fbpx

বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি প্রবাসে

সকাল সকাল অফিসের লিফট থেকে বের হতেই ইস্ট আফ্রিকান মাফিয়ার সামনে পড়ে গেলাম। ইথিওপিয়া আর ইরিত্রিয়ার চার সহকর্মীর এই দলটাকে মজা করে ডাকা হয় ইস্ট আফ্রিকান মাফিয়া। মাফিয়া সদস্যরা যাচ্ছেন কফি খেতে। সবচেয়ে বয়স্ক, কিন্তু স্বভাবে তরুণ মাফিয়া সদস্য, জাতিতে ইরিত্রিয়ান বেকুরে হাত তুলে শরীর দুলিয়ে বললো “হেই ভাজ্জি, হাউ আর ইউ ডুয়িং?”

আমার নাম ভাজ্জি না। আমহেরিক ভাষায় ভাজ্জি মানে চরিত্রহীন। আমি চরিত্রহীনও না। এই ভাজ্জি সম্বোধনের পিছনে একটা ছোট্ট গল্প আছে।

অফিসের কাছেই মিডটাউন ম্যানহাটনে (নিউ ইয়র্ক) “জয় কারি” বলে একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট আছে। নামে ইন্ডিয়ান হলেও রেস্টুরেন্ট চালায় চাঁটগাইয়া আলীম চাচা আর তার জ্ঞাতিগোষ্ঠী। আলীম চাচার রেস্টুরেন্টে সব সেট মেন্যু। এক প্লেট ভাত, এক পদের মাংস বা মাছ, এক পদের সবজি আর একটা নানরুটি। রেস্টুরেন্টটা বিভিন্ন দেশের মানুষের মধ্যে এত জনপ্রিয় যে অতিথির লাইন প্রায়ই ভিতর ছাড়িয়ে ফুটপাথে এসে পড়ে। ভাত আর কারি নেয়া শেষ করে সবজির দিকটায় আসলে আলীম চাচা নানা পদ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেন “মাই ফ্রেন্ড, ভাজ্জি?”।

সেই থেকে ইস্ট আফ্রিকান মাফিয়া আমাকে আর আমি তাদের ভাজ্জি বা ভেজিটেবল, অন্য অর্থে চরিত্রহীন বলে ডাকি।

বাঙালির রান্নার হাত কি অন্যদের চেয়ে ভাল? অমুক-তমুক দেশের কুইজিন খেতে গিয়ে যখন জানতে পারি রান্নাঘর চালায় আসলে আমার দেশি কেউ তখন এটা ভাবা ছাড়া আর উপায় কী? এই তো কয়েক মাস আগে সিরিয়ান শরণার্থীদের জন্য একটা তহবিল গঠনে ভলান্টিয়ারিং করছিলাম। বিভিন্ন দেশের মিশন বা কনস্যুলেট খাবারের দোকান সাজিয়ে বসেছে। লাভের টাকা তহবিল গঠনে জমা হবে। ইন্ডিয়ান আর নেপালীরা মিলে একটা স্টল করেছে, সেখানে ভলান্টিয়ারিং শেষে একটু ঘুরে ঘুরে দেখছি। তুরস্কের স্টলটার সামনে আসতেই স্টলে দাঁড়ানো তরুণ ছেলেটা একটা খাবার দেখিয়ে বাংলায় বললো “এইটা নেন ভাই। খাইতে খুব মজা। আমি নিজে বানাইছি।”

আলাপচারিতায় জানা গেলো তরুণের নাম মামুন। গড়গড় করে তুর্কি ভাষায় কথা বলতে পারে। তুর্কি সব রান্না তার নখদর্পনে। খুব হাসিখুশি ছেলে। মামুনের সাথে তুরস্ক কনস্যুলেটের যে-ই কোন বিষয়ে কথা বলতে আসছে, মামুনের হাসিমুখ দ্বারা সংক্রমিত হয়ে তার চেহারায়ও হাসি-হাসি ভাব ছড়িয়ে পড়ছে।

২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওমানের রাজধানী মাসকাটে এইরকম একদল হাসিখুশি বাঙালির সাথে দেখা হয়েছিলো। হোটেলে চেক-ইন সেরে, গোসল করে রাতের খাবার খুঁজতে বের হয়েছি। সাথে আমার ইন্দোনেশিয়ান সহকর্মী। হাটতে হাটতে একটা বাজার মত এলাকায় চলে আসলাম। জায়গায় জায়গায় লোকজন জটলা হয়ে চা খাচ্ছে আর আড্ডা দিচ্ছে। আমি এইরকম একটা জটলার সামনে গিয়ে বাংলায় জিজ্ঞেস করলাম “ভাই, এইদিকে খাবারের হোটেল কোথায় পাব?”

আমার সহকর্মী একটু অবাক হলো। বললো “আচ্ছা, তোমরা দক্ষিণ এশীয়রা তো সবাই দেখতে একই রকম। তুমি জানলে কী করে যে এরা বাংলাদেশী?”

আমি উত্তর দিলাম “এরা সবাই শ্রমিক শ্রেণির, সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে। তারপরও দেখো এদের পারস্পারিক সামাজিক বন্ধন কত দৃঢ়। দেখো এরা কত হাসিখুশি আর দেহভঙ্গিতে কেমন একটা সারল্য। এই সব মিলিয়ে নিশ্চিত হলাম যে এরা বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জের মানুষ।”

আমার এই ধারণা কি নিছক রোমান্টিসিজম? আমার বিশ্বাস এটা একজন পেশাদার পরিসংখ্যানবিদের পর্যবেক্ষণ পরবর্তী সিদ্ধান্ত। আমরা বাঙালিরা আকারে ছোটখাটো কিন্তু সংগ্রাম করতে জানি, টিকে যেতে জানি। আর এই সবটাই আমরা করি হাসিমুখে।

বাঙালি কতটা সংগ্রাম করে বাঁচতে পারে তার যথার্থ উদাহরণ মধ্যপ্রাচ্যের অভিবাসী শ্রমিক বাঙালিরা। ২০১৬-এর অগাস্টে দেশে ফেরার সময় আরব আমিরাতে তিন দিনের যাত্রা বিরতি নিলাম। আমি একজন এমেচার রানার। নতুন কোন জায়গায় গেলে সেটা ঘুরে দেখার জন্য আমি দৌড়ের উপর নির্ভর করি। দুবাই দৌড়িয়ে ঘুরে দেখব এই পরিকল্পনা শুনে আমার দুবাই প্রবাসী বান্ধবী বলল “তোর মাথা খারাপ? অগাস্টে দুবাইয়ের গরমে বাইরে হাঁটাহাঁটি করলেই মরে যাবি!”

তাই নাকি? দুবাইয়ের গরম মোকাবিলা করতে হাঁটতে বের হলাম। আমার বান্ধবীর কথা সত্য। বিকালের শুরুতে রাস্তায় তেমন লোকজন নেই। মানে তারা নেই যাদের অফিস বিল্ডিং-এর ভিতর এসি রুমে কাজ করার সৌভাগ্য আছে। হাঁটাপথে একটা কন্সট্রাকশন সাইট পড়লো। গরম, রোদ, ধুলা সব তুচ্ছ করে একদল নির্মাণ শ্রমিক কাজ করে যাচ্ছে। শ্রমিকদের বেশির ভাগ বাংলাদেশী।

লালন শাহ গেয়েছিলেন “চাতক বাঁচে কেমনে? মেঘের বরিষণ বিনে?” বাংলা বদ্বীপের বৃষ্টিভেজা, নদীস্নাত নরম মাটিতে বেড়ে ওঠা এই মানুষগুলোও তো চাতকের মতই। ইচ্ছে হলো লালনকে ডেকে বলি “সাঁইজী, দেখে যান আপনার চাতকেরা এই মরুর বুকেও বেঁচে আছে। শুধু বেঁচেই নেই, মাথা উঁচু করে বাঁচিয়ে রেখেছে তাদের দেশটাকেও।”

এই কথাটাও রোমান্টিসিজম না, নিছক পরিসংখ্যান অথবা নির্ভেজাল সত্য। বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো রেমিটেন্স।

জীবনানন্দ দাশ বাংলার প্রকৃতিতে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন “বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর”। পেশাগত কারণে আমার প্রতিনিয়ত পৃথিবীর রূপ দর্শন করা হয়। কিন্তু এই পরিক্রমায় আমি বাংলার মুখ খুঁজে পাই অহরহ। বাংলাদেশ তো শুধু বাংলার প্রকৃতি নয়, এর মানুষও।

বিদেশে বসবাসরত বেশির ভাগ শিক্ষিত, পদস্থ বাংলাদেশী দেশ নিয়ে খুবই হতাশ। আমি এর ব্যতিক্রম। পৃথিবীর নানা প্রান্তে দেখা বাংলার মুখ আমাকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করে যে আমরা হেরে যাব না। সংগ্রাম করতে করতে আমরা একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে যাব। দেশ থেকে ইন্টারনেটে ভেসে আসা অজস্র দুঃসংবাদের বিপরীতে আমি যখন আলীম চাচা, মামুন আর মধ্যপ্রাচ্যের নাম না জানা চাতকদের এক পাল্লায় মাপি তখন বাংলার মুখ-এর পাল্লাটাই ভারী হয়।

দুঃখ আর লজ্জার বিষয় এই যে, যে মানুষগুলো তাদের পরিশ্রমী কাঁধে পুরো বাংলাদেশটা বয়ে নিয়ে চলেছে, বাংলা সাহিত্য বা কবিতায় তাদের কোন জায়গা হয়নি। কয়েক মাস আগে টুইটার ঘাটতে গিয়ে একজন বাঙালি-বৃটিশ কবির একটা কবিতা চোখে পড়ল –

“I come from seeds that sprouted in the face of
Slavery, war and famine.
Whose only language was survival,
and whose only prayer was me.
I do not know how to die.
So watch me bloom instead.”

Wild flower, Orin Begum

বিদেশের মাটিতে বাংলার মুখগুলোর যে টিকে থাকার লড়াই, যে দৃঢ় সংকল্প তার পুরোটাই যেন এই কয়েক ছত্রে ধারণ করে ফেলা হয়েছে। বাংলা ভাষায় এমন একটা কবিতা কোথায়?

প্রাক্তন শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশন: ২০০২ - ২০০৩

হাবিবুর রহমান খান

সেশন: ২০০২ - ২০০৩