আঁকাবাঁকা মেঠো পথ। পথের দু’ধারে আমলকি, বহেরা আর হরিতকির গাছগুলো স্বগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আর এ পথেরই পাশ দিয়ে সোজা দক্ষিণে চলে গেছে আরেকটি পথ। পথের একেবারে শেষে একটি বিশাল বন। বনের বর্ণনা লিখে শেষ করা অসম্ভব। বিশাল জায়গা জুড়ে তার বিস্তার। বড় বড় গাছ বনটিকে গহীন করে তুলেছে। বনটিকে কেন্দ্র করে যে কত প্রাণী বেঁচে আছে তার কোনো হিসেব নেই। বিশাল আকৃতির হিংস্র চারপেয়ে প্রাণী থেকে শুরু করে বাতাসের আগে আগে উড়ে বেড়ানো ক্ষুদ্র কীটও বনটির স্থায়ী বাসিন্দা ছিলো।
বনের একেবারে শেষপ্রান্তে মাঝারি এক কাঠবৃক্ষে বাস করতো একটি শালিক পাখি। গাছটির পাশেই ছোট একটি ঝোপের আড়ালে বাস করতো একটি সাদা খরগোশ। খরগোশটি এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। কিন্তু শালিক পাখিটির বসবাসের কোনো জায়গা নেই। তার বাড়ি ঐ কাঠবৃক্ষে হলেও সে তার বাড়িতে অনিয়মিত। তার কত বন্ধু! কত স্বজন! যেদিন যেখানে খুশি সেদিন সেখানেই থেকে যেতো সে। সব মিলিয়ে খুব বর্ণিল জীবন তার। অপরদিকে খরগোশটি ছিলো খুব শান্ত স্বভাবের। বনে তারও অনেক বন্ধু ছিলো, স্বজন ছিলো। সে একা ছিলো না কিন্তু কেন জানি খুব একাকিত্ব অনুভব করতো। রোজ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কত নিয়ম মেনে তার জীবনযাপন। বাড়ির পাশের লতা পাতাই ছিলো তার একমাত্র খাবার। লতা-পাতার সাথে আরও উপকরণ মিশিয়ে অনেক সুস্বাদু খাবার তৈরি করতে পারতো সে। আর একটু মন খারাপ হলেই খরগোশটি তার বাড়ির পাশের আমলকি, বহেরা ও হরিতকি গাছগুলোর কাছে যেতো। গাছগুলোকে তার মনের কথা বলতো, গল্প করতো। শালিক আর খরগোশটির রোজই দেখা হতো। দেখা হতে হতে কথা, এরপর বন্ধুত্ব। রোজ সকালে উঠেই দু’জন কাজে যেতো। সারাদিন কাজের ফাঁকে কথা হতো। সন্ধ্যা হলেই খরগোশটি বাড়িতে ফিরতো। কিন্তু শালিকের বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হতো। কোনো কোনো দিন বাড়িই ফিরতো না সে। খরগোশটি নিজের মতো খেয়ে ঘুমিয়ে যেতো। সবকিছু এভাবেই চলছিলো।
একদিন একটি হরিণ খরগোশটির বাড়ির পাশে বাসা বাঁধে। খরগোশটি অনেক মিশুক ছিলো। তাই নিজে থেকেই হরিণটির কাছে গিয়ে কথা বলে সে, পরিচিত হয়। হরিণটি তার থেকে বয়সে বড় ছিলো। তাই হরিণটিকে সে দাদা বলেই ডাকতো। হরিণটি খুব কাজপ্রিয় ছিলো। সারাদিন কাজ করতো।
খরগোশটি যখন সময় পেতো তখনই হরিণের সাথে কথা বলতে যেতো, গল্প করতো। কত বিষয় নিয়ে কথা বলতো ওরা। মাত্র কদিনেই খরগোশ আর হরিণটি অনেক ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলো। খরগোশটির এই এক বড় গুন ছিলো। অনেক দ্রুত সবাইকে আপন করে নিতে পারতো। আর এদিক থেকে হরিণটি আরও পারদর্শী ছিলো। অনেক বিষয়ে গল্প করতো ওরা। গল্প করতে করতে হঠাৎ-ই খরগোশটি কান্না জুড়ে দিতো। কত দুঃখ তার! কতজনই যে তাকে দুঃখ দিয়েছে। হরিণটিও নিশ্চুপ হয়ে যেতো। কী বলে যে স্বান্তনা দেবে সে ভাষাই খুঁজে পেতো না। তবু দাদা বলে কথা। খরগোশটিকে একদম আগলে রাখতো সে। একদিন সন্ধ্যাবেলা খরগোশটি একদম অবাক হয়ে গেলো। মহাব্যস্ত শালিক পাখিটি তার বাড়িতে এসেছে। অনেক আগে থেকেই তাদের পরিচয়। এজন্য খরগোশটি শালিক পাখিটিকে খুব ভালো বন্ধু হিসেবেই জানত। শালিক পাখিটি যে তাকে কী ভাবতো, তা একেবারেই অজানা ছিলো। তবে এই শান্ত খরগোশ, দুরন্ত শালিক পাখি আর বিজ্ঞ হরিণটির মধ্যে একটা বিষয়ে অনেক মিল ছিলো। এরা সবাই আমলকি, বহেরা আর হরিতকি গাছকে অনেক পছন্দ করতো। হয়ত বিশাল বনে বসবাস এদের মনকেও বিশাল করে তুলেছে।
শালিকটিকে দেখেই খরগোশটি বসতে বললো। শালিকটি কিছু খেতে চায় কিনা তা জিজ্ঞেস করলো। খরগোশটি অনেক আপ্যায়ন প্রিয় ছিলো। বাড়িতে কেউ বেড়াতে এলে তাকে আপ্যায়ন না করে যেন তার মন শান্ত হয় না। আর শালিকটিকে দেখে খরগোশটিরও গল্প করার পুরানো অভ্যাসটি জেগে ওঠে। শালিকটি সারাদিন কোথায় ছিলো, কী করেছে, ভালো আছে কিনা, মন ভালো কিনা, দুপুরে কী খেয়েছে, কত প্রশ্ন তার মনে। শালকটিও আপন মনে উত্তর দেয় আর অবাক হতে থাকে। এই বিশাল বনে তার বাড়ির পাশে এত ভালো একটা বন্ধু আছে এতা এতদিন একদমই বুঝতে পারেনি সে। শালিক পাখিটির জীবনযাত্রাও যেন একদম মুখস্ত খরগোশটির। সেও তোতা পাখির মত বলতে থাকে। শালিক পাখিটি স্থিরভাবে তাকিয়ে থাকে আর মনে মনে ভাবে, এতো খেয়াল খরগোশটির মনে! গল্পে গল্পে সেদিন রাত খরগোশটির বাড়িতেই কেটে যায়। শেষ রাতের দিকে গল্প শুনতে শুনতেই শালিক পাখিটি ঘুমিয়ে যায়। খরগোশটিও শালিকের মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুমকে গভীর করে তোলে। সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে যায় খরগোশটির। শালিক পাখিটি তখনও ঘুমাচ্ছে। ঘুমন্ত শালিককে না ডেকেই খরগোশটি কাজে বেড়িয়ে যায়। দুপুরে বাড়িতে ফিরে ঘুমন্ত শালিককে ডেকে তোলে খরগোশটি। শালিক পাখিটিকে খুব খুশি লাগছিলো। রাতে নাকি তার খুব ভালো ঘুম হয়েছে। সেদিনও শালিকটি খরগোশের বাড়িতে থেকে যায়। সারাদিন ওরা কথা বলে। কত বিষয় নিয়ে আলাপ হয় ওদের। বনের অবস্থা এখন কেমন, কার কোথায় বন্ধু আছে, কে কেমন আছে, ভবিষ্যতে কী হবে ওদের, কত আলোচনা সমালোচনা। দিন শেষে রাত হয়। কথা আরও বাড়তে থাকে। তারপর ঘুম। তার সাথে বিশাল বনে শালিক আর খরগোশটির বন্ধুত্বটাও যে বিশাল হয়ে গেছে তা খরগোশটি খুব ভালই বুঝতে পারে। কিন্তু শালিক পাখিটার এতে কোন আগ্রহ অনাগ্রহ কিছুই বোঝা যায় না।
পরদিন সকালে উঠে শালিক পাখিটি চলে যায়। খরগোশটিও নিজ কাজ করতে থাকে। কাজে কাজে দিন কেটে যায় খরগোশটির। তবে সারাদিন কাজের ফাঁকে অনেকবার শালিকের কথা মনে পড়ে। কিন্তু শালিকটির কোনো দেখাই পাওয়া যায় না। শান্ত খরগোশটি অবচেতন মনে ভাবে, শালিকের কোনো বিপদ হলো না তো! হঠাৎ- ই চমকে ওঠে সে। আবার স্থির হয়। এরপর টানা কয়েকদিন শালিকের কোনো দেখা পাওয়া যায় না। খরগোশটি মনের দুঃখে হরিণের কাছে গিয়ে সব বলে দেয়। হরিণটি জীবন নিয়ে তার অভিজ্ঞতার কথা খরগোশকে বলে।
এই বিশাল বনে খরগোশটির আরেকটি বন্ধু ছিলো। শুধু বন্ধু নয়, স্বজনও বটে। সে ছিলো একটি ময়না পাখি। খরগোশটির বাড়ির পাশেই মাঝারি একটি গাছে ময়নাটি বাস করতো। সে ভীষণ ভালো কথা বলতে পারতো। বনের অনেকেই তার কথা বন্ধু ছিলো। শুধু কথা বলেই সবাইকে মাতিয়ে রাখতে পারতো সে। তাই মন খারাপ হলে খরগোশটি ময়নার কাছে গিয়ে সব বলে দিত। আর কথা জাদুর জাল বিছিয়ে খরগোশের মন ভালো করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতো সে।
সেদিন দুপুরে নিজ বাড়িতে খরগোশটি বিশ্রাম নিচ্ছিলো। হঠাৎই চিরচেনা সেই শব্দ! শালিক পাখির উড়ার শব্দ। উড়তে উড়তে দ্রুত পাখিটি খরগোশের পাশে গিয়ে বসে। খরগোশটি অবাক হয়। শালিক পাখিটি গলা ছেড়ে গান গাওয়া শুরু করে। খরগোশটিও গান শোনে আর হাসতে থাকে। শালিকের গান শেষ হলে খরগোশটি অভিমানে চুপ করে বসে থাকে। শালিকটি বুঝেও না বোঝার ভান করে আবারও গান ধরে। এভাবেই বেশ কিছুক্ষণ চলে। সরল খরগোশের অভিমানও ভেঙে যায়। শালিকটি এতোদিন কোথায় ছিলো খরগোশটি তা জানতে চায় আর অভিযোগ করে বলে কোনো যোগাযোগ না করে কোথায় এতো উড়ে উড়ে বেড়ায় শালিকটি! শালিকের কোনো অনুভূতিই হয় না। এতো প্রশ্ন, এতো অভিযোগ, সব কিছুই যেন অর্থহীন। অবশ্য এটাই এই বিশাল বনের নিয়ম! শালিকটি কখনও খরগোশের মুখের দিকে ভালোভাবে তাকায়নি। খরগোশের ছোট ছোট অভিমান আর সহজ সরল অনুভূতিগুলোও তার কাছে মূল্যহীন ছিলো। সবকিছু এমন যেন ঠিক বুঝেও না বঝার ভান করা।
দিনের পর দিন এভাবেই চলতে থাকে। সবার জীবনেই পরিবর্তন আসে। সেই বিজ্ঞ হরিণটিও আরও বেশি বিজ্ঞ হয়। মিষ্টি ময়নাটিরও কথাবন্ধু বাড়তে থাকে। বনের পরিধিও বেড়ে যায়। কত নতুন নতুন বাসিন্দা আসে।
চঞ্চল শালিকের চাঞ্চল্য আর সরল খরগোশটির অভিমানও একটু একটু করে বহুগুন হয়ে যায়। শালিকটির এই চাঞ্চল্যই হয়তো খরগোশটিকে একদিন অভিমান করা ভুলিয়ে দেবে। দু’জনের দূরত্বকে বহুগুন বাড়িয়ে দুটি আলাদা বনের বাসিন্দা করে দেবে। সে অবশ্য সময়ের ব্যাপার।
তবে হরিণ, ময়না আর বিশাল বনটি খরগোশ, শালিক আর সবাইকে নিয়ে সারাজীবনই হয়তো একসাথে থাকতে চাইবে। তবে এটাই তো সত্য যে, সবাই সবার বন্ধু হয়ে পাশে থাকাটাই সবার জন্য মঙ্গলজনক। সেদিন সন্ধ্যার একটু পরেই খরগোশটি ঘুমিয়ে যায়। ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখে সে। অচেনা অনেককে নতুন করে চেনে । চেনা অনেককেই অচেনা মনে হয়। বাস্তবে আমাদের অনেকের সাথে রোজ এমনটাই ঘটে।
- সজীব সরকারhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%b8%e0%a6%9c%e0%a7%80%e0%a6%ac-%e0%a6%b8%e0%a6%b0%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%b0/বৃহস্পতিবার, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২১