fbpx

ফুটবল জাদুকরঃ মেসি

“They tell me that all men are equal in God’s eyes, this player makes you seriously think about those words.” -Ray Hudson

আমরা হয়তো একদিন বলবো, আমরা একজন লিওনেল মেসির খেলা দেখেছি।  রোজারিও থেকে বার্সেলোনা, তারপরে প্যারিস এবং সেখান থেকে বর্তমানে ইন্টার মিয়ামি।  জীবনে কি কি জিতেছেন সেটা হিসেব করার চেয়ে, কি কি জিততে পারেন নি সেটা খোঁজাই বোধ হয় সহজ হবে  মেসির ক্যারিয়ারের শুরুতে ক্লাব পর্যায়ে শুধু মাত্র উত্থানই ছিলো। বার্সেলোনার হয়ে দুইটা ট্রেবল সহ একটা হেক্সা, কি জিতেন নি তিনি?  তবে দেশের হয়ে ২০১৪ তে বিশ্বকাপ ফাইনাল, ২০১৫ ও ২০১৬ তো কোপা আমেরিকা ফাইনাল খেলে যখন হেরে গেছেন, তখন সবাই টুর্নামেন্ট সেরা খেলোয়াড়কে বলেছিলো যে, দেশের জন্য কিছুই করতে পারেননি তিনি। শেষ পর্যন্ত তিনি করে দেখালেন, ক্লাবের ও দেশের হয়ে সব ধরণের দলীয় ট্রফি জিতলেন। তিনি বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ট্রফি জয়ী খেলোয়াড়। এছাড়াও পুসকাস ব্যাতীত সব ব্যাক্তিগত ট্রফির মালিক তিনি। একজন মেসির পুসকাস লাগে না, কারণ গেটাফের বিপক্ষে যার গোলকে শতাব্দীর সেরা গোল হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তার কি আদৌ এটির দরকার আছে?

0907 মেসি1

মেসি অনেকের কাছেই একটা অনুপ্রেরণার নাম। ফুটবলের সৌন্দর্য্য যাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তারা মেসির অভাব ভালোই বোধ করবেন, যখন এই ফুটবলের বাঁ পায়ের জাদুকর তার বুট জোড়া তুলে রাখবেন। তাকে অনেকেই একসময় বলতো শুধু বা-পায়ের খেলোয়াড়। এই কথার উত্তরে তার একসময়ের বার্সা সতীর্থ ও সুইডেনের সাবেক অধিনায়ক ইব্রাহিমোভিচ বলেছিলেন:

Messi does not need his right foot. He only uses the left and he’s still the best in the world. Imagine if he also used his right foot, then we would have serious problems.”

মেসির জীবন যেনো একটা সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। জীবন তাকে বললো- আপনার হরমোনে সমস্যা, আপনি ফুটবল খেলতে পারবেন না। তবে মনের জোরে আর প্রতিভার সাহায্যে, তিনি ঠিকই ফুটবল খেললেন। আর শুধু খেললেনই না, হলেন সর্বকালের সেরাদের মাঝে একজন। এর মাঝে বারবার তীরে গিয়ে তরী ডোবার পরে নিজ দেশের মানুষদের রোষানলে পড়লেন, অবসর নিলেন। তারপরে দেশের প্রয়োজনে আবারো ফিরে আসলেন এবং দেশের হয়ে সম্ভাব্য সব ট্রফি জিতলেন। একটা সিনেমার স্ক্রিপ্ট এমন হলে হয়তো সেটাতে বাড়াবাড়িই মনে হতো। তবে Neil Gaiman এর ভাষায়- “Life is always going to be stranger than fiction, because fiction has to be convincing, and life doesn’t.”

আর একজন মেসির জীবনে এমনও সম্ভব। যখন ২০২২ সালে ফুটবলের সবচেয়ে আরাধ্য বিশ্বকাপ মেসি হাতে নিলেন, তখন কমেন্টেটর পিটার বললেন:

“Lionel Messi has conquered his final peak. Messi has shaken hands with paradise, the little boy from Rosario Santa Fe has just pitched up in Heaven. He climbs into a galaxy of his own, he has his crowning moments. The greatest player of his age, finally has the greatest accolade football can afford him.”

0907 মেসি2

তার ফুটবল স্কিলে মুগ্ধ হয়ে বার্সেলোনা যখন তাকে নিজেদের জন্য সাইন করাতে চাইলো, তখন হাতের কাছে কাগজ না পেয়ে টিস্যু পেপারে সাইন করে বার্সেলোনা তে আসলেন। এরপরে তিনি পাল্টে দিলেন বার্সেলোনার ইতিহাস, হয়ে গেলেন বার্সার ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড়। ইউরোপে একটি ক্লাবের হয়ে সর্বোচ্চ গোলের মালিক তিনি, গোলে সর্বোচ্চ কনট্রিবিউটও (গোল+এসিস্ট) তাঁর। তবে এই ক্লাবে শেষটা কিন্তু ততোটাও মধুর ছিলো না। শুরুটা টিস্যু পেপারে সাইন করে হলেও, শেষটা হয়েছিলো ২০২১ সালে বার্সার প্রেস কনফারেন্সে একটা টিস্যুতে চোখের পানি মুছে। ক্লাবের প্রতি লয়াল(অনুগত) থাকার পরেও, সেই ক্লাব কর্মকর্তাদের অদূরদর্শিতার কারণে তাকে তার প্রাণের ক্লাব ছেড়ে চলে যেতে হয়।

0907 মেসি3

প্যারিসে দুই সিজন কাটানোর পরে আবারো যখন বার্সেলোনাতে ফিরে এসে একটা সুন্দর বিদায়ের হাতছানি দিচ্ছিলো, তখন নিজেই সিদ্ধান্ত নিলেন যে, যদি তার জন্য অর্থনৈতিক ভাবে ক্লাবের ক্ষতি হয় বা অন্য খেলোয়াড়দের বেতন জোরপূর্বক কমিয়ে আনতে হয়, তাহলে তিনি আর আসতে চান না ক্লাবে। ভালোবাসাটা এমনই যে, নিজে না পাই, তবুও যেনো সেটা ভালো থাকে। এই চাওয়া থেকেই ইউরোপীয় ফুটবলের পাট চুকিয়ে তিনি চলে যাচ্ছেন ইন্টার মিয়ামিতে। এর মাঝে ফুটবলের প্রায় সকল মহা কীর্তি নিজের নামে করে নিয়েছেন। রয়েছে শতাধিক রেকর্ড, যার অনেকগুলিই অদূর ভবিষৎ এ ভাঙ্গবে বলে মনে হয় না। তাকে নিয়ে পাতার পরে পাতা লিখে যাওয়া যাবে। কখনো কি এর কোনো শেষ হবে!

মেসিকে নিয়ে লিখার সময় ভাবছিলাম যে, আসলে মেসির সবচেয়ে বড় গুণ কি? একজন এতো বড় ফুটবলার যার নামে শতাধিক রেকর্ড আছে, তার নম্র স্বভাব নাকি ফুটবলকে শৈল্পিকভাবে সবার সামনে ফুটিয়ে তোলা? তখন মনে হলো, একজন মানুষের সবচেয়ে বড় গুণ মনে হয় নিজের বিরোধী কাওকে ভালোবাসতে বাধ্য করা। আর আমার ধারণা, মেসি সেটাই করতে পারেন। ভালোবাসতে বাধ্য করতে না পারলেও কট্টোর মেসি বিরোধীও হয়তো কোনো একসময় মনে মনে বলে ওঠেন, যে বাহ, কি সুন্দর খেলেন মেসি।

জাদুকর মেসির অনন্য রেকর্ড ঝুড়ির গল্প হয়তো এখানে বলে শেষ করা সম্ভব নয়। চলুন দেখি আসি মেসির কিছু রেকর্ড যা ভবিষ্যতে খুব সহজে ভাঙ্গবে বলে মনে হয় না-

১. ইতিহাসের একজন খেলোয়াড় কখনো নিজের খেলা ম্যাচ গুলোর মাঝে ৫৩% ম্যাচে ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ হতে পারেন নি। যেটা মেসি করেছেন। নিজের খেলা অর্ধেকের বেশি ম্যাচে তিনিই ছিলেন মোস্ট ইমপ্যাক্টফুল প্লেয়ার।

২. আধুনিক টোটাল ফুটবলের জনক ডাচ কিংবদন্তী ক্রুইফ বলেছিলেন “Messi will be the player to win the most Ballons d’Or in history. He will win five, six, seven. He is incomparable. He is in a different league”. আর মেসি তাঁর ভবিষ্যৎ বাণী সত্যি প্রমাণ করে দেখিয়েছেন, যা অভাবনীয় ছিলো। তিনি ৭ টি ব্যালন ডি’ওর জিতেছেন।

0907 মেসি4

৩. এক বছরে সর্বোচ্চ ৯১ টি গোল করেছেন মেসি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হলো ৮৫, যা করেছিলেন গার্ড মুলার ১৯৭২ সালে।

৪. মেসি একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে দুইটি বিশ্বকাপে  ‘Player of the tournament’ বা সেরা খেলোয়াড় হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন, যা কখনো কেউ হতে পারেন নি।

৫. মেসি সর্বোচ্চ ৬ বার ইউরোপীয় গোল্ডেন সু জিতেছেন, যা ইউরোপ এর সব লীগ মিলিয়ে সর্বোচ্চ গোল স্কোরার কে দেয়া হয়।

৬. বিশ্বকাপের মঞ্চে সর্বোচ্চ গোল কন্ট্রিবিউশান ও মেসির (২১ টি)।

মেসির তুলনা মেসি নিজেই। ফুটবলের সৌন্দর্য মানেই মেসি। তাঁর মত একজন জীবন্ত কিংবদন্তীর খেলা দেখতে পারা বর্তমান বিশ্ববাসীরাও সাক্ষী হয়ে থাকবে ইতিহাসের পাতায়। তাইতো Pep Guardiola বলেছেন-

“Don’t write about him, don’t try to describe him. Just watch him.” – Pep Guardiola

শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শিক্ষাবর্ষঃ ২০১৯-২০

মো: সাবিত আল-সাবা রিয়ন

শিক্ষাবর্ষঃ ২০১৯-২০