fbpx

মুহূর্ত

বেলা বাজে সাড়ে পাঁচটে। ফাহিমের আজ অফিস থেকে বের হতে বড্ড দেরি হয়ে গেল, বৃহস্পতিবার কাজের প্রেসারটাও যে অনেক বেশি থাকে এদিন। তার উপর রয়েছে একটা ক্লাসিক বস- কোনো বিশেষ দিনেই ওনার যেন কাজের স্যাম্পল স্পেসের পুরোটা নিয়ে হাজির হতে হয় ফাহিমের সামনে, কোনো সাবসেট বা ইভেন্ট দেয়ার কথা ওনার সেদিন মাথাতেও আসে না বোধ হয়, এককথায় যাকে বলে অসহ্য যন্ত্রণার সম্ভাবনা।

ঐদিকে ফাহিমকে সুপ্রীতি আসতে বলেছে ঠিক বিকেল ৫ টায় সীমান্ত স্কয়ার এ, কী যেন জরুরি কাজ আছে। আসলে জরুরি কাজ যে কী বা আজকের দিনটাও যে কী তা ফাহিম খুব ভালো করেই জানে। আজকের এই দিনে যে তার ফুলশূন্য জীবনবাগানে প্রথম ফুল ফুটেছিল, যে ফুল তার কাছে বিশ্বের সবচেয়ে অপরূপ ফুলের চেয়েও অপরূপ, এই একটি দিনের আশায় যে সারাবছর অপেক্ষা করে থাকে, তা কী আর ভোলা যায়! তবুও সে প্রতিবারই ভুলে যাওয়ার ভান করে কারণ, এই বিশেষ উপলক্ষে সুপ্রীতির বকুনি যে তার বেশ লাগে।

আদৌতে এখানেই হয়েছিল তাদের প্রথম সাক্ষাৎ, শীতের সেই বিকেলে মিষ্টি মিষ্টি রোদে সেদিনের সেই পথচলা আজও যেন তা মনের ডায়েরির প্রচ্ছদ হয়ে আছে। যদিও দুজনের কেউই আজও স্বীকার করতে নাছোড়বান্দা, তবুও দুজনেই যে প্রথম দেখায় মন দিয়েছিল অপরজনকে তার স্বীকারোক্তি কিন্ত মনের ডায়েরির প্রথম পৃষ্ঠায়ই লেখা আছে।

সেই প্রথম দেখা থেকে আজ তাদের বিয়ের দশ বছর হয়। বরাবরই সুপ্রীতি এসে দাঁড়িয়ে থাকে একদম ঠিক সময়ে আর ফাহিম, সে তো বরাবরই আসে এক-দেড় ঘন্টা পর। একবার তো বৃষ্টির দিনে এসেছে তিন ঘন্টা পর, তাও সুপ্রীতি দাঁড়িয়ে আছে সেই এক জায়গায়। কারণ সে জানে, ফাহিম যে কথা দিয়েছে, সে আসবেই। এই যে একে অপরের প্রতি বিশ্বাস, এই বিশ্বাসই যে তাদের ভালোবাসার স্ট্যাটিসটিক্স।

মতিঝিল থেকে জ্যাম ঠেলে ফাহিম যখন লোকাল বাস থেকে নামল তখন তার মেজাজ যেন আকাশ ছুঁই ছুঁই, মনও বড়ই বিষণ্ণ, কারণ প্রত্যেকবার সুপ্রীতির জন্য যে বেলি ফুল নিয়ে এসে চমকে দেয় আজ তাও কিনতে পারলো না সে। কিন্ত নীল শাড়িতে একপাশে শাল দিয়ে দাঁড়ানো ছিমছাম রূপবতী সুপ্রীতিকে দেখে দিনের সকল ক্লান্তি, ক্ষোভ, অবসাদ যেন নিমিষে উবে গেল। কে বলবে দশ বছর হয়েছে, আজও তো মনে হয় যেন তাকে প্রথম দেখেছি। সেই সুপ্রীতি, যে কিনা তার নামকে অর্থবহ করে চলেছে সারাটি জীবন।

যথারীতি সুপ্রীতি মুচকি হেসে বলে উঠল, ” কী ফাহিম সাহেব, আজকেও দেরি? আচ্ছা, এ ভুল মাফ করা হবে, যদি বলতে পারো আজ কোন দিন? আর কেনই বা তোমাকে এখানে আসতে বললাম?” ফাহিম গভীর চিন্তার ভান করে বললো, “না, সুপ্রীতি কিছুতেই তো মনে পড়ছে না। তুমিই বলো।” এবার সুপ্রীতি রেগে গেল, বলল – “না, তোমাকে নিয়ে তো আর পারা গেল না, বাপু। প্রত্যেকবার কী করে একটা মানুষ একই ভুল করতে পারে? এই নিয়ে দশ বছর হয়ে গেল আর তুমি একবারও আমাদের বিবাহবার্ষিকী মনে রাখতে পারলে না? কী করে একটা মানুষ এরকম হতে পারে? এ আমি কার সাথে সংসার করি, বুঝতে পারি না।”

ফাহিম এতক্ষণ সুপ্রীতির বকুনি মুগ্ধ হয়ে শুনছিলো। তারপর সুপ্রীতির হাতটা ধরে বলল, “আচ্ছা, আচ্ছা, সরি সরি। নেক্সট টাইম আর ভুল হবে না, পাক্কা।” সুপ্রীতি হতাশার সুরে বলে, “সেই তোমার নেক্সট টাইম যে আর কবে আসবে, আদৌ এ জীবদ্দশায় তার দেখা পাব কিনা কে জানে?” ফাহিম বলে, “এরপরের বার আর কোনো ভুল হবেনা, দেখো। চলো হেঁটে হেঁটে লেকের ধারে যাই।”

আসলে সুপ্রীতি কিন্ত রাগ করেনি, কখনোই করে না। কারণ সুপ্রীতি ভালো করেই জানে ফাহিম কিছুই ভুলে যায়নি, ও প্রত্যেকবারই ভুলে যাওয়ার অভিনয় করে, আসলে সুপ্রীতির রাগ ভাঙাতে ফাহিমের হাত ধরে হাঁটার যে অভিনব কৌশল, তা সুপ্রীতির বেশ লাগে। একটু পরেই দেখা যাবে ফাহিম ওর জ্যাকেটের ভেতর থেকে একটা বেলি ফুলের মালা সুপ্রীতির হাতে পড়িয়ে বলবে, “এই নাও তোমার বিবাহবার্ষিকীর উপহার, মাই কুইন। আমি অতোটাও আন-রোমান্টিক নই। “

কিন্ত আজ এখনও তা হচ্ছে না, সুপ্রীতির আর তর সইল না, ভাবলো এবার বলেই ফেলবে আর যে ভাবা সেই কাজ, ” আচ্ছা ফাহিম, অনেক অভিনয় হয়েছে, দাও এবার বেলিফুলের মালা। আমি জানি প্রত্যেকবার তুমি আমাকে প্রথমে রাগিয়ে তারপর সারপ্রাইজ দিতে চাও, কিন্ত আজ এতো দেরি করছো কেন? আর তো ভাল্লাগছে না।” ফাহিম অবাক হয়ে বলল, “তুমি তাহলে সবই জানতে?” সুপ্রীতি একটু হেসে, “দশ বছর ধরে তোমাকে দেখছি। এটুকুও যদি না বুঝি, তবে আর তোমার বৌ হলাম কীভাবে? দাও এবার মালা দাও, তারপর বাকি পথ হাঁটা যাবে কেমন?” এবার ফাহিমের মন খারাপ হয়ে গেল, বলল “সরি, সুপ্রীতি, আজ বের হতে এতো দেরি হয়ে গেল, আর যে দোকান থেকে সবসময় ফুল কিনি সে দোকানটাও আজ কেন যেন বন্ধ ছিল, তাই আর খোঁজার সময়ও পেলাম না, কিনতেও পারলাম না।” সুপ্রীতির ওর বিষণ্ণ মুখ দেখে খুব মায়া হলো, “আচ্ছা, ফুলের মালা লাগবে না, তুমি তো আছো তাতেই হবে।” ফাহিম হঠাৎ দেখল, দূরে একটি গোলাপ গাছ, সুপ্রীতিকে বলল, “এক মিনিট দাঁড়াও, আমি আসছি।” এরপর ছুটে গিয়ে একটা গোলাপ নিয়ে এসে সুপ্রীতির হাতে দিয়ে বলল, “আজ থেকে না হয় গোলাপ দিয়ে আমাদের নতুন দশকের পথচলা শুরু হবে। কী বলো সুপ্রীতি?” সুপ্রীতি মুচকি হেসে বলল, “বেশ তো, আজ না হয় আবার দশ বছর আগের সেই নীল জ্যাকেট পড়া ফাহিম আর দশ বছর আগের সেই নীল শাড়ি পরিহিত যুবতীর নতুন করে পরিচয় হলো।” ফাহিম সুপ্রীতিকে হাতটা বাড়িয়ে আগলে ধরে বলে, কী মনে হয়, “ওরা কী দশ বছর পর আবার তোমার আমার মতো এখানে আসবে? ” সুপ্রীতি ফাহিমের দিকে তাকিয়ে হেসে, “তা তো আসবেই। ভাবছি তখন ফাহিম নতুন কী ফুল দিবে সুপ্রীতিকে? হাসনাহেনা?” ফাহিম হেসে বলে, “হুম দেয়া যেতে পারে। তবে একটু জোগাড় রাখতে হবে আরকি!”

তারপর দুজন হাঁটতে হাঁটতে লেকের ধারে যায়।
আজ উঠেছেও পূর্ণিমার চাঁদ। দুজনে মুগ্ধ চোখে চাঁদের দিকে তাকায় আর তখন শুনে কোথায় যেন বাজছে, অর্ণবের সেই গান যা ছিল তাদের ভালোবাসার অ্যান্থেম-

“সময় যেন কাটে না আর..
এক ঘেয়ে লাগে না কিছু..
সময় যেন মন শুধু..
ছুটে যায় স্বপ্নের পিছু..
ভাল লাগা ভাল লাগা..
দারুন ভালো লাগা..
এটাই বোধ হয় ভালোবাসা..
এটাই বোধ হয় প্রেম..”

তারপর দুজন দুজনের দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকায় আর দুজনেরই চোখের সামনে ভেসে উঠে ভালোলাগার সেই প্রথম মুহূর্ত যা দুজনেরই মনের ডায়েরির মণিকোঠায় চিরস্থায়ী হয়ে আছে। 

শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়