fbpx

আদ্রিকা

শুক্রবার দিনটা খুবই পছন্দ অনিমেষের। কারণটা আর সবার মতোই— ছুটির দিন, বৃহস্পতিবার রাতে এলার্ম না দিয়েই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়া যায়; সারাদিন নিজের মতো করে কাটানো যায়।  এইতো গত শুক্রবারেও সে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিল- ‘ঢাকার বুকে শুক্রবার আসুক নেমে।’

বছর চারেক হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে বেসরকারি একটা চাকুরিতে ঢুকেছে অনিমেষ। লম্বা সময় ধরে সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নেওয়ার ধৈর্য্য আর সুযোগ কোনোটাই ছিল না ওর। ভাণ্ডারিয়ার মতো এক মফস্বল শহরে মুদি দোকানের কামাইয়ে ছেলেকে এতদূর নিয়ে আসা তার বাবা স্নাতকের ফলটুকুও শুনে যেতে পারেননি। গ্রীষ্মের এক তপ্ত দুপুরে দোকান থেকে এসে স্ত্রীকে জানালেন, বুকে সামান্য ব্যথা। বমি করলেন একবার। মাথায় জল ঢালতে শুরু করলেন বোন; এক গাড়ু জল শেষ হবার আগেই অসীমে পাড়ি জমালেন। অনিমেষের কাছে যখন ফোন এলো তখন সে টিউশনিতে। মিনিট দুই স্তব্ধ হয়ে বসে থেকে, ছাত্রীকে, ”আমি কয়েকদিন আসতে পারব না”, এই বলে দ্রুত পা ফেলে বেড়িয়ে এসেছিল সে সেদিন, চোখের জলটুকু লুকোবার জন্য। সেদিন থেকে সে সহ এই পৃথিবীর আরও দুইটি প্রাণীর সকল দায়িত্ব এসে পড়েছিল সদ্য স্নাতক হওয়া এই যুবকের অপরিপক্ব কাঁধে।

ক্যাম্পাসের আশেপাশে থাকবে বলেই বাসা নিয়েছে আজিমপুরে, যদিও ওর অফিস মালিবাগে। অবশ্য অফিসের গাড়িতেই যাতায়াত করতে পারে বলে রক্ষে। নইলে আর এখানে থাকাটা হতো না নিশ্চিত। কেননা, ওর সব থেকে অপ্রিয় কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো এই ঢাকায় লোকাল বাসে যাতায়াত করা। চাকুরি পাওয়ার পর অনিমেষের বিয়ের আগের শুক্রবারগুলোর অর্ধেক দিন কাটতো ঘুমিয়ে আর বাকি দিন বাজার করে, হলের বন্ধুদের সাথে এবং ডিপার্টমেন্টের বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে। বিয়ের পরে শুক্রবারগুলোতে ঈশিতাকে নিয়ে বের হয়; ঘুরে আসে বাসার আশপাশ থেকেই। চায়না বিল্ডিং এর গলি দিয়ে বের হয়ে পলাশী দিয়ে ফুলার রোড। কিছুক্ষণ বসে ব্রিটিশ কাউন্সিলের ওপাশটায়। বই কেনার থাকলে হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় নীলক্ষেত। দূরেও যে যায় না তা কিন্তু নয়। সপ্তাহ তিনেক আগে গেছিল মাওয়া, পদ্মার ইলিশ খাবে বলে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহকারী অধ্যাপক বন্ধুর নিমন্ত্রণে ময়মনসিংহ থেকে ঘুরে এসেছে মাস দেড়েক আগে। তাছাড়া মাস তিনেক পরপর তো বাড়ি যাওয়া পড়েই। মা আর পিসিকে ঢাকায় এনে নিজের কাছে রাখার চেষ্টা যে অনিমেষ করেনি তা নয়। তাদের যেন ঠিক পোষায় না এই এতো বড় শহরে। মন খুলে দুটো কথা বলার জো নেই যে কারো সাথে!

প্রত্যেক শুক্রবারই যে তার বের হতে মন চায় তা কিন্তু নয়। বরং বেশিরভাগ দিনই মনে হয় সারাদিন ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিই। কিন্তু বের হতে হয় ঈশিতার জন্য। মেয়েটা ঢাকায় এসেছে ওর হাত ধরেই বছর দুই হলো। বাজার সদাই করা ছাড়া তেমন একটা বাইরে বের হয় না ও,  সেটা জানে অনিমেষ। ঈশিতা যে ওকে নিয়ে বের হতে বলে তাও না। এই গত দুই বছরে যতই ঈশিতাকে দেখছে অনিমেষ ততই অবাক হচ্ছে। কী সুন্দর সংসারটাকে গুছিয়ে তুলেছে সে। কী সুন্দর খাপ খাইয়ে নিয়েছে নিজেকে এই জাদুর শহরে। অথচ সে কী ভয়েই না ছিল এই মেয়েটাকে নিয়ে। গ্রামের আলো বাতাসে বিশ বছর কাটানো একটা মানুষকে হঠাৎ এত বড় একটা শহরে এনে বিপদে পড়ার ভয়৷ বন্ধুদের সাথে, তাদের শহুরে বউদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে কিনা সেই ভয়। কিন্তু সকল শঙ্কাকে ভুল প্রমাণিত করে অনিমেষসহ বাকি সকলকে অবাক করেছে সে। ঈশিতাকে বিয়ে করাতে ঈশিতাও একেবারে কম অবাক হয়নি। পরপর দুই মেয়েকে উচ্চ যৌতুকে বিয়ে দিয়ে ঈশিতার বাবা যেন হঠাৎ করেই অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। মেয়েদের উচ্চশিক্ষা দেয়াটায় এই শেষ বয়সে এসে যেন তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। উচ্চশিক্ষিত মেয়ের জন্য চাই উচ্চশিক্ষিত বর। আর তার জন্য চাই মোটা অঙ্কের যৌতুক। প্রথম দুই মেয়েকে তাও কষ্ট করে সরকারি চাকুরের হাতে তুলে দিয়েছেন। বড় মেয়েকে এক প্রাইমারি স্কুল শিক্ষকের হাতে আর মেজটাকে বিজিবির। সম্বল যা ছিল সব তলানিতে। ছোট মেয়ের জন্য পড়েছিলেন অথৈ জলে। এমন অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, বিনে যৌতুকে যদি কোনো আধপাগল ছেলেও ঈশিতাকে বিয়ে করতে চাইতেন, তিনি তার হাতেই তুলে দিতেন ঈশিতাকে। ঠিক সেই সময়ে অনিমেষ এগিয়ে গেল। ঢাকা শহরে মোটা অঙ্কের বেতন পাওয়া চাকুরে একটি ছেলের পক্ষে তাই ঈশিতাকে কাছে পাওয়া খুব একটা কঠিন হয়ে পড়েনি। বরং ঈশিতার পরিবারেরই বেশ বড়সড় এক উপকার হয়ে গিয়েছিল!

কোনো দয়া বা উপকার করবার জন্য ঈশিতাকে যে অনিমেষ বিয়ে করছে না, তা সে বিয়ের আগেই বেশ লম্বা সময় ধরে ঈশিতাকে বুঝিয়েছে; ঈশিতা বুঝেছেও। ঈশিতাকে অনিমেষ দেখেছিল অনার্স শেষ বর্ষে, তার মাসতুতো দিদির মেয়ের অন্নপ্রাশনে। অনিমেষ ভাগ্নির মুখে পায়েস তুলে দিচ্ছে পাঁচ টাকার একটা কয়েন দিয়ে আর মেয়েটা সামনে দাঁড়িয়ে; স্মিতহাস্য। অনিমেষের কী যে ভালো লেগেছিল! সেদিনই সে ঠিক করেছিল- যদি সম্ভব হয় এই মেয়েটাকেই তার জীবনসঙ্গী করবে। মনে মনে সেদিন নিজের সাথে অনেক কথা বলেছিল অনিমেষ। এই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নিশ্চয় এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা যায় না। বয়সের দোষ ভেবে তাই সেই ভাবনাটাকে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল সে। কিন্তু পারেনি। তার প্রমাণ এই বিয়েটাই। অন্নপ্রাশনের কয়েক মাসের মাথায় বাবা মারা গেলেন। বিয়ের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে হঠাৎ করে এলোমেলো হয়ে যাওয়া জীবনটাকে গোছাতে শুরু করেছিল সে। বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। বছর দুয়েকের মধ্যেই নিজেকে একটা পাকাপোক্ত অবস্থানে নিয়ে যেতে পেরেছিল সে। তারপর মা আর পিসি যখন বিয়ের কথা পাড়লেন, প্রথমেই ঈশিতার সে দু’বছর আগের দেখা মুখখানা ভেসে উঠেছিল ওর মনের দর্পনে!

ঠিক যেমনটি চেয়েছিল সেরকম ভাবেই চলছে অনিমেষের জীবন; শুধুমাত্র বাবা মারা যাওয়ার ঘটনাটিকে বাদ দিয়ে। কিছু জিনিস চাওয়ার চাইতেও বেশি পেয়েছে সে। যেমনটি এই ঈশিতাকে নিজের করে পাওয়া। মনে মনে বই পড়ুয়া এক সহধর্মিণী চেয়েছিল সে। ঈশিতা যে এত সাহিত্য ভালোবাসে তা সে পূর্বে কল্পনাও করেনি। বই পড়ার সাথে অবশ্য ঈশিতাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে সেই-ই। গ্রামে তো আর ভালো লাইব্রেরি নেই। কিনে কিনে পড়বে সে সুযোগও হয়নি কখনও। প্রথম দিন নীলক্ষেতে গিয়ে সে কতটা অবাক হয়ে গেছিল তা বলে বোঝানোর মতো নয়। এ যেন এক আস্ত বইয়ের সমুদ্র। অনিমেষের উদ্বেগ ছিল যে এই যান্ত্রিক শহরে মেয়েটার সময় কাটবে কী করে এই নিয়ে। সেই সকালে অফিস যায় ও, আসে সন্ধ্যায়। তাই ভেবেছিল বই পড়ে যদি ভালো করে সময়টা কাটাতে পারে। অনিমেষ যতটা ধারণা করেছিল তার চেয়েও কয়েকগুণ উৎসাহ নিয়ে ঈশিতা বই পড়তে শুরু করল। বইকে ও কতটা আপন করে নিয়েছে এই দুই বছরে তা বোঝা যায় যখন ওর সাথে বই নিয়ে কোনো আলোচনা করে অনিমেষ। চোখজোড়া কেমন জ্বলজ্বল করতে থাকে নতুন কিছু এক আবিষ্কারের আনন্দে। কী যে ভালো লাগে তখন অনিমেষের!

বাবা মারা যাওয়ায় বেশ বড়সড় একটা ধাক্কা খেয়েছিল অনিমেষ। হঠাৎ কী এক শূন্যতা এসে জেঁকে বসেছিল ওর চারপাশে। বাবাকে কি খুব ভালোবাসত ও? নাকি শুধু নির্ভর করত? দিনে দু-তিনবার করে কল করত মানুষটা। খুব বিরক্ত হতো অনিমেষ। কিন্তু সেটি প্রকাশ করত না। পাছে আবার মন খারাপ করে সে ভয়ে। মশারি টাঙানো অনিমেষের আরেকটা বিরক্তিকর কাজের মধ্যে অন্যতম। বাড়িতে থাকলে রাতে শোবার আগে মশারিটা বাবাই টাঙিয়ে দিয়ে সুন্দর করে চাদরের নিচে দিয়ে আসতেন প্রতিদিন। সেই সাথে আবার কয়েলও জ্বালিয়ে দিতেন। অনিমেষ বিরক্ত হতো। মশারি টাঙালে আবার কয়েল জ্বালানোর কী দরকার?

মশারি টাঙ্গানোর পরেও কয়েল জ্বালানোর কী দরকার তা অনিমেষ মাসখানেক হলো টের পাচ্ছে। আদ্রিকা ওদের পরিবারে আসার পর হিসেবনিকেশ অনেকটাই পাল্টে গেছে। যেদিন ওরা নিশ্চিত হলো আরও একটা প্রাণের সংখ্যা ইতোমধ্যে বেড়ে গেছে তাদের পরিবারে, সেদিন কেমন যেন এক আনন্দ আর ভয়ের দুইটি স্রোত পাশাপাশি বয়ে গেল দুজনের শিরদাঁড়া বেয়ে। মা আর পিসি চলে এলেন ঢাকাতে এ ক’মাসের জন্য। এইবারও অনিমেষের মনের ইচ্ছাই পূরণ করলেন সর্বশক্তিমান। যতটা ভয়ে তারা পেয়েছিল ঠিক ততটাই নির্বিঘ্নে কেটে গেল ন’টা মাস। আদ্রিকা ঘরে আসলো। কী এক আনন্দধারা বয়ে যেতে লাগল চায়না বিল্ডিং এর গলির সেই বাসাটায়!

এতদিন ঈশিতা আর অনিমেষ পরস্পরকে দেখে অবাক হচ্ছিল। কারো প্রতি কারো এতটুকু অনুযোগ নেই। দু’জনের মধ্যে কী একটা যেন আন্তঃবোঝাপড়া রয়েছে অনন্তকাল ধরে। কিন্তু এবার দুজনেরই অবাক হওয়ার পালা। যতই দিন যাচ্ছে আদ্রিকা অবাক করে চলেছে তাদের দু’জনকে। এই বয়সের একটা বাচ্চা এতটা শান্ত হয় কী করে! দু’জনে তো এই ভয়টাই পেত সবচেয়ে বেশি। এই এইটুকুনি একটা মেয়েকে ওরা সামলাবে কী করে? কান্না জিনিসটা অনিমেষ আরেকটি অপছন্দের জিনিস। একদিনই সে কেঁদেছিল বুদ্ধি হওয়ার বয়েসে— যেদিন বাবা মারা গেলেন সেদিন। তাও বাড়িতে পৌঁছানোর আগেই। বাবা মারা যাওয়ার খবরটা শুনে টিউশনি থেকে বের হয়ে যাবার সময় চোখে যে জলটুকু এসেছিল তাকে গাল পর্যন্ত আসতে দেয় নি সে৷ বাড়ি পৌঁছানোর পর মাকে সামলিয়েছে, পিসিকে সামলিয়েছে। শুকনো চোখে বাবার মুখাগ্নি করেছে। কিন্তু আদ্রিকা সেই ভয়কে অমূলক প্রমাণিত করে দু’জনের মুখের দিকে চেয়ে হেসেই গেছে। ভাবটা এমন যে, কেমন ভড়কে দিলাম তোমাদেরকে বলো!

বাড়িতে যাওয়া ছাড়া আর বছরখানেক হলো কোথাও যাওয়া হয়নি অনিমেষ এবং ঈশিতার। এমনকি শুক্রবারের সেই বাইরে হওয়াগুলোও বাদ পড়ে গেছিল। মেয়েকে বুকের উপর নিয়ে ঘুমাতে ঘুমাতেই যেন একটা বছর কর্পূরের মতো উবে গেল অনিমেষের। বাবা হওয়ার সে কী আনন্দ! এ তো স্রষ্টারই মহা পরিকল্পনার এক অংশ মাত্র। সন্তান জন্মদানের মধ্যে এই এতোটা আনন্দ নিহিত না থাকলে কি প্রাণিরা বংশবিস্তার করত? পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব কি টিকে থাকত এতটা স্বমহিমায়?

ইদানিং আবার তারা তিনজন মিলে বাইরে বের হওয়া শুরু করেছে প্রায় শুক্রবারে। আদ্রিকা ছোট ছোট পা ফেলে ছোটার চেষ্টা করে। অনিমেষ এবং ঈশিতা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখে। তিনজনের আনন্দের যেন সীমা নেই। আহা, জীবন কত সুন্দর! টুকটাক এটা সেটা বলতেও শিখেছে আদ্রিকা। প্রথম যেদিন ‘বা’ ধ্বনিটা উচ্চারণ করল সে, অনিমেষের মনে হলো এর চেয়ে অধিক সুখ আর কিছুতে পাওয়া সম্ভব নয় এই জড়জগতে! অনিমেষ ভালো করেই জানে আরও বেশ ক’মাস সময় লাগবে মেয়ের মুখে ‘বাবা’ ডাক শুনতে, কিন্তু তাও যেন তর সইছে না ওর। এই প্রথম তার নিজেকে ধৈর্যহারা মনে হচ্ছে। এতো আকুল আকাঙ্খার জাঁতাকলে পূর্বে কখনও পড়েনি সে।

আসছে শনিবার আদ্রিকার জন্মদিন। বাসার পাশেই জাতীয় মন্দির অথচ আদ্রিকাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে মাত্র দু’বার। ঈশিতা অনিমেষকে বলল, “চলো, শুক্রবারে ঢাকেশ্বরী যাই। শনিবার তো তুমি পারবা না?” এই প্রথম মেয়েটা তার কাছে মুখ ফুটে কিছু চেয়েছে। এমন একটা জিনিস চেয়েছে যার জন্য তাকে কোনো অর্থ ব্যয় কর‍তে হবে না, করতে হবে না কোনো শ্রমসাধ্য কাজ। কী আনন্দ! এতটা সুখ কি সে সত্যিই পাওয়ার যোগ্য? নাকি সর্বশক্তিমানের কোনো দুরভিসন্ধি রয়েছে? মনে মনে এই চিন্তা করে হাসে অনিমেষ। অবশ্য এ সপ্তাহে অফিসে যে কাজের চাপ গেছে, সে ভেবেছিল এই শুক্রবারটা সারাদিন ঘুমিয়ে কাটাবে। শনিবারে আধবেলা অফিস করে বাসায় ফিরে জন্মদিন উদযাপন করবে। ঈশিতাকে সে কথা জানালে আরও খুশি হবে নিশ্চয়, কিন্তু অনিমেষ আর তা বলল না। এই প্রথম মেয়েটা মুখ ফুটে কিছু চেয়েছে তার কাছে; এই প্রথম!

বৃহস্পতিবার রাতে মেয়েকে বুকে নিয়ে ঘুমাতে গেল অনিমেষ। ইদানীং বাবা-মেয়ের আবার এক নতুন খেলা শুরু হয়েছে। অনিমেষ অবাক হওয়ার ভান করে আদ্রিকার মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলে– এই পরীর বাচ্চাটা এখানে কোত্থেকে আসলো রে! কোন পরী ভুল করে বাচ্চাটারে এখানে রেখে গেল রে! আদ্রিকা এসব শোনে আর ফিকফিক করে হাসে। কালকের দিনটা পার করলেই মেয়েটা দ্বিতীয় বছরে পা দেবে। ‘বাবা’ ডাক শোনবার দিন এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। এসব ভাবতে ভাবতে বাপ-বেটিতে ঘুমিয়ে পড়ল। অনিমেষের বুকে উপর হয়ে ঘুমিয়ে আছে আদ্রিকা। ঈশিতা বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সে অপ্রাকৃত প্রেমময় দৃশ্যের দিকে। তারপর ফোনে একটা ছবি তুলে রাখল শনিবারে ফেইসবুকে পোস্ট করবে বলে।

হটাৎ রাত আড়াইটার দিকে ঘুম ভেঙ্গে গেল অনিমেষের। বুকে হালকা ব্যথা। এরকমটা তো কখনই হয় না। বরাবরই গভীর ঘুম হয় অনিমেষের। এক ঘুমেই রাত কাবার। ঘুম আসতেও বেশি দেরি হতো না ওর। যখন শুয়ে পড়ত তখনই ঘুমিয়ে পড়ত। হলে রুমমেটরা তাই তাকে ‘ইচ্ছাঘুমের অধিকারী’ বলে ডাকতো। ঈশিতাকে ডেকে তোলে সে। আদ্রিকা কী নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে! ঘুমের মধ্যেও মেয়েটার মুখ হাসিমাখা। এটা আগে কখনও খেয়াল করেনি অনিমেষ। ঈশিতা ভয় পেয়ে যায়। গত ক’বছরে কখনোই তো এমনটা হয়নি। বুকের ভেতরটা কেমন জানি ধড়ফড় করছে অনিমেষের। একবার বমি করার পর শরীরটা কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়ল। পাশের ফ্লাটের ভাইকে ডেকে আনে ঈশিতা। জড়ো হয়ে যায় আরও কয়েকজন। মাথায় জল ঢালে ঈশিতা। একজন গিয়ে রিকশা ডেকে আনে ইডেনের সামনে থেকে। দু’জন ধরে রিকশায় করে অনিমেষের নিথর দেহকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেলে। পিছনে আরেক রিকশায় ঈশিতা আর পাশের ফ্লাটের ভাবী। ডাক্তার দেখে বললেন, “আপনাদের রোগী তো বেঁচে নেই।”

ঈশিতা— শান্তশিষ্ট যে মেয়েটির নিঃশ্বাসের শব্দটুকুও শোনা যেত না অধিকাংশ সময়, সে আজ চিৎকার করে করে ডাকলো- “আমার প্রাণপাখিটা আমাকে ছেড়ে চলে গেল রে।”

আদ্রিকা— গগনচুম্বী সুউচ্চ গিরি শৃঙ্গের ন্যায় বৃহৎ যে নারীর হৃদয়; বড় হতে থাকল পিতৃবর্জিত এক পৃথিবীতে!

Prize Owner Story 2nd
Story2

প্যাপাইরাসের অনলাইন সংস্করণের ৪র্থ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় গল্প লিখাতে দ্বিতীয়
হরিপদ শীল

শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশনঃ ২০১৬-১৭

হরিপদ শীল

সেশনঃ ২০১৬-১৭