বিদ্রোহী কবি নজরুলের “প্রিয় মতিহার” বেঁচে আছেন কবির সৃষ্ট সাহিত্য, কবিতা ও পত্রে। আবার কবির এই প্রিয় বন্ধুটিই সকলের অতি শ্রদ্ধেয় বাংলাদেশে পরিসংখ্যানের পথিকৃৎ। আমাদের প্রিয় “পরিসংখ্যান বিভাগ” তারই পরিশ্রমের ফসল। কিন্তু আমরা যারা এই বিভাগে একসময় ছিলাম বা বর্তমানে অধ্যয়ন করছি- কয়জনই বা এই প্রথিতযশা বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, ক্রীড়াবিদ, শিক্ষাবিদ, পরিসংখ্যানবিদ ড. কাজী মোতাহার হোসেন সম্পর্কে জানি!
১৮৯৭ সালের ৩০ জুলাই কাজী গওহরউদ্দিন আহমদ এবং তাসিরন্নেসার ঘরে জন্মগ্রহণ করেন কালজয়ী এই পুরুষ। শৈশব কেটেছে পৈতৃক নিবাস ফরিদপুর জেলার পাংশা উপজেলার বাগমারা গ্রামে। শিক্ষাজীবন শুরু হয় মাতুলালয় কুষ্টিয়ায় (বৃটিশ ভারতের নদীয়া জেলায়।) কাজী মোতাহার হোসেন ১৯০৫ সালে নিম্ন প্রাইমারী এবং ১৯০৯ সালে উচ্চ প্রাইমারী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ছোটবেলাতেই বিজ্ঞানের প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল তাঁর। শুধুমাত্র তাঁর জন্যই তাঁর স্কুলটিতে “মেকানিক্স” বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। তিনি ১৯১৫ সালে কুষ্টিয়া হাই স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন।
কলকাতার ‘প্রেসিডেন্সী কলেজ’ -এ ভর্তির মাধ্যমে তাঁর কলেজ জীবন শুরু হয়। এখানে তিনি শিক্ষক হিসেবে পান প্রফুল্ল চন্দ্র রায় (রসায়ন) -কে যিনি তাকে সারাজীবন প্রভাবিত করেন। তবে পরবর্তীতে কলেজ পরিবর্তন করে চলে আসেন ‘রাজশাহী কলেজ’ -এ এবং এখান থেকেই ১৯১৭ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ঢাকা কলেজ থেকে ১৯১৯ সালে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স সহ বিএ এবং ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিশেষ কৃতিত্বের সাথে এমএ পাশ করেন।
ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায়ই তিনি ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ডেমনেস্ট্রেটর হিসাবে এবং পরবর্তীতে ১৯২৩ সালে একই বিভাগের সহকারী প্রভাষক হিসাবে নিয়োগ পান। পদার্থবিজ্ঞানের পাশাপাশি তিনি পরিসংখ্যান বিষয়ে ব্যাপক উৎসাহ বোধ করেন। ১৯৩৮ সালে ‘ভারতীয় পরিসংখ্যান ইন্সটিটিউট’ থেকে পরিসংখ্যানে ডিপ্লোমা ডিগ্রী লাভ করেন এবং একই সাথে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে এমএ ডিগ্রী অর্জন করেন। পরিসংখ্যানে ডিপ্লোমা করার সময় তিনি অধ্যাপক মহলানবীশের সান্নিধ্য লাভ করেন। কাজী মোতাহার হোসেন নিজ উদ্যোগে ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যানে পিএইচডি লাভ করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ‘Design of Experiments’ । তাঁর প্রবর্তিত ’Hussain’s Chain Rule’ আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত।
১৯৫১ সালে তিনি পরিসংখ্যান বিভাগের একজন রিডার ও ১৯৫৪ সালে অধ্যাপক হন। তিনি ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করলেও ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসাবে কাজ করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘পরিসংখ্যান গবেষণা ও শিক্ষণ ইন্সটিটিউট’ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তিনি প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে অনারারী অধ্যাপক ( Professor Emeritus) হিসেবে নিয়োগ দেয়। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘জাতীয় অধ্যাপক’ হিসাবে সম্মানিত করে এবং আমৃত্যু তিনি এই পদটি অলংকৃত করেছেন।
১৯৬৪ সালে পাকিস্তান সরকার কাজী মোতাহার হোসেনকে ‘সিতার- ই- ইমতিয়াজ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি ১৯৬৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরষ্কার এবং ১৯৭৯ সালে স্বাধীনতা পুরষ্কার লাভ করেন। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান ও কলা বিষয়ে অবদানের জন্য তাঁকে ডি.এস.সি. সম্মান প্রদান করে।
কাজী মোতাহার হোসেনকে শুধু বিজ্ঞানী বা পরিসংখ্যানবিদ হিসাবে বিবেচনা করলেই হবে না। তিনি ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক, ক্রীড়াবিদ এবং সংগঠক।
তিনি খুব ভালো ফুটবল খেলতেন। বাংলাদেশে দাবা খেলার পথিকৃৎ তিনি। ১৯২৯ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত অবিভক্ত বাংলা ও পূর্ব পাকিস্তানে দাবাড়ু হিসেবে এককভাবে চ্যাম্পিয়ন ছিলেন তিনি।
কাজী মোতাহার হোসেন বিজ্ঞান, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উপর অনেক বই ও প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর রচিত বইগুলোর মধ্যে রয়েছে- সঞ্চায়ন, নজরুল কাব্য পরিচিতি, সেই পথ লক্ষ্য করে, সিম্পোজিয়াম, গণিত শাস্ত্রের ইতিহাস, আলোক বিজ্ঞান, নির্বাচিত প্রবন্ধ ইত্যাদি।
তিনি ভাষা আন্দোলনের একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। শিক্ষার সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর দাবিতে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তিনি বক্তৃতা, বিবৃতি ও প্রবন্ধ ইত্যাদি প্রকাশ করে এ আন্দোলনকে গতিদান করেছেন। বাঙালির ৬ দফা আন্দোলনের একজন বলিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন। তিনি বাংলা বানান ও লিপি সংস্কার কমিতির সদস্য ছিলেন। ১৯৫৭ সালে তিনি মাওলানা ভাসানী আয়োজিত ‘কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলন’ -এ সভাপতি হন।
১৭ জানুয়ারি ১৯২৬ সালে অধ্যাপক আবুল হোসেন, কাজী আব্দুল ওয়াদুদ, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, আব্দুল কাদির, আবুল ফজল প্রমুখ ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ নামে যে সংগঠন গড়ে তোলেন তার অগ্রভাগে ছিলেন ড. কাজী মোতাহার হোসেন। ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ নামে তাঁরাই প্রথম মুসলিম শিক্ষিত সমাজে মুক্ত বুদ্ধির চর্চায় উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াস নেন। তিনি এই সংগঠনের পক্ষে ‘শিখা’ নামক পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তিনি ‘বাংলা একাডেমী’-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।
অন্যান্য ক্ষেত্রের মত ব্যাক্তি ও পারিবারিক জীবনেও কাজী মোতাহার হোসেন সফল ও সুখী ছিলেন। এই মানুষটি রেখে গেছেন কৃতী চার পুত্র ও সাত কন্যা। তাঁর কন্যা সানজিদা খাতুন খ্যাতনামা গবেষক, শিক্ষাবিদ এবং রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী এবং পুত্র কাজী আনোয়ার হোসেন একজন লেখক, অনুবাদক, প্রকাশক ও জনপ্রিয় ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের স্রষ্টা।
বহুবিধ প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটি ১৯৮১ সালে ০৯ অক্টোবর তাঁর কর্মময় জীবন থেকে চিরবিদায় নেন। প্রগতিশীল, বুদ্ধি ভিত্তিক, বিজ্ঞান মনস্ক সমাজ গড়ে তোলায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। অসামান্য কৃতী পুরুষ ড. কাজী মোতাহার হোসেন যুগে যুগে আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন।
প্রাক্তন শিক্ষার্থী
পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সেশনঃ ১৯৯৯-২০০০
- This author does not have any more posts.