fbpx

পাঠ প্রতিক্রিয়া: ছিন্নপত্রাবলী (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

বই: ছিন্নপত্রাবলী  

লেখক: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  

প্রিয়জনের কাছে চিঠিতে যত অকপটে মনের ভাবনা বলা যায়, তত সহজ সাবলীল ভাষায় গল্প বা উপন্যাসে বলা যায় না। চিঠিকে গ্লুকোজের সাথে তুলনা করা চলে, হজম করতে যেমন কোন এনজাইমের দরকার পড়ে না। এমনকি প্রবন্ধেও একটা ফর্মাল ভাব থাকে, চিঠির আন্তরিক ভাষা শুধু চিঠিতেই পাওয়া যায়। কিন্তু শর্ত হচ্ছে, পত্রপ্রেরকের সেরাটা বের করে আনতে প্রয়োজন একজন সমঝদার প্রাপক। রবীন্দ্রনাথের কাছে ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবী ছিলেন এমন একজন সমঝদার, যাকে প্রাণখুলে মনের কথাগুলো বলা যায়। রবীন্দ্রনাথের নিজের ভাষা থেকেই উদ্ধৃত করা যাক –   

“… তোকে আমি যে-সব চিঠি লিখেছি তাতে আমার মনের সমস্ত বিচিত্র ভাব যে রকম ব্যক্ত হয়েছে এমন আমার কোন লেখায় হয় নি…।”  

ছিন্নপত্রাবলীতে ২৫২ টি চিঠি সংকলিত হয়েছে এবং এই চিঠিগুলো লেখার সময়কাল সেপ্টেম্বর ১৮৮৭ থেকে ডিসেম্বর ১৮৯৫;  রবীন্দ্রনাথ তখন শিলাইদহ, সাজাদপুর, পতিসর ও অন্যান্য অঞ্চলে জমিদারি দেখাশোনার কাজে নিযুক্ত ছিলেন। দীর্ঘ জীবনের এই অংশটিতেই রবীন্দ্রনাথ গ্রামে কাটিয়েছিলেন। গ্রামের মানুষের সরলতা, অকপট ভালোবাসা, অল্পতে তুষ্ট হওয়ার গুণাবলি তাঁকে মায়ার বাঁধনে বেঁধেছিল, এমনকি প্রজারা তাঁকে ‘তুমি’ বা ‘তুই’ পর্যন্ত সম্বোধন করতো যা তিনি খুব উপভোগও করতেন। মানুষ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ কতটা আন্তরিক ও নিরহংকার ছিলেন সেটা এখান থেকে খানিকটা আঁচ করা যায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘প্রথম আলো’তেও এই রবীন্দ্রনাথকে আমরা পেয়েছি। তবে এই দরিদ্র চাষীদের সংগ্রামী জীবন, তাদের দুর্দশা তরুণ রবীন্দ্রনাথের কোমল মনে গভীর বেদনার রেখাপাত করেছিল, সেকথা তাঁর চিঠিতে বারবার বর্ণিত হয়েছে।  

“কোথায় প্যারিসের আর্টিস্ট- সম্প্রদায়ের উদ্দাম উন্মত্ততা আর কোথায় আমার কালীগ্রামের সরল চাষী প্রজাদের দুঃখদৈন্য-নিবেদন! … এদের অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং এদের অসহ্য কষ্ট দেখলে আমার চোখে জল আসে। … এরা যেন আমার একটি দেশজোড়া বৃহৎ পরিবারের লোক।’’   

শুধু দরিদ্র চাষীদের প্রতি দরদ দেখিয়েই থামেননি তিনি, তরুণ রবীন্দ্রনাথ সমাজতন্ত্রের প্রতি নিজের নৈতিক সমর্থনও প্রকাশ করেছেন। সময়টা ১৮৯৩ সালের মে মাস, রুশ বিপ্লব হতে তখনও দুই যুগ বাকি –  

“আমার এই দরিদ্র চাষী প্রজাগুলোকে দেখলে আমার ভারি মায়া করে – এরা যেন বিধাতার শিশু সন্তানের মত – নিরুপায়… সোসিয়ালিস্টরা যে সমস্ত পৃথিবীময় ধন বিভাগ করে দেয় সেটা সম্ভব কি অসম্ভব ঠিক জানি নে – যদি একেবারেই অসম্ভব হয় তা হলে বিধির বিধান বড়ো নিষ্ঠুর, মানুষ ভারী হতভাগ্য!”  

মানবপ্রেমকে একপাশে রেখে এবার অন্যান্য প্রাণীকুলের কথা বলা যাক। ইন্দিরাকে চিঠিতে তিনি বলেছিলেন যে তিনি ভেজেটেরিয়ান হয়ে দেখবেন। পাখির বাচ্চা মেরে খাওয়ার সময় তাঁর মনে পড়েছিল নিজের সন্তানের কথা, কি ভয়ানক ব্যাপার হত মানুষ যদি অন্য কোন প্রাণীর খাদ্য হত! তবে অন্যান্য প্রাণীর প্রতি সমবেদনা কর্পূরের মত উড়ে গেছে কলকাতা শহরে গেলেই, সেখানে তিনি নির্দ্বিধায় মাংস খেয়েছেন। তিনি আফসোস করেছেন, কলকাতায় গেলে তাঁর মন-মানসিকতা ইউরোপিয়ানদের মত কঠিন হয়ে যায়।   

ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কাজী নজরুল ইসলাম বা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যেমন প্রতিবাদী ভাবমূর্তি দাঁড় করিয়েছিলেন তেমন ইমেজ রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে তৈরি হয়েছিল না। যদিও রবীন্দ্রনাথ কখনই ব্রিটিশদের গুণমুগ্ধ ছিলেন না। কিন্তু তিনি শাসক গোষ্ঠীর সাথে একরকম ডিপ্লোম্যাসি মেইনটেইন করে চলেছেন। তবে ছিন্নপত্রাবলীতে ব্যক্তিগত চিঠির সংকলন বলেই কিনা, এখানে খাঁটি রবীন্দ্রনাথকে পাওয়া যায়; প্রিয় ইন্দিরার কাছে তিনি ঠিকই অন্তরের গরল উগরে দিয়েছেন। কোন এক ফরাসি সাহিত্যিকের ভ্রমণকাহিনী পড়ে মুগ্ধতা প্রকাশ করছেন রবীন্দ্রনাথ; তখন বলছেন, ব্রিটিশ লেখক হলে এমন ভালো হয়ত লিখতে পারতেন না।   

“ইংরাজ ভ্রমণকারীদের যতগুলো বই পড়েছি প্রায় সবগুলোতেই তাদের উদ্ধত পাশব প্রকৃতির এবং আত্মাভিমানের পরিচয় পাওয়া যায়। তারা অন্য জাতের প্রতি সুবিচার করতে এবং ভালোবাসা দিতে পারে না। অথচ বিধাতা এদের উপরে যত ভিন্ন জাতের ভার সমর্পণ করেছেন এমন আর কারও উপর করেন নি।”   

ছিন্নপত্রাবলীর পাতায় পাতায় ঠাঁসা রবীন্দ্রনাথের অবিমিশ্র অনুভূতি। শুধু জীবনদর্শনের কঠিন কথাবার্তাই না, চিঠিগুলোতে গ্রামবাংলার রূপের প্রতি তাঁর মোহাবিষ্টতা এসেছে ঘুরে ফিরেই। সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের রঙ, পদ্মানদীতে বোটে বসে উপভোগ করা জ্যোৎস্নারাতের সৌন্দর্য, বৃষ্টিদিনে কবিতা-গান রচনার অনুভূতি, গদ্যের চেয়ে কবিতার প্রতি তাঁর অধিক ভালোবাসা, প্রকৃতির ভীষণ সুন্দর রূপ ভাষায় প্রকাশ করতে না পারার আক্ষেপ… এমন কত কি অনুভূতি চিঠিগুলোতে জায়গা করে নিয়েছে।   

আমরা যখন একলা অবসর কাটাই, তখন কত রকম দার্শনিক চিন্তা আমাদের মনের কোণে উদয় হয়, না পাওয়া প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলে আমাদের ভালো লাগে, নতুন কোন ভাবনা ভাবতে পারলে আমরা আবেগে আপ্লুত হই, আমাদের একলা একলাই যেন ভালো লাগে। এই যে একলা ভালোলাগা, এই ভালোলাগার অনুভূতিটা প্রিয় কারও সাথে শেয়ার করতে না পারলে আবার আমাদের মনটা ছটফট করে। ফরাসি সাহিত্যিক অনরে দ্য বালজাক একটা চমৎকার কথা বলেছিলেন,  

“Solitude is fine but you need someone to tell that solitude is fine.”  

এই একলা চলার দিনগুলোতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিন্নপত্রাবলীর বেশিরভাগ চিঠিগুলো লিখেছিলেন। বড় সরল এই চিঠিগুলোর ভাষা, সাধুভাষার টিকিটির দেখা এখানে মিলবে না, আবার ইচ্ছামতো ইংরেজি শব্দের ব্যবহারও করা হয়েছে, অর্থাৎ ছিন্নপত্রাবলীকে বলা যায় ‘‘যেমন খুশি তেমন লেখো – রবীন্দ্রনাথ ভার্শন’’। আরেকটা বিশেষ আকর্ষণীয় ব্যাপার উল্লেখ না করলেই না, রবীন্দ্রনাথের কিছু ছোট গল্পের নেপথ্যের গল্প ছিন্নপত্রাবলী থেকে জানা যাবে।   

এই চিঠিগুলোর মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের সুন্দর মনের মধ্যে ঘুরে আসার সুযোগ করে দিয়েছেন যিনি, সেই ইন্দিরা দেবীর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। শেষ করছি ১৮৯৪ সালের মার্চ মাসে লেখা একটা চিঠির একাংশ উদ্ধৃত করে, যেখানে ধর্ম সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের দর্শন চমৎকারভাবে প্রকাশিত হয়েছে –  

“আমার বোধ হয় সকল ধর্মের শ্রেষ্ঠ ধর্ম সর্ব জীবে দয়া। প্রেম হচ্ছে সমস্ত ধর্মের মূল ভিত্তি। জগতে আমা হতে যেন দুঃখের সৃজন না হয়ে সুখের বিস্তার হতে থাকে। আমি যেন সকল প্রাণীর সুখ দুঃখ বেদনা বুঝে নিজের স্বার্থের জন্য কাউকে আঘাত না করি – এই যথার্থ ধর্ম, এই যথার্থ ঈশ্বরচরিত্রের আদর্শে আপনাকে গঠিত করা।” 

প্রাক্তন শিক্ষার্থী | প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশন: ২০১১-১২

নূর সিদ্দিকী

সেশন: ২০১১-১২