fbpx

অক্টোবর ১৫, ২০২৪

Humayun Ahmed - Work

হুমায়ূন আহমেদের কর্মব্যস্ত জীবন

হুমায়ূন আহমেদ (১৩ নভেম্বর ১৯৪৮–১৯ জুলাই ২০১২) ছিলেন একজন বাংলাদেশী ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার, গীতিকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা।  বলা হয় তিনি বিংশ শতাব্দীর জনপ্রিয় বাংলা কথাসাহিত্যিকদের একজন এবং স্বাধীনতা পরবর্তী অন্যতম সেরা লেখক। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় তিন শতাধিক। তাঁর বেশ কিছু গ্রন্থ পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে, বেশ কিছু গ্রন্থ স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত। এটা বললেও ভুল হবে না যে, তিনি প্রায় তিন যুগের বেশি সময় বাংলা সাহিত্যে একক আধিপত্য করেছেন। 

কেমন ছিলো হুমায়ূনের শৈশব?

তাঁর জন্ম ১৩ নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত নেত্রকোণা মহুকুমার মোহনগঞ্জে, তাঁর নানা বাড়িতে। তাঁর পিতা শহীদ ফয়জুর রহমান আহমদ এবং মা আয়েশা ফয়েজ। তাঁর পিতা একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন যিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তৎকালীন পিরোজপুর  মহকুমার উপ-বিভাগীয় পুলিশ অফিসার (এসডিপিও) হিসেবে কর্তব্যরত অবস্থায় শহীদ হন।

হুমায়ূনের সাহিত্যের জগতে প্রবেশ এর পিছনে তাঁর পরিবারের কি কোন ভুমিকা ছিলো? এ প্রশ্নের জবাব মিলবে তাঁর শৈশবে।

হুমায়নের বাবা ছিলেন সাহিত্য অনুরাগী একজন সৎ অফিসার; পত্রপত্রিকায় তাঁর লেখা ছাপা হত। বগুড়া শহরে থাকাকালীন একটি  গ্রন্থ প্রকাশ করেন – ‘দ্বীপ নেভা যার ঘরে’। তাঁর মা’র লেখালেখির অভ্যাস না থাকলেও শেষ জীবনে একটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন যার নাম ‘জীবন যে রকম’। পরিবারে সাহিত্যমনস্ক আবহাওয়া ছিলো। তাঁর অনুজ মুহম্মদ জাফর ইকবাল দেশের একজন শিক্ষাবিদ এবং কথাসাহিত্যিক; সর্বকনিষ্ঠ ভাই আহসান হাবীব রম্য সাহিত্যিক এবং কার্টুনিস্ট। তাঁর তিন বোন হলেন সুফিয়া হায়দার, মমতাজ শহিদ ও রোকসানা আহমেদ।

তাঁর রচিত আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় যে ছোটকালে হুমায়ূন আহমেদের নাম রাখা হয়েছিল শামসুর রহমান; ডাকনাম কাজল। তাঁর পিতা (ফয়জুর রহমান) নিজের নামের সাথে মিল রেখে ছেলের নাম রাখেন শামসুর রহমান। পরবর্তীতে আবার তিনি নিজেই ছেলের নাম পরিবর্তন করে ‌হুমায়ূন আহমেদ রাখেন। 

আমরা হুমায়ূনের জীবন শুধু ইতিহাস আকারে জানতে চাই না, আমরা তাঁর জীবন আর তাঁর সৃষ্টি সাহিত্যকে-ও দেখতে চাই এক অন্যরকম বিশ্লেষণে, একজন পাঠকের বিশ্লেষণে। 

মধ্যবিত্ত পরিবারে অনেক ভাইবোনের মাঝে বেড়ে ওঠা হুমায়ূন বাংলা সাহিত্যে মধ্যবিত্ত পরিবারের অপূর্ব কিছু উপন্যাস উপহার দিয়েছেন। একটি মধ্যবিত্ত পরিবার, অর্থকষ্ট, জীবনের ছোট ছোট কষ্ট, ছোট ছোট পাওয়া – এ সব কিছু হুমায়ূন আহমেদ নিয়ে এসেছেন তাঁর লেখায়। 

তাঁর লেখা বহু গল্পে মায়াবী চেহারার এক বালককে দেখা যায়, যার নাম কাজল। বাবার বদলির সুবাদে জায়গার পরিবর্তন, আর তাতে নতুন নতুন মানুষ, নতুন উপলব্ধিই হয়তো তাঁর সাহিত্যের ভিত গড়ে দিয়েছিলো। 

যুবক বয়সে মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন গোটা দেশের জন্য একটা কঠিন সময় চলছে সে সময় তিনি তাঁর বাবাকে হারান। ‘সূর্যের দিন’ – মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা এ কিশোর উপন্যাস পড়লে পাঠক বুঝতে পারে মুক্তিযুদ্ধকে কতটা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছেন তিনি। বাবার এই মৃত্যু হুমায়ূনের জীবনের এক কষ্টের অধ্যায়। এ কষ্টই হয়তো তাকে ‘আগুনের পরশমণি’ উপন্যাস আর চলচ্চিত্র সৃষ্টিতে সাহায্য করেছিল।

হুমায়ূনের ভাষায় – “এই সংসারে বাস করতে হলে মাঝে মধ্যে কষ্ট পেতে হয়। সংসারের অনেক নিয়মের একটি হলো কষ্ট পাওয়া।” (সূত্র: কালো যাদুকর)

হুমায়ূন আহমেদের শিক্ষাজীবনেও প্রভাব পড়ে বাবার এই বদলির চাকরিতে। হূমায়ুন আহমেদের লেখাগুলো পড়লে তাঁর শৈশব নিয়ে একটা ধারণা পাওয়া যায়। তাঁর অনেক গল্পেই বড় চাচা নামে একজন রাগী চরিত্র, বাবার বদলি নিয়ে নতুন নতুন জায়গায় যাওয়া কিশোর, বন্ধুর মত বাবা, আর বজ্রের মত শক্তিশালী মা’র খোঁজ মেলে। 

হুমায়ূন আহমেদের শিক্ষাজীবনের কথা না বললেই নয়। বাবা চাকরি সূত্রে দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করেছেন বলে হুমায়ূন আহমেদ দেশের বিভিন্ন স্কুলে লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়েছেন। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় ১৯৫৫ সালে কিশোরী মোহন পাঠশালায় (বর্তমান কিশোরী মোহন বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়)।  তিনি ১৯৬৩ সাল বগুড়া জিলা স্কুলে  নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৬৫ সালে তিনি এই বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন এবং রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। তারপর তিনি ঢাকা কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন শাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন এবং প্রথম শ্রেণিতে বিএসসি (সম্মান) ও এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন এবং ৫৬৪ নং কক্ষে তাঁর ছাত্রজীবন অতিবাহিত করেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ মুহসীন হলে থাকা অবস্থায়ই লেখা।

একজন ভালো লেখকের জন্ম হয় বহু লেখকের লেখা পড়ে। হুমায়ুন আহমেদ প্রচুর পড়েছেন এবং প্রভাবিত হয়েছেন। তাঁর  প্রমাণ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের  ছোটগল্প “শৈলজ শিলা” গল্প থেকে নিজ কন্যার নাম রাখেন শীলা।

এখন আসা যাক তাঁর কর্মজীবনে।

১৯৭৩ সালে ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত অবস্থায় তিনি তাঁর প্রথম ছোটগল্প রচনা করেন। ‘সৌরভ’ নামক গল্পটি বিচিত্রা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।  ১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে যোগদান করেন। এই বছর বিচিত্রা পত্রিকায় ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় তাঁর রচিত উপন্যাস অচিনপুর। পরে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পলিমার রসায়ন বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি লাভ করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র জীবনে একটি নাতিদীর্ঘ উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য জীবনের শুরু। ‘শঙ্খনীল কারাগার’ তাঁর লেখা প্রথম উপন্যাস, কিন্তু প্রকাশিত দ্বিতীয় গ্রন্থ। প্রথম উপন্যাসের নাম ‘নন্দিত নরকে’, ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে উপন্যাসটি প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭২-এ লেখক-সমালোচক আহমদ ছফার উদ্যোগে উপন্যাসটি খান ব্রাদার্স কর্তৃক গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রখ্যাত বাংলা ভাষাশাস্ত্র পণ্ডিত আহমদ শরীফ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এ গ্রন্থটির ভূমিকা লিখে দিলে বাংলাদেশের সাহিত্যামোদী মহলে কৌতূহল সৃষ্টি হয়। বইটির প্রচ্ছদ করেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও ভাস্কর শামীম শিকদার। উপন্যাসটি লেখক শিবির হতে বর্ষসেরা উপন্যাসের পুরস্কার লাভ করে। তাঁর রচিত তৃতীয় উপন্যাস বিজ্ঞান কল্পকাহিনীমূলক ‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’। বিজ্ঞান সাময়িকী সাপ্তাহিক পত্রিকায় উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।

কেন ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাসটি এতো আলোচনায় আসে? নিম্নবিত্ত পরিবারের আর্থিক জীবনে নরক যেখানে নন্দিত তা-ই নিয়ে লেখা উপন্যাস; নামটিই উপন্যাস পড়ার আগ্রহ জাগাতে ভূমিকা পালন করেছে।

এককথায়, এটি লেখকের সেরা উপন্যাসের একটি। সাবলীল ভাষায় বাইরের দুনিয়ায় মেয়েরা কতটা অনিরাপদ তা লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন। একজন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মেয়ের এই করুণ পরিণতি আমাদের চারপাশ সম্পর্কে সজাগ করতে অনেকাংশে ভূমিকা রেখেছে। বইয়ের শেষ লাইনগুলো ছিল-“ভোর হয়ে আসছে। দেখলাম চাঁদ ডুবে গেছে। বিস্তীর্ণ মাঠের উপরে চাদরের মতো পড়ে থাকা ম্লান জ্যোৎস্নাটা আর নেই।”

হুমায়ূন আহমেদ আজিমপুর স্কুলের ক্লাস নাইনে পড়ুয়া কিশোরী গুলতেকিন কে বিয়ে করেন ১৯৭৬ সালে। পাগলাটে, খামখেয়ালী আর প্রেমিক হুমায়ূন ভালবেসেই বিয়ে করেছিলেন গুলতেকিনকে। মুগ্ধ ছিলেন তাঁর সৌন্দর্যে, গুনে। অভিজাত পরিবারের মেয়ে হয়েও গুলতেকিন একজন আধপাগল লেখকের প্রেমে পড়ে বিয়ে করেন। এই দম্পতির তিন মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ে নোভা আহমেদ, মেজো মেয়ে শীলা আহমেদ এবং ছোট মেয়ে বিপাশা আহমেদ। তাঁর বড় ছেলের নাম নুহাশ আহমেদ। ‘অয়োময়’ নাটক লেখার সময় অন্য আরেকটি ছেলে সন্তান অকালে মারা যায়। তিনি তাঁর নাম রেখেছিলেন রাশেদ হুমায়ূন। 

নুহাশ ও আলাদীনের প্রদীপ বইটির মূল চরিত্র নুহাশ, কিন্তু চরিত্রটি হয়তো তাঁর মেয়ের আদলেই গড়া। দায়িত্বহীনতা, স্বামী ও স্ত্রী’র কলহ হয়তো নিজের জীবন থেকে নেয়া। হুমায়ূন আহমেদের একটি লেখায় তিনি লিখেছিলেন, ‘অয়োময়’ গল্প লেখার মূহুর্তে সন্তানের মৃত্যুর সময় তিনি গুলতেকিনকে সঠিক যত্ন করেন নি, এমনকি সান্ত্বনাও দিতে পারেননি, কারণ তাকে যে নাটক লিখতে হবে, the show must  go on। এই গল্পে  মেয়ের সাথে বাবার যে মধুর ও আদরে ভরা সম্পর্ক আর বাবা চরিত্রকে তিনি নিজের আদলেই গড়েছেন তা পাঠক সহজেই বুঝতে পারেন।

টেলিভিশন নাট্যকার হিসেবে হুমায়ূন আহমেদকে আবিষ্কার করেন নওয়াজিশ আলি খান। তিনি হুমায়ূন আহমেদকে টেলিভিশনের জন্য নাটক লিখতে আহবান জানান। টেলিভিশনের জন্য হুমায়ূন আহমেদের প্রথম কাজ হল টেলিভিশন নাটক – ‘প্রথম প্রহর’। এটি ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। নাটকটি পরিচালনা করেন নওয়াজিশ আলি খান। মানুষের সততাকে কেন্দ্র করে নির্মিত নাটকটি প্রচারের পর ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। পরবর্তীতে খান, হুমায়ূন আহমেদ রচিত অসময়, অযাত্রা, বিবাহ, এসো নিপবনে, নিমফুল প্রভৃতি নাটক প্রযোজনা করেন। হুমায়ূন আহমেদ রচিত প্রথম ধারাবাহিক নাটক ‘এইসব দিনরাত্রি’ (১৯৮৫)। নাটকে লিউকোমিয়া আক্রান্ত শিশু চরিত্র ‘টুনি’কে বাঁচিয়ে রাখার জন্য হুমায়ূনের কাছে এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনে দর্শকের পক্ষ থেকে প্রচুর চিঠি আসে, কিন্তু তিনি তাঁর চিত্রনাট্যে অটল থাকেন।

নওয়াজিশ আলি খানের প্রযোজনায় হুমায়ূন আহমেদ রচিত প্রথম টেলিভিশন ধারাবাহিক ‘বহুব্রীহি’। এটি ১৯৮৮-৮৯ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। ধারবাহিকটির প্রতিটি পর্ব ছিল বিষয়ভিত্তিক ও স্বয়ংসম্পূর্ণ, যা ছিল বাংলাদেশের টিভি নাটকের অভিনব ব্যাপার। এই ধারাবাহিকের মাধ্যমে কিছু সামাজিক বিষয়, যেমন – মিথ্যা না বলা ও মাছের বংশ রক্ষার জন্য সপ্তাহে এক দিন মাছ না খাওয়া, এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাগিয়ে তোলার ভিন্ন উদ্যোগ প্রভৃতি বিষয় তুলে ধরা হয়। ধারাবাহিকের একটি সংলাপ “তুই রাজাকার” সে সময় বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে । 

‘বহুব্রীহি’ নাটকের পর হুমায়ূন আহমেদ সিদ্ধান্ত নেন আর ধারাবাহিক লিখবেন না, শীলা আহমেদ কে বলেন তাদের ফ্রিজে “ধারাবাহিক আর লিখবেন না” এ স্টেটমেন্ট টাঙ্গিয়ে রাখতে। কিন্তু তাকে ধারাবাহিকের জগতে ফিরতে হয়।

এই সময়ে নির্মিত হয় টেলিভিশন নাটক ‘অয়োময়’। এই নাটকেই তাঁর কন্যা শীলা আহমেদের অভিনয়ে পরিপূর্ণ অভিষেক হয়। আহমেদ এই নাটকের মহড়া, চিত্রায়ণ ও সম্পাদনার সাথে যুক্ত ছিলেন, যা তাকে পরবর্তীতে পরিচালক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে।

ময়মনসিংহ অঞ্চলের ভাটি এলাকার জমিদারদের নিয়ে লেখা এই উপন্যাসে তাকে গবেষণা এবং নাটকের চিত্রায়নে বেগ পেতে হয়েছিল। মুক্তাগাছার জমিদারবাড়ির লোকমুখে শোনা এক অদ্ভুত জমিদার আর তাঁর তিন স্ত্রী’র গল্প নিয়েই তিনি লিখলেন অয়োময়। বাগানের তিনটি গাছ নিয়ে নাম রাখলেন জমিদারের ৩ স্ত্রী’র নাম – এলাচি , লবঙ্গ, দারুচিনি। 

অয়োময় নাটকের কিছু গান হুমায়ূনের লেখা। এ নাটকের সবচেয়ে প্রিয় গান ছিল – “আমার মরণ চাঁদনী পশর রাইতে যেন হয়।“ তিনি চাইতেন মৃত্যুর ঠিক আগের মুহূর্তে অসহ্য সুন্দর পৃথিবীকে দেখে যেতে।

তাঁর রচিত আরেকটি অন্যতম জনপ্রিয় টেলিভিশন ধারাবাহিক হল ‘কোথাও কেউ নেই’ (১৯৯০)। এই ধারাবাহিকের বাকের ভাই চরিত্রটি তুমুল দর্শকপ্রিয়তা লাভ করে। এই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন আসাদুজ্জামান নূর। বাকের ভাইয়ের ফাঁসি রুখতে দর্শক ‘বাকের ভাইয়ের কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’ স্লোগান দিয়ে মিছিল করে। এমনকি, আহমেদের এলিফ্যান্ট রোডের বাড়িতে দর্শকেরা আক্রমণ করে। এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে তিনি রমনা থানায় জিডিও করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি অনেকগুলো এক পর্বের নাটক নির্মাণ করেছেন। যাদের মধ্যে খেলা, অচিন বৃক্ষ, খাদক, একি কাণ্ড, একদিন হঠাৎ, অন্যভুবন উল্লেখযোগ্য।

হুমায়ূন আহমেদের অন্যতম কৃতিত্ব বাংলা সাহিত্যে অতিপ্রাকৃত ঘটনাকে স্থান করে দিয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদের নিজের জীবনেও এমন কিছু অতিপ্রাকৃত ঘটনার উল্লেখ করেছেন তিনি , যেমন বিখ্যাত গোলাম মোর্তাজা’র (‘ব্রাহ্মী লিপি ও সম্রাট প্রিয়দর্শী’ গ্রন্থের লেখক)। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারের সাথে দেখা হয় হুমায়ুনের। তাঁর স্ত্রী ছিলেন একজন বেশ শক্ত মহিলা, তাঁর এক শিশু কন্যা পুকুরে ডুবে মারা যাবে এমন মৃত্যুর পূর্বাভাস পেয়ে সচেতন থেকেও বাঁচাতে পারননি।  হুমায়ূনের ‘কালো জাদুকর’ সহ বহু গল্পে এভাবে পুকুরে ডুবে ফুটফুটে মেয়ের মৃত্যুর উল্লেখ রয়েছে। সেই সাথে মায়ের মনের সিক্সথ্‌ সেন্সকে বহু গল্পে তুলে ধরেছেন। 

মিসির আলি চরিত্রটি আহমেদের মাথায় আসে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটার ফার্গো শহরে স্ত্রী গুলতেকিনের সাথে গাড়িতে ভ্রমণকালে। এই ঘটনার অনেকদিন পর তিনি মিসির আলি বিষয়ক প্রথম উপন্যাস ‘দেবী’  লিখেন। ১৯৮৫ সালে উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে তিনি এই চরিত্রকে কেন্দ্র করে রচনা করেন – ‘নিশীথিনী’ (১৯৮৭), ‘নিষাদ’ (১৯৮৮), ‘অন্য ভুবন’ (১৯৮৯) ও ‘বৃহন্নলা’। এছাড়াও হুমায়ূন আহমেদের মিসির আলিকে নিয়ে লেখা প্রথম উপন্যাস ‘দেবী’ থেকে ২০১৮ সালে নির্মিত হয় ‘দেবী’ নামের একটি চলচ্চিত্র। যেটির মাধ্যমে প্রথমবারের মতো মিসির আলির বড় পর্দায় অভিষেক হয়। ছবিটি পরিচালনা করেন অনম বিশ্বাস। এতে মিসির আলির ভূমিকায় অভিনয় করেন চঞ্চল চৌধুরী। 

বাস্তবে মিসির আলী চরিত্র হুমায়ূন নিজেই। ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ছবির শুটিং সহ নানা শুটিং এ নুহাশ পল্লী এবং নানা সেটে জ্বীনের উপদ্রবসহ নানা অদ্ভুতুড়ে ঘটনা এবং নিজে সমাধান করে একটি ব্যাখ্যা দাড় করাবার অদ্ভুত ক্ষমতা থেকেই হুমায়ূন লিখেন মিসির আলীকে নিয়ে বিভিন্ন রচনা। যেখানে শেষমেষ কখনো যুক্তি টেকে কখনো বা জয় হয় অতিপ্রাকৃত শক্তির। সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার এবং গাছের অদ্ভুত সত্ত্বা নিয়ে তাঁর মত লেখা বাংলাদেশে কেউই লিখতে পারেননি। ‘কালো জাদুকর’, ‘অন্যভুবন’ গল্পের প্রাধান চরিত্রকে দেখা যায় জীবনের শেষে গাছে পরিণত হতে, শুনতে অদ্ভুত লাগলেও উপন্যাসের শেষে মোটেও অস্বাভাবিক কিছু মনে হবে না পাঠকের।

হুমায়ূন আহমেদ ১৯৮৭ সালে ঢাকার অদূরে গাজীপুর জেলার সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের পিরুজালি গ্রামে ২২ বিঘা জমির ওপর স্থাপিত বাগান বাড়ি ‘নুহাশ পল্লী’ গড়ে তুলেন। বাড়িটির নামকরণ করা হয় স্ত্রী গুলতেকিন ও তাঁর প্রথম পুত্র নুহাশ হুমায়ূনের নামে। বর্তমানে এর আয়তন আরও বৃদ্ধি করে ৪০ বিঘা করা হয়েছে। তাঁর বহু নাটক, চলচ্চিত্রের শুটিং এখানে সম্পন্ন করা হয়েছে।

হুমায়ূন আহমেদ সৃষ্ট হিমু চরিত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে ‘ময়ূরাক্ষী’ উপন্যাস দিয়ে। ১৯৯০ সালে মে মাসে অনন্যা প্রকাশনী থেকে বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে চরিত্রটি পাঠকদের, বিশেষ করে তরুণ সাহিত্যপ্রেমীদের মাঝে জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে একে একে প্রকাশিত হতে থাকে ‘দরজার ওপাশে’ (১৯৯২), ‘হিমু’ (১৯৯৩), ‘পারাপার’ (১৯৯৪), ‘হিমু’ (১৯৯৫), ‘হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম’ (১৯৯৬), ‘ হিমুর দ্বিতীয় প্রহর’ (১৯৯৭), ‘হিমুর রূপালী রাত্রি’ (১৯৯৮) এবং ‘একজন হিমু কয়েকটি ঝিঁ ঝিঁ পোকা’ (১৯৯৯) ইত্যাদি। এছাড়া এই উপন্যাসগুলো নিয়ে হিমু সমগ্র (১৯৯৪), হিমু সমগ্র (দ্বিতীয় খণ্ড) (১৯৯৮), এবং হিমু অমনিবাস (২০০০) প্রকাশিত হয়। হুমায়ূন আহমেদ এর লেখায় রাজনৈতিক প্রণোদনা অনুপস্থিত – এধরণের কথা বলাও হলেও হিমুর লেখাগুলোর ক্ষেত্রে তা সত্য নয়।

হিমু হলুদ পাঞ্জাবী পড়া উদ্ভ্রান্ত যুবক, এলোমেলো জীবনে যার গভীর জীবনদর্শন রয়েছে। 

শুভ্র চরিত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে ‘দারুচিনি দ্বীপ’ উপন্যাস দিয়ে। যদিও শুভ্র চরিত্রটি প্রথম আসে তাঁর লেখা একটি ছোটগল্পে, যার নাম ‘সাদা গাড়ি’। শুভ্রকে নিয়ে রচিত তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস হল ‘মেঘের ছায়া’। এটি ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয়। দারুচিনি দ্বীপ উপন্যাসের গল্পের শেষ থেকে শুরু হয় পরবর্তী উপন্যাস ‘রূপালী দ্বীপ’ (১৯৯৪)।

অসম্ভব  সুন্দর, মিষ্টি স্বভাবের এবং একটি ধনী পরিবারের দত্তক নেয়া ছেলে শুভ্র। শুধু শুভ্র নয় বহু গল্প উপন্যাসে অসম্ভব সুন্দর কিশোরী এবং কিশোরদের বর্ণনা থাকতো হুমায়ূনের লেখায়।

১৯৯২ সালে হুমায়ূন আহমেদ রচিত ‘শঙ্খনীল কারাগার’ উপন্যাস অবলম্বনে মোস্তাফিজুর রহমান একই নামের চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। শঙ্খনীল কারাগার শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ চারটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে এবং আহমেদ শ্রেষ্ঠ কাহিনীকারের পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৪ সালে ‘আগুনের পরশমণি’ চলচ্চিত্র দিয়ে তাঁর পরিচালনায় অভিষেক হয়। এই চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য তিনি ২৫,০০০ টাকা সরকারি অনুদান পান। তিনি মূলত তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু চলচ্চিত্রকার আনিস সাবেতের অকাল মৃত্যুর খবর শোনার পর চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহী হন। চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাওয়া শিক্ষকতার চাকরি থেকে অব্যহতি দেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধভিত্তিক চমৎকার গল্প ও দুর্দান্ত নির্মাণশৈলী দিয়ে তিনি দর্শকের মন জয় করেন। চলচ্চিত্র পরিচালক কবীর আনোয়ার বলেন, “এতোবড় মাপের ছবি বাংলাদেশে আগে কখনো হয় নি, জানি না সামনে কেউ আসবেন কিনা এরকম ছবি বানানোর মেধা নিয়ে।” চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ আটটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে এবং আহমেদ শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার ও সংলাপ রচয়িতা বিভাগে পুরস্কার অর্জন করেন। ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর উপন্যাস ‘কবি’। এতে তিনজন কবির গল্প বিবৃত হয়েছে। ১৯৯৫ সাল থেকে ছোটদের কাগজ পত্রিকায় ‘কালো জাদুকর’ উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করতে থাকেন। পার্ল পাবলিকেশন্স ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একুশে বইমেলায় বইটি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে।

১৯৯৯ সালে তিনি নির্মাণ করেন লোক-নাট্যধর্মী ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’। এটি তাঁর নিজের রচিত একই নামের উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণ। চলচ্চিত্রটি সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করে এবং ২০০২ সালে ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের অধিভুক্ত সাইট অ্যান্ড সাউন্ড ম্যাগাজিনের করা জরিপে সমালোচকদের বিচারে এটি সেরা দশ বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের তালিকায় নবম স্থান অধিকার করে।

এছাড়া ছবিটি সাতটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। হুমায়ূন আহমেদ মূলত গান রচয়িতা বা গীতিকার নন। কেবল নাটক ও চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে তিনি গান রচনা করে থাকেন। এই চলচ্চিত্রের জন্য তাঁর রচিত “এক যে ছিল সোনার কন্যা” এবং “আমার ভাঙা ঘরে” গান দুটি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। প্রথম গানটিতে কণ্ঠ দিয়ে গায়ক সুবীর নন্দী শ্রেষ্ঠ পুরুষ কণ্ঠশিল্পী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।

২০০০ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয় তাঁর রচিত উপন্যাস ‘বৃষ্টিবিলাস’। মধ্যবিত্ত পরিবারের টানা পোড়ন নিয়ে লেখা বইটি তাঁর সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের একটি। ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই বইটির দ্বাদশ মুদ্রণ বের করতে হয়। ২০০১ সালে ‘দুই দুয়ারী’ চলচ্চিত্র সকল শ্রেণির দর্শকদের কাছে দারুণ গ্রহণযোগ্যতা পায়। এই চরিত্রে অভিনয় করে রিয়াজ শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। ২০০৩-এ নির্মাণ করে জমিদারদের কঠোর মনোভাব, বিলাসিতা আর শিল্পকর্মের প্রতি গভীর অনুরাগ নিয়ে চিত্রিত চলচ্চিত্র ‘চন্দ্রকথা’। এই ছবিতে তিনি একই সাথে মানবতা ও নিষ্ঠুরতার প্রতিফলন ঘটান। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ২০০৪ সালে নির্মাণ করেন ‘শ্যামল ছায়া’ চলচ্চিত্রটি। এটি ২০০৬ সালে শ্রেষ্ঠ বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে একাডেমি পুরস্কারের জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। এছাড়াও চলচ্চিত্রটি কয়েকটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়। ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর রচিত যুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘জোছনা ও জননীর গল্প’।

২০০৩ সালে স্ত্রী গুলতেকিনের সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ হয় এবং পরবর্তীতে অভিনেত্রী, গায়িকা মেহের আফরোজ শাওনকে বিয়ে করেন । এ ঘরে তাদের তিন ছেলে-মেয়ে জন্মগ্রহণ করে। দুর্ভাগ্যবশত প্রথম ভূমিষ্ঠ কন্যাটি মারা যায়। এ কন্যার নাম তিনি রাখতে চেয়েছিলেন লীলাবতী। ছেলেদের নাম নিষাদ হুমায়ূন ও নিনিত হুমায়ূন।

হুমায়ূন আহমেদের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র। এর মধ্যে ২০০৬ সালে মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত ‘দূরত্ব’, বেলাল আহমেদ পরিচালিত ‘নন্দিত নরকে’ এবং আবু সাইয়ীদ পরিচালিত ‘নিরন্তর’। ২০০৭-এ শাহ আলম কিরণ পরিচালিত ‘সাজঘর’ এবং তৌকির আহমেদ নির্মাণ করেন বহুল আলোচিত চলচ্চিত্র ‘দারুচিনি দ্বীপ’। এ সময়ে তিনি হাস্যরসাত্মক ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’ (২০০৭) এবং ত্রিভুজ প্রেমের গল্প নিয়ে ‘আমার আছে জল’ (২০০৮) নির্মাণ করেন।

নিরন্তর  তাঁর ‘জনম জনম’ উপন্যাস নিয়ে লেখা। তিথি নামের একটি অসহায় মেয়ে যাকে বেছে নিতে হয় পতিতার জীবন। আর কোনভাবেই মুক্তি পায় না এ জীবন থেকে।

এ সময়ের দিকে তিনি নিজেই বেশ কিছু বছর ধরে প্রচুর নাটক লিখে নিজেই বিরক্ত ছিলেন। নিজেই বলতেন দর্শক নাটক দেখে না। সে সাথে নাটকের মান এবং লেখার মান প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছিল। বহু আগে ‘অয়োময়’ আর কিছু নাটকের জন্য তাকে নারী বিদ্বেষী খেতাব দেয়া হয়। অনেকেই তাঁর বিরুদ্ধে বিকৃত আর অশ্লীল জিনিস উপস্থাপনার অভিযোগ তুলেন।

তখনো বাংলার দর্শক জানতেন না হুমায়ূনের অভাবে বাংলার নাটক কী হারাতে যাচ্ছে।

তাছাড়া একটি তথ্য অনেকের অজানা, আর তা হল হুমায়ূনের প্রতিষ্ঠা করা একটি স্কুল “শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ”। দুরদুরান্ত থেকে বহু লোক স্কুলটি দেখতে গিয়েছিল। তবে কোন এমপি এ স্কুল ভিজিটে যান নি।

আরও একটি মজার ব্যাপার তিনি ক্ষুদে গানরাজের বিচারক ছিলেন। শান্ত মিয়া নামে এক প্রতিযোগীর হেরে যাবার পর এই যশ নিয়ে পুরাতন হতদরিদ্র জীবনে ফিরে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তাদের নতুন ঠিকানা হয় নুহাশ পল্লীতে এবং শান্ত মিয়া লেখাপড়ার সুযোগ পায়।

তাঁর পরিচালিত সর্বশেষ চলচ্চিত্র “ঘেটুপুত্র কমলা”। চলচ্চিত্রটি ৮৫তম একাডেমি পুরস্কারে (অস্কার)  সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগের জন্য বাংলাদেশ থেকে নিবেদন করা হয়েছিল। 

২০১২ সালের মে মাসে দৈনিক প্রথম আলোর সাহিত্য সাময়িকীকে ‘দেয়াল’ উপন্যাসের দুটি অধ্যায় প্রকাশিত হয়। সেখানে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ঘটনার বিবরণে তথ্যগত ভুল থাকায় আদালত তা সংশোধনের নির্দেশ দেয় এবং কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করে। এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের ভাষ্যমতে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে খন্দকার মোশতাক আহমেদ জড়িত ছিলেন বলে মামলার সাক্ষ্য প্রমাণে উঠে এসেছে। কিন্তু মোশতাক আহমেদ কিছুই জানতেন না, এমনটাই তুলে ধরা হয়েছে ঐ উপন্যাসে। তবে এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, “দেয়াল কোনো রাজনৈতিক উপন্যাস নয়, এ এক ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস৷ এতে ইতিহাসের খলনায়কদেরকে খলনায়ক হিসেবেই দেখানো হয়েছে”। পরবর্তীকালে হুমায়ূন আহমেদ কর্তৃক সংশোধিত বইটি অন্যপ্রকাশ ২০১৩ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশ করেন।

নোবেল বিজয়ী বাংলাদেশী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূস হুমায়ূন আহমেদের সামগ্রিক প্রভাব মূল্যায়ন করে বলেন, “হুমায়ূনের কাজসমূহ সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের পরে সবচেয়ে গভীর ভাবসম্পন্ন ও সবচেয়ে ফলপ্রসূ।” একই রকমভাবে, বাংলাদেশি কবি আল মাহমুদ তাঁর সম্পর্কে বলেন, “ঠাকুর ও নজরুলের মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যের একটি স্বর্ণযুগ শেষ হয়েছে এবং আরেকটি শুরু হয়েছে হুমায়ূন আহমেদের মধ্য দিয়ে।” বাংলাদেশি লেখক ইমদাদুল হক মিলন তাকে “বাংলা সাহিত্যের সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকারী” বলে উল্লেখ করেন, যিনি তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের সকল কাজ ও চিন্তা-ভাবনা নিয়ন্ত্রণ করেন। বাঙালি লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাকে “বাংলা সাহিত্যে একটি শতাব্দীর সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক” উল্লেখ করেন এবং তাঁর মতে “আহমেদ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধায়ের চেয়েও জনপ্রিয় ছিলেন।” বাঙালি লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়  তাকে “উপমহাদেশের অন্যতম সেরা লেখক” বলে উল্লেখ করেন। বাংলাদেশি লেখক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, “তিনি বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন।” পাকিস্তানের প্রাচীনতম ও সর্বাধিক পঠিত ইংরেজি সংবাদপত্র ডন তাকে “বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক কিংবদন্তি” বলে উল্লেখ করে।

অবিশ্বাস্য গল্প ও চরিত্রকে বিশ্বাস্য করে তোলা, চরিত্রের নির্মাণ এবং খলনায়ক বা নেগাটিভ রোলকে পাঠকের কাছে সিম্প্যাথি অর্জন করিয়ে নেয়ার মতো করে কাহিনী উপস্থাপনে হুমায়ূন আহমেদের জুড়ি নেই। এ বিষয়ে তিনি মার্কিন লেখক জন স্টাইনবেক দ্বারা প্রভাবিত। অনেক রচনার মধ্যে তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং উপলব্ধির ছায়া  লক্ষ্য করা যায়। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাস ‘মধ্যাহ্ন’ তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা হিসেবে পরিগণিত। এ উপন্যাসে পাঠক পৌঁছে যাবে বহু বছর আগের সমাজের নিষ্ঠুরতা আর তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থানে।

জীবনের শেষভাগে ঢাকা  শহরের অভিজাত আবাসিক এলাকা ধানমণ্ডির ৩/এ রোডে নির্মিত ‘দখিন হাওয়া’ ভবনের একটি ফ্লাটে তিনি বসবাস করতেন। খুব ভোর বেলা ওঠা অভ্যাস ছিল তাঁর, ভোর থেকে সকাল ১০-১১ অবধি লিখতেন তিনি। মাটিতে বসে লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। কখনো অবসর পেলে ছবি আঁকতেন।

২০১১-এর সেপ্টেম্বের মাসে সিঙ্গাপুরে ডাক্তারি চিকিৎসার সময় তাঁর দেহে মলাশয়ের ক্যান্সার ধরা পড়ে। তিনি নিউইয়র্কের মেমোরিয়াল স্লোন-কেটরিং ক্যান্সার সেন্টারে চিকিৎসা গ্রহণ করেন। তবে টিউমার বাইরে ছড়িয়ে না পড়ায় সহজে তাঁর চিকিৎসা প্রাথমিকভাবে সম্ভব হলেও অল্প সময়ের মাঝেই তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ১২ দফায় তাকে কেমোথেরাপি দেওয়া হয়েছিল। অস্ত্রোপচারের পর তাঁর কিছুটা শারীরিক উন্নতি হলেও, শেষ মুহূর্তে শরীরে অজ্ঞাত ভাইরাস আক্রমণ করায় তাঁর অবস্থা দ্রুত অবনতির দিকে যায়। মলাশয়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ নয় মাস চিকিৎসাধীন ছিলেন। কৃত্রিমভাবে লাইভ সাপোর্টে রাখার পর ২০১২ সালের  ১৯ জুলাই দুপুরে হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টির পর চূড়ান্ত দুঃসংবাদটি আসে যে, তিনি নিউইয়র্কের বেলেভ্যু হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে নুহাশ পল্লীতে দাফন করা হয়।

হুমায়ূন আহমেদ স্মরণে এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিনের যৌথ উদ্যোগে ‘হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার’ প্রবর্তন করা হয়েছে। প্রতি বছর হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনে ১২ নভেম্বর দুজন সাহিত্যিককে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়। ২০১৭ সালে তাঁর জন্মদিনে গুগল তাদের হোমপেজে হুমায়ূন আহমেদের গুগল ডুডল প্রদর্শন করে উদযাপন করে। গুগল ডুডলটিতে দেখা যায় চায়ের টেবিলে বই হাতে বসে আছেন হ‌ুমায়ূন আহমেদ। তাঁর সৃষ্টি করা জনপ্রিয় চরিত্র হিমু হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। আর চারপাশে প্রকৃতির আবহ দিয়ে সাজানো হয়েছে ইংরেজি গুগল লেখাটি।

একজন হুমায়ূন বাংলা সাহিত্য, নাটক আর চলচিত্রকে যে সম্পদ আর গৌরব দিয়ে গিয়েছে তা অনস্বীকার্য। এদেশের পাঠক এখনও নিজের অজান্তেই সেরকম একটি নাটকের জন্য অপেক্ষা করে, অপেক্ষা করে বইমেলায় তাঁর নতুন বই-এর জন্য। নতুন প্রজন্ম এখন তাঁর বই পড়ে বিস্মিত হয়, হারিয়ে যায় অন্যভুবনে।