২য় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন – Taare Zameen Par: ভ্রমণ ভারতে
রুমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।
ভোরের আলো তখনো পুরোপুরি ফোটেনি। ট্রেনের ঘুমানোর জন্য একখানা কম্বল এনেছিলাম। বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা।
তাই কম্বলখানা গায়ে মুড়িয়ে আধবোজা অবস্থায় সিটে হেলান দিয়ে আছি। কেউ কেউ ঘুমাচ্ছে, কেউ কেউ গাড়ির জানালায় মাথা ঠেকিয়ে উচু নিচু পাহাড়ের ঢেউ দেখছে।
চন্ডিগড়ের ট্রেনে কেউ ঘুমাতে পারিনি। পুজার ছুটিতে ট্রেনে ছিল উপচে পড়া ভিড়। দাড়ানোর জায়গাও ছিলো না।
মেয়েরা রাত কাটিয়েছে ভয়ে ভয়ে। কারণ মাঝ রাতে উঠে দেখে তাদের বেডে অপরিচিত পুরুষ মানুষ বসে আছে।
উঠতে বললেও কেউ গায়ে লাগায় না। শুধু শান্ত চোখে ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকে। সেই চোখে তাকিয়ে কোন কঠিন বলার ক্ষমতা বিধাতা কাউকে দেননি।
ছেলেদের বেডগুলো আগে থেকেই পরিপূর্ণ। তাই কোন মতে ঘাপটি মেরে বসে থেকে রাত পার হয়েছে সবার। নড়াচড়ার জায়গাও ছিল না।
ট্রেন থেকে নেমে যখন গাড়িতে উঠেছিলাম তখন ভোর রাত। চোখে জড়ানো ঘুম।
চন্ডিগড় থেকে সিমলার দূরত্ব একশ কিলোমিটারের বেশি। পুরোটাই পাহাড়ি রাস্তা।
ট্রেন স্টেশনে এত শীত ছিল না। গাড়ি চলছে, পাহাড়ের উচ্চতা বাড়ছে, সেই সাথে হু হু করে বাড়ছে শীতও। সবাই শীতে জুবুথুবু।
তখন প্রায় অর্ধেকটা পথ পার করেছি। পৃথ্বী হঠাৎ খেয়াল করলো রুমি শক্ত হয়ে গেছে। ডাকাডাকিতে সাড়া দিচ্ছে না।
গাড়ি থামানো হলো। চোখে মুখে পানি ছিটানো হলো। জ্ঞান ফিরছে না।
জ্ঞান কিভাবে ফেরানো যায় সে জ্ঞান আমাদের নেই। হাসপাতাল কোথায় পাওয়া যাবে এখন?
ড্রাইভার বলল হাসপাতাল আছে শহরে। শহর মানে সামনে সিমলা, পিছনে চন্ডিগড়। দুটোই এখন সমান দূরে, আমরা আছি মাঝামাঝি।
রাস্তার পারে চা-বিস্কিট জাতীয় দোকান ছাড়া আশে পাশে তেমন কোনো দোকান খোলা নেই। কি করা যায় এখন?
কেউ একজন বলল হাত পা মালিশ করে গরম করার জন্য। শায়েখ দোকান খুঁজে সরিষার তেল নিয়ে আসলো।
অরিনের কাছে ইনহেলার ছিল। গ্যাস দেয়া হলো। জ্ঞান ফিরছে না। আতঙ্ক গ্রাস করলো আমাদের।
অনেক চেষ্টার পর রুমি চোখ খুললো। কিন্তু কোন কথা বলছে না। ভয় কমলো, কিন্তু রেশ কাটলো না। এখন যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতাল যেতে হবে। আবার গাড়ি ছাড়লো।
রুমিকে নিয়ে ভয়ে ভয়ে সিমলা গিয়ে পৌঁছলাম। মুনিম রুমিকে নিয়ে হাসপাতাল খুঁজতে বের হলো, বাকিরা হোটেলে চলে গেল।
ডাক্তার জানালো উচ্চতার কারণে অনেকেরই জ্ঞান হারানোর ঘটনা ঘটে, তবে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।
রুমিকে হাসপাতালে পাঠিয়ে বাকি গাড়িগুলো হোটেলে এসে থামলো। হোটেলের গেট সুন্দর। ফুল দিয়ে সাজানো। ট্যুরে সাধারণত আমাদের হোটেল ছাড়া আশে পাশের হোটেলগুলো বেশি সুন্দর হয়। এইবার ব্যতিক্রম।
রুম পেলাম তিন তলায়। রিসিপশন থেকে চাবি নিয়ে দেখি উপরে ওঠার সিঁড়ি নেই। সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের দিকে।
রাস্তা থেকে বুঝা যায় না যে হোটেলটি পাহাড়ের ঢালে বানানো। পাঁচতলায় রিসিপশন আর নিচের দিকে হোটেল রুম। নিচে নামতে নামতে মনে হচ্ছে মাটির গর্তে ঢুকে যাচ্ছি।
[ট্যুরের সংক্ষিপ্ত বিবরণ:
আমরা পরিসংখ্যান ডিপার্টমেন্টের ৬৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ২০১৮ সালে ব্যাচ ট্যুরে গিয়েছিলাম ভারতের কলকাতা, আগ্রা, দিল্লি, হিমাচল প্রদেশে।
আজকে ট্যুরের ষষ্ট দিন। এখন আছি হিমাচলে প্রদেশের রাজধানী সিমলাতে। সিমলা থেকে যাব মানালি।]
সিমলা
বাকিদের কথা জানি না আমি ট্যুরে এসেছি একদম কিছুই না জেনেই। কোথায় কি দেখার আছে সেই সম্পর্কে কোন ধারণা নেই আমার।
সিমলার ক্ষেত্রেও তাই। এখনো জানি না আজকে কি কি দেখবো। ট্যুর গাইড জানালো বিকেলে ‘Sightseeing’ এ বের হবো।
‘Sightseeing’ শব্দটা ট্যুরে এসে প্রথম শুনলাম। সিমলাতে দেখার জিনিস শুধুমাত্র এই ‘Sightseeing’।
সকালের নাস্তা আর দুপুরের খাবার খেতে খেতেই সময় পার করে ফেললাম। কিছুই দেখা হলো না সকালে।
সফলভাবে সময় নষ্ট করার পর সাদিদ এসে বলল ওরা ‘টয় ট্রেন’ ঘুরে আসছে।
হায় আল্লাহ আমি ‘টয় ট্রেন’ এর নামও শুনিনি আগে। জিজ্ঞেস করলাম, “টয় ট্রেন কি?”
বলল, “পাহাড়ি রাস্তায় যোগাযোগের জন্য এক ধরণের ট্রেন।”
একটা জিনিস বুঝতে পারছি না পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চলাই কঠিন সেখানে ট্রেন চলে কিভাবে? ট্রেন চলতে তো সমতল রাস্তা লাগে।
এই ট্রেনকে ‘টয় ট্রেন’ বলা হয় মূলত আকারে ছোট বলে। কয়েক ধরণের ট্রেন গেজ রয়েছে। যেমন-
১। Narrow gauge.
২। Meter gauge.
৩। Standard gauge.
৪। Broad gauge.
টয় ট্রেন হলো Narrow gauge এর। চলেও ধীর গতিতে। তৈরি করা হয়েছে পর্যটনের জন্য উপযোগী করে। পাহাড়ি রাস্তায় চলে। ফলে ইন্ডিয়ার পর্যটনে খুবই বিখ্যাত হয়ে ওঠে।
দুইটার দিকে আমাদের Sightseeing বের হবার কথা থাকলেও বের হতে পারছি না। দুইটায় গাড়ি চলা নিষেধ।
কারণ এই সময় স্কুল ছুটি হয়। সিমলাতে স্কুল শুরু ও ছুটির সময় গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকে। এদের কাছে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা সবার আগে। আমাদের ভাড়া নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে চলন্ত বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়ার খবর শুনেছি।
গাড়ি চলাচল শুরু হলে প্রথমে গেলাম Green Valley তে। এখান থেকে দূর সবুজ পাহাড়গুলো অত্যন্ত মনোরম দেখতে।
মোটা মামুন (মামুন আমাদের দুই জন) এসে বলল, “এ কোথায় নিয়ে আসলো?”
বললাম, “কেনো, কি হয়েছে?”
বলল, “পাহাড়ের জন্য কিছুই দেখতে পারছি না।“
আমার একটু সময় লাগলো বুঝতে যে এটা কৌতুক ছিল। যখন বুঝলাম হো হো করে হেসে উঠলাম।
কৌতুকে যে খুব মজা পেয়েছি আসলে তা না, মামুন যে কৌতুক করতে পারে এটাই তো আশ্চর্য ঘটনা।
এমনিতে মামুন রাগী ছেলে, কখন কোন বিষয়ে রেগে যায় সেটা নিয়ে ভয়ে থাকি সবাই। কদাচিৎ হাসতে দেখা যায়।
সেই ছেলে যখন কৌতুক করে তখন হাসা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। একই কৌতুক আরো দুই তিন দিন করলো। প্রত্যেকবারই হাসলাম। দায়িত্ব নিয়েই হাসলাম।
বিকেলেটা কেটে গেলো Kufri Adventure Park এ। আহ শুধু এই দেখতে এসেছি সিমলাতে?
যে পার্কে গিয়েছে তাতে মানুষজন তেমন নেই। আমাদের সাথে অল্প কিছু বাইরের লোক।
পার্কটায় ৪-৫ ধরণের রাইড আছে। এক একজনের টিকিটের দাম পড়লো ৭০০-৮০০ রুপি করে।
পার্কটা একদম পাহাড়ের কিনারায়। প্লেসিংটা সুন্দর। টিকেট কিনেও ভিতরে কেউ ঢুকতে চাচ্ছে না। গেটের বাইরেই ছবি সুন্দর আসছে। এখনে ছবি তোলার পর্ব শেষ না করে ভিতরে ঢোকা যাবে না।
কয়েক জন সিদ্ধান্ত নিলো তারা ভিতরেই ঢুকবে না। টিকেটের দাম বেশি। তাছাড়া বাইরেই তো সুন্দর।
চিকনা মামুন, আর মইনুল আকাশসহ কয়েকজন থেকে গেলো। বিপত্তি ঘটলো ওয়াশরুম নিয়ে। পার্কের বাইরে তো ওয়াশরুম নেই। এই দুই জনেরই প্রচন্ড হিসু পেয়েছে।
ছেলে মানুষের হিসুতে ওয়াশরুম কোন ইস্যু না। কিন্তু সিমলাতে ইস্যু। চাইলেই গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়া যায় না। সবদিক ঝকঝকে তকতকে। কোথায় কোন ময়লার চিহ্ন নেই।
বেগও কন্ট্রোলের বাইরে। পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে পরলো। ঢালও অনেক গভীর। আকাশ মামুনকে ডাক দিয়ে বলে, “দেখ, দেখ, একদম ঝরনার মত।“
যারা পার্কে ঢুকলাম প্রথম রাইডে সবাই উঠলো শুধু জুঁই ছাড়া। মেয়েটা ৮০০ রুপি দিয়ে সবগুলো রাইডের টিকিট কিনেছে। কিন্তু সাহসের অভাবে একটা রাইডেও উঠতে পারেনি।
অবশ্য ৮০০ রুপি জলাঞ্জলি দেয়াও সাহসের ব্যাপার। সেই বিবেচনায় সে যথেষ্ট সাহসী।
বাকিরা কি পরিমাণ সাহসী তার নমুনা দিচ্ছি।
আমার বাম পাশে ছিল সাবরিনা আপু। সিট বাঁধার সাথে সাথে সে মনে মনে আল্লাহ খোদার নাম নিতে শুরু করলো। রাইড চালুর হওয়ার সাথে সাথে জোরে জোরে দোয়া পড়তে শুরু করলো।
এক মিনিটের ভিতরে দোয়ায় ইউনুস, দোয়ায় মাসুরা সহ যত দোয়া জানা ছিল সব পরে ফেললো। দোয়া পড়া তো সব শেষ এখন কি করবে?
শুরু করলো চিৎকার। গলা ফাটানো চিৎকার। আমার কানের মেয়াদ মনে হয় এই মেয়ে একাই ফুরিয়ে ফেলবে। দুই হাত দিয়ে সিট আকড়ে ধরে বসতে হয়, তাই কানে আঙ্গুল দিতে পারছি না।
নেমে সে কানে ধরছে আর কোন রাইডে সে উঠবে না। তার মত অনেকেই প্রথম রাইডে দিগন্ত বিদারী চিৎকার দিয়ে তাদের Adventure পর্ব শেষ করেছে।
দ্বিতীয় রাইড ছিল বাঞ্চি জাম্পের মত। একজন একজন করে উঠতে হয়।
এটায় কোমরে রাবারে দড়ি বেঁধে উপরে ছুড়ে মারে। নিচে পড়ার সময় সে রাবার টেনে ধরে। এটায় অর্ধেকই উঠলো না।
আমার ইচ্ছে আমি সবগুলোতেই উঠবো। যারা প্রথম দিকে উঠলো তাদের বিকট চিৎকারে নিজের সাহসের উপর ভরসা হারালাম। বুঝলাম আমাকে সাহস সঞ্চার করতে হবে।
সাইফকে যখন উপরে ছুড়ে মারলো চিৎকার দিয়ে কেঁদে ফেলেছে সে। আমার আর সাহস হচ্ছে না উঠার।
কিন্তু দেখি এরপরও পুজা, আঁখি এই দুইজন মেয়ে দেখলাম উঠে পড়েছে। তারও যথাসাধ্য চিৎকার দিয়েছে কিন্তু উঠার সাহস তো দেখিয়েছে।
ছেলে মানুষ হয়ে উঠতে না পারলে আত্মসম্মানে আঘাত লাগবে। ফলে সিদ্ধান্ত নিলাম উঠতেই হবে।
বললাম এইবার আমি উঠবো। কোমরে দড়ি বাঁধা হলো। ছুড়ে মারলো উপরে। কোনো চিৎকার করলাম না। মনে মনে ভাবলাম ভালোই সাহস দেখিয়েছি।
আরো সাহস দেখানোর জন্য বললাম আরেকবার মারতে। আবার মারলো। এইবারও কোন চিৎকার করলাম না।
শারমিনকে বলেছিলাম ভিডিও করতে। বীর দর্পে নেমে জিজ্ঞেস করলাম, “কি, কেমন হয়েছে?”
শারমিন বলল, “শুধু তোর টা দেখে আমরা কেউ মজা পাই নি।”
অবাক হয়ে বললাম, “কেনো?”
বলল, “এই রকম মুখ বুজে থাকলে কোনো মজা আছে?”
বুঝলাম বেশি সাহস দেখিয়ে ফেলেছি। আরেকটু কম দেখানোর দরকার ছিল। এই রাইডের আসল মজা মূলত চিৎকারেই। আমি দর্শককে সেই মজা থেকে বঞ্চিত করে ফেলেছি।
একটা সহজ আইটেম ছিলো ‘Mirror Maze’। এটার টিকেট কিনিনি। শাফকাত দেখি গেটম্যানকে কিছু রুপি ঘুষ দিয়ে ঢুকে পড়েছে।
খাইছে আমারে, এই ছেলে আমাদের ক্লাসে সবচেয়ে লাজুক (ভীতুও বলা যায়) ছেলে। সেই ছেলেও বুঝে গেছে কোথায় কিভাবে ঘুষ দিতে হয়? আমিও শাফকাতের পথ অনুসরণ করলাম।
বের হবার সময় গেটম্যান আমাদেরকে বলল, “বলনা নেই। মেরা জব ছুট জায়েগি।”
এই লোক মনে হয় ঘুষ খাওয়ায় খুব এক্সপার্ট না। হয়তো ঘুষ খাওয়ার তেমন কোন সুযোগও পায় না।
পার্ক থেকে ফিরে আসতে আসতে দিনের আলো নিভে গেলো। রুমি আবারও অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
এইবার বমিও হয়েছে। আবার হাসপাতালে নিয়ে গেছে। রুমিকে সঙ্গ দিয়ে আরো কয়েকজন এইবার অসুস্থ হয়েছে।
সুতরাং বুঝতে পারলাম এই ঝামেলা নিয়ে আর কিছু দেখা হবে না। সিমলা সমাপ্ত।
কিন্তু সিমলার আসল সৌন্দর্য তখনো দেখার বাকি ছিলো। সিমলার রাতটাই ছিলো ট্যুরের সবচেয়ে সুন্দরতম রাত।
Mall Road
সিমলার রাত সুন্দর ছিল মূলত Mall Road এর জন্য। আগে Mall Road এর ব্যাপারটা ক্লিয়ার করে নেই, তারপরে কিছু মুভির ঘটনার সাথে মল রোডের সৌন্দর্য নিয়ে কথা বলবো।
Mall Road এর সাথে আমার প্রথম পরিচয় সিমলাতেই। শহরের যে রাস্তায় প্রধান শপ আর রেস্টুরেন্ট অবস্থিত সেটাই Mall Road.
সেখানকার রাস্তা দিয়ে শুধু হাটা যায়, সাধারণত যানবাহন নিষেধ। তবে শহরটা হতে হবে কোনো পাহাড়ি শহর।
আমার সাথে যারা ছিলো তারা হয়ত কেউ লক্ষ্য করেনি যে Mall Road শুধু সিমলা আর মানালিতে ছিল। কলকাতা, দিল্লিতে Mall Road বলে কিছু ছিল না, ছিল নিউমার্কেট আর চাঁদনী-চক।
এই Mall Road দেখে মনে হলো এটা মোটেও ইন্ডিয়ায় কোন জায়গা নয়। ইউরোপের কোন শহর। আমার ধারণা মিথ্যে নয়।
সিপাহি বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার প্রশাসনিক কাঠামোতে পরিবর্তন আনে। তাই ১৮৬৪ সালে সিমলাকে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার গ্রীষ্মকালীন রাজধানী করে। এর কারণ ছিলো সিমলার আবহাওয়া অনেকটা ইউরোপের মত।
মল রোড সুন্দর মূলত দুইটা কারণে।
এক, রাস্তার দুই পাশের দোকান-পাট এবং লাইটিং ছিল অত্যন্ত চমৎকার। প্রশস্ত ফাঁকা রাস্তা। সোনালি আলো ঠিকরে পড়ছে লাম্পপোস্ট থেকে।
দুই, মিটিমিটি জ্বলতে থাকা পাহাড়ি তারা। সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘর-বাড়ি গুলোতে আলো জ্বলে ওঠে। পাহাড়ের নিচ থেকে চূড়া পর্যন্ত। যেন ধীরে ধীরে আকাশ ছুঁতে চায়। আকাশের তারাগুলো তখন জ্যোতি হারায়। সৌন্দর্যের রাজ্যে তখন মাটির তারার রাজত্ব।
এটাই সবচেয়ে মন কাড়া দৃশ্য।
আমির খানের একটা মুভি ছিলো নাম ‘Taare Zameen Par’। নাম কোথা থেকে দিয়েছেন জানি না।
তবে এখন ওই পাহাড়ের মিটিমিটি জ্বলা বাতিগুলো বিশ্বাস হচ্ছে যে তারা মাটিতে থাকতে পারে। আমার লেখার নাম ‘Taare Zameen Par’ ঠিক এই কারণেই।
এখন আরেকটা মুভির কথা মনে পড়ছে, ‘Pirates of the Caribbean’. Captain Jack Sparrow জাহাজ নিয়ে বের হয়েছে সমুদ্রের শক্তির খোঁজে। জাহাজ গিয়ে পৌঁছেছে রত্ন দ্বীপে। সেই দ্বীপ জুড়ে বিভিন্ন আকারের রত্ন পাথরের ছড়াছড়ি।
সূর্যের আলো পড়লে পাথরগুলো জ্বলজ্বল করে ওঠে। মনে হয় পুরো দ্বীপ জুড়ে যেনো তারা ঝিলমিল করছে।
নায়িকা বলে ওঠে, “It’s the most beautiful thing I ever seen. This island is a perfect reflection of the heavens.”
সিমলার মল রোডে দাঁড়িয়ে যখন পুরো শহরটা দেখছিলাম তখন এই এই দুটো লাইনই আমার মাথায় আসছে, “It’s the most beautiful thing I ever seen. This is a perfect reflection of the heavens.”
আরেক টা মুভির কথা বলি, আশা করি দেখেছেন। বলেন তো নিচের ছবিটি কোন মুভির?
মল রোডে দাঁড়িয়ে শহর দেখার দৃশ্য অনেক টা এই দৃশ্যের মত। কি ধরতে পেরেছেন কোন মুভি?
বলে দিচ্ছি। শাহরুখ খানের ‘Rab Ne Bana Di Jodi’ মুভির Love Proposal Scene ছিলো এটি। রোমান্টিক মুভি।
কলেজ ভার্সিটির ছেলে মেয়েদের ভালো লাগার কথা। বেশ কয়েকবার দেখেছি। এই লেখার জন্য আরেকবার দেখলাম।
আমাদের ডিপার্টমেন্টে এক ভাই আছে, সুজন ভাই। ভাইয়ের Girl Friend এর নাম ছিলো তানিয়া, এখন বউ হয়ে গেছে, তারই বউ। এই মুভি দেখার পর সে বউকে ডাকে Taani Partner বলে।
এই মুভির মত এই রকম সুন্দর স্থানে প্রোপজ করলে কোন মেয়ের কি ক্ষমতা আছে না বলার? না বলতেও যে ক্ষমতা লাগে তার প্রমাণ দেব।
তার আগে একটু বলে নেই একটা ব্যাচ ট্যুরে ছেলেমেয়েরা কি কি করে-
১। ট্যুরে যাবার জন্য শপিং করে।
২। ট্যুরে গিয়ে বাসার জন্য শপিং করে।
৩। ভাল-মন্দ খাওয়া দাওয়া করে, অনেকে ট্যুরে যায় শুধু মন্দ খাওয়ার জন্য।
৪। প্রেম করে, প্রেম না থাকলে নতুন করে প্রেমে পড়ে।
৫। দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে যায় (সময় পেলে), ঘুরতে গিয়ে আবার প্রধান ছবি তোলা, ছবি কত সুন্দর আসলো এটাই মূখ্য বিষয়, স্থান গুরুত্বপূর্ণ নয়।
প্রথম চারটা গুরুত্বপূর্ণ, শেষেরটা ঐচ্ছিক।
সুতরাং বুঝতেই পারছেন, ট্যুরে গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে প্রেম করা একটা। তাই ট্যুরে সাধারণত ভালোবাসার নিবেদন কেউ ফিরিয়ে দেয় না। সিমলার মত পরিবেশ পেলে ফিরিয়ে দেওয়াও যায় না।
সিমলার আবহাওয়া অনেকের প্রেমের পালে হাওয়া দিয়েছে। এখানে এসে অনেকেই শাহরুখ খান হয়ে গেছে, অনেকেই হয়েছে Taani Partner.
একটা উদাহরণ দেই। প্রেমে টানাপোড়া ছিল এমন একটা জুটি হঠাৎ করে রাতে গায়েব। দু জনে ঘুরতে গেছে কাউকে কিছু না বলেই। রাত দশটা বেজে গেছে খবর নেই। চিকনা মামুন ফোনের পর ফোন দিয়ে যাচ্ছে কেউ ধরছে না।
দশটার পরে আপনা আপনি ফিরে আসলো দুজন, হাতে হাত রেখে হাসতে হাসতে। সেই হাসি বাকিদের রাগ বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট।
তাদের জিজ্ঞেস করা হলো, “কিরে ফোন ধরিস না কেনো? কতবার ফোন দিয়েছি?”
এরা কোন বিচলিত না হয়ে সহজ ভঙ্গিতে উত্তর দিলো, “ফোন দিছিলি নাকি! দেখতে পাই নি।“ এদেরকে আর কি বলা যেতে পারে এর পরে।
এই প্রেম রাজ্যে এই হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা তো স্বাভাবিক বিষয়। কিছু কিছু প্রেমের ঘটনা এতই confidencial যে তা লিখলে লেখা Censor Board এ আটকা পড়ে যাবে। আজকে কেউ কাউকে কোন কিছুতে না বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।
তবে আবহাওয়া পরিবর্তনের সাথে সাথে সম্পর্কের রুপ বদলায়। যে প্রেম হিমাচলের ঠান্ডা আবহাওয়ায় শুরু হয়েছিলো, তা দিল্লির ভ্যাপসা গরমে ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিলো। দেশে ফিরতে ফিরতে ছিল শুধু স্মৃতিটুকু।
তবে সফলতার গল্পও ছিলো। এই ট্যুরের সফল দুইটা জুটির দুইটাই আমাদের দুইজন CR (Class Representative) এর জুটি।
সিলভিয়া জিম জুটি ট্যুর থেকে এসেই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। সিলভিয়া জিম জুটিকে যদি জিজ্ঞেস করা ইন্ডিয়াতে আমরা কি কি দেখছি? মনে হয় না ওরা কিছু বলতে পারবে না।
ওরা একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে থেকেই ট্যুরটা কাটিয়ে দিয়েছে। কিছুটা সময় অবশ্য শপিংকেও দিয়েছে, কারণ বিয়ে সামনে।
তবে শায়েখ পৃথ্বী জুটির সফলতা পেতে একটু সময় নেয়। এর কারণ হতে পারে শায়েখ তখন CR ছিল না। যখন সে সফল হয় তখন সে CR।
তাদের বিয়ে হয়তো এই লেখা পাবলিশ হওয়ার আগেই হয়ে যাবে। এই ট্যুরটা ছিল তাদের সফলতার অন্যতম নিয়ামক।
কাকতালীয়ভাবে আমাদের ব্যাচে যারা CR ছিলো তারা সবাই ডিপার্টমেন্টে সফল। বাকিদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ।
সাইফ চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত আমাদের CR ছিলো। তার বেলায় একই ব্যাচ না হলেই একই ডিপার্টমেন্ট ঠিক ছিল।
শায়েখকে জিজ্ঞেস করা হয়নি সফলতার এই CR সূত্র সে আগে থেকে জানতো কিনা?
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টাই তো বলা হয়নি, শপিং।
এখন পর্যন্ত যেই নতুন পর্যটন স্থানে গিয়েছি সব জায়গাতেই আগে আমরা শপিং করেছি। সিমলাই একমাত্র জায়গা যেখানে কেউ শপিং এ যায়নি। তবে ব্যতিক্রম আছে, প্রভাতী আপু। এখানেও সে এক বস্তা শপিং করেছে।
আচ্ছা শপিং এ Guinness World Record এর কোনো ব্যবস্থা আছে?
খাওয়া দাওয়ার বিষয়ে আসি। ইউরোপে যখন আসছি খানা দানা তো ইউরোপের মত হওয়া চাই।
এখানে আমাদের দেশের মুদির দোকানের মত রাস্তার মোড়ে মোড়ে মদের দোকান । দোকানগুলো খুবই সুন্দর করে সাজানো। একদম ইউরোপীয় কায়দা।
আজ রাতে ড্রিংসের আসর বসবে আমার রুমে। আগের আসরগুলোতে মেয়েরা ছিলো না। আজকে মেয়েরাও থাকবে। ঐদিকে স্যারদের ব্যস্ত রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে তারা কিছু টের না পায়।
এই আসরের বেশিরভাগই আগে কোন ধরণের ড্রিংস করেনি। বিদেশে আসছে দুই এক ফোঁটা ড্রিংস না করলে দেশে গিয়ে বন্ধু বান্ধবদের মুখ দেখাবে কিভাবে? মুখ দেখানো জরুরী।
রুমিকে নিয়ে ঝামেলা শুরু হয়েছে। সকালে মানালি রওনা দেবো, কিন্তু স্যার জানিয়ে দিলো রুমিমে নেয়া যাবে না। রুমি সকালে ও সন্ধ্যায় দুবার জ্ঞান হারিয়েছে।
সিমলা থেকে মানালি এক দিনের পথ, দীর্ঘ যাত্রা। আবার উচ্চতাও বেশি। এই দীর্ঘ যাত্রায় কোথাও হাসপাতাল নেই। এতবড় রিস্ক নেয়া যাবে না।
রুমি কান্নাকাটি শুরু করেছে। জীবন দিয়ে হলেও সে যাবে, বরফ দেখবে। সে কোন ভাবেই একা থাকবে না। স্যার কোনভাবেই তাকে নিবেন না।
রুমির বাসায় ফোন দেয়া হলো। বাসা থেকে অনুমতি পেয়ে স্যার রাজী হলেন। ভাগ্য ভালো আর কোন অঘটন ঘটেনি। রুমি পুরোপুরি সুস্থভাবেই পুরো ট্যুর শেষ করলো।
আসর বসার আগেই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে উঠে দেখি আসরীদের মন খারাপ। কারণ যাকে কিনতে পাঠিয়ে ছিল তার অতি পারদর্শিতার কারণে জিনিস চিনে আনতে পারেনি। খেয়েছে কিন্তু কোন ফিলিংস পায়নি।
সব সময়ই একটা দল থাকে যারা ট্যুরে আসে বার ও বারবনিতার খোঁজে। পৃথিবীর সৌন্দর্য তাদের স্পর্শ করে না। অবৈধ ও নিষিদ্ধ কাজের মধ্যেই তাদের যত আত্মতৃপ্তি।
রোল- শহ-৩৪
সেশন-২০১৪-১৫
ড। মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হল
- মো: আজমির হোসেনhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%ae%e0%a7%8b-%e0%a6%86%e0%a6%9c%e0%a6%ae%e0%a6%bf%e0%a6%b0-%e0%a6%b9%e0%a7%8b%e0%a6%b8%e0%a7%87%e0%a6%a8/বৃহস্পতিবার, জুলাই ১৪, ২০২২
- মো: আজমির হোসেনhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%ae%e0%a7%8b-%e0%a6%86%e0%a6%9c%e0%a6%ae%e0%a6%bf%e0%a6%b0-%e0%a6%b9%e0%a7%8b%e0%a6%b8%e0%a7%87%e0%a6%a8/বৃহস্পতিবার, আগস্ট ১১, ২০২২
- মো: আজমির হোসেনhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%ae%e0%a7%8b-%e0%a6%86%e0%a6%9c%e0%a6%ae%e0%a6%bf%e0%a6%b0-%e0%a6%b9%e0%a7%8b%e0%a6%b8%e0%a7%87%e0%a6%a8/বৃহস্পতিবার, মার্চ ৯, ২০২৩
- মো: আজমির হোসেনhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%ae%e0%a7%8b-%e0%a6%86%e0%a6%9c%e0%a6%ae%e0%a6%bf%e0%a6%b0-%e0%a6%b9%e0%a7%8b%e0%a6%b8%e0%a7%87%e0%a6%a8/বৃহস্পতিবার, জানুয়ারি ১১, ২০২৪