fbpx

অক্টোবর ১৬, ২০২৪

আঁচড়

মাঘ মাস শুরু হয়েছে মাত্র। বর্গীর মত হানা দিয়ে নেমেছে শীত। পাশের গ্রামে বিদ্যুৎ এসে পৌঁছেছে গত বছর। কিন্তু এখন অব্দি আফসারদের গ্রামে নাগরিক আলো প্রবেশ করেনি। তবে গ্রামের মানুষ তোড়জোড় শুরু করেছে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিদ্যুৎ এর আনজাম করতে। বাংলাদেশের দক্ষিণে সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার কপোতাক্ষ নদের তীরে শাহাজাদপুর গ্রামে আফসারদের বাস। একটি আদর্শ অজপাড়া গ্রামের সকল বৈশিষ্ট্যই আফসারদের গ্রামে বিদ্যমান।

গ্রামের ছোট্ট একটি বাজারে আফসারের মুদি কাম চায়ের দোকান। তার একমাত্র ছেলে আজহার। বয়স বছর পনের। তার কাজ চা বানানো। মাঘের এই হাড় কাঁপানো শীতে সন্ধ্যার পায়ে পায়ে গভীর অন্ধকার রাত্রিও নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে। দিনের আলো মিলিয়ে যেতেই মানুষের ঘরে ফেরা শুরু হয়ে যায়। ঘন গাছগাছালির এই গ্রামে সন্ধ্যাকেও মনে হয় গভীর রাত্রির মত। চারিদিকের দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে। আফসার হারিকেনের টিমটিমে আলোতে সারাদিনের বিক্রির হিসাব করছে। আজহার বাবার সাইকেলের পিছনে কিছু কাপড় চড়াচ্ছে যেটার উপর ও সমাসীন হবে। রাস্তা খুব খারাপ। পশ্চাৎদেশের ব্যথা লাঘবের এটাই একমাত্র উপায়। আফসার হিসেব মিলিয়ে হারিকেনের আলো নিভিয়ে দিতে দিতে তার ছেলেকে বলে,

“টর্চ লাইটটা বাইর করে আলোটা এদিক ধর।”

আজহার আলোটা ধরে। আফসার দোকান বন্ধ করে সাইকেলটা নিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। ঘুটঘুটে অন্ধকার। আলো ছাড়া নিজেকে অন্ধ মনে হয় আফসারের।

“ওঠ, আর লাইটটা সামনে ধর।”

আজহার উঠে বসে তার আসনে। পথের সামনে আলোটাকে ধরে সে।

দোকান থেকে তার বাড়ি এক মাইলের পথ। আফসারের সাইকেল আস্তে আস্তে চলতে শুরু করে রাত্রির নিকষ কালো আঁধার ভেদ করে।

ঝিঁঝিপোকার ডাক আর সাইকেলের সাথে রাস্তার বাগযুদ্ধের আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।

অর্ধ মাইল পথ অতিক্রম করেছে প্রায়। রাস্তার দুপাশে ঘন বাগানের রাজত্ব। সেই বাগানের ভিতর থেকে হঠাৎ কেমন যেন গোঙানির আওয়াজ ভেসে এল কানে।

“বাজান, তুমি কিছু শুনতি পাইছ?”

“হুম, নাম তো। আর লাইটটা আমার কাছ দে।”

আফসার আওয়াজ লক্ষ্য করে লাইটটা সেদিকে মারে। সন্তর্পণে এগিয়ে যায় বাগানের দিকে। আবার গোঙানির আওয়াজ হতেই লাইটের আলো পড়ে সেদিকে। একটা লোক দু হাতে পা ধরে ব্যথায় গোঙাচ্ছে। লতাপাতার মধ্যে আর কুয়াশার পর্দা ভেদ করে মুখটা দেখা যায় না ভালো করে।

“আজহার, জলদি এদিক আয়।”

আজহার ছুটে যায়।

দুজনে মিলে এগিয়ে যায় লোকটার দিকে। ঝোপঝাড়ের ভিতর থেকে দুজনে টেনে বের করে লোকটাকে রাস্তায় নিয়ে আসে। আলোটা হাতে দাঁড়িয়ে আছে আজহার।

লোকটার বয়স বছর চল্লিশেক হবে। জাদরেল গোঁফওয়ালা মুখে খুব দীর্ঘ ও পুরানো একটি তীক্ষ্ম আঁচড়ের দাগ। গায়ের গেঞ্জি মনে হয় টেনে হিঁচড়ে ছেঁড়া। হাতের তালুতে জখম। রক্ত ঝরছে সেখান থেকে। পায়ের রানের জখমটা আরো বেশি ভয়ংকর। ব্যথার তীব্রতায় চোখ বন্ধ করে আছে লোকটা। দুজনে মিলে ধরে সাইকেলের পেছনে বসাই লোকটাকে।

“তুই লোকটাকে ধইরে রাখবি যাতি পইড়ে না যায়।”

আফসার খুব সাবধানে আস্তে আস্তে সাইকেল নিয়ে হাঁটতে থাকে আর আজহার লোকটাকে ধরে রাখে। বাড়িতে যখন পৌঁছায় তখন রাত প্রায় ৮টা। সাইকেলের বেলের আওয়াজ শুনে হারিকেন হাতে বের হয়ে আসে আফসারের স্ত্রী মরিয়ম। বাপ-বেটা ধরাধরি করে লোকটাকে বাড়ির ভিতর নিয়ে চৌকিতে শুইয়ে দেয়। মরিয়মের মুখে আতঙ্ক। ভয়মিশ্রিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,

“ওগো, এইডা তুমি কারে নিয়াইছ? লোকডা কেডা?”

“বলতাছি, তুই আগে একটু জল লইয়া আয়।”

মরিয়ম কলসি থেকে জল ঢেলে নিয়ে স্বামীর হাতে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে চৌকির পাশে।

“আজহার, হারিকেন ডা এদিক ল।”

আজহার হারিকেন হাতে লোকটির মাথার কাছে দাঁড়ায়। আফসার লোকটির চোখেমুখে পানি দিয়ে পরিষ্কার করে দেয়। লোকটি বেহুশ হয়ে গেছে। হারিকেনের ক্ষীণ আলোয় লোকটার মুখের সেই তীক্ষ্ম গভীর আঁচড়ে দৃষ্টি আটকে যায় মরিয়মের।

এই ক্ষতের দাগ তার চেনা!!!

বছর তিনেক আগে আফসারের আজকের এই মুদি কাম চায়ের দোকান ছিল না। তাদের একটা নৌকা ছিল। কপোতাক্ষের বুকে ভেসে দূরদূরান্তে মানুষের আনা-নেওয়ার কাজ করত। একবার গ্রাম থেকে বের হলে কখনো কখনো ফিরতে অর্ধমাস চলে যেত। আফসার দাঁড় টানত আর আজহার নৌকার পানি সেচতো।

আষাঢ় মাসের কোন এক বৃষ্টিস্নাত দুপুরে গ্রামের শহিদুল মেম্বার লোক মারফত আফসারের কাছে খবর পাঠায়। ছাতা মাথায় হাজির হয় শহিদুল মেম্বারের বাড়ি।

“ও আফসার আইছোস! বস এখানে।”

আফসার একটা পিড়ি টেনে নিয়ে বসে বাড়ির বারান্দায়। শহিদুল মেম্বার বারান্দায় হাতলওয়ালা চেয়ারে বসে বিড়িতে একটা লম্বা টান দিয়ে বলে,

“আমার মাইয়েডা পোয়াতি। মাইয়েডারে শ্বউর বাড়িততে আনা লাগবে। তুই কালগেই রওনা কর। এই টাহা গুলান এখন রাখ, পরে বাকিডা দোবানে।”

আফসার টাকাগুলো হাত বাড়িয়ে নিয়ে বলে,

“ঠিক আছে মেম্বার সাব। আমি কালগে বেহানে রওনা হইয়ে যাবানে। মৌসুম যদি ভালা থায় তিন-চার দিনের মদ্দি আপনার মেইয়ারে বাড়িত পৌঁছায় দিব, ইনশাআল্লাহ।”

স্মিত হেসে প্রস্থান করে, আফসার।

পরদিন রবিবার সকাল। আকাশে ছিটেফোঁটা মেঘের আনাগোনা। যেন বিভিন্ন রংয়ের তুলোর দলা আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। ছেলেকে নিয়ে আফসার রওনা হবে তেতুলগোলা গ্রামের উদ্দেশ্যে। মরিয়ম টিফিন বক্সে খাবার তৈরি করে ছেলের হাতে দেয়।

“বউ, তুই সাবধানে থাকিস। আল্লাহ ভালা করলে তিনদিনেই আমরা আইস্যা পড়মু।”

বলে ছেলেকে নিয়ে রওনা হয়, আফসার। সোমবার সকাল থেকেই জোর বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সারাদিন চললো ঝুম বৃষ্টি। বিকেল নামতেই চারিদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে এল। মরিয়ম আজ বিকেলেই হারিকেন জ্বেলে নিয়েছে। আফসারদের বাড়িটি মাটির। উপরে গোলপাতার ছাউনি। বাড়িতে দুটো মাত্র ঘর। বড় উঠানের বামপ্রান্তে গরুর গোয়াল। গোয়ালের পাশে সারিসারি কয়েকটি নারিকেল গাছ। উঠোনের ডান পাশে একটা পুকুর। পুকুরের পাশ দিয়ে সরু রাস্তাটা বাইরের প্রধান রাস্তার সাথে মিলেছে। আশেপাশে বাড়ি বলতে বামদিকে একটা বাঁশঝাড় এর পর মরিয়মের জা আসমাদের বাড়ি। আর বাড়ির উত্তর দিকে পুকুর পাড় পেরিয়ে মাওলা মিস্ত্রির বাড়ি। প্রচণ্ড বর্ষায় তার মাটির চুলোও ভিজে ভেঙে গেছে। তাই এখন রান্নাও সম্ভব নয়। মরিয়ম সন্ধ্যায় কিছু শুকনো চিড়ি আর পাটালি খেয়ে রাতের আহার সেরে ফেলল। রাত তখন গভীর। মরিয়ম ঘুমে আচ্ছন্ন। বাইরে তখনও গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। এমন সময় দরজায় করাঘাত। ঘুম ভেঙে গেল মরিয়মের। ভাঙা গলায় বলল,

“ওই কেডারে, এত রাইতে?”

কোন উত্তর ভেসে এল না। চুপিচুপি কিছু অস্পষ্ট কথা ভেসে এল। বোঝা গেল বাইরে একাধিক মানুষ। মরিয়মের বুকের ভিতর ছ্যাৎ করে ওঠে। মনেপড়ে গত পরশু গ্রামের উত্তরপাড়ায় ডাকাত পড়েছিল। মরিয়মের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা হিম স্রোত বয়ে যায়। তাড়াতাড়ি ঘরের আড়া থেকে দা পেড়ে জ্বলন্ত চোখে দরজার দিকে চেয়ে থাকে মরিয়ম। ওরা দরজা ভাঙছে। হেচকা ধাক্কায় দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকল তিনজন গামছা দিয়ে মুখ বাঁধা লোক। সবার হাতে ছুরি।

“টাহা পয়সা, সোনাদানা যা আছে দিয়া দে। নইলে জানে মাইরা দিমু।”

মরিয়ম কোন কথা বলে না। দু-হাতে দা উচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

মাঝখানের জন বোধহয় পালের গোদা। সে মরিয়মের দিকে দৃষ্টি না সরিয়ে বলল,

“ওই, বেডিডার দেহি মনে জোর বহুত। তোরা বাড়ির বাইরে যাইয়া নজর রাখ। আমি আইতাছি।”

অন্য দুজন বের হয়ে গেল। লোকটা মুখের গামছা খুলে এক বীভৎস হাসি দিয়ে মরিয়মের দিকে তাকায়। কোনকিছু বুঝে ওঠার আগেই ক্ষিপ্র ভাবে মরিয়মের হাত আটকে ধরে লোকটা। শারীরিক শক্তিতে মরিয়ম নিতান্তই দুর্বল লোকটার কাছে। মরিয়ম পড়ে যায় বিছানায়। লোকটার লালসা থেকে বাঁচতে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করে মরিয়ম। নিজের শেষ অস্ত্র হিসেবে লোকটার হাতে কামড়ে ধরে মরিয়ম। তীব্র ব্যথায় হাত সরানোর সাথেসাথে মরিয়ম নখ দিয়ে আঁচড়ে ধরে লোকটির মুখে। লোকটা হাত দিয়ে ব্যথায় মুখ চেপে ধরে। মরিয়ম দ্রুত হাতে দা উঠিয়ে তেড়ে আসে লোকটার দিকে। লোকটি পা দিয়ে লাথি মারে মরিয়মের পেটে। মরিয়ম পড়ে যায় হুমড়ি খেয়ে। লোকটা আবার জাপটে ধরে মরিয়মকে। বাইরের বৃষ্টির শব্দে অনেক আর্তনাদ মিলিয়ে যায় রাত্রির আঁধারে। ঘুমন্ত পৃথিবীর কেউই জানেনি সেই রাতে মরিয়মের সাথে কী ঘটেছিল।

আজ তিন বছর পর সেই নরপিশাচ তার গৃহে আবার ফিরে এল। গায়ের লোম কাঁটা দিয়ে উঠলো মরিয়মের হিম শরীরে।

আফসার বলল, লোকডারে বোধহয় কেউ মাইরধোর করছে। গার (শরীরের) কাপড়-চোপড় সব ছিঁড়া। পায়ে আবার কাঁটার দাগ।”

মরিয়মের বুঝতে ভুল হয় না লোকটার শরীরে এসব কিসের দাগ। কোনো জায়গায় ডাকাতি করতে যেয়ে ধরা খেয়ে হয়ত মার খেয়েছে। আফসার বলে,

“বেডাডা পাশের ঘরে শুইয়া থাকুক। রাত পোহালি ডাক্তারের কাছে নিয়ি যাবানি।”

মরিয়ম কিছুই বলেনা।

সারাদিনের ক্লান্তিতে বাপ-বেটা দুজনেই গভীর ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে। শুধু জেগে দুটো চোখ। কীসের প্রতীক্ষায়!!!

রাত ভোর হলে আফসার পাশের ঘরে যেয়ে দেখে লোকটি নেই। ঘরে এসে মরিয়মকে টেনে তোলে।

“কী ব্যাপার! লোকডা এত সকালে গেল কনে?”

মরিয়ম কিছুই বলে না। আফসার ছেলেকে সাথে নিয়ে দোকানের উদ্দেশ্যে বের হয়। বেলা বাড়তে থাকে। আফসারের দোকানে ভিড়ও বাড়তে থাকে। লোকজন তার দোকানে বসে চায়ের আড্ডায় বলতে থাকে নদীতে একটা লাশ ভেসে উঠছে আর লাশটা নাকি বিল্লা ডাকাতের। আফসার বিহবল হয়ে যায়। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে তার ছেলের দিকে। আজ বিকেল হতেই বাড়ি ফিরে আসে আফসার। মরিয়ম আজ নতুন শাড়ি পরেছে। গুনগুন করে গানও গাচ্ছে। অল্প কথায়ও হেসে লুটিয়ে পড়ছে আফসারের গায়ে।

আজ রাতে বেশ শীত পড়েছে। মরিয়ম তার নিজের হাতে বোনা নকশী কাঁথা আজ প্রথম বের করল। অনেকদিন পর আজ মরিয়ম দুঃস্বপ্নহীন রাত কাটালো। গভীর ঘুমে গভীর রাত পার হয়ে গেছে। প্রভাতের অপার্থিব দৃশ্য অনেকদিন পরে চোখে নতুন করে ধরা দিল মরিয়মের কাছে।

এই প্রভাত যে সহস্রাধিক রাতের পরের প্রভাত, নতুন আলোর প্রভাত।

(সমাপ্ত)