মে ১৩, ২০২৫

সীমানা পেরিয়ে (প্রথম পর্ব)

প্রথম পর্ব

করোনা ভাইরাস মহামারীরূপ ধারণ করেছে। ১০ দিনের ছুটি পাওয়ায় গৃহবন্দী। মুভি-সিরিজ দেখতে আর কতক্ষণই ভালো লাগে। তাই সময় কাটাতে গত বছরের ইন্ডিয়া ভ্রমণের ছবিগুলো দেখছিলাম। ভাবতে ভাবতে মনে হল যে প্রত্যেকটা ছবির একেকটা গল্প আছে আমাদের। আমাদের বলতে রাকিব ভাই, নাসরাত আর আমি (আদিত্য)। আমরা একই ব্যাংকে কর্মরত। দেখা যাক ঘুরে আসার ৭ মাস পর কতটুকুই লিখতে পারি।
ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যানটা অনেকদিন আগের। খুব সম্ভবত সীমান্ত স্কয়ারে আমাদের তিনজনের সামিটের মাধ্যমে শুরু। এই সামিটেরও অনেক কাহিনী আছে। তারপর থেকে ছুটি খুঁজতে থাকা তিনজন আল্লাহ্‌র রহমতে অগাস্টে সেই সুযোগ পেলাম। ঈদ এবং ১৫ অগাস্টের ছুটি মিলে আরেকদিন ছুটি নিলে মোটামুটি ১০ দিনের একটা সময় পাওয়া যায়। ওভাবেই টার্গেট নিয়ে যার যার মত ভিসা নেয়া এবং টিকেট করা হলো। রাকিব ভাই অনলাইনে কলকাতা – দিল্লী – শ্রীনগর টিকেট কাটলেন। আমরা কাশ্মীর ঘুরবো। কিন্তু ইন্ডিয়াতে কাশ্মীর নিয়ে শুরু হলো ঝামেলা। আমরা এই ছুটিটা কোনোভাবেই বৃথা যেতে দিব না। তাই যাওয়ার ঠিক সপ্তাহখানেক আগে রাকিব ভাই টিকেট চেঞ্জ করে শুধু দিল্লীর টিকেট কেটে ফেললেন। এবার গন্তব্য শিমলা – মানালি আর পথে ১ দিনের জন্য দিল্লী শহর এবং আশপাশ। আর শেষে সম্রাট শাহ্‌জাহান যেটা বানিয়েছেন সেটা দেখবো।

ঢাকা – কলকাতা – দিল্লী
(অগাস্ট ৯ – ১০, ২০১৯)

৯ই আগস্ট, ২০১৯, শুক্রবার। ব্যাগ গোছানো শেষ। সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার উপহার দেয়া শার্টটা পড়ে রওনা হলাম। বাসা থেকে এয়ারপোর্ট, তারপর সিএনজি দিয়ে সোজা কল্যানপুর বাস-স্ট্যান্ড। বাকি দুই ভদ্রলোকের সাথে দেখা হলো। কুশল বিনিময় করলাম। কে কীরকম প্রিপারেশন নিয়েছি, কার কী প্ল্যান, চাকরি, অফিস, ক্যারিয়ার প্ল্যান সবকিছু নিয়েই কথা হলো। ঘোরাঘুরি নিয়ে আমার অবশ্য তেমন প্ল্যান করার কিছু ছিলনা। রাকিব ভাই এবং নাসরাত এগুলো সামলাতে বিরাট ওস্তাদ এবং আমি মোটেও বাড়িয়ে বলছি না। সকাল ৮টায় বাস ছাড়ার কথা। কিন্তু বাস আসতে আসতে ৯টা পার হয়ে গেলো। যেহেতু ঈদ, এরকমটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের মনে একটা টেনশন কাজ করছিল। প্ল্যান অনুযায়ী আমাদের আজকেই কলকাতা পৌঁছাতে হবে। কারণ ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, হাওড়া ব্রিজ আর কিছু কেনাকাটার ব্যাপার আছে। তার ওপর রাকিব ভাইয়ের সামনে যেকোনো সময় বিয়ে হয়ে যেতে পারে, বিয়ের কিছু কেনাকাটাও তিনি এই ফাঁকে সেরে ফেলতে চান।

যাইহোক, বাসে চড়ে বসলাম। মনের আনন্দে তিনজন মিলে ছবি তুললাম। অনেক প্ল্যান, অনেক সুন্দর জায়গা দেখার আগ্রহ, সবকিছু মিলে উত্তেজনা অস্বাভাবিক। ইন্ডিয়া দেখার শখটা আমাদের তিনজনের অনেক আগে থেকে। জীবনে অন্তত একবারের জন্যেও ঘুরে দেখতে চাই। কিন্তু রাস্তায় ঈদের ভিড় যেন আমাদের কোন প্ল্যানকেই সফল হতে দিচ্ছিলো না। সারা রাস্তা আল্লাহ আল্লাহ করে যাচ্ছি। এইটুকু জানি যে সন্ধ্যা ৫টার পরে বর্ডার বন্ধ। নো এন্ট্রি, নো এক্সিট। সাভার পার হয়ে গেলাম খুবই তাড়াতাড়ি। তবে সাভার থেকে মানিকগঞ্জ হয়ে ফেরি ঘাটে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকাল ৩টা। যেহেতু রাস্তা এবং বর্ডারের দূরত্ব সম্পর্কে আইডিয়া নাই, তাই ফেরি পার হয়ে ভাবছিলাম হয়তো পৌঁছে যাবো। আজকেই যদি বর্ডার পার হতে পারি তবে ওপাশে কলকাতার বাস আজকেই কলকাতা পৌঁছে দিবে। কিন্তু কপালে কী ছিলো সেটার দিকে এগোই।

মাঝখানে আমাদের বাসের কন্ডাক্টর বললেন যে তারা বর্ডার অথরিটির সাথে কথা বলে সময় আরেকটু বাড়িয়ে নিচ্ছে। আমরা পৌঁছাতে পারলে নাকি ইমিগ্রেশান হয়ে যাবে। কিন্তু আমার ধারণা উনি বাড়িয়ে বলছেন। শেষমেশ আমরা রাত ৯টার দিকে পৌঁছালাম বেনাপোল, যশোর। আমি এতটাই আবেগী অবস্থায় ছিলাম যে মনে হচ্ছিল বর্ডার গার্ডকে রিকোয়েস্ট করে ইমিগ্রেশান করিয়ে ফেলি। কিন্তু হাতে বন্দুক দেখে আর কিছু বলার সাহস পাইনি। যাইহোক আজকে আল্লাহ্‌ রিযিক রেখেছেন বেনাপোলে। আমাদের আজকে রাত এখানে অপেক্ষা করে আগামীকাল সকালে বর্ডার পার হতে হবে। বাসভর্তি এতগুলো যাত্রী হন্যে হয়ে হোটেল খুঁজছে। সবাই থাকার জায়গা পেয়েছে ভালোই। আমরা তিনজন একটা রুম নিয়ে নিলাম পাশেই একটা হোটেলে। বেশি না, ৭০০ টাকা ঐ রাতের জন্য।

ফ্রেশ হলাম। সারাদিন জার্নি এবং অনিশ্চয়তার কারণে ট্যুরের টুকিটাকি নিয়ে আমাদের আলোচনা হয়নি তেমন। খুব গভীর আলোচনায় বসেছি আমরা। আমার অবশ্য অত জানা-বোঝা নেই। মূল প্ল্যানকারী হলেন রাকিব ভাই আর নাসরাত। তাদের ভালো নলেজ। প্রথমে আমাদের প্ল্যান ছিলো যে আমরা কম খরচের মধ্যে ট্যুরটা শেষ করবো। কিন্তু যেভাবে শুরু থেকেই সব প্ল্যানে ঝামেলা হচ্ছিলো তাই সেই রাতেই রাকিব ভাই তার পরিচিত এক ভাই মারফত একজন ড্রাইভার কাম গাইড ঠিক করলেন। গাইড আমাদের দিল্লী থেকে শুরু করে মানালি – শিমলা ঘুরিয়ে আবার দিল্লী এয়ারপোর্টে দিয়ে যাবে। এই ট্যুরের ফান শুরু হয় মূলত গাইডের সাথে রাকিব ভাইয়ের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে। রাকিব ভাইয়ের হিন্দি শুনে আমি আর নাসরাত হাসি থামাতে পারছিলাম না। সে কী একসেন্ট এবং শব্দচয়ন! এটার একটা উদাহরণ পরের কোন এক জায়গায় দিতেই হবে। এখনই না।

আমাদের পর্যাপ্ত রেস্ট এবং প্ল্যানিং শেষে পরদিন ভোরে উঠে লাইনে দাড়ালাম ইমিগ্রেশানের। তিনজনের ট্রাভেল ট্যাক্স যদিও আগেই দেয়া ছিল (রাকিব ভাই এর কৃতিত্ব), আরেকটা ৫০ টাকার ফি দিতে কত দালাল যে দেখলাম। তবে লাইনে দাঁড়িয়েই ট্যাক্স দিয়েছি। তিনজন হওয়াতে বদলি করে করে দাঁড়িয়েছিলাম। প্রায় ৯টা বাজে। ভেতরে ইমিগ্রেশানের ডাক পড়লো। ওখানেও লাইন। আমার আগে নাসরাত, রাকিব ভাই এর ইমিগ্রেশান হয়ে গেলো। গেলাম কর্তব্যরত পুলিশের কাছে। উনি বললেন আমার আর যাওয়া হচ্ছেনা। আমার NOC নাকি ঠিক নেই। ঠিক কতদিন ইন্ডিয়া থাকবো সেটা লিখা নেই, তাই আমার ইমিগ্রেশান হবে না। আর খুব দরকারি হলে ঢাকা থেকে NOC ঠিক করে নিয়ে আসতে হবে। আরে ভাই, ঢাকা কি পাশের বিল্ডিং? আরেকটু হলে চোখ দিয়ে পানি চলে আসতো। তো আমাদের বাসের কন্ডাক্টরকে ফোন দিলাম এবং সমস্যা বুঝিয়ে বললাম। সে একজন লোক পাঠালো। হয়ে গেলো ইমিগ্রেশান। অন্যদিকে নাসরাত এবং রাকিব ভাই শপথ করে ফেলেছেন যে আমাকে যেতে না দিলে উনারাও যাবেন না। একটা চকচকে নতুন কাগজের বিনিময়ে পাসপোর্টে ডিপার্চার সীল পড়লো।

উঠে গেলাম বাসে। কলকাতা পর্যন্ত পুরো রাস্তার নাম যশোহর রোড। সবকিছু আমার দেশের মতোই। শুধুমাত্র ব্যানারগুলোতে এমনভাবে বাংলা লেখা যেটা দেখলে বোঝাই যায় যে এটা ইন্ডিয়া। নতুন শহর দেখতে খুবই ভালো লাগছিল। মাঝরাস্তায় আমরা পরোটা, ডালমাখনি আর মাটন রেজালা খেলাম। মাটির কাপে চা খেলাম। আবেগে আমি আর রাকিব ভাই বাসের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। কলকাতা পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর ২টা। যে সময় কলকাতাতে কাটানোর কথা ছিলো তার কিছুই পেলাম না। আমরা এর মধ্যেই একদিন লেট।

নিউমার্কেট নামলাম বাস থেকে। এটা যে কলকাতা সেটা বোঝা যায়। ফেলুদা পড়েছি ছোটবেলায়, মুভি দেখেছি। সশরীরে আসার একটা ইচ্ছা ছিল। আসলাম। আমাদের প্রথম কাজ ডলারকে রূপিতে কনভার্ট করা। রাকিব ভাই এবং নাসরাতের দামাদামিতে অসাধারণ রেট পেলাম। আমি মুগ্ধ হয়েছি তাদের এই গুণ দেখে। তারা যখন সংসার করবে তাদের পরিবার তাদের বাহবা দিবে শুধুমাত্র এই গুণটার কারণে। উনারা যাস্ট এক্সপার্ট। তারপর সিম কেনা হলো। সিম কিনলাম আমি এবং রাকিব ভাই। ভোডাফোন। প্রতিদিন ৩ জিবি করে ফ্রী। আর আনলিমিটেড টকটাইম। মাত্র ৪০০ রূপিতে। গেলাম স্রি-লেদারে। দোকানে ঢুকার পরে কী রেখে কী কিনবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এতকিছু কেনার পর আর রাখার জায়গা নেই। তাতে কী? ওখানে ব্যাগও আছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার ছিলো যে জিনিসপত্র পছন্দ হয় এবং দাম খুবই সস্তা।

অনেক সময় পার করে ফেলেছি এই দোকানে। হাতে সময় খুবই স্বল্প। আমাদের দিল্লী যাওয়ার ফ্লাইট ১০টায়। দমদম এয়ারপোর্টে তার আরও ৩ ঘণ্টা আগে পৌঁছাতে হবে। কারণ আমরা তিনজনই গরীব। আগে কখনো প্লেনে উঠিনি। তাই বাড়তি সময় রাখতে হবে হাতে। এয়ারপোর্টে কীভাবে কী করে জানিনা। ৪টা পর্যন্ত আমরা ঐ দোকানেই। লাঞ্চ করা হয়ে ওঠেনি। ব্যাগ হাতে নিয়ে কাচ্চি বিরিয়ানি খুঁজতে খুঁজতে আরসালানে গিয়ে বসলাম। লাঞ্চ শেষে যখন বের হই তখন সময় ৫টা। আকাশ অনেক মেঘলা, বৃষ্টি হচ্ছে গুড়ি গুড়ি।

বিখ্যাত এম্বাস্যাডর ট্যাক্সি নিয়ে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল এর দিকে রওনা দিলাম। এই গাড়িতে ওঠার শখটাও পূরণ হলো। যদি বৃষ্টি থেমে যায় তাহলে ঢুকতে পারবো। পৌঁছালাম ঠিকই, কিন্তু বৃষ্টি থামছে না। এত ব্যাগ নিয়ে এই বৃষ্টির মধ্যে ঢোকা যাবেনা । হাওড়া ব্রীজ যাওয়াও ক্যান্সেল হয়ে গেলো। নাসরাতের বুদ্ধিতে আমরা ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেইন দিয়ে রওনা হলাম এয়ারপোর্টের দিকে। ভালো সার্ভিস ছিলো। দাঁড়িয়ে ছিলাম কিন্তু ক্লান্তি লাগেনি। আমরা শেষ স্টেশন দমদমে নামলাম। আমাদের ব্যাগের ওজন কত হয়েছে আমরা জানিনা। প্লেনে বাড়তি রূপি গুনতে রাজি না আমরা। এখানেই এক দোকানে মেপে নিয়েছি। ২০ কেজির অর্ধেকও হয়নি কারও। সেখানে দাঁড়িয়ে ২০ রূপি করে আমের জুস খেলাম। সত্যি কথা, এই জুসটা ঢাকায় খেলে কম করে হলেও ১৫০ টাকা লাগতো। ওরা বাদাম পর্যন্ত দিয়েছে ২০ রূপির জুসে।

আরেকটা ট্যাক্সি নিয়ে এয়ারপোর্টে চলে গেলাম। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস এয়ারপোর্ট, কলকাতা। একে দমদমও বলে। আমাদের গন্তব্য দিল্লী। সময় আনুমানিক ৭টা হবে। যথেষ্ট সময় হাতে পাওয়া গেলো। ইন্ডিগো এয়ারলাইন্স। যার যার মত বসে ব্যাগগুলো গুছালাম। এমনিতেই আমরা গরীব মানুষ, এয়ারপোর্টের চালচলন বুঝিনা। তাই বাড়তি সতর্ক হয়ে বসে ছিলাম। এয়ারপোর্টটা ঘুরে দেখতে লাগলাম, ছবি তুললাম। এয়ারপোর্টের কসাইখানাগুলো (খাবারের দোকান) এত সুন্দর করে সাজানো ছিলো! অযথা ফাঙ্কি জিনিসের পেছনে কেন রূপি নষ্ট করবো? আমাদের মধ্যে এখনো ছাত্র ছাত্র ভাব। তাই আর ওদিকে পা বাড়ানোর সাহস হলো না।

এরমধ্যে দেখতে পেলাম যে আমাদের ফ্লাইট আধা ঘণ্টা লেট। আমরা যেহেতু এয়ারপোর্টের আদব কায়দা বুঝিনা তাই আমরা বোর্ডিং পাস কখন নিবো, লাগেজ কখন দিবো কিছুই জানিনা। আরামে আড্ডা দিয়ে যাচ্ছি। ৯টার দিকে এয়ারলাইন্সের ভদ্রলোক হুঁশ এনে দিলো যে এত লাক্সারিও না যে পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকবেন আর চ্যালচেলাইয়া প্লেনে উঠিয়ে দিবে। তাড়াহুড়ো করে প্লেনে যেয়ে উঠলাম।

Picture 6

আল্লাহ্‌র কী লীলাখেলা, নাসরাত জানালার পাশে সিট পেলো। ছেলেটা বেশ ভাগ্যবান। আবার বুদ্ধিও বেশি। আমাদের মধ্যে রাকিব ভাই সবচেয়ে সিনিয়র। উনার চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। খুব বাজে সিট পেয়েছেন। আমি মাঝখানে। মনে মনে বলছি যে জীবনে প্রথম প্লেনে উঠেছি ভাই, সিট ছাড়বো না। গেলে যান, না গেলে নাই। রাকিব ভাই আশ্বস্ত করলেন যে সমস্যা নাই, কিন্তু মনে মনে বুঝলাম যে উনি জীবনে আর আমাদের সাথে প্লেনে উঠবেন বলে মনে হয়না। ফেরার সময় উঠবেন কী না সন্দেহ আছে।

Picture 7

মেকআপের নিচে বসে থেকে তিনজন ক্রু ৩টি ভাষায় আমাদের সব নিয়ম শিখিয়ে দিলেন যে প্লেন এক্সিডেন্ট হলে কীভাবে আকাশে ভেসে থাকতে হয়। প্লেনটা মাটিতে আছড়ে পড়ার আগ মুহুর্তে কীভাবে লাফ দিয়ে প্লেন থেকে নেমে যেতে হয়। এটা আমার মাথায় কখনোই আসেনি আগে। কী সহজ একটা সমাধান! রাকিব ভাই, এরপর যেটা দেখলাম তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। “এই কফি, এই চা”, বলে বলে মেকআপওয়ালা মহিলা হকারি করতেসে। হোয়াট?

যতই অবাক হই না কেন, কফি কিনে খেলাম। উড়োজাহাজের হকার, ১০০ রূপির কফি। আকাশে কফি শেষ হতে হতে রাত ১২.৩০ বা ১টার দিকে আমরা দিল্লী এয়ারপোর্টে। আমরা লাগেজ নিতে গিয়েছি। নাসরাতের ব্যাগ অনেক দামি। সেটা থেকে আবার অনেক দামি গন্ধ আসছিলো। প্লেনে অন্য কোন ব্যাগের বোতল ভেঙে তার ব্যাগও ভিজে গিয়েছে। আমরা বুঝতে পারিনি। পরে অবশ্য রাকিব ভাই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে ওটা কীসের বোতল ছিলো।

দিল্লী
(অগাস্ট ১১, ২০১৯)

দিল্লী এয়ারপোর্ট। আমরা তখনও জানিনা ঐ রাতে দিল্লীতে কোথায় উঠবো। শুধুমাত্র অনিল ভাইয়ের (আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড) নাম্বার আছে। ল্যান্ড করার আগেই তার এয়ারপোর্টে থাকার কথা। কিন্তু অনিল ভাই দিল্লীতে নেই। অনিল ভাইয়ের কাজিন সান্নি পাজী আমাদের নাকি আমাদের নিতে আসবেন। এয়ারপোর্টের ঠিক কোথায় আছি আমরা সেটা রাকিব প্রায় আধা ঘণ্টা বোঝালেন। যেমন ‘হাম এখানেই হ্যায়’, ‘তুম কই হো?’, ‘নেহি দেখতাহু তুমকো’ ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি আর নাসরাত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসলাম, কাঁদলাম। দিল্লীর আকাশটা অনেক পরিষ্কার ছিলো। চাঁদ খুবই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। চোখে ঘুম, ক্লান্তি, এক্সাইটমেন্ট, নতুন শহর, গরম সবমিলিয়ে আমাদের অবস্থা ভালো না। ক্ষুধা তো আছেই। মোটামুটি আধা ঘণ্টা লাগলো গাড়ি আসতে।

যাচ্ছি কারোলবাগের দিকে। ওখানেই আমাদের হোটেলের ব্যবস্থা করে রেখেছেন অনিল পাজী। রাস্তায় কিছুক্ষণ ভালো জ্যাম ছিলো। সান্নি পাজী বললেন শহরের ভেতর দিয়ে গেলে দেরি হয়ে যাবে। তাই আমরা দিল্লীর আশপাশ দিয়ে দিল্লী ইউনিভারসিটির ভেতর দিয়ে গেলাম। আমাদের ক্ষুধা তখন চরমে। ইন্ডিয়ার মানুষ নাকি খাওয়াতে ভালোবাসে। সান্নি পাজীকে ক্ষুধার কথা বলার পর উনি আমাদের নিয়ে গেলেন কারোলবাগের পাশেই মুসলিম পাড়ায়। প্রায় মিনিট চল্লিশ লাগলো। মাঝরাতেও এখানে বেশ জমজমাট অবস্থা। তিনজন একটা কাবাবের দোকানের সামনে দাড়ালাম। চিকেন কাবাব রুটি দিয়ে মোড়ানো। চোখের সামনে ভেজে দিলো। আমার শরীর ভালো না থাকায় খেলাম না। কিন্তু রাকিব ভাই আর নাসরাত তো পারলে চুলার ওপর বসে খায়। উনারা খুবই তৃপ্ত। উনাদের অনুরোধে আমি আমার জন্য পার্সেল নিয়ে নিলাম। এবার হোটেলের উদ্দেশ্য।

হোটেল প্রিন্স ইন্টারন্যাশনাল। আমাদের পাসপোর্ট রেখে দিলো, এন্ট্রি হলো। রুমে আসলাম। ক্লান্তি কাকে বলে। সেই যশোর থেকে টানা দুইদিন জার্নি। ফ্রেশ হলাম সবাই। সান্নি পাজী চলে গেলেন। আমরা কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে যার যার মত শুয়ে পড়েছি।

সকাল ৯টার মধ্যে আমরা সবাই রেডি। সান্নি ভাই আজকে আমাদের দিল্লীতে ঘোরাবেন। আমরা ভেবেছি আজকে দিল্লিতে সব দেখবো এবং তাজমহল দেখবো। কিন্তু সান্নি ভাই তার ছোট গাড়িতে এতদূর যাবেন না আর এত রাস্তা কুলানো যাবেনা। তো শেষমেশ আমরা দিল্লী শহরটা ঘুরবো। নয়াদিল্লী। কেন্দ্রীয় সচিবালয়, রাষ্ট্রপতি ভবন, ইন্ডিয়া গেট, ইন্দিরাগান্ধি মেমোরিয়াল, কুতুব মিনার ইত্যাদি।

নতুন শহর, আমরা সবাই রিচার্জড। গাড়িতে বসে ভালো লাগছিলো। নয়াদিল্লী বেশ গোছানো। সবুজের সমারোহ। সান্নি পাজী বললেন যে মোদীর স্বছ ভারত অভিযানের কারনে আরও বেশি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়েছে শহরটা। একটা বড় হনুমান দেখলাম। প্রচুর ফ্লাইওভার আর মেট্রোর লাইন। রবিবার হওয়াতে রাস্তায় জ্যাম কম ছিলো। অন্যান্য দিন হলে নাকি মুভ করাই সম্ভব ছিল না। চলে আসলাম কেন্দ্রীয় সচিবালয়ের সামনে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় সব গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রনালয়গুলো সব এখানে। ব্রিটিশ আর্কিটেক্ট হারবার্ট বেকার এর নকশা করেছেন মুঘল স্থাপত্যের সাথে মিল রেখে।

একটা বিশালতা আছে। রাস্তাগুলো সামনে বড় বড়, চওড়া। বিল্ডিংগুলো দূরে দূরে। বোঝাই যায় যে মুঘল আমলের স্থাপত্যের সাথে মিল রেখে করা। আমরা ছবি তুললাম। দুনিয়ার আজগুবি সব ভঙ্গিমায়। একজনের চেয়ে আরেকজনের বেশি। তবে নাসরাত এক্ষেত্রে অনবদ্য।

Picture 9

পার্লামেন্ট এর সামনে থেকে একটা সোজা রাস্তার মাথায় ইন্ডিয়া গেট। একদম নাক বরাবর সোজা। হেঁটেও যাওয়া যায়। তবে সময় লাগবে। গাড়িতেই গেলাম। ইন্ডিয়া গেটের পাশে গাড়ি থামিয়ে লাইন ধরে ঢুকলাম। কোন টিকেট লাগে না। খুবই সুন্দর। কারুকার্জ করা। ইন্ডিয়ার স্মৃতিসৌধ বলা চলে। ১ম বিশ্বযুদ্ধে শহীদদের সম্মানার্থে ১৯২১ সালে নির্মিত। কত সিনেমার শ্যুটিং যে এখানে হয়েছে। ওদের ব্যাপার যেটা ভালো লেগেছে সেটা হলো যে এক জায়গায় পুলিশ বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে দেয় না। আর জায়গাটা পরিচ্ছন্ন। ছবি তোলা হলো। অন্যদিক দিয়ে আমরা বের হয়ে গেলাম। রাস্তায় পেলাম পানিপুরিওয়ালা। এত হতাশ এইচএসসিতে এ-প্লাস না পেয়েও হইনি। ওভাররেটেড। মুখ নষ্ট হয়ে গেছে। পরের গন্তব্যে যাওয়ার আগে মোদী যেখানে থাকে সেটার পাশ দিয়ে গেলাম। বিশাল অবস্থা। পরে মনে হলো ১৩০ কোটি মানুষের পিএম। ঠিকই আছে।

Picture 10

এবার আমাদের গন্তব্য ইন্দিরাগান্ধি মেমোরিয়াল। এটা মূলত তার বাসা। পরবর্তীতে মিউজিয়ামে পরিণত করা হয়েছে। গাড়ি পার্কিং করে আমরা ঢুকলাম। ইন্ডিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসের মোটামুটি সবকিছুই এখানে রয়েছে। সবকিছু ঘুরে দেখছিলাম। পুরো বাসাতেই একটা আভিজাত্যের ছাপ। ভাবছিলাম যে এই ঘরে থাকা মানুষগুলো কতকিছুর স্বাক্ষী। বিভিন্ন পেপার কাটিং, সার্টিফিকেট বাঁধাই করে টানানো আছে। ইতিহাসের উপর ভালো দখল থাকলে ঘুরে অসম্ভব তৃপ্তি পাওয়া যাবে। তবুও বই-পত্রের ক্যারেক্টারগুলোর কাছে গেলে একটা আলাদা অনুভূতি কাজ করে। সবচেয়ে মুগ্ধ হয়েছি তাদের লাইব্রেরি দেখে। অসাধারণ। নিচে যে ছবি দিয়েছি সেখানে আছে। এই রুমে থাকলে আপনার বই নিয়েই বসে থাকতে মন চাইবে। আর ঘরের প্রত্যেকটা কোনায় রুচিশীলতা স্পষ্ট। বের হয়ে গেলাম। বাইরে যে লন ছিল, সেখানে ছবি তুললাম। বের হবার সময় স্যুভেনির হিসেবে বইও কিনলাম আমরা।

টিকেটের লাইন কাকে বলে, সেটা রবিবারে কুতুব কমপ্লেক্সে আসলে বোঝা যায়। আমি তো রাকিব ভাইকে বললাম, ভাই ঢুকবোনা। গরম। কিন্তু আমরা যে ওখানে ফরেইনার সেটা খেয়াল ছিলোনা। ছোট একটা লাইন। আস্তে করে টিকেট কিনে ফেললেন রাকিব ভাই। ঢুকে গেলাম।

কুতুব মিনার। বিশ্বের সর্বোচ্চ ইটনির্মিত মিনার। প্রাচীন হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের পাথর দিয়ে কুতুব কমপ্লেক্স এবং মিনারটি তৈরি করা হয়েছে। ভারতের প্রথম মুসলমান শাসক কুতুবুদ্দিন আইবেকের আদেশে কুতুব মিনারের নির্মাণকাজ শুরু হয় ১১৯৩ খ্রিষ্টাব্দে। তবে মিনারের উপরের তলাগুলোর কাজ সম্পূর্ণ করেন ফিরোজ শাহ তুঘলক ১৩৮৬ খ্রিষ্টাব্দে। ভারতীয়-মুসলিম স্থাপত্যকীর্তির গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে কুতুব মিনার খ্যাত। এর আশে-পাশে আরও বেশ কিছু প্রাচীন এবং মধ্যযুগীয় স্থাপনা এবং ধ্বংসাবশেষ আছে। সবগুলোকে একত্রে কুতুব কমপ্লেক্স বলা হয়।

তখনকার আর্কিটেক্টদের কবর থেকে তুলে পুরষ্কার দেয়া উচিত। এত চিকন আর এত উঁচু একটা মিনার কীভাবে দাঁড়িয়ে আছে, নো আইডিয়া। আগেই বলেছি, ইতিহাস সম্পর্কে তেমন জানিনা। তবে চোখের দেখায় যতটুকু নিতে পেরেছি, তাতে বুঝতে পেরেছি মোঘল সম্রাটদের এসব কারুকার্যের ব্যাপারে খুব সৌখিনতা ছিলো। একদম সূক্ষ্ম জায়গাতেও রয়েছে যত্ন করে করা কারুকার্যের ছাপ। গাছের ছায়ায় বসে ছিলাম আমরা অনেকক্ষণ। যার যার বাসায় কথা বললাম। কাঠবিড়ালী ঘুরছিলো আমাদের চারপাশ দিয়ে। রোদ ছিলো প্রচণ্ড। এর মধ্যেও আমাদের ছবি তোলা থেমে ছিলো না। রীতিমত মারামারি অবস্থা। আমরা বের হচ্ছি।

প্রায় ৩টার মত বেজে গিয়েছে। অস্বাভাবিক রোদের জন্য আমরা দ্রুত ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি। হোটেলে চলে যাবো। আজকে দিল্লীর বিভিন্ন জায়গা ঘোরার এখানেই সমাপ্তি। তবে এরপরেও একটা চমক আমাদের জন্য রয়ে গেলো। হোটেলে ফিরে আমরা যার যার মত ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিয়ে আরাম করে আড্ডা দিচ্ছি। সন্ধ্যায় আমরা মল রোড মার্কেটে ঘুরছি আর মূলত ওয়েট করছি অনিল পাজীর জন্য। কারণ কালকে থেকে তার ৭ সিটের গাড়িটাতেই ঘুরাঘুরি শুরু হবে। এই রোডে কোন গাড়ি-ঘোড়া চলেনা। রাস্তার দুই পাশে শুধু ব্র্যান্ড-শপ। আমাদের চোখ আটকে গেলো। যাই দেখি তাই ভালো লাগছে। তিনজনের টার্গেট Firstrack। এখানে কিছু পছন্দ হলোনা। ঈদ উপলক্ষে কাপড়ের দোকানগুলোতে যাই দেখি তাতেই ছাড়। ১টা কিনলে ৩টা ফ্রী, এরকম একটা অবস্থা। কিনলাম কাপড়-চোপড়। ব্যাগ একদম ফুল। ঐ রাতে অনেক মাস্তি হল। ভালো ছিলো দিনটি।
তাজমহল

(অগাস্ট ১২, ২০১৯)

আজকে আমরা যাচ্ছি তাজমহল। সকাল হতে না হতেই অনিল পাজী আমাদের ঘুম থেকে ডেকে উঠালেন। আজকে কুরবানীর ঈদ। ঈদের নামাজ পড়বো রাস্তায় আগ্রা যাওয়ার পথে। দিল্লীতে আজকেই আমাদের শেষ থাকা। হোটেল থেকে চেকআউট করে আমরা আমাদের বাক্স-পেটরা গাড়িতে রেখে দিলাম। অনিল পাজীর গাড়িটা বড়। সামনের কয়েকদিন এই গাড়িই আমাদের সঙ্গী। বের হবার সময় বৃষ্টি দেখে আমাদের মেজাজ চরমে। তাছাড়া অনেকক্ষণ যাবত মসজিদ খুঁজছি, কিন্তু কোন নাম-গন্ধ নেই। কিন্তু আল্লাহ্‌র রহমতে পেয়ে গেছি একটা। নাসরাত ইমামতি করলো। আমরা কোলাকুলি করলাম। ঈদের কোন আমেজ নেই দিল্লী শহরে। এখানে ঈদের দিনে মসজিদগুলোতে আর্মি পাহারা দেয়, যেন কোন ধরনের দাঙ্গা না হয়। মসজিদে শুধু আমরাই তিনজন। আরও অবাক করা কাণ্ড হলো রাকিব ভাই সিনিয়র হওয়ায় উনি আমাদের সালামি দিলেন । অবাক হবার কারণ হলো উনার পকেট থেকে টাকা বের হওয়া মানে কোন একটা গণ্ডগোল তো আছেই। রাকিব ভাইকে বারবার জিজ্ঞেস করলাম যে ভাই কোন সমস্যা হলো কি না, আপনি সালামি দিচ্ছেন, আপনার শরীর ঠিক আছে তো? নামাজ শেষে আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম।

গতকাল আমরা দেখেছিলাম দিল্লীতে মোঘল সম্রাটদের করা স্থাপত্য। আজকে অনিল পাজী যেদিক দিয়ে নিয়ে এসেছেন সেদিকে বেশিরভাগই বৃটিশদের করা। বিল্ডিংগুলোর নকশা তাই বলে দেয়। অনেকটা ইউরোপ ফিল আসছিলো। সেই বিল্ডিংগুলোতে আবার বিভিন্ন ব্র্যান্ডশপ। খুবই ছিমছাম। স্বাভাবিকভাবেই ছবি তোলা হলো। কিন্তু বৃষ্টি থামছেনা। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। এর মধ্যে অনিল পাজী তার গাড়িতে তেল নিয়ে নিলেন। এই অনিল পাজী লোকটা খুবই অদ্ভুত কিসিমের। ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সামথিংস অফ এবাউট হিম। যাইহোক আমাদের পেছনে ফেরার সুযোগ নেয়য়?

দিল্লী থেকে আগ্রা প্রায় ২৪০ কিলোমিটারের মত। মোটামুটি ঘণ্টা চারেক লাগতে পারে। আমরা যমুনা এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে যাচ্ছি। ন্যাশনাল হাইওয়ে ৪৪। টোটাল ৪ আর ৪, ৮ লেন। এই রাস্তাটা মুগ্ধ করার মত। গাড়ি সোজা চলছে তো চলয়য়?। ইতোমধ্যে বৃষ্টি শেষ। এখানকার আবহাওয়া আবার ঠিক উল্টো। চোখ ধাঁধানো রোদ আর মারাত্মক গরম। আমরা সকালের নাস্তা করিনি। পাজীর কথামতো হাইওয়ের কোন ধাবাতে সকালের নাস্তা হবে। হলোও তাই। টোল প্লাজা পার হয়ে আমরা একটা ধাবায় থামলাম। জায়গাটা সুন্দর করে সাজানো। অনয়য়? চকোলেট এর দোকানও আছে। আমরা আলুপরোটা, ছোলা, টক দই ইত্যাদি খেলাম। ইন্ডিয়াতে মুখ নষ্ট করা খাবারের শুরু এখান থেকেই। জায়গাটা যতটা পছন্দ হয়েছিলো, খাবারগুলোর টেস্ট তার উল্টো। সবকিছুতে পনির। ইন্ডিয়ার এই পচা খাবার আমাদের রাকিব ভাইকে পাগল বানিয়ে ফেলেছিলো। মাংস পাওয়া যাচ্ছিলো না কোথাও। অনিল পাজী এখানের দোকান থেকে কম করে হলেও ১ কেজি পানমশলা কিনলেন। এই পানমশলা নাকি তাকে রাতে সজাগ থাকতে সাহায্য করে। আমরা যখন মানালি যাচ্ছিলাম, আমি টেস্ট করেছিলাম একটু। প্রচণ্ড ঝাঁঝওয়ালা। তাজমহল দেখে আজকেই আমাদের লম্বা যাত্রা শুরু হবে মানালীর পথে।

Picture 21

আগ্রা পর্যন্ত আরও তিন ঘণ্টার রাস্তা। এই রাস্তাটা খুবই সুন্দর। চারপাশে শুধু মাঠ আর মাঝখানে প্রশস্ত রাস্তা। আমরা সব নস্টালজিক করে দেয়া গান শুনছি। আগ্রায় যখন এসেছি তখন সুর্য ঠিক মাথার ওপরে, ২টার মত বাজে। মাথার ঘিলু ভাজি করে ফেলার মত গরম। অনিল পাজী আগেই আমাদের জন্য একজন গাইডের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। মেইনরোড থেকে বড় গাড়ি তাজমহলে ঢোকে না। অটোতে করে আমরা গাইডসহ চারজন তাজমহলে ঢুকছি। গরম থেকে বাঁচার জন্য হ্যাট কিনলাম সবাই। সার্কভুক্ত দেশের ভ্রমণকারীদের জন্য টিকেট ৭০০ রূপি করে জনপ্রতি। ঢুকে গেলাম। যেহেতু গাইডের সাথে, উনি খুবই ইন্টারেস্টিং ওয়েতে আমাদের তাজমহলের ইতিহাস বর্ণনা করছিলেন। আমার পক্ষে পুরো ইতিহাস লেখা সম্ভব না। আমাদের চোখে যা ধরতে পেরেছি সেটাই অনেক।

গাইডের প্রত্যেকটা কথায় অন্যরকম আবহ তৈরি হচ্ছিলো। ছোট্ট একটা মোড় নিয়েই তাজমহলকে প্রথম দেখলাম। খৃষ্টানদের বিয়েতে কনে যেভাবে সাদা গাউন পরে, ঠিক ওইরকম। কড়া রোদে একদম চিকচিক করছিলো। মানুষের ভিড় ছিলো অস্বাভাবিক। গাইডের মতে প্রতি বন্ধের দিনে ১ লক্ষেরও বেশি মানুষ আসে এখানে ঘুরতে। পূর্নিমার রাতে শুধু আধা ঘণ্টার ফি ২০,০০০ রূপি। সেটাও আবার অনেক আগে থেকে বুকিং দিয়ে রাখতে হয়?

Picture 22

সম্রাট শাহজাহান তাজমহল তৈরিতে কোন কার্পণ্য করেনি। ২২ বছর প্রায় ২০ হাজার শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল এটা। তবে মতভেদ আছে অনেক। ওসবে আমি যাবো না। ছবি তুললাম। গাইড আমাদের ছবি তুলে দিচ্ছে। তাজমহলের বৈশিষ্ট্য আমার পক্ষে এখানে লিখে বলা সম্ভব না। যখনই শুনলাম যে দেয়ালের প্রত্যেকটা ফুলের নকশা বা যে নকশাই আছে, সবগুলোই পাথর কেটে কেটে করা হয়েছে তখনই আমাদের মাথা নষ্ট হবার মত অবস্থা। বিশ হাজার শ্রমিকের ২২ বছর সময়টা তখন কমই মনে হচ্ছিলো। প্রত্যেকটা সূক্ষ্ম আলপনাও একেকটা আলাদা রঙ এর পাথর। এগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে বিভিন্ন দেশ থেকে। আর সাদা অংশটা হোয়াইট মার্বেল দিয়ে বানানো। পুরো তাজমহলটা একটা সিমেট্রিক স্ট্রাকচার। মুল স্থাপনার চার পাশে যে চারটা মিনার আছে সেগুলো বাইরের দিকে হেলানো। যেনো ভুমিকম্প হলে মুল স্থাপনাতে না পরে যায়। এসব শুনে আমরা তিনজন তখনকার আর্কিটেক্টদের কথা ভাবছিলাম। কতটা ডেডিকেশান থাকলে এভাবে একটা স্ট্রাকচার দাড় করানো যায় ভাবা যায়না।

Picture 23

হোয়াইট মার্বেলে কড়া রোদে আমাদের ভেতরের যত পানি আছে সব শুকিয়ে যাচ্ছিলো। মূল স্থাপনার ভেতরে যাচ্ছি। মমতাজ এবং সম্রাট শাহজাহানের কবর এখানে আছে। তবে সেখানে রাষ্ট্রপ্রধান ছাড়া কারও যাবার অনুমতি নেই, গাইড বললেন। না থাকলে নাই। আমাদের তো এমনিতেই মাথা আউলে গিয়েছে এতসব কাহিনী শুনে। ভেতরে একজন দেখালেন পাথরগুলোতে লাইট ধরলে কেমন করে জ্বলে ওঠে। যতই দেখছিলাম আর অবাক হচ্ছিলাম। তাজমহলের বাইরে যতটা গরম ছিলো, ভেতরে ঢোকার পর একটুও গরম লাগছিল না। বরং কোথাও থেকে যেন ঠান্ডা বাতাস আসছিলো। গাইড এখানেও আর্কিটেক্টদের কৃতিত্বের কথা জানালেন। তাজমহলের ডিজাইন নাকি এমনভাবেই করা হয়েছে যেন পেছনে যমুনা নদীর বাতাস ঠান্ডা হয়ে ঢোকে। আমরাও ঠান্ডা হলাম। পেছনে যমুনা নদী। পালা করে ছবি তোলা হলো।

আমরা বের হবার জন্য হাঁটছি। তাজমহলের দিকে পেছন ফিরে দেখি তাজমহলের রঙ পাল্টে যাচ্ছে। তাজমহল সাদা পাথরের হওয়ার কারনে এটা লাইট রিফ্লেক্ট করে বেশি। জোছনা রাতে, সন্ধ্যায় এটার রঙ পালটে যায়। আমাদের ওসব দেখার সুযোগ নেই। স্যুভনির হিসেবে বই কিনলাম, একলাইনও পড়িনাই এখনো। বের হয়ে গিয়েছি আমরা। ৪টার বেশি বাজে। লাঞ্চ করা হয়নি। তবে তার আগে আমরা মিষ্টির দোকান থেকে ১ কেজি মিষ্টি কিনে ধরা খেলাম। তাজমহলের রেপ্লিকা কিনলাম, আরও কিছু হাবিজাবি। আমরা খাবার খুঁজছি। এমন কিছু যেটা খাওয়া যায়। রাস্তায় পাও ভাজির দোকান পড়লো। ভেবেছিলাম মুরগির পা, মানে রান ভাজি করে দিবে। এবারও হতাশা। পাও মানে পাউরুটির পাও। একটা ঝোল দিলো সাথে। কী আর করা, খেয়ে নিয়েছি। ক্ষুধা থাকায় খারাপ লাগেনি। তবে এই দোকানের মিষ্টি খেয়েছি পেট ভরে।

আমরা মানালির দিকে রওনা দিয়েছি বিকেলে। সারা রাতের জার্নি। সবাই মোটামুটি প্রস্তুত। সন্ধ্যায় যখন আমরা ন্যাশনাল হাইওয়ে দিয়ে ব্যাক করছিলাম ক্লান্তি নিয়ে গোধূলির দিকে তাকিয়ে ছিলাম। গোধূলির রঙটা মন শান্ত করে দেয়। ভেতরের নিরবতাকে বাইরে নিয়ে আসে। একটাই আকুতি ছিলো ভেতরে। সময়টা আরেকটু ধীরে যাক।

(চলবে)

Rifat Reza Story Writer
সিনিয়র অফিসার | ব্যাংক এশিয়া লিমিটেড

প্রাক্তন শিক্ষার্থী
পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সেশনঃ ২০১২-১৩ (৬২তম ব্যাচ)