জুলাই 12, 2025

৭১ এর যুদ্ধশিশুদের কথা

ইতিহাসে এবার ৭১ এর যুদ্ধশিশুদের কথা জানার চেষ্টা করবো!

একাত্তরে ত্রিশ লাখ মানুষের গণহত্যার পাশাপাশি অসংখ্য নারীর সম্ভ্রমহানি করেছে পাকিস্তানি সেনারা, সাথে ছিল তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনী।

জানবো ধর্ষিতা সেই নারীদের কোল জুড়ে জন্ম নেয়া শিশুদের কথা, যাদের সমাজের চাপে, কলঙ্কের ভয়ে বাধ্য হয়ে মায়েরা তুলে দিয়েছিলেন অন্যের হাতে।

অবুঝ শিশুদের হতে হয়েছিল নির্বাসিত!

নির্যাতিত এসব নারীদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নাম দিয়েছিলেন ‘বীরাঙ্গনা’। তাদের অনেকে যুদ্ধের পুরো নয় মাস বন্দি ছিলেন বিভিন্ন সেনা ক্যাম্পে।

যুদ্ধশেষে দেশ যখন স্বাধীন হল, দুর্ভাগা বীরাঙ্গনাদের বেশিরভাগেরই আর ঠাঁই হলো না বাবা বা স্বামীর সংসারে।

কলঙ্ক আর অপমানের বোঝা বইতে না পেরে অনেকেই করেছেন আত্মহত্যা।

বাকিরা নীরবে দেশ ছেড়েছেন, ভারতে চলে গিয়েছেন অনাহূত সেই শিশুদের জন্ম দিতে বা গর্ভপাত করাতে।

পাকিস্তানি সেনাদের ভাষ্য ছিল, যত বেশি সংখ্যক নারীর গর্ভে তাদের শিশুর জন্ম হবে, তত বেশি ‘সাচ্চা মুসলিম’ বা ‘সাচ্চা পাকিস্তানি’র জন্ম হবে।

পাশবিক নির্যাতনের শিকার অসংখ্য নারী এর ফলে গর্ভবতী হন।

পরবর্তীতে তাদের অনেকেরই যেতে হয় গর্ভপাতের মতো ভয়ানক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে।

অনেকেই জন্ম দিয়েছেন যুদ্ধশিশু!

পরবর্তীতে কী হয়েছিল এসব যুদ্ধশিশুর কিংবা এসব যুদ্ধশিশুরাই কোথায় আছে, কেমন আছে তারা!

আন্তঃদেশীয় দত্তক প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে বাংলাদেশ সরকার ‘দ্য বাংলাদেশ অ্যাবান্ডান্ড চিলড্রেন (স্পেশাল প্রভিশন্স) অর্ডার ১৯৭২’ নামক অধ্যাদেশ জারি করে।

পরবর্তীতে কানাডাসহ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডসসহ অনেক দেশই এগিয়ে আসে এসব শিশুর দায়িত্ব নিতে।

অবশেষে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে পনেরো যুদ্ধশিশুর প্রথম দলটি কানাডায় প্রবেশ করে ১৯ জুলাই, ১৯৭২ সালে। কানাডার সংবাদপত্রগুলোতে নিয়মিত এ নিয়ে উচ্ছ্বসিত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়, যাতে কানাডার জনগণসহ বিশ্বে এ সম্পর্কে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় এবং আরও বেশি মানুষ ভাগ্যাহত যুদ্ধশিশুদের দত্তক নিতে এগিয়ে আসে।

এদিকে এ নিয়ে কাজ করা মানুষদের বর্ণনায় ফুটে উঠেছে সেসব মায়েদের আর্তনাদের চিত্র।

এসব শিশুর জন্মদাত্রী মায়েদের অনেকেই স্বেচ্ছায় তার বাচ্চাকে তুলে দিতে চাননি অন্যের হাতে। করেছেন কান্নাকাটি, কড়া সিডেটিভ জাতীয় ঔষধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখে মায়েদের অজান্তেই তাদের সন্তানদের তুলে দিতে হয়েছে নতুন মা-বাবার হাতে।

কেমন আছেন সেসব যুদ্ধশিশু? ‘৭২ সালে যারা ছিলেন নিতান্তই অবুঝ শিশু, আজ তারা পরিণত বয়স্ক মানুষ। তাদের অনেকেই শেকড়ের সন্ধানে বার বার ফিরে এসেছেন বাংলাদেশে।

খুঁজে পেতে চেয়েছেন তাদের জন্মদাত্রী মা, স্বজনদের।

দেখতে এসেছেন নিজেদের জন্মভূমি। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে উঠে এসেছে তাদের কথা।

এবার শুনবো চারজন যুদ্ধশিশুর কথা!

১)

এমনই একজন হলেন কোহিনূর। নরওয়েতে বেড়ে উঠেছেন তার পালক বাবা-মায়ের আশ্রয়ে। আজ তিনি সেদেশে সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে বেশ পরিচিত।

তিনি নিজেই জানিয়েছেন যে, তিনি একজন যুদ্ধশিশু। ২০১১ সালে এসেছিলেন মাতৃভূমিতে।

তিনি জানান, নরওয়েতে তার মতো আরও একশজনের মতো যুদ্ধশিশু আছেন।

৭১ এর যুদ্ধশিশুদের কথা

২)

কানাডায় যাওয়া ১৫ যুদ্ধশিশুর মধ্যে একজন ছিলেন রায়ান গুড।

১৯৮৯ সালে ১৯ বছর বয়সে প্রথমবার তার পালক বাবা-মায়ের সাথে আসেন বাংলাদেশে।

শেকড়ের তীব্র টানে আবার ফিরে আসেন নিজের গর্ভধারিণী মায়ের খোঁজ করতে। এবার তার সাথে ছিলেন বন্ধু ব্রেন্ট জিঞ্জারিক, চেষ্টা করেছেন মাকে খুঁজে পেতে, কিন্তু তাকে বিফল হয়ে ফিরে যেতে হয়েছে।

তিনি কোনোভাবে জানতে পেরেছিলেন যে, তার মা বরিশালের মেয়ে। তাই ঐটুকু তথ্যের উপর ভিত্তি করে ছুটে যান বরিশাল।

ছোটাছুটি বিফলে যায়, তবুও হাল ছাড়েননি, আবার নতুন উদ্যমে ছুটে গিয়েছেন কলকাতার মিশনারিজ অব চ্যারিটির প্রধান কেন্দ্রে, যদি তার মায়ের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়!

কিন্তু তার সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়।

তিনি মাকে না পেলেও মাতৃভূমির টান ভুলে যেতে পারেননি। তাই তো ১৯৯৮ সালে আবার আসেন এদেশে, এবার পাক্কা এক বছর অবস্থান করে জানার চেষ্টা করেন বাংলাদেশকে।

রায়ান বাংলাদেশে যুদ্ধশিশুদের নিয়ে আয়োজিত বিভিন্ন সভা-সেমিনারে অংশ নেন, বক্তৃতাও দেন।

১৯৭২ সালে গঠিত সেবা সদনের রেকর্ড বইতে তার নাম লেখা হয়েছিল ‘বাথল’। রায়ান নিজেকে পুরোদস্তুর বাঙালী করতে বাথল নামটিও নিজের নামের সাথে রেখে দেন।

পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করে তা পেয়ে যান। যখন জানতে পারলেন, নিজের বাংলা ‘বাথল’ নামের কোনো অর্থ নেই তখন তিনি তা পরিবর্তন করে নাম রাখেন ‘বাদল’।

এখন তিনি রায়ান গুড বাদল।

juddho shishu 2

৩)

রানী কানাডায় যাওয়া পনেরো যুদ্ধশিশুর একজন। নিজের জন্ম সংক্রান্ত সত্য জেনে রানীর মধ্যে দেখা দেয় অস্বাভাবিক পরিবর্তন।

তার ভেতরে বয়ে যায় এক কষ্টের নদী। ধীরে ধীরে তার মনোজগতে পরিবর্তন ঘটে যায়, তিনি তার আশেপাশে দেখতে শুরু করেন তার মাকে।

তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, চিকিৎসকরা জানান, রানী বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত।

সাত বছর তার চিকিৎসা চলে, অবশেষে সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে ১৯৯৮ সালে ২৭ বছর বয়সে রানী তার জীবনের অবসান ঘটান নিজ হাতে।

বড় অভিমান নিয়ে চলে যান পৃথিবী ছেড়ে। বেঁচে থাকতে তিনি ‘নদীর সন্তান’ নামে তার মাকে নিয়ে একটি কবিতা লিখে গিয়েছিলেন।

juddho shishu 3

৪)

যুদ্ধশিশু মনোয়ারা ক্লার্কের ব্যাপারটা আরো বেশি কষ্টের!

মনোয়ারা ক্লার্ক একজন যুদ্ধশিশু। মায়ের গর্ভেই সে রক্তাক্ত হয়। আঘাতে আঘাতে তার নরম শরীর কেটে যায়।

সেই ক্ষত নিয়ে মৃত মায়ের গর্ভ থেকে তার জন্ম হয়। পাকিস্তানী হায়েনারা গণধর্ষণের পর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে তার মাকে। খোঁচার দাগে মায়ের গর্ভের শিশুর দেহও কেটে যায়। মনোয়ারার বাহুতে, পিঠে, কাঁধে এখনও সেই দাগ বয়ে বেড়াচ্ছে তার জন্ম দাগ। তার মা মৃত পড়েছিল। অলৌকিকভাবে শিশুটিকে বিশেষ ব্যবস্থায় পৃথিবীর আলোতে নিয়ে আসেন কানাডিয়ান চিকিৎসক হালকে ফেরী। তার স্থানও হয় ঢাকার মাদার তেরেসা হোমে। সেখানে এক কানাডিয়ান দম্পতি ৬ মাস বয়সে তাকে দত্তক সন্তান হিসেবে নিয়ে যান। নাম হয় তার মনোয়ারা ক্লার্ক। একেবারে বাংলা না জানা মনোয়ারা মুক্তিযুদ্ধের ৪৫ বৎসর পরে বাংলাদেশে এসেছে কেবলমাত্র তার জন্ম সনদ নিতে।

পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে ফিনল্যান্ডের এক নাগরিকের সাথে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর তাদের একটি কন্যা সন্তান হয়। সেই শিশুটি অটিজম আক্রান্ত। তারপর থেকে তার স্বামী বলতে থাকে, অটিস্টিক বেবির জন্য তুমিই দায়ী। কারণ আমার পরিবারের পরিচয় আছে, তোমার কোন পরিচয় নেই। তুমি একটা ওয়ার বেবি সেই কারণেই তোমার বেবি অটিস্টিক হয়েছে। তার বেঁচে থাকার কথাও ছিল না। সে জানে না তার মাকে বাবাকে।

এখন সে বাংলাদেশে ছুটে এসেছে তার জন্ম সনদের জন্য।

সে বলছে, “I am here for my identity, I am here for my family. My birth certificate makes me more confident.”

বাংলাদেশের জন্মের সাথে জড়িয়ে আছে অসংখ্য মায়ের ত্যাগের গাঁথা! ৪৬ বছর ধরে বাংলাদেশ বয়ে চলেছে যুদ্ধশিশুদের করুণ আর্তি। যারা শুধু একবার তার মাকে, তার শেকড়কে কাছে পেতে চেয়েছে!

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এই নিরপরাধ যুদ্ধশিশুগুলো যেখানেই থাকুক ভালো থাকুক।

juddho shishu

আত্মবিশ্বাসের সাথে থাকুক। ওরা এদেশের সন্তান। ওরা আমাদের সন্তান। কোন গ্লানি যেন ওদের স্পর্শ না করে। ভালো থাকুক কোহিনুর, রায়ান, রানী’রা।

ভালো থাকুক মনোয়ারা এবং অচেনা অজানা সব যুদ্ধশিশুরা।

সত্যিই বাংলাদেশ এমন এক দেশ, যার জন্মটা শুধুই কষ্টের!!!

10551535 10204516367132976 3362260560092346827 o
উপ-কর কমিশনার | কর অঞ্চল-৩, ঢাকা বিভাগ

সেশন : ২০০১-২০০২

Facebook
Threads
LinkedIn
Telegram
X
Reddit
Email
WhatsApp

আরও লেখা সমূহ