fbpx

একটি ফোন কলের জন্য…

সময়টা ২০২০ সাল, স্বপ্নে বিভোর দুটি চোখ ভার্সিটির গন্ডিতে যাবার আড়াই মাসের মাঝেই করোনা আঘাত করে আমাদের জীবনে। অনেক কিছুই স্থবির হয়ে যায়, পাল্টে যায় আমাদের জীবনের গতি। আজ ২০২৪ এ দাঁড়িয়ে এসব বলারই বা কি প্রয়োজন? কোনো প্রয়োজন নেই আসলে, কিন্তু এই অপ্রয়োজনীয় বচনে আমি আমার দৃষ্টিতে একজন অনেক ভালো মানুষ; অনেক ভালো শিক্ষক- তসলিম স্যারের এর কথা বলবো।
আমাদের পরিসংখ্যান বিভাগে QMH Statistics Club এর প্রতিষ্ঠাতা-আহ্বায়ক তসলিম স্যার। ছাত্রদের মাঝে পরিসংখ্যান ভীতি দূর করতে, ২০১৯ সালে তসলিম স্যারের পরিচালনায় এবং সেই সময়ে বিভাগের ছাত্রদের প্রচেষ্টায় ও পরিশ্রমে চালু হয় ক্লাবটি। বিভিন্ন সেমিনার ও প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পরিসংখ্যানের প্রতি ছাত্রদের আগ্রহ বারানোর কাজটা ভালোই চলছিল। বিভাগে প্রথমবারের মতো ২০১৯ সালের শেষের দিকে আয়োজিত হয়েছিলো Statistics fest। তবে এসবই আমার ঢাবিতে ভর্তি হবার আগের ঘটনা। এরপরে হয়তো আরো অনেক প্ল্যান ছিলো ক্লাবটিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার। কিন্তু ২০২০ এর মার্চ মাসে করোনার জন্য অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয় সব কিছু। জীবনের গতি পাল্টে যায়। তবুও ক্লাবের মাধ্যমে সকল ছাত্রছাত্রীদের জন্য কিছু করার ইচ্ছা থেকে তসলিম স্যার অনলাইনে ৮ টি লেকচারের ব্যাবস্থা করেন, যেখানে মূল উদ্দেশ্য ছিলো ১ম ও ২য় বর্ষের শিক্ষার্থীদের Data Analysis নিয়ে জানানো। বাস্তবে ক্লাস না পেলেও, অনলাইনে তসলিম স্যারের ক্লাস করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিলো। তাঁর ক্লাস করে পরিসংখ্যানের প্রতি আগ্রহও কিছুটা বেড়েছিলো। এরপরে ২০২০ সালের অক্টোবরে বিশ্ব পরিসংখ্যান দিবস উপলক্ষে QMH Statistics Club থেকে আয়োজিত হয় প্রোগ্রামিং, ডাটা এনালাইসিস ও ভিডিও মেকিং কম্পিটিশন। সেখানে উম্মে সালমা ও নিহার রঞ্জন সিকদার এর সাথে আমি কোনোরকমে একটা রিপোর্ট লিখে মেইল করে দেই স্যারকে। মেইল এর Subject কি লিখবো, আর নিজেদের পরিচয় হিসেবে রিপোর্টটিতে কি লিখবো তা নিয়ে আমাদের মাঝে কিছু কনফিউশান থাকায় জমা দেয়ার আগের দিন স্যারকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, কিভাবে কি লিখে জমা দিবো। তিনি অনেক সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন, আর তখন উনার কথা শুনে মনে হয়েছিলো যেন অনেকদিন ধরে উনি আমাদের ক্লাস নেন, সবাইকে যেন চিনেন। সেদিন ১ মিনিটের কম সময়ের একটা ফোন কলে তাকে প্রথম বর্ষ পড়ুয়া এক ছাত্রের অনেক ভালো একজন মানুষ মনে হয়েছিলো। আর অনলাইন ক্লাসে তার বুঝানোর পদ্ধতির কারণে প্রথম বর্ষে থাকার পরেও কিছু জিনিস বোধ হয় ভালোই বুঝতে পেরেছিলাম।
এর হয়তো দুই বা তিন দিন পরে কিংবা রেজাল্ট দেবার পরে, স্যারকে কোনো এক কারণে আবারো কল দিয়েছিলাম (এখন সঠিক দিনটা মনে নেই)। তবে সময়টা ছিলো সন্ধ্যায়, আর সেই সময়ে উনি ৫ মিনিটের মতো আমার সাথে কথা বলেছিলেন।
“আসসালামু আলাইকুম, স্যার। আমি রিয়ন, পরিসংখ্যান বিভাগের ১ম বর্ষে…”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম, হ্যা, রিয়ন, আপনি কেমন আছেন?…” দিয়ে শুরু করে উনি আরো অনেক ব্যাপারে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলেন, সাথে কিছু দিকনির্দেশনাও দিলেন। তাঁর মতো ব্যাস্ত মানুষ, একজন শিক্ষার্থী কল দিয়েছে বলে এতো সময় কথা বলবেন, এটা আমার ভাবনায়ও ছিলো না। তার সব কথা এখন আমার মনে নেই, তবে তার কথা বলার ধরণটা আমি হয়তো কোনোদিনই ভুলবো না। এমন একজন স্যারের ক্লাস বাস্তবে করতে না পারার আক্ষেপটা হয়তো থেকেই যাবে। উনি শিক্ষক হিসেবে, একজন মানুষ হিসেবে অনুকরণীয় ব্যাক্তিত্ব। এর পরে ২০২১ সালের জানুয়ারির শেষে যখন তিনি মারা যান, আমরা হারিয়ে ফেলি পরিসংখ্যান বিভাগের একজন অনুকরণীয় ব্যাক্তিকে। শুধু একটি ফোন কলের পরে তার সম্পর্কে আমি এতো কিছু লিখছি, আর এর কিছুই অতিরঞ্জিত নয়। এরপর থেকে QMH Statistics Club এর জন্য মনে একটা আলাদা স্থান তৈরী হয়ে যায়, শুধু ৫ মিনিটের ওই ফোন কলের জন্য। আশা করি ক্লাবটি যেই লক্ষ্যে তসলিম স্যার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই লক্ষ্য অর্জন করবে। ক্লাব টির অগ্রযাত্রায় কখনো কোনো অবদান রাখতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করবো। ক্লাবটির প্রতি ভালোবাসা যতটা না পরিসংখ্যানকে ভালো লাগার কারণে, এর চেয়ে বেশি ওই পাঁচ মিনিটের ফোন কলের জন্য।
There is a famous saying in English:
‘What you’ve never had, you never miss.’
তবে তসলিম সাজ্জাদ মল্লিক স্যার, বাস্তবে যার ক্লাস আমরা কখনো পাই নি, তাকে আমি মিস করি।

শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শিক্ষাবর্ষঃ ২০১৯-২০

মো: সাবিত আল-সাবা রিয়ন

শিক্ষাবর্ষঃ ২০১৯-২০