অসম্ভব মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে আছি তার দিকে।সে নেই একবারও বিশ্বাস হচ্ছে না।তার বড় করে টাঙিয়ে রাখা ছবির দিকে তাকিয়ে বারবার মনে হচ্ছে, এই হাসিটুকু সত্যিই নেই! কি অদ্ভূত হাসিমাখা মুখে তার প্রিয় পুরস্কার বই হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে মেয়েটা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হিসেবে তার মৃত্যুতে সবাই শোকাহত, স্তব্ধ। আমার অনুভূতি একটু বেশিই, কারন হিসেবে সবাই জানে আমরা একই জেলার, একই কলেজের। তবে সেই কলেজ জীবনে কতটা উজ্জ্বল মুখ সে ছিলো তা হয়তো এই কয়মাসের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন খোঁজ পায় নি!
নতুন কলেজ, নতুন পরিবেশ, নতুন সব মুখ। কলেজের প্রথম ক্লাসেই সে তার আত্নপ্রকাশ করেছিলো। সপ্তাহ শেষ হওয়ার আগেই একেবারে সাধারন ভঙ্গিতে এক গল্প বলে সে সকলের কাছে পরিচিত হয়ে উঠলো। ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছাত্রী সে ছিলো না।কিন্তু তার চমকপ্রদ উত্তর আর সুচতুর প্রশ্নের কারনে সে সকলের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছিলো। ক্লাসের ফাঁকে কখনোবা ক্লাসের মাঝে তার হাতে গল্পের বই অনেকেরই নজর কাড়তো। সবাইকে “তুমি” সম্বোধন করে একটুকরো হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করতো “ভালো আছো?”, এমনিতে খুব ভালো ছাত্রী না হলেও কারো কোনো পড়ায় সমস্যা হলে চমৎকার করে বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টায় কমতি ছিলো না। অনেকবার শুধুমাত্র তার অদ্ভূত ভঙ্গির কথা শোনার জন্যে পড়া বুঝতে গিয়েছি, সেও হাসিমুখে বুঝিয়ে দিয়েছে। কলেজ লাইব্রেরি তার খুব প্রিয় ছিলো, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে আমিও যেতাম। একদিন তার প্রিয় বইয়ের পর্যালোচনা শুনেছিলাম তার মুখে, মনে হয়েছিলো চমৎকার তার প্রকাশ ভঙ্গি। প্রথমে ভাবতাম শুধুমাত্র আমারই এই সাধারন মেয়েটার প্রতি মুগ্ধতা কাজ করে কিন্তু ক্রমেই দেখলাম এই মুগ্ধতা প্রায় সকলকেই ছুঁয়ে গেছে। সে তার আশেপাশের প্রত্যেকটা মানুষের সাথে মিশেছে সহজভাবে, কোনো সংকোচ ছিলো না তার মধ্যে। তার একটা আকুল শক্তি ছিল যার কারনে তার আন্তরিকতাকে কেউ ফেলে দিতে পারতো না।
মেয়েটার নৈতিকবোধ ছিলো খুব শক্ত, সক্রিয়।তার আরো একটা গুনের পরিচয় বের হলো, একাদশ শ্রেনির নতুন ডিবেট টিম হবে।তার পূর্বপরিচিত কেউ একজন ক্ষীনস্বরে তার নামটা উচ্চারন করলো। সে খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উঠে দাড়িয়ে স্যারের নির্ধারিত বিষয়ে কথা বলা শুরু করলো। সে দুই মিনিট পরে শেষ করলো, ক্লাসের সবাই অজান্তেও হলেও মুগ্ধ হয়েছিলো সেদিন। তারপরে তার নেতৃত্বেই দাঁড়িয়েছিল আমাদের ডিবেট টিম। সে বলতো, “তোমরা আমার চেয়ে অনেক ভালো বলতে পারো, শুধু একবার শুরু করই দেখো!” সে কতটুকু ভালো বক্তা ছিল তার বিচার করার সাধ্যও নেই, ইচ্ছাও নেই। তবে সে খুব ভালোবেসে কথা বলতো। কলেজের যেকোনো সভা,সেমিনারে তার খুব শান্ত কিন্তু সরব উপস্থিতি ছিল। এমনিতে খুব শান্ত মেয়ে হলেও যতবার দেখেছি সে কোথাও কথা বলার জন্যে দাড়িয়েছে, তার মুখ আনন্দ আর তৃপ্তিতে পরিপূর্ণ। কলেজের বিশাল মাঠের একপ্রান্তে জনাকয়েক পথশিশুর সাথে কয়েকবার দেখেছি তাকে, খুব উৎসাহ নিয়ে কথা বলছে তারা, যদিও কি নিয়ে সেটা জানার উপায় ছিলো না।আমরা কেউ সামনে গেলেই তাদের উচ্ছল আলোচনা চুপ হয়ে যেতো। রঙিন সিনেমার নায়ক, রঙিন সাজ-পোশাক বা প্রেম নিয়ে মুখরোচক আড্ডায় তার উপস্থিতি ছিলো নগন্য। সে তার পছন্দের বিষয়ের আড্ডায় ছিলো প্রানবন্ত। প্রথমত কোনো বই, হয়তো সে বইটা পড়েছে, নয়তো লেখকের অন্য বই তার পড়া, সাথে সাথে জুড়ে দিতো রাজ্যের গল্প। বইটা পড়া না হলে ধার চাইতে কুন্ঠিত হতো না সামান্যতম। খেলাধুলা নিয়ে তার বিশেষ আকর্ষন ছিলো, বিশেষত ক্রিকেট নিয়ে তার প্রানবন্ত আর চমৎকার সমালোচনা শোনার শখে বহুবার তাকে এই বিষয়ে উসকে দিতাম আমিও ।তর্ক শুরু করতাম তার সাথে, সে হয়তো জিতে যাওয়ার চেষ্টায় কথা বলে গেছে অনবরত। আর তার সেই সুচতুর যুক্তি শোনার জন্যেই হয়তো তর্কটা এগিয়ে নিয়েছি আমি।
কলেজ শিক্ষা সফরে যাবে, আয়োজনের সময় হাতে খুব কম। মাত্র দুই দিন। এই দুইদিনের মধ্যেই তার সেকি উৎকণ্ঠা নিয়ে কাজ করে যাওয়া। প্রতিযোগিতা মূলক পরিক্ষায়ও তার ফলাফল প্রথম সারিতেই থাকতো। ক্লাসের বাইরে কলেজেও তার পরিচিতি বাড়ছিলো। কলেজের বার্ষিক সাহিত্য সাংস্কৃতিক প্রতিযোগীতায় তার স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি, উপস্থিত বক্তৃতায় স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থাপনা, বিজ্ঞাপনে মার্জিত বিষয়ের সাবলীলতায় সকলকে হাসানো, বিশাল দল নিয়ে অভিনয় করে সমসাময়িক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মেসেজ দিয়ে সকলের চোখে আইকন হয়ে ওঠা! যেকোনো ধরনের ক্লাব, অনুষ্ঠানে কলেজের হয়ে তার উপস্থিতি থাকতোই!
আমরা সহপাঠীরা নই শুধু শিক্ষকদের ভালোবাসায়ও সিক্ত ছিল সে।২১ শে ফেব্রুয়ারিতে মাতৃভাষায় কথা বলে চমৎকৃত করছিলো সকলকে, পেয়েছিলো সব্যসাচী খেতাব। সব্যসাচী খেতাব আর বই পাওয়ার আনন্দে উজ্জ্বল ছবিটাকেই তার শোকবার্তার বিশাল ব্যানারে ব্যবহার করা হয়েছে।সে নেই, চলে গেছে।সকলের মুগ্ধতার জন্ম দেয়া মানুষটা তার স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলো, কিন্তু সে আর আসবে না।তার এই ছোট্ট জীবনে তার সংস্পর্শে থাকা আমার মতো বহু মানুষকে মুগ্ধ করেছে বলে আমার বিশ্বাস।একজন শুদ্ধতম আবেগী মানুষের প্রতি আমার মুগ্ধতাটাও বেঁচে থাকুক যুগান্তরে!
বিদায় বন্ধু
- ইকরা মুন নেছাhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%87%e0%a6%95%e0%a6%b0%e0%a6%be-%e0%a6%ae%e0%a7%81%e0%a6%a8-%e0%a6%a8%e0%a7%87%e0%a6%9b%e0%a6%be/মঙ্গলবার, এপ্রিল ১৮, ২০২৩
- ইকরা মুন নেছাhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%87%e0%a6%95%e0%a6%b0%e0%a6%be-%e0%a6%ae%e0%a7%81%e0%a6%a8-%e0%a6%a8%e0%a7%87%e0%a6%9b%e0%a6%be/বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ৯, ২০২৩
- ইকরা মুন নেছাhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%87%e0%a6%95%e0%a6%b0%e0%a6%be-%e0%a6%ae%e0%a7%81%e0%a6%a8-%e0%a6%a8%e0%a7%87%e0%a6%9b%e0%a6%be/বৃহস্পতিবার, জানুয়ারি ১১, ২০২৪
- ইকরা মুন নেছাhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%87%e0%a6%95%e0%a6%b0%e0%a6%be-%e0%a6%ae%e0%a7%81%e0%a6%a8-%e0%a6%a8%e0%a7%87%e0%a6%9b%e0%a6%be/বৃহস্পতিবার, জুলাই ১১, ২০২৪
- ইকরা মুন নেছাhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%87%e0%a6%95%e0%a6%b0%e0%a6%be-%e0%a6%ae%e0%a7%81%e0%a6%a8-%e0%a6%a8%e0%a7%87%e0%a6%9b%e0%a6%be/সোমবার, আগস্ট ১২, ২০২৪