোনদিন অনুষ্ঠানে এক মিনিট বিলম্বেও পৌঁছাতেন না। এমনকি সে সময় তার বয়স ছিলো আশি বছরের মতো,তবুও তিনি পরিসংখ্যান বিভাগের চার তলায় উঠতে মোটেও দ্বিধা করতেন না। সিংহভাগ সময়েই আমি তার এই ক্ষুদ্র সফরের সফরসঙ্গী হিসেবে থাকতাম। আমরা সাধারণত অনুষ্ঠান শুরুর যে সময়সূচী স্থির করতাম কাজী স্যারকে সময় দিতাম তার চেয়ে কমপক্ষে আধা ঘণ্টা পরে, কারণ তিনি অনুষ্ঠানে বিলম্বে আসতেন না এবং অন্যদের জন্য অনুষ্ঠান বিলম্বে শুরু হোক তিনি তা মোটেও পছন্দ করতেন না।
সেবার ১৯৮২ সনের মধ্যভাগে কোন একটা সময় টিএসসি অডিটরিয়ামে আমাদের বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের নির্বাচিত সংসদের অভিষেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। আমি ঐ সংসদের নির্বাচিত ভীপি, কাজী মোতাহার হোসেন স্যার প্রধান অতিথি আর কাজী ফজলুর রহমান তখন সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)-এর সচিব, সৈয়দা রিজিয়া বেগম ম্যাডাম বিভাগের চেয়ারম্যান। কাজী স্যারকে দেয়া নির্ধারিত সময়ে তিনি এসে উপস্থিত। অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি কাজী ফজলুর রহমান সাহেব তখনও অনুষ্ঠানস্থলে এসে পৌঁছাননি। আমিতো ভয়ে ঘামছি কখন কাজী স্যার বেঁকে বসেন। দু’মিনিট যেতে না যেতেই তিনি আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন অনুষ্ঠান শুরু করতে বিলম্ব হচ্ছে কেন? আমি ভয়ে ভয়ে বললাম কাজী ফজলুর রহমান সাহেব অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি, তিনি রাস্তায় যানজটে পড়েছেন, তার আসতে দশ মিনিট বিলম্ব হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। কাজী ফজলুর রহমান সাহেব কাজী স্যারের প্রিয় ছাত্রদের একজন। কাজী স্যার বিরক্তির সাথে বসে রইলেন, ঠিক দশ মিনিট পরে তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করার জন্য রওয়ানা দিলেন। তাঁকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেও কোন অবস্থাতেই তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে বিরত করতে পারলাম না। আমার তো মাথায় বাজ পরার উপক্রম, পুরো অনুষ্ঠান পণ্ড হতে চলেছে । চেয়ারম্যান ম্যাডাম, আমি আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করলাম কিন্তু আমাদের সকল প্রচেষ্টা পণ্ডশ্রম, আমরা কাজী স্যারের পিছু পিছু হাঁটছি আর অনুনয়-বিনয় করছি কিন্ত তাকে নিবৃত্ত করতে পারছি না। ইতিমধ্যে কাজী স্যারসহ আমরা সবাই যখন টিএসসি-এর গেইটে এসে উপনীত হলাম তখন দেখি কাজী ফজলুর রহমান সাহেব গাড়ী থেকে নেমে এগিয়ে আসছেন। আমার ধরে প্রান ফিরে পেলাম এবার বুঝি বাঁচা গেলো, কাজী স্যারকে ফিরিয়ে নেয়া যাবে। কাজী ফজলুর রহমান সাহেব কাজী স্যারের পায়ে ধরে সালাম করলেন এবং তাঁর স্বল্প সময় বিলম্বের জন্য ক্ষমা চাইলেন। কিন্তু না! কাজী মোতাহার হোসেন স্পষ্ট বলে দিলেন সময় সম্বন্ধে যারা সচেতন নয় তাদের সাথে আমার কোন অনুষ্ঠান করা নয়। তিনি ঠিক চলে গেলেন। আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আশ্চর্যজনক ড. কাজী মোতাহার হোসেনের সময়ানুবর্তিতা।
অধ্যাপক ড. মোঃ ফরহাদ হোসেন
প্রো-উপাচার্য,জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সেশনঃ ১৯৭৬-৭৭
- This author does not have any more posts.