fbpx

হাওরে চাঁদের আলো

কারো কারো জন্য ঘোরাঘুরি একটা ব্যাধি। আমি সে ব্যাধিতে আক্রান্ত। আইয়ুব শুনলে হয়তো বলবে, “তোর যদি ব্যাধি হয়, আমার তাইলে ক্যান্সার!”

বলার কারণও আছে, ঘোরাঘুরির সব প্লান থাকে তার। অ্যারেঞ্জমেন্ট, ম্যানেজমেন্টেও থাকে সে। আর তাই প্রত্যেকবার ট্যুর শেষ করে এসে বলে, “এইবারের ট্যুরটা বেস্ট ছিল।”

এইবারের  টাঙ্গুয়ার হাওর ট্যুরের আয়োজনও তার। যাবার কথা ছিল নয় জনের। কিন্তু বাসে উঠার একটু আগে একজন ফোন করে জানালো সে যাবে না।

তার না যাওয়ার পিছনে অনেক কারণ দেখালো, তবে আসল কারণ একটাই ‘বউ ভীতি’। অজুহাতের ধরণ দেখেই বোঝা যায়। বিয়ে না করলে জোর করে নিয়ে যেতাম, এখন পারছি না।

বিয়ের পর বন্ধুরা হয়ে যায় ‘অর্ধ-বন্ধু’, অনুরোধ খাটে, অধিকার খাটে না। 

বিবাহিত বন্ধুদের মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করি, “বউকে এতো ভয় পাওয়ার কারণ কী?”

প্রায় সবাই একটা উত্তরই দেয়, “বিয়ে করো, বুঝতে পারবা!”

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “মানুষের একটা বয়স আছে যখন সে চিন্তা না করিয়াও বিবাহ করিতে পারে। সে বয়স পেরোলে বিবাহ করিতে দুঃসাহসিকতার দরকার হয়।”

সে বয়স পার হয়েছে। তাই দুঃসাহস অর্জন করার চেষ্টা করছি। যা একটু অর্জন করি তা এইসব বিবাহিতদের কারণে হারিয়ে ফেলি। 

বিবাহিতদের এটাও জিজ্ঞেস করেছি, “বউয়ের সাথে ঘুরতে যাওয়া আর বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাওয়ার মধ্যে কোনটা বেশি মজার?”

সকলেই একবাক্যে উত্তর দিয়েছে, বন্ধুদের সাথে। তাই এখন বিয়ের কথা উঠলে মনে হয় জীবন ফুরিয়ে আসছে। যাই জীবনের শেষ কটা দিন বন্ধুদের সাথে কাটিয়ে আসি। 

এক সিট ফাঁকা রেখেই রওনা দিলাম। জার্নিটা ছিল ভয়ের। ট্যুর থেকে ফিরে একদিন আইয়ুবকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আমাদের ট্যুরের একটা ঘটনা বল যেটা তোর কাছে মজার মনে হয়েছে?”

আইয়ুব বলল, “মজার ঘটনা বলতে বাসের ড্রাইভারের কথা মনে পড়ে। বাসে যাত্রীরা সবাই জেগে আছে কিন্তু ড্রাইভার ঘুমাচ্ছে!”

সবাই জেগে ছিল ভয়ে, এই বুঝি অ্যাকসিডেন্ট হলো! এইরকম একটা ভয়ের ব্যাপারও এখন মজার মনে হচ্ছে। বিপদ কেটে গেছ তো!

যখন ট্রলার ঘাটে পৌঁছেছি তখন বাজে সকাল ১১ টা। ভোর ৬ টায় পৌঁছানোর কথা ছিল। আমাদের ট্রলার ছাড়া বাকি সব ট্রলার চলে গেছে। 

ট্রলারে নিজস্ব বাবুর্চি থাকে। তাকে নিয়ে দুই দিনের বাজার করে ট্রলার উঠলাম। ছাড়তে ছাড়তে ১২ টা বেঁজে গেলো, যথেষ্ট দেরি।

জাদুকাটা নদী

হাওরের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য হলো বৃষ্টি। তবে বৃষ্টির কোন লক্ষণ দেখছি না, তীব্র গরম। 

শরীর খুবই ক্লান্ত। রাতে ঘুম হয়নি (যদিও সকলের অভিযোগ পুরো বাস আমি ঘুমিয়েছি), গত দু বেলা খাইনি। ট্রলার ছেড়ে দিতেই বাতাস লাগতে শুরু করলো, শান্তি লাগছে। কিন্তু রান্না হতে ঘন্টা দুই লাগবে। নদী দিয়ে ট্রলার চলছে।

ট্রলারওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, “এখন আমরা কোথায় যাচ্ছি?”

বলল, “এখন যাচ্ছি বারেইক্কা টিলা আর শিমুল বাগান।”

জিজ্ঞেস করলাম, “এরপর কোথায় যাব?”

বললেন, “এরপর যাব টেকেরঘাট। সেখানে রাতে থাকব। সকালে ওয়াচ টাওয়ার যাব।”

সুরমা নদী ছেড়ে হাওরে ঢুকলাম। এখন বাড়িঘরগুলো চোখের সীমানার বাইরে। দূরে মেঘের মধ্যে দিয়ে কতগুলো আঁকাবাকা রেখা দেখিয়ে সজীব বলল, “ওইগুলো ইন্ডিয়ার পাহাড়।” মেঘের মধ্য থেকে পাহাড় আলাদা করতে কষ্ট হচ্ছে।

ট্যুরে আসার কয়েক দিন আগেই সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ‘পালামৌ’ ভ্রমণ কাহিনি পড়েছিলাম।

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় গাড়িতে করে পালামৌ যাচ্ছিলেন। যাবার পথে পাহাড় দেখে গাড়োয়ানকে গাড়ি থামাতে বললেন ।

গাড়োয়ান জিজ্ঞেস করলো, “কোথায় যাবেন?”

বললেন, “পাহাড়ে যাব।”

গাড়োয়ান বললো, “সেখানে গেলে তো সন্ধ্যার আগে ফিরতে পারবেন না।”

তিনি বললেন, “আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি পাঁচ মিনিটের পথ।” এই বলে তিনি দ্রুত পায়ে হেঁটে চললেন। 

পনেরো মিনিট হাঁটার পর দেখলেন পাহাড় আগের মতই পাঁচ মিনিটের পথ। আর না গিয়ে ফিরে আসলেন। 

তিনি বুঝতে পারলেন বাঙ্গালিরা পাহাড় দেখায় অভ্যস্ত নয়, তাই দূরত্ব বুঝতেও ভুল করে। 

এই অভিজ্ঞতা থেকে আমি সবাইকে জিজ্ঞেস করলাম, “বলতো এখান থেকে পাহাড় কত দূরে?”

জানি সবাই ভুল করবে। কেউ বলল পাঁচ কিলোমিটার, কেউ দশ, কেউ বিশ। আমি ওদের ভুল ঠিক করে দিলাম। বললাম, “কমপক্ষে চল্লিশ কিলোমিটার।”

মিনিট বিশেক পরেই দেখি ট্রলার পাহাড়ের নিচে চলে এসেছে। চল্লিশ কিলোমিটার তো অনেক দূরের কথা, পাঁচ কিলোমিটার হবে কি না সন্দেহ।  

যে পাঁচ কিলোমিটার বলেছিলো সে হয়তো আমাকে খুঁজতেছে। ট্রলার থামতেই দ্রুত গোসল করতে নেমে গেলাম, যাতে এই কথা তোলার সুযোগ না পায়। সুযোগ পেলে পন্ডিতি ছুটিয়ে দেবে।

নদীর পানি খুবই স্বচ্ছ। তীব্র রোদেও পানি আশ্চর্য রকমের ঠান্ডা। মুহূর্তেই শরীরের সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। এজন্যই হয়তো নদীর নাম জাদুকাটা।

জাদুকাটা নদীর তীর (ছবি সংগৃহীত)
জাদুকাটা নদীর তীর (ছবি সংগৃহীত)

নদীর এই পাড়টা সমুদ্রের বীচের মত। তবে বালিগুলো লালচে, বড় বড় দানা, পাথুরে ধরনের। এগুলোই বিখ্যাত ‘সিলেট স্যান্ড’।

ছোট ছোট দুইটা ছেলে মেয়ে ঠেলা জাল দিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা করছে। কোন মাছ পাচ্ছে না। কিন্তু তাতে তাদের মাছ ধরার উৎসাহের কোন কমতি পরছে না। ছোট মেয়েটা খুবই খুশি, লাফাতে লাফাতে ভাইয়ের পিছনে ছুটছে।

একটু দূরেই তাদের বাবা নৌকায় বসে তাদের দিকে খেয়াল রাখছে আর নৌকার পানি সেচছে। ঘাটে অনেকগুলো ডিঙি নৌকা বাঁধা। এগুলো পাথর আর বালি টানে।

তার কাছে গিয়ে তাকে আমরা জিজ্ঞেস করলাম, “কিসের নৌকা এটা?” 

উত্তর দিলো, “পাথার টানার নৌকা।” 

বললাম, “পাথর কি হিসেবে বিক্রি করেন? কেজি দরে?”

বলল, “না, নৌকা হিসেবে।”

জিজ্ঞেস করলাম, “এক নৌকা কত?”

জানালো, “১৪০০-১৫০০ টাকা।”

আবার জিজ্ঞেস করলাম, “এক নৌকায় কত জন কাজ করেন?”

বললেন, “দুই জন।”

আইয়ুব জিজ্ঞেস করলো, “দিনে কত নৌকা পাথর পান?”

বললেন, “কোন দিন এক নৌকা হয় কোন দিন হয় না। বিএসএফ ঝামেলা করে মাঝে মাঝে।”

নদীর বাংলাদেশ অংশে কোন পাথর নেই, সব বিক্রি হয়ে গেছে। এখন শুধু বালি আছে, ঐটাও বিক্রি হচ্ছে। পাথর আনতে নৌকা নিয়ে ভারতে ঢুকতে হয়।

(ছবি সংগৃহীত)
(ছবি সংগৃহীত)

আমি আর আইয়ুব ছাড়া বাকিরা গোসল শেষ করে চলে গেছে। পাশেই আরেকজনকে দেখালাম এই তীব্র রোদে নৌকায় চা বিস্কিট বিক্রি করছে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আশে পাশে দেখার কি আছে?”

তিনি বললেন, “এইদিকে একটা যৌথ বাজার আছে। হাটবার ইন্ডিয়া থেকে গারোরা আসে এখানে।”

 জিজ্ঞেস করলাম, “কত দূর?” 

বললেন, “অটোতে ১৫ টাকা ভাড়া। তবে আজকে কিছু পাবেন না। বুধবার হাট বসে।”

আজকে বৃহস্পতিবার, হাট নেই। তাই আমরা দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে গেলাম নদীর অপর পাড়ে ‘বারেইক্কা টিলা’ দেখতে। সজল ঘুমিয়ে পড়েছে, সে যাবে না। ক্লান্ত, রাতে ঘুম হয়নি।

টিলার উপর থেকে দেখতে অনেক সুন্দর। একটু সামনেই একটি সাইনবোর্ড, “বাংলাদেশের সীমানা শেষ। বর্ডার অতিক্রম করা নিষেধ।” 

‘নিষেধ’ লেখা সাইনবোর্ডের কোন দাম নেই এদেশে। তাছাড়া নিষিদ্ধ কাজের প্রতি মানুষের আকর্ষণ তীব্র ও চিরন্তন। 

আমরা বর্ডার অতিক্রম করার সুযোগ খুঁজছি। দুইজন লোক ভারতের বর্ডার থেকে এদিকে আসছে। আমাদের দেখে বললেন, “ঐদিকে যাইয়েন না।”

আমি বললাম, “আপনারা নিজেরা ঘুরে আসছেন, আমাদের যেতে নিষেধ করছেন কেন?”

লোকটা কঠিন চোখে তাকালো আমার দিকে, বলল, “বিএসএফ বাঁশি দিয়েছে, এজন্য আমরা চলে এসেছি। আপনাদের যেতে ইচ্ছে করলে যান।” 

এরপর আর সাহসে কুলালো না। আশেপাশেই কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করলাম। সন্ধ্যা হতে বেশি সময় বাকি নেই। শিমুল বাগান ঘোরা বাকি। 

এখান থেকে যদিও বেশি দূরে নয়, দেখা যায়। কিন্তু ছবি তুলতে হলে আলো থাকতে যেতে হবে। 

শীতের শেষে যখন ফুল ফোঁটে পুরো বাগান আগুন রঙ ধারণ করে। টকটকে লাল ফুল দাউ দাউ করে ফুটতে থাকে। ফুল না থাকলেও বাগানটা সুন্দর। নিখুঁতভাবে সারি করে লাগানো চমৎকার লাগে দেখতে।

শিমুল বাগানের মালিক হয়তো কোনোদিন কল্পনাও করেনি তার এই বাগান দেখার জন্য এভাবে বছরভরে সারা দেশের মানুষ আসবে। হয়তো শখের বসেই এই বাগান করেছিলেন। শখটাই তাকে অমর করেছে।

বসন্তের শিমুল বাগান (ছবি সংগৃহীত)
বসন্তের শিমুল বাগান (ছবি সংগৃহীত)

গাছের সারির সাথে ছবি তুলতে গিয়ে দেখি সারিগুলো ভালো বোঝা যাচ্ছে না। ঘোড়াওয়ালাদের যন্ত্রণায় ছবি তুলতে পারছি না। ঘোড়ায় ওঠার জন্য পীড়াপীড়ি করছে।  

“ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাটিয়া চলিল,
কিছু দূর গিয়া মর্দ রওনা হইলো।”

ঘোড়া দেখলেই আমার বাংলা পুথির এই দুই লাইন মনে পড়ে। ছোট বেলায় বাবার কাছে শুনেছিলাম। বাবা শুনেছিল আবার দাদার কাছে।

ঘোড়ায় উঠলাম। ইরফান ভাইকে বললাম ঘোড়ার সাথে ছবি তুলে দিতে।

ইরফান ভাই বললেন, “ঘোড়া বলছেন কেন? এইগুলো তো ঘোড়া না।”

আমি বললাম, “এইগুলো কি তাইলে?”

ইরফান বললেন, “এগুলো খচ্চর। ঘোড়া আরো বড় হয়।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “খচ্চর কি?”

বললেন, “গাধা আর ঘোড়া মিলিয়ে নতুন একটা প্রজাতি।”

আমি যে বায়োলজি জানি তাতে দুই প্রজাতি মিলানো যায় না। যেমন, মুরগী আর হাঁস মিলিয়ে ‘মচ্চর’ বানানো সম্ভব না। আমি আমার বায়োলজি বিদ্যা উপস্থাপন করলাম। 

তার ব্যাখ্যা শুনে মনে হলো তার বায়োলজি বিদ্যা অনেক অ্যাডভান্স। তার সামনে আমার বায়োলজি টিকবে না। তাই যাতে চড়েছি সেটাকে এখন খচ্চর মেনে নেয়াই উত্তম। আরেকটা উপকারও অবশ্য আছে, যুক্তি মেনে নিলে তার আরও অ্যাডভান্স যুক্তি থেকে বাঁচা যাবে।

ঘোড়াকে খচ্চর মেনে নিতে ততটা কষ্ট মনে হয়নি, যতটা কষ্ট মনে হয়েছে সেটায় চড়তে।  খচ্চরটা হঠাৎ আমাকে নিয়ে দৌড় দিল। খচ্চরের মালিক পিছনে পিছনে দৌড়াচ্ছে।

আমি ঝাঁকির সাথে তাল মিলাতে পারছি না। পিঠের গদি নড়ছে, পিছলে পড়ে যাবার ভয়ে আছি।

পড়ে গেলে বন্ধু-বান্ধব হাসাহাসি করবে, পর্যটকরাও হাসাহাসি করবে। মান-সম্মানের বিষয়। এখন খচ্চর ব্রেক করি কিভাবে?  

ভাগ্য ভালো ঘোড়ায় চড়িয়া রাজকুমারীকে উদ্ধারের দিন এখন আর নেই। এই সাহস আর যোগ্যতা দিয়ে রাজকুমারীকে উদ্ধার করা হতো না। আর উদ্ধার করলেও বলত, “কি ব্যাপার, তুমি ঘোড়াও চেন না?”

জ্যোৎস্না রোগ

রাজকুমারীকে উদ্ধারের চিন্তা ছেড়ে নৌকায় উঠলাম। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আকাশে এত্ত বড় একখান চাঁদ, আজ পূর্নিমা। হুমায়ূন আহমেদ হলে লিখতেন ‘আজ চান্নি-পসর রাত’। 

হুমায়ূন আহমদের নানাবাড়িতে এক কাজের লোক ছিল। ঐ বাড়িতেই থাকতো, কাজ-বাজ করতো। সেই লোকের ছিল প্রচন্ড জ্যোৎস্নাপ্রীতি। তিনি জ্যোৎস্না রাতকে বলতেন চান্নি-পসর রাত।

চান্নি-পসর রাতে তিনি খুব আয়োজন করে চান্নি দেখতেন। একরাতে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে নদীতে গেলেন চান্নি দেখতে। মাঝ নদীতে অপূর্ব চান্নি দেখে হুমায়ূন আহমদ অভিভূত। এরপর থেকে তার মধ্যে জ্যোৎস্না রোগ ঢুকে গেছে। 

এরপর হুমায়ূন আহমেদ সারা জীবনে জ্যোৎস্না দেখার জন্য অনেক পাগলামি করেছেন। জ্যোৎস্না নিয়ে গানও লিখেছেন- “চান্নি-পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়”।

গানটা লিখেছেন সেই কাজের লোকের কথা ভেবে। তার ইচ্ছে ছিল তিনি যেন চান্নি-পসর রাতে মারা যান। এবং তিনি যে দিন মারা যান সেদিন রাতে আকাশে ছিল ফকফকা চান্নি, তার সেই চান্নি-পসর রাত।

আজকের জ্যোৎস্নাটাও মারা যাবার ইচ্ছার মত সুন্দর। ট্রলারের ছাঁদে উদাস হয়ে শুয়ে আছি। এই জ্যোৎস্নায় উদাস হতে ভালো লাগছে। এত সুন্দর জ্যোৎস্না কি কখনো দেখেছি আগে?

আরেকবার হয়তো দেখেছি। তখন আমার সাথে একটা মেয়ে ছিল। দুজনে জুতা জোড়া হাতে নিয়ে সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে আছি।

আকাশ ভরা জ্যোৎস্না। একটু পর পর গর্জন করে ঢেউ ভাঙছে, এসে পায়ে পরছে। আমি হারিয়ে যাওয়া পথিকের দৃষ্টিতে দেখছি। 

হটাৎ মেয়েটাকে বললাম, “তোমার ডান হাতের জুতা জোড়া বাঁ হাতে নাও।”

মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো, “কেন?”

বললাম, “আমার হাত টা একটু ধরো, আমি জ্যোৎস্না দেখবো।”

আমি আমার আচরণে অবাক। কারণ, তার সাথে আমার মোটেও হাত ধরার সম্পর্ক না। তারপরও অপেক্ষা করে আছি হাত ধরে কি না।   

ট্রলারের ভটভট শব্দ ছাড়া চারদিকে আর কোনো শব্দ নেই। সবাই ট্রলারের ছাঁদে শুয়ে হাওরে চাঁদের আলো দেখছি। এখন যাচ্ছি টেকেরঘাট।

চাঁদের আলোয় মাঝে মাঝে দুই একটা ঘর বাড়ি দেখা যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে মনুষ্য সভ্যতার বাইরে এরা।

ঘোরাঘুরি করে একটা জিনিস জেনেছি, সভ্যতার স্পর্শ যেখানে কম প্রকৃতি সেখানে অপরূপ। কি অপরূপ আজকের রাত!

শিমুল বাগান থেকে টেকেরঘাট পৌঁছাতে ঘন্টা তিনেক সময় লাগলো। ঘুরতে আসা সব নৌকা রাতে টেকেরঘাট আশ্রয় নেয়, নিরাপত্তার জন্য। 

ঘাটের সাথেই ভারতের পাহাড়, অতি নিকটে। এতই নিকটে যে পাহাড়ের রাস্তায় বাতির আলো ঘাটে এসে পড়ছে।

পাহাড়ের গায়ে অনেক ছোট ছোট কিছু ঘর। ঘরের বাতিগুলো তারার মিটিমিটি জ্বলছে। পাহাড়ের এই দৃশ্যটা সবচেয়ে সুন্দর।

ঘাটে নামলাম। ট্রলার ঘাটে একটাই দোকান। দোকানের প্রধান ব্যবসা হলো মোবাইল চার্জ দেয়া। ২০ টাকায় ফুল চার্জ। টোকেন নিয়ে মোবাইল চার্জ দিতে হয়। কঠিন ব্যবসা।

দ্বিতীয় ব্যবসা হলো কয়েল বিক্রি। প্রায় সবাই কিনছে। অথচ আমি জানি হাওরে মশা নেই। দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম, “এখানে কি মশা আছে আসলে?”

দোকানদার বলল, “দেখেন না সবাই কয়েল নিচ্ছে! এক কার্টুন কয়েল ছিল, প্রায় সবই বিক্রি হয়ে গেছে।”

জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কয়েল জ্বালিয়েছেন?”

দোকানদার হেঁসে দিল, বলল, “না। ডেঙ্গুর ভয়ে নেয় সবাই।”

এই অল্প জায়গায় আজ রাতে কয়েকশো নৌকা। আশেপাশের নৌকায় উচ্চশব্দে গান বাজাচ্ছে। মনে হচ্ছে এদের যন্ত্রণায় ঘুমানো যাবে না। এর চেয়ে ঢাকায় অনেক নিরিবিলি। 

হাওরের ভোজন

রাতে খেতে বসেছি ট্রলারের ছাদে। খেতে বসেই মনে হয়েছে দুপুরে ট্রলারের ভিতরে বসে খাওয়াটা ভুল ছিল। ছাদে অনেক খোলামেলা, হালকা বাতাস সাথে।

ছোটবেলায় মামার সাথে একদিন আড়িয়াল খাঁর চরে কাজ করতে গিয়েছিলাম। দুপুরে তাদের সাথে ক্ষেতের আইলে খেয়েছি। অন্যরকম এক অনুভূতি। তৃপ্তি আর প্রশান্তিতে ভরপুর। মনে হয়েছিল খাবারের স্বাদও বেড়ে গেছে কয়েকগুন।

ট্রলারের ছাঁদেও একই রকম অনুভূতি হচ্ছে।  রাতের আইটেম হাঁস। টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণে হাঁস স্পেশাল আইটেম।

কিন্তু হাঁসের মাংস দেখে হতাশ। এত ছোট ছোট করে কাটা যে রানের মাংস আর ডানার মাংস আলাদা করা যাচ্ছে না। আর দুইটা হাঁসে মাত্র এইটুকু মাংস?

আমাদের ধারণা বাবুর্চি ভালো মাংস আলাদা করে রেখেছে। যদিও দেখিনি, তবে এই ধরনের ধারণা অমূলক না। কারণ ছেচড়া চুরিতে এদেশের মানুষ সিদ্ধহস্ত।

বাবুর্চিরা যা লাগবে তার চেয়ে বেশি বাজার করায়। কারণ বেঁচে যাওয়া আইটেমও তাদের ইনকামের আরেকটা উপায়।

তবে এখানকার বাবুর্চিরা খুবই ভালো রান্না করে। আপনি সুনাম করতে বাধ্য। মসুরির ডাল কিনেছিলাম ঘন করে রান্না করার জন্য। এই ডাল ভাগে পেতে যুদ্ধ করতে হয়েছে। খাওয়ার শুরুতেই ডাল শেষ।

হাঁস রান্নাও ছিল চমৎকার। মাছ রান্না খেয়ে মনে হয়েছে ঢাকায় আসলে আমরা কি আবর্জনা খেয়ে বেঁচে আছি!

দুই দিনে মোট চারবেলা ট্রলারে খেয়েছি। হাঁস ছাড়া বাকি তিন বেলাতেই ছিল মাছ। বড় সাইজের রুই মাছ দুই বেলা, কৈ মাছ এক বেলা। হাওরে এত এত তাজা মাছের সমাগমে মাংস খাওয়া বোকামি।

শুধু খাওয়া-দাওয়ার জন্য আরেকবার টাঙ্গুয়ার হাওর যাওয়া দরকার। অনেক রকম মাছ খাওয়া বাকি। বঁড়শি দিয়ে মাছ ধরতে চেয়েছিলাম, সেটাও বাকি।

খাওয়া-দাওয়া শেষে তর্ক করতে বসলাম। চাঁদ দেখছিলাম আর ‘Rockstar’ মুভির গান শুনছিলাম। তর্কের বিষয়বস্তু- এই গানের গায়ক কে?

সজলের মতে রাহাত ফতে আলি খান, আর আমি বললাম এ আর রহমান।

আমি জানি আমিই সঠিক। এখানে নেট পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই প্রমান দেখানোর সুযোগ নেই। সবাই সজলের পক্ষে। কারণ তার কনফিডেন্স ১০০% ছাড়িয়েছে অনেক আগেই, কিছুক্ষণের মধ্যে হাজারও ছাড়িয়ে যাবে।

একটা বইতে পড়েছিলাম, “তর্ক করে কখনো জেতা যায় না। তর্কে জেতার উপায় হচ্ছে তর্ক এড়িয়ে যাওয়া।”

শাস্ত্র মেনে তর্ক এড়িয়ে গেলাম। কিন্তু লাভ হলো না৷ এখন সজল আমাকে নিয়ে টিটকারি করছে (খোঁচা মারছে)। বাংলা গান ছেড়েও বলছে, “এটা এ আর রহমানের গান।” আর সবাই হো হো করে হাসছে। আর চাঁদ দেখা হয়েছে! তার চেয়ে বরং ঘুমাতে যাই।

ঘুমাতে গিয়ে টের পেলাম শব্দ বা মশা মূল সমস্যা না, মূল সমস্যা হলো প্রচন্ড গরম। ছোট দুইটা ফ্যান আছে, কিন্তু তা আটজনের ঘুমানোর জন্য যথেষ্ট না। তারমধ্যে সজল একাই একটা নিয়ে নিয়েছে।

ইবনে বতুতা এখানে ঘুরতে এসেছিলেন। মরক্কোর মানুষ, মরুভূমি থেকেছেন। তাও এখানকার গরমে অতিষ্ঠ হয়ে এদেশ সম্পর্কে বলেছেন, “A hell full of good things.” ‘সম্পদে পরিপূর্ণ নরক।’

নীলাদ্রি লেক
নীলাদ্রি লেক

নীলাদ্রি লেক  

নরকের রাত পার করেছি। বিছানায় শুয়ে শুয়েই দেখছি একটা মেয়ে বাইরে নাচছে। সামনেই পাহাড়, পাহাড়ের নিচেই সুন্দর ছোট্ট ছোট্ট টিলা। 

সেই টিলার উপরে মেয়েটা শাড়ি পরে নাচছে, একটা ছেলে ভিডিও করছে। টিকটকারে দেশ ছেঁয়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে এরাও টিকটকার।

মেয়েটার ডেডিকেশন নিয়ে চিন্তা করছি। সূর্য এখনো ওঠেনি। নাচার জন্য তার সাঁজতে হয়েছে, শাড়ি পড়তে হয়েছে। তাহলে সে ঘুম থেকে উঠেছে কখন? 

টিলার পরেই একটা লেক আছে, নাম ‘নীলাদ্রি লেক’। এটা এখানে? আমাদের কারো জানা ছিল না। ট্যুর প্লানে ভালো করে খোঁজ নেয়া হয়নি সবকিছু। ব্রাশ নিয়ে হাটাহাটি করতে এসে দেখলাম।

এখানে লাকমা ছড়া নামক যে একটা জায়গা আছে, সেটা জেনেছি ট্যুর থেকে ফেরার পর। এখানে মানুষ মূলত আসে লাকমা ছড়া দেখতেই, আর আমরা তার সম্পর্কে কেউ জানতামই না।  

স্থানীয় এক মহিলা জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আশেপাশে দেখার মত আর কি আছে?” তিনিও লাকমা ছড়ার কথা কিছু বলেননি।

বলেছেন শুধু, “এইদিকে একটা বাজার আছে।”

জিজ্ঞেস করলাম, “কত দূর? হেটে যেতে কতক্ষণ লাগবে?”

উত্তর দিলেন, “দশ-পনেরো মিনিট লাগবে। তবে রাস্তায় অটো পাবেন, অটোতে যেতে পারবেন।”

কিছু লোক ভারতের পাহাড় কাটছিল। এখানে বর্ডারে কাটাতার নেই। এটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা, এরা কি বাংলাদেশি?”

মহিলা বললেন, “হ্যাঁ।”

জিজ্ঞেস করলাম, “বিএসএফ কিছু বলে না?”

মহিলা বললেন, “দেখলে তো বলেই। দুই মাস আগে একজন ধরে নিয়ে বাজার থেকে।”

জিজ্ঞেস করলাম, “ধরে নিয়ে কি করছে?”

মহিলা উত্তর দিলেন, “মেরে ফেলছে।”

মনটা খারাপ হয়ে গেলো। জীবন বাঁচানোর তাগিদে পাথর আনতে গিয়ে জীবনটাই খুইয়ে আসে। বর্ডার কিলিং এ বিএসএফ গোল্ড মেডেল পাওয়ার চান্স আছে। বিজিবি কি করে কে জানে!

বাজারে এসে লস হয়েছে। গতরাতে নৌকাঘাট থেকে আমরা ভারতীয় সাবান, শ্যাম্পু কিনেছিলাম। দাম কম মনে হয়েছিল, তাই অনেক করে কিনেছি।

বাজারে এসে দেখি এখানে দাম আরও কম। ২০ টাকার সাবান এখানে ১৫ টাকা। মনটা খারাপ হয়ে গেল। এখানে না আসলে জানতামও না, মন খারাপও হতো না। 

সজল পুরো হতাশ। ও ব্যাগ ভর্তি করে জিনিসপত্র কিনেছিল। যা যা কিনেছিল আবার কিনছে। বাজারে আসায় এই বাড়তি টাকাটা খরচ হলো। পুরাই লস।

বাজার থেকে ফিরতে ফিরতে রোদ চড়ে গেছে। গরম সহ্যের বাইরে চলে গেছে। নৌকায় ঢুকে ফ্যানের বাতাসেও দরদর করে ঘামছি। বাইরে গরম দেখে রায়হান আর ঘুরতে বের হয়নি। ঘুমাচ্ছে আর ঘামছে।

অথচ পাশের নৌকায় পাথর খনির শ্রমিকেরা কাজ করছে, আর গান গাচ্ছে। এত গরমে গান আসে কোথা থেকে? এরা কি স্বাভাবিক মানুষ?

আবার মনে পড়লো এরা হাসন রাজা, শাহ আব্দুল করিমের অঞ্চলের লোক। গানই এদের জীবন, জীবনই এদের গান।

করচ গাছের সারি 

ট্রলার ছাড়তেই বাতাস গায়ে লাগতে শুরু করলো। একটা রৌদ্রোজ্জ্বল শান্ত নির্মল দিন। মনে হচ্ছে সমস্ত প্রকৃতিটা থেমে আছে, শুধু ট্রলারটা চলছে।

এখন যাচ্ছি টাঙ্গুয়ার হাওরের ওয়াচ-টাওয়ারে।  উত্তরে পাহাড়, এরপরই হাওর। পাহাড় বাদে যা দেখা যাচ্ছে তার প্রায় সবটাই পানি। মাঝে মাঝে দুই একটা ঘর। ট্যুরের সবচেয়ে সুন্দর অংশ ছিল টেকেরঘাট থেকে ওয়াচ-টাওয়ারের পথটুকু।

এখানকার পানিতে একধরনের গাছ জন্মে নাম করচ গাছ। এরা গলা পানিতেও বেঁচে থাকতে পারে। জায়গায় জায়গায় সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। টাঙ্গুয়ার হাওরের এত সৌন্দর্য এই গাছের জন্যই। 

একটা বাংলা বিখ্যাত গান আছে, “এই পথ যদি শেষ না হয়, তবে কেমন হতো তুমি  বলতো?” পথ শেষ না হওয়ার জন্য এইভাবে কখনো দোয়া করেছি বলে মনে পড়ে না। তবে আজকে আসলেই মনে হচ্ছে, এই পথ যেন শেষ না হয়।

দোয়া কবুল হয়নি, পথ শেষ হয়ে গেছে। ওয়াচ-টাওয়ার চলে এসেছি। এসেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো।

এদেশের মানুষ এত অশিক্ষিত কেন? না, অশিক্ষিত না, হবে নির্বোধ। কতটা নির্বোধ হলে পর্যটন কেন্দ্রের গাছগুলো নির্বাচনের পোস্টারে ছেয়ে ফেলতে পারে?

রাজনীতিবিদরা এত নির্বোধ কেন? ওয়াচ-টাওয়ারও ঢেকে ফেলেছে। এদেশীয় রাজনীতিবিদরা মনে হচ্ছে একটু বেশিই নির্বোধ।

ওয়াচ-টাওয়ারে ছেলে-মেয়েদের ছোট ছোট কয়েকটা দল দেখলাম। এদের কাজ গান শুনানো, বিনিময়ে টাকা নেয়া। আমাদের দেখেই কতগুলো মেয়ে ছুটে আসলো, “গান শুনবেন?”

বললাম, “মাইকে তো ফ্রি ফ্রি গান শোনাই যাচ্ছে!” 

মেয়েগুলো মুখ ভেংচি দিয়ে চলে গেলো। নতুন পর্যটক দল এসেছে। তারা গান শুনতে রাজী হলো। ভালোই গাইছে। একসাথে গলা মিলিয়ে শুরু করলো- 

“ওই লাল টুক টুক শাড়ি পড়া মাইয়া–”

এদিকে আসার পর থেকেই ওটা মাইকে বেজেই চলেছে, “আমার মন বসে না শহরে, ইট পাথরের নগরে। তাই তো আইলাম সাগরে, তাইতো আইলাম সাগরে।”  

দুপুর হয়ে গেছে। আজ শুক্রবার। গোসল করে জুমার নামাজ পড়তে যেতে হবে। ঘোলা পানি এড়াতে যেখানে ভীড় নেই সেখানে নৌকা ভেড়ালাম।

এখানে এসে একা একা লাগছে। মানুষের হাসাহাসি, কথা-বার্তার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না। হৈ-হুল্লোড় দেখতেও মজা লাগে।

তাছাড়া ভীড়ের ঐখানে অনেক সুন্দর সুন্দর মেয়েও ছিল। সুন্দরীদের আশেপাশে থাকতে ভালো লাগে। তাই আবার ভীড়ের মধ্যে ফিরে আসলাম। বউয়ের চেয়ে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে ঘোরা কেন বেশি মজার এবার নিশ্চয়ই বুঝা যাচ্ছে।

পানিতে নামতেই চুলকানো শুরু করেছে। কিন্তু পানি দেখতে তো পরিস্কার। কয়েক মাস ধরে এই বদ্ধ পানিতে ঘাস লতাপাতা পচে পানি কুটকুটে হয়ে গেছে।

নৌকা থেকে পানি উঠা নামা বেশ কঠিন। গাছ বেয়ে উঠতে নামতে হয়। নৌকার মাঝি বললেন, “গাছে কিন্তু বিছা আছে। সাবধানে উঠা নামা কইরেন।”

দেখলাম গাছে শুধু বিছা না, জমিতে যত রকমের পোকামাকড় থাকে তার প্রায় সবই আছে। বর্ষার পানিতে এই গাছই তাদের একমাত্র আশ্রয় স্থল।

হাওরের জীব-বৈচিত্র রক্ষায় এই গাছ তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু নির্বোধের দল দেখলাম গাছ কেটে অর্ধেক করে ফেলেছে।

গোসল শেষ করে নামাজ পড়তে গেলাম। ছোট একটা মসজিদ। দাঁড়ানোর জায়গা নেই। বাইরেও লোক ধরবে না। শুকনো জায়গার সংকট।

আমরা নৌকার উপরেই নামাজ পড়তে দাঁড়ালাম। বাতাসে নৌকা পশ্চিম দিকে নিয়ে গেছে, ইমাম আমাদের পিছনে পড়ে গেছে। এই প্রথম ইমামেরও সামনে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়লাম।

বিদায় পর্ব

নামাজ শেষে আমরা তাহেরপুর রওনা দিলাম। ট্রলারের সাথে চুক্তি শেষ। এখন ফেরার পালা। আমাদের ট্রেনের টিকেট কেটেছি মোহনগঞ্জ, নেত্রকোনা থেকে। মনে মনে ভেবেছিলাম ট্যুরের মজা এখানেই শেষ। না, আরও বাকি ছিল।

এক বুড়ো চাচার ছোট নৌকা ভাড়া করেছিল দুই হাজার টাকা দিয়ে। কোন মতে আটজন বসা যায় এত ছোট।

ঘন্টা দুইয়ের পথ। কিছুদূর যাবার পরেই চাচা দেখলো একটা বড় খালি ট্রলার নেত্রকোনা যাচ্ছে। চাচা আমাদেরকে বড় নৌকায় তুলে দিল। আর তাদেরকে পাঁচশ টাকা দিয়ে দিলো। চাচার থাকলো পনেরশ। 

ব্যাপারটা খেয়াল করে দেখলাম এতে আমাদের তিন পক্ষেরই লাভ হয়েছে। অনেক win-win সিচুয়েশন দেখেছি। কিন্তু win-win-win সিচুয়েশন আগে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

চাচার লাভ হলো তার আসা যাওয়ার তেল খরচ আর সময় বেঁচে গেছে। আর বড় নৌকা তো খালিই যাচ্ছিল, তার পাঁচশ টাকা ইনকাম হলো। আর আমরা পেলাম আরাম আয়েশ।

এখানে নীল  রঙের পানি, খুবই শান্ত। হালকা বাতাসে ছোট ছোট ঢেউ। কয়েক মাইলের মধ্যেও বাড়িঘর নেই। বিকেলের সূর্য ভারতের পাহাড়ের পিছনে লুকাচ্ছে। লাল আভায় আকাশ ছেয়ে গেছে। ছবি তোলার উপযুক্ত পরিবেশ।

সন্ধ্যা নেমে আসছে। গতকাল থেকেই একটা ব্যাপার লক্ষ্য করছি, সন্ধ্যার পর দক্ষিণ দিকে বিদ্যুৎ চমকায়। প্রথমে ভেবেছিলাম মেঘ করেছে, পরে লক্ষ্য করলাম আকাশে মেঘের চিহ্ন নেই। প্রকৃতির কিছু অদ্ভুত ব্যাপার থাকে।

নেত্রকোনা দিয়ে ফিরে ভালো করেছি। রাস্তাটা খোলামেলা, গাছপালা কম। হাওরের মাঝ দিয়ে চলে গেছে। মনের মত রাস্তা।

ট্রেন স্টেশনে একটা কাজ বাকি। বউয়ের ভয়ে যে বন্ধু আসে নাই তার একটা টিকিট রয়ে গেছে। টিকিট বিক্রি করতে হবে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর একজনকে পাওয়া গেলো। আড়াইশ টাকার টিকিট তিনশো টাকা বিক্রি করলো এক বন্ধু। 

কিন্তু ব্যাপারটা আমাদের বাকিদের কাছে ভাল লাগেনি। দারদা ভাই আপত্তিটা উত্থাপন করলো, “বেশি টাকা নেয়া ঠিক হয়নি। আমাদের সবার কাছেই টাকা আছে। ঘুরতে এসে এত টাকা খরচ করতে পারলাম আর পঞ্চাশ টাকার লোভ ছাড়তে পারলাম না?”

পরে ট্রেন বিরতি দিলে দারদা ভাই আর আইয়ুব তাকে কিছু শুকনো খাবার কিনে দিল। তাতে পঞ্চাশ টাকার বেশি খরচ করে ফেললো।

আমার কাছে মনে হলো এটাই ট্যুরের সুন্দরতম ঘটনা। শিক্ষিত ছেলেদের নৈতিকতা থাকা দরকার। সেটা তাদের আছে।

পুরো ট্যুরের গল্পে যাকে নিয়ে একটিও কথা বলনি তিনি হলেন তাইফুল ভাই। না বলার কারণ হচ্ছে তাইফুল খুবই চুপচাপ মানুষ, তাই তাকে নিয়ে বলার মত কোনো ঘটনা মনে করা কঠিন। এতই চুপচাপ যে তিনি যদি ট্রলার থেকেও পড়েও যেতেন ট্রেনে ওঠার আগ পর্যন্ত টের পেতাম না।

শুধু একটা সময় তার কথা মনে পড়তো, সেটা হলো কার্ড (তাস) খেলার সময়। সহজ সরল মানুষটা কার্ড খেলার সময় খুবই জটিল, খেলেন খুবই ভালো।

প্লান ছিল ফেরার সময় ট্রেনে তাইফুল ভাইকে নিয়ে কার্ড খেলব। কিন্তু রায়হানের জন্য সে ইচ্ছা পূরণ হলো না। সে গিয়ে সিট দখল করে বসে আছে।

মেজাজ খারাপ করে খেলা বাদ দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। ঘুমাতেও পারছি না। ট্রেনে সারা রাত বাতি জ্বলে। মাঝে মাঝে স্টেশনে থামে। লোকজন ওঠা নামা করে। আরও একটি নির্ঘুম রাত।

অবশ্য এই রকম একটি ট্যুরের জন্য দুই এক রাত নির্ঘুম কোন ব্যাপার না। এখন আর সেই ক্লান্তি নেই, কিন্তু হাওরের স্মৃতিগুলো সব তাজা। মনে হচ্ছে এই মাত্র সেই চাঁদের আলোতে হাঁস দিয়ে ভাত খেয়ে উঠলাম। সুযোগ পেলে আরও একবার ঘুরতে যেতে চাই।

“Travel makes the world new.”

রোল- শহ-৩৪
সেশন-২০১৪-১৫
ড। মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হল

মো: আজমির হোসেন

রোল- শহ-৩৪ সেশন-২০১৪-১৫ ড। মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হল