fbpx

রইস উদ্দিনের মাফলার

সাদা চেকের ফিনফিনে শার্টের কলারটার গা ঘেষে লাল রঙের প্যাঁচানো মাফলারটা দেখলেই বুঝা যায়- এটা রইস উদ্দিন। রইস উদ্দিন চলে যাচ্ছে।

         চলে যাচ্ছে বলতে – আমরা যারা রইস উদ্দিন কে চিনি, তারা জানি, সে কোথায় যাচ্ছে। সে দুবাই চলে যাচ্ছে। তার এক দূর সম্পর্কের মামা আব্দুল খালেকের সাথে দীরঘদিনের চেষ্টা-তদবিরের পর অবশেষে রইস উদ্দিন চলে যেতে পারছে। আমরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করি, রইস উদ্দিন হয়তো কখনই যেতে চায়নি। কিন্তু কেন রইস চলে যাচ্ছে হঠাৎ করে – তা আমরা ভেবে বের করতে পারতাম না। ভিসা কনফার্ম হয়ে গেছে দিন পনের আগে; এ মাসের সাতাশ তারিখে রইস উদ্দিন চলে যাচ্ছে।

        মিঠেখালি গ্রামের প্রায় সবাই এক নামে রইস উদ্দিনকে চিনে। আমরা যারা সদ্য কৈশোর পেরুনো ছেলে-ছোকরার দল; ক’দিন আগেও মিঠেখালি হাই-ইস্কুলের মাথে ডাংগুলি আর দাঁড়িয়াবান্ধা খেলতাম কিংবা স্কুল ছুটি হওয়ার পর গণি মিয়ার দোকান থেকে কমলা রঙের আইসক্রিম কিনে বাড়ি ফিরতাম; তখন স্কুলের মাঠটার পাশে প্রকাণ্ড শিরিষ গাছটার নিচে অথবা রহমতের চায়ের দোকানের মাচায় বসে থাকা প্রৌঢ়দের মুখে শুনতাম রইস উদ্দিনের কথা। বত্রিশ পেরুনো দীর্ঘকায়, উজ্জ্বল শ্যামলা রঙের রইস উদ্দিন রেশমের লাল মাফলারটা গলায় পেঁচিয়ে গ্রামের এ-মাথা ও-মাথা ঘুরে বেড়ায়। মিঠেখালি বাজার থেকে ডানদিকে যে পথটা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের দিকে চলে গেছে, তার কয়েক ঘর পরেই রইস উদ্দিনের বাড়ি। বাপ-মা হারা রইসউদ্দিনের শৈশব কেটেছে চাচা আফছার উদ্দিনের বাড়িতে। সাত ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার করা আফছার উদ্দিন, তার বড়ভাই এখলাছ উদ্দিনের হঠাৎ মারা যাওার পর এতিম রইস উদ্দিনকে নিতান্ত বাধ্য হয়েই নিজের ঘরে নিয়ে আসেন । ইচ্ছা না থাকলেও কে কি বলে – এটা ভেবে আফছার উদ্দিন তার তিন ছেলের সাথে রইস উদ্দিনকেও স্কুলে পাঠাতো। একটা সময় রইস উদ্দিনেরও স্কুল ভাল লাগলো না আর আফছার উদ্দিনও তার পানের ব্যবসায় লোকসান দিতে থাকলো। এর ফলে যেটা হলো-রইস উদ্দিন তার সংসারে একটা উটকো বোঝা হয়ে দাঁড়ালো এবং তারপরের বর্ষা মৌসুমের আগে আগে কিসলু চেয়ারম্যান রইস উদ্দিনকে তার নিজের বাড়িতে নিয়ে আসলো। চেয়ারম্যানের দুটো ইটের ভাটা,মহাজনী ব্যবসা আর পূবের কয়েক বিঘা জমির দেখাশোনা করতে করতে বড় হয়ে উঠলো রইস উদ্দিন।

        রইস উদ্দিন চলে যাচ্ছে। শৈশব থেকে মিঠেখালির ধুলো-ময়লায় বেড়ে উঠা রইস উদ্দিন একসময় বুঝতে পারলো- আর এখানে থেকেই বা কী হবে! ভীষণ একরোখা, সাদামাটা আর বঞ্চিত রইস উদ্দিনকে আমরা যতটুকু চিনি, চেয়ারম্যানের গোলাঘরে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে চায়না সে। অথচ রইসউদ্দিন, চেয়ারম্যানের নিজের লোকের মতো মিঠেখালি চষে বেড়িয়েছে। তবে, কেন চলে যাচ্ছে সে? আমরা ভাবতে বসি, আর আমাদের  লাল মাফলারের কথা মনে হয়। চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে সারি করে লাগানো নারকেল আর সুপারি গাছের ফাঁক দিয়ে গলায় লাল মাফলার পেঁচিয়ে হেলেদুলে আসতো সে। পথে কাউকে দেখলেই বলতো, দুবাই চইলা যাইতেছি। বিরাট দ্যাশ। আর কত?” বলেই লাল মাফলারটা এ-কাঁধ থেকে ও-কাঁধে তুলে দিতো।

        আমরা যারা রইস উদ্দিনকে দেখে এসেছি কিংবা বৃদ্ধ সোবাহান বক্সের কথাতেও জেনেছি, সে অনেকদিন আগে থেকেই রইস উদ্দিন তার মাফলারটা গলায় পেঁচিয়ে রাখতো। প্রচণ্ড শীত, আশ-পাশের গ্রাম ডুবিয়ে দেয়া বর্ষা কিংবা ঘাম ছুটিয়ে দেয়া গরমেও রইস উদ্দিন তার মাফলারটা গলা থেকে খুলত না। এক অদ্ভুত সম্পর্ক যেন হয়ে গিয়েছিলো সেই মাফলারের সাথে। রহমতের চা-দোকানের মলিন খাম্বাটার সাথে গা-ঘেঁষে বসে থাকা বৃদ্ধ সোবাহান বক্স বলতো, অনেকদিন থেইকা এই মাফলার রইসের গলায়। মাফলারের লগে এতো পিরিত কিসের জিগাইলে রইস হাইসা উড়ায়া দিতো! মাফলার নিয়া বেশি কিছু কইলেই আবার রাইগা যাইতো। বড় আচানক এই রইস!”

        রইসের লাল মাফলার মিঠেখালির অবসন্ন বিকেল কিংবা রঙচটা দুপুরে গ্রামজুড়ে এক রহস্যের সৃষ্টি করতো। আর সোবাহান বক্স কিংবা তার মতোই প্রৌঢ়রা রহমতের চায়ের দোকানে খুলে বসতো মাফলারের বায়োস্কোপ। আমরা যারা তখন হাফপ্যান্ট পড়ে ইস্কুলে যাই, তারা এই আশ্চর্য মাফলারের নানা অজানা কথা শুনতে ভিড় জমাতাম। রইস উদ্দিনের লাল মাফলার অজান্তেই সবার আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়াতো।

একদিন অঘ্রাণের এক হলুদ বিকেলবেলা কম চিনির সাদাটে রঙের চায়ে চুমুক দিতে দিতে কলিম দফাদার বলে উঠলো, এই মাফলার রইস কোথাও না কোথাও পাইছে। না অয় অরে কেউ রাখপার দিছে।“

        তার কথা কেড়ে নিয়ে লাল দাঁতের ফাঁক দিয়ে পিচিক করে পানের পিক ফেলে মুকুল মেম্বার বলে উঠে, আমি বাজি ধইরা কইবার পারি – চেয়ারম্যানের ছোড মাইয়া, যেইটা শহরে থাকে, এই মাফলার তার দেয়া। তার লগে অবশ্যি লাইন আছে।

        আমরা যারা দোকানে বসে টু-ইন-ওয়ান শোনার ছুতোয় কান পেতে মাফলারের রহস্য শোনার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতাম কিংবা যারা এইসব রহস্যের কথা হড়বড় করে বলতো- আমাদের সবার মনে তখন ভেসে উঠতো শহর থেকে বেড়াতে আসা চেয়ারম্যানের মেয়ে সুফিয়ার কথা। কোনোদিন আশ্বিনের মেঘের মতো সাদা কিংবা কোনোদিন জলডুমুরের মতো আবছা সবুজ অথবা মিঁয়াবাড়ির পেছনের প্রকাণ্ড হিজল গাছ থেকে সিঁদুরের মতো ঝুলে থাকা হিজল ফুলের মতো লাল রঙের পোষাক পরে সুফিয়া মিঠেখালির ধুলোউড়া রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছে। কোথেকে জানি হাসনাহেনার গন্ধ বয়ে যাওয়া বাতাসে তার চুল উড়ছে আর তার সাথে হাসতে হাসতে কথা বলে যাচ্ছে লাল মাফলার গলায় প্যাঁচানো রইস। আমরা যারা তখন হাসনাহেনার গাছ কোথায় হতে পারে ভাবছিলাম – তখন প্রৌঢ়রা বলাবলি করতো, এই গন্ধডারে বড়লোকেরা পারফিউম কয়।“

        তারপর থেকেই মিঠেখালির মানুষের মুখে মুখে ঘুরতে লাগলো সুফিয়া আর রইসের কথা। হয়তো এ কথা এক কান দু-কান করে চেয়ারম্যান বাড়িও পৌঁছে যায়। আমাদের মনে পড়ে, তার পরের আষাঢ়ে, আবারো যখন হাসনাহেনার গন্ধ রঙিন ওড়নায় মিশিয়ে সুফিয়া মিঠেখালি আসে, তার ক’দিন আষাঢ়ের ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে শহরে চলে যায়। এতো তাড়াতাড়ি সুফিয়া কেন চলে যাচ্ছে- এই কথা যখন আমরা ভাবতে বসতাম, তখন কোনোভাবেই আমাদের মনে হতো না – বৃষ্টিতে চোখের জল বুঝা যায় না।

         এর পরের বছরই রইসের দুবাই যাওয়া পাকাপাকি হয়ে যায়। তারপর মিঠেখালির লোকজন কিংবা আমরা যারা আরেকটু বড় হয়েছি – রইস উদ্দিনকে মাফলারের কথা জিজ্ঞেস করতেই কেমন যেন উদাস হয়ে যেত সে। আবারো মিঠেখালি বাজারে রইস উদ্দিন আর তার মাফলার নিয়ে উদাসীনতার রস্য চলতে থাকতো।

        রইস উদ্দিন চলে যাওয়ার কয়েকদিন আগে মিঠেখালিতে অন্য এক কথা শোনা যেতে থাকলো। চেয়ারম্যানের বড় ছেলে, এইবারের নতুন নির্বাচিত চেয়ারম্যান, কাশেমের সাথে রইসের সাথে বনিবনা না হওয়ার খবর রটিয়ে পড়লো। বনিবনা না হওয়ার কারণ কাশেমের ছোট বোন সুফিয়া, নাকি, এতদিন ধরে চেয়ারম্যানের বিপুল সম্পত্তি আগলানোর সূত্রে রইসের সম্পত্তি আত্মসাতের অভিযোগ- তা নিয়ে মিঠেখালির বাতাসে আবার গুঞ্জন ভেসে বেড়াতে লাগলো। এসময় রইসকে আরো বিমর্ষ দেখা যেতো।  “এই রইস সেই রইস নাই” বলে আবারো প্রৌঢ়রা কিংবা আমরা যারা আরেকটু বড় হয়েছি তারা আমাদের চেনা রইস উদ্দিনের কথা মনে করতাম আর তার পরপরই আমাদের আলোচনায় চলে আসতো রইস উদ্দিনের লাল মাফলার।

        পঁচিশ তারিখ সকালে আমরা যখন ঘুম থেকে উঠে দাঁত মাজছিলাম, তখনই জানতে পারি ঘটনার কথা। মিঠেখালির বাজারে দোকানিরা মাত্র দোকান খুলছে, রহমত মিয়া তার কেটলিতে সরিষার দানার মতো চা-পাতা ঢেলে দিচ্ছে। এমন সময় কোথা থেকে যেন হাসনাহেনার গন্ধ চলে আসে মিঠেখালিতে। আর তখনি আমাদেরকে সুফিয়ার উড়নার কথা মনে করিয়ে দেয়, কিন্তু কোথাও সুফিয়াকে দেখতে না পেয়ে অবাক হই। আমরা মিঠেখালি বাজারের দিকে দৌঁড়ে যাই। মিঠেখালির সবাই তখন দেখে – বাজারের পূবে উঁচু ব্রিজটার পাশে উবু হয়ে পড়ে আছে একজন। সোবাহান বক্স বলতে থাকে, “গলায় দাগ পাওয়া গেছে। মাফলার দিয়া প্যাঁচাইয়া দম আটকাইয়া মারছে।“

        সাদা চেকের ফিনফিনে শার্টের কলারটা গা ঘেষে লাল রঙের মাফলারটা দেখলেই বুঝা যায় – এটা রইস উদ্দিন।

        রইস উদ্দিন চলে যাচ্ছে ।

প্রাক্তন শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশন: ২০০৭ - ২০০৮

মানিক মাহ্‌মুদ

সেশন: ২০০৭ - ২০০৮