fbpx

অক্টোবর ১৬, ২০২৪

থ্রি সিস্টার্স অভ ঈশ্বরমনি

২০২১ সালে যখন যোগী হাফং (বাংলাদেশের ২য় সর্বোচ্চ পাহাড়) এর চূড়ায় যাই, চূড়ায় পৌঁছে এক ভাই মদক রেঞ্জের সব জায়ান্ট গুলোকে চেনাচ্ছিল। একে একে জোতলাং(৪র্থ), সাকা হাফং(১ম) দেখানোর পর ৩টি চূড়া দেখিয়ে বলে এদের নাম যথাক্রমে হাজরা, সাদরা এবং তাওবা! এদের মধ্যে সর্বোচ্চ হচ্ছে হাজরা, যার আরেক নাম হাজাছড়া। সেবার ই প্রথমবারের মত নামগুলো শুনি!

একই বছর আগস্টে থানচি-লিকরি রোডের ২২ কিলো দিয়ে তামলো পাড়া যাওয়ার সময় টিমলিডার সুমন ভাই আবার ও এই ৩টা পাহাড়কে চেনায়!

1112 থ্রি সিস্টার্স অভ ঈশ্বরমনি 0cv

বাসায় এসে ঘাটাঘাটি করে জানতে পারলাম এই ৩টা চূড়া হচ্ছে ঈশ্বরমনি পাড়ার ম্যাসিফ। আর এই ৩টা চূড়াকে একসাথে একটি সুন্দর নামে ডাকা হয়, “থ্রি সিস্টার্স অভ ঈশ্বরমনি”, নাম টা আমার বেশ পছন্দ হয় আসলে! সেই থেকেই শয়নে স্বপনে “ঈশ্বরমনি” জপে বেড়াচ্ছি আমি! রীতিমত না দেখেও প্রেমে পড়ার মত অবস্থা হয়েছিল ঈশ্বরমনি পাড়ার জুম এর প্রতি।

তার কিছুদিন পর জানতে পারলাম এই পাড়ার পাশেই আছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্যাম্প এবং হাজাছড়া চূড়ার একদম নিচেই ভিনদেশী মামুদের (আরাকান বাহিনী) ক্যাম্প! যার জন্য ২০১৪ সালে টিম ডি ওয়ে এক্সপেডিটর্স এবং সর্বশেষ ২০২০ সালে টিম সংশপ্তক অভিযাত্রী’র পর আর কেও কখনো এই চূড়া সামিট করতে পারে নি।

তবে ২০২২ সালের শুরুতে ক্যাম্প গুলো একটু অন্যত্র সরানোর বদৌলতে অনেকেই হালকা পাতলা এটেম্পট নিচ্ছে সামিটের, সাকসেস ও হচ্ছে। সেই তখন ই মনে গেঁথে ফেলি চূড়া টা নষ্ট হওয়ার আগেই কিংবা আবারো আরাকান বাহিনীর ক্যাম্প বসানোর আগেই এই চূড়ায় আমার পদচিহ্ন আঁকা লাগবেই!

যেই নিয়ত সেই কাজ! ফাইনালের ১৫ দিন আগেও তাই সুযোগ পেয়ে হাতছাড়া করি নাই। ২০দিন আগে নেয়া প্রথম এটেম্পট শুন্য হাতে ফিরিয়ে দিয়েছিল হাজাছড়া, এবার তো আমার চূড়া স্পর্শ করা লাগবেই। তাই সলোই রওনা দেই বান্দরবান এর উদ্দেশ্যে, একদম মিয়ানমার বর্ডারের কাছাকাছি ও বান্দরবান এর এত গভীরে এই প্রথমবার একাই রওনা দিচ্ছি। সামিটের চাপা উত্তেজনায় ভয়, অনিশ্চয়তা সব এক নিমিষেই কেটে যায় মন থেকে।

আগস্ট মাসের ১৩ তারিখ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত হেঁটে একটা পাড়ায় পৌছোলাম। সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে বিশ্রাম নেয়ার কাজ টা সেরে ফেলি আসলে। এরপর সন্ধ্যা ৭টায় পাড়া থেকে বের হলাম চূড়ার উদ্দেশ্যে, বিদ্যুৎ চমকাতে চমকাতে দমকা হাওয়া শুরু হয় তখনি, এত পরিমাণ বাতাস আমি ইহজীবনে কোনোদিন ফেস করি নি বোধহয়, বড় বড় গাছ গুলো চোখের সামনে ভেঙে পড়ে যাচ্ছিল, জলজ্ব্যান্ত একটা মানুষ কে বাতাস ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছিল। ঘুটঘুটে অন্ধকারে তিন কুল আর আয়তুল কুরসী পড়তে পড়তে এগিয়ে যাচ্ছি আমি ও সাথে থাকা লোকাল ছেলেটা…

ফোনের অফলাইন ম্যাপে একটু পর পর চেক করতেছি কত ফিট উঠলাম; ৬৩০ ফিট, ১৩২০ ফিট, ২৪০০ ফিট হতে হতে রাত ১২ টা নাগাদ গিয়ে পেলাম ২৮০০ ফিট। উঠে পড়েছি মদক রেঞ্জের রিজলাইনে। চোখের সামনেই হাজাছড়া ঠায় দাঁড়িয়ে আছে!! আনন্দে আমার চোখ মুখ ছলছল করছিল।

আমার সাথে যে লোকাল বম ছেলে টা গাইড হিসেবে ছিল, ওকে শুধু বলতেসিলাম পুরা রাস্তা, “পারব তো?”, “হবে তো?” ও শুধু একটা উত্তর ই দিচ্ছিল, “অঙ্ক ভুল হইতে পারে ভাই কিন্তু উত্তর ভুল হবে না” হাহাহা!

রাতেই চূড়ায় না উঠে রাত টা চূড়ার নিচে কোথাও বসে বা শুয়ে পার করে দেয়ার পরিকল্পনা থাকলেও, এত পরিমাণ বাতাস ছিল তখন, যে ঢাকার ১৩°সে. এর শীতেও আমি কখনো এত পরিমাণ কেপেছি বলে মনে হয় না। আমার সাথে থাকা পঞ্চো(একধরনের রেইনকোট) টা পড়ে একটু শীত আটকানো গেছে শুধুমাত্র!

যেহেতু চূড়া টা থানচি-লিকরি রোডের পাশেই আর রোডের কাজ করার জন্য কিংবা সরঞ্জাম পাহারা দেয়ার জন্য অনেকেই রাতে থাকে – সেরকম একটা ঘর পেলাম, মাচার মত; কোনোরকমে ওইটার ভিতর ঢুকে গুটিশুটি দিয়ে রাত পার করে দিলাম।

1112 থ্রি সিস্টার্স অভ ঈশ্বরমনি 2

সকালে ৫টায় চূড়ায় উঠে তখনি আবার ব্যাক করার প্ল্যান থাকলেও সকালে বৃষ্টির কারণে দেরিতে বের হই, শেষমেষ কাদার রাস্তায় হাচড়ে পাচড়ে শেষ ৩০০ফিট উঠে চূড়ায় পৌঁছে যাই।

অবশেষে সামিট হলো দেশের ৯ম সর্বোচ্চ চূড়া হাজাছড়া হাফং।

প্রতিটি চূড়ায় উঠার পর একই রকম অনুভূতি কাজ করে, নিজেকে একদম তুচ্ছ মনে হয় সবকিছুর তুলনায়! আর নিজের উপর নিজের অনেক প্রাউড ফীল হয়। আরেকটা জিনিষ ও মনে হয়, “ইশ, এখানে যদি আম্মুকে নিয়ে আসতে পারতাম”।

চূড়ায় উঠে আফসোস শুধু একটাই, বৃষ্টি আর মেঘের কারণে আশেপাশের মাথা নষ্ট করা ৩৬০°ভিউ টা দেখতে পারি নাই।

কিছক্ষন চূড়ায় জিড়িয়ে ও ছবি তুলে আবার ফিরতি পথে হাঁটা শুরু। একেবারে এক হাঁটাতে ৩১০০ ফিট নেমে বান্দরবান শহরে চলে আসি!

1112 থ্রি সিস্টার্স অভ ঈশ্বরমনি 3

ছোট্ট এই জীবনে যতবার যতগুলো চূড়ায় যাওয়ার তৌফিক দিয়েছেন আল্লাহ সবগুলোই ছিল খানিকটা এরকম যে ২/৩ দিন ধীরে ধীরে হেঁটে ৮০% রাস্তা উঠেছি, তারপর বাকি টুক সামিট পুশ দিয়ে উঠে গেছি একেবারে।

কিন্তু এবার ব্যতিক্রম হলো,

এই প্রথমবার একটানে ৩১০০ফিট উঠে আবার ওইটুক ই নিচে নামি এক হাটাতে, যেটা কিনা মাত্র দেড়দিনেই। পা ফুলে আলুর মত হয়ে গিয়েছিল শেষদিন আমার! বাসায় এসে ডাক্তার দেখানোর পর জানতে পারলাম, ডান হাঁটুর আরেকটা লিগামেন্ট ছিড়ে গেছে…

এই কষ্ট গুলোর বিনিময়ে হলেও নিজের সামর্থ্যকে যাচাই করা কিংবা নিজেকে আরেকটু পুশ করার যেই মেন্টালিটি আমাকে প্রতিনিয়ত পাহাড় শিখিয়ে যাচ্ছে সেটার জন্যই আমি বারবার পাহাড়ে ফিরে যাই। আর বিনিময়ে যদি মোটামোটি কম সামিট হওয়া একটা পাহাড় সামিট করে ফেলতে পারি তাহলে তো সোনায় সোহাগা।

1112 থ্রি সিস্টার্স অভ ঈশ্বরমনি 4

চূড়াহাজাছড়া হাফং / হাজরা হাফং
রেঞ্জমদক
প্রাপ্ত উচ্চতা৩১০২ ফিট (+/-৮)
সামিট১৪ আগস্ট, ২০২২ | সকাল ৬:৫৮
কো-অর্ডিনেটN 21° 44.546′ E 092° 36.322′
নাভিদ নেওয়াজ
শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়