০৭-০৭-২০২৩
যান্ত্রিকতার ভিড়ে আবার মানিয়ে চলার যুদ্ধ শুরু হলো। কিন্তু গতকাল ছিল বাকি আট-দশটা দিনের থেকে একটু ভিন্ন। শুরুটা হরহামেশার মতো হলেও, সম্পূর্ণটা এক রকম ছিল না।
প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা চলছে; দীর্ঘ একমাস ধরে চলতে থাকা পরীক্ষা যেন শেষ হওয়ার নামই নিচ্ছে না। লিখিত পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই পেয়ে গেলাম ঈদ-উল-আযহার ছুটি। কিন্তু ঈদের আনন্দের রেশ কাটতে না কাটতেই মনে হলো এখনও যে প্র্যাক্টিক্যাল আর ভাইভা পরীক্ষা বাকি, দিতে তো হবে। তাই আর দেরি না করে যান্ত্রিক ধুলো-বালির শহরে ফেরার প্রস্তুতি নিয়ে ফেললাম।
আগে থেকে ঠিক করে রেখেছিলাম ট্রেনে করে ঢাকায় ফিরবো। তাই সেই ভাবনা মোতাবেক আট দিন আগেই কেটে রেখেছিলাম ট্রেনের টিকেট।গতকাল ছিল ঢাকায় ফেরার দিন।
আগেই বলেছি দিনটা বাকি দিনগুলোর মতো শুরু হলেও ছিল না অন্য দিনের মতো। কারণ নিজের চিরচেনা শহর আর বাবা-মাকে ছেড়ে যেতে হবে, যেটাতে মন কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না। কিন্তু মায়া বাড়িয়ে আর কাজ নাই যেতে তো হবেই। রাত ৯.০৫ এ ট্রেন। মোটামুটি সময় হাতে রেখেই বেরিয়ে পড়লাম স্টেশন এর উদ্দেশ্যে। যথারীতি সেই আগের ঢাকায় ফেরার দিন গুলোর মতোই আম্মু রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো আমাকে বিদায় জানাতে। ঠিক যত দূর পর্যন্ত আমাকে দেখা সম্ভব ঠিক ততক্ষন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখতে থাকলো। হয়তো সেটা ছিলো দুই থেকে চার মিনিট এর মত; এর চেয়ে বেশি সময় পর আমাকে আর দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। যাই হোক আমার বাসা থেকে স্টেশন খুব বেশি দূরে না। কিছুক্ষণের মাঝেই স্টেশনে এসে পৌঁছালাম। আব্বুও আমার সাথেই এসেছে; আমাকে ট্রেনে ঠিক মতো তুলে দেয়ার জন্য ।
যদিও এ আমার প্রথম ট্রেন যাত্রা ছিল না কিন্তু ঈদ ছুটি শেষে এত ভিড়ের মাঝে এটা আমার প্রথম ট্রেন যাত্রা। ভিড় যে হবে আগে থেকেই কিছু অনুমান করলেও ঠিক এত যে ভিড় হবে সেটা আমি ভাবিনি। স্টেশনে এসে অনুমান করলাম ঠিক যত মানুষ দাঁড়িয়ে আছে তার জন্য হয়তো অর্ধেক সিট আছে ট্রেনে।ট্রেনের ভিতরের অবস্থা ঠিক কেমন হবে সেটা আর আমার বুঝার বাকি রইল না। ওমনভাবে মন ঠিক করে নিলাম যে যেকোনো ভাবেই হোক ট্রেনে আমাকে উঠতে হবে।
যদিও ট্রেনে উঠার পর নিজের সিটে পৌঁছাতে পারবো কিনা সেটা নিয়ে সন্ধিহান ছিলাম।
সে যাই হোক অবশেষে প্রায় দেড় ঘণ্টা দেরিতে ট্রেন আসলো; আর আমি পূর্বপরিকল্পনা হিসেবে ভিড় ঠেলে ট্রেনে উঠে পড়লাম । প্রায় ১০ থেকে ১৫ মিনিট এর চেষ্টার পর নিজের সিটে বসতে পারলাম। এতো ভিড়ের মাঝেও নিজের সিটে বসতে পেরে একটু স্বস্তি পেলাম। ট্রেন তার গতিতেই ছুটতে আরম্ভ করলো। চলতে চলতে যথারীতি পরের স্টেশনে দাঁড়িয়ে পড়লো।
জানালা দিয়ে একটু বাইরে তাকিয়ে দেখি এইখানেও মানুষ কম নয়; আর তারাও ঠিক হয়তো আমার মতোই ভেবে রেখেছে, লক্ষ্য একটাই: যে করেই হোক ট্রেনে উঠতে হবে। মোটামুটি ঠিক যতজন লোক একটা বগিতে উঠা সম্ভব তার থেকেও বেশি জন উঠে পড়ল। এতে করে ট্রেনে আর হাঁটার মত কোনো জায়গা থাকলো না। ঠিক যত মানুষ বসে আসে তার থেকেও বেশি মানুষ এখন দাঁড়ানো। আমার পাশেই আমার সিট ধরে একজন ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে ছিলেন; বলতে গেলে আমার উপরই দাঁড়িয়ে ছিলেন উনি।
ট্রেন আবারও চলতে শুরু করল এবং পরের স্টেশনেও চলে আসলো। এইখানেও মানুষ যে পরিমাণ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম, সেটা যে আগের স্টেশন থেকে ঠিক কম না,বরং আরো একটু বেশি হবে। কিন্তু এইবার আর তাদের দরজা দিয়ে ট্রেন এ উঠা সম্ভব না। তাই দেখলাম অনেক জন বাধ্য হয়েই জানালা দিয়েই ঢুকতে শুরু করলেন। দুই একজন তো টিকেট হাতে নিয়ে জোরে জোরে বলতে লাগলেন, “আমার সিট এই বগিতেই।একটু ঢুকতে দেন।“ কিন্তু কে শুনে কার কথা। নিজে উঠতে পারলেই বেঁচে যায়।
আবারও ট্রেন ছুটতে শুরু করলো। আমার সামনেই এক ভদ্রমহিলা টিকেট বের করে দেখলেন তিনি ভুল বগি তে উঠে পড়েছেন। তার সিটে যেতে হলে আরো তিনটা বগি পার হতে হবে। কিন্তু সেটা একেবারেই অসম্ভব উনি চাইলেও এই বগি থেকেই বের হইতে পারবেন না ,সেখানে তিনটা বগি পার করা তো দুঃসহ ব্যাপার ।তাই কোনো উপায় না পেয়ে টিকেট থাকার পরেও দাঁড়িয়ে গেলেন।
পরের স্টেশন আবারও ট্রেন দাঁড়িয়ে পড়লো ।কিন্তু এইবার আর কোনো লোক উঠা সম্ভব না, দরজা দিয়ে তো না ই বরং জানালা দিয়েও না। তাই বাধ্য হয়েই কয়েকজন সব জানালা বন্ধ করে দিলেন যাতে আর কেউ ভিতরে না আসতে পারে। এতে ট্রেনে উঠতে না পারা বাকি যাত্রীদের জন্য খারাপ লাগলেও করার কিছু ছিলো না। হয়তো ছুটি শেষ ঢাকায় যেতেই হবে,কর্মক্ষেত্রে যেতেই হবে তাই দাঁড়িয়ে,কিন্তু সেটা আর সম্ভব হলো না। বগির ভিতরে থাকা মানুষদের কাছে বাহিরে দাঁড়ানো মানুষগুলো অতিরিক্ত; আর বাইরে দাঁড়ানো মানুষগুলোর কাছে ভিতরের মানুষগুলো স্বার্থপর। দু’পক্ষের কথা না ঠিক না ভুল। আমার প্রচন্ড ক্ষুধা পাওয়ার পরও এতো ভিড়ের মাঝে খেতে পারি নাই, যেখানে আমার ব্যাগেই খাবার রাখা।
একটু পাশে তাকিয়ে দেখি মোটামুটি অনেক ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। প্রায় সাড়ে নয় থেকে দশ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ঢাকা যাওয়া অনেক বেশি কষ্টের। যার যার ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ফিরছিলাম সবাই ঢাকা, কিন্তু কাল আমরা সবাই মিশে গিয়েছিলাম একে অপরের সাথে। আমি কিছুক্ষণ সিটে বসি আবার কিছুক্ষণ পাশে দাঁড়ানো মানুষ। এমন করেই কেটে গেলো আমাদের সবার প্রায় নয় থেকে দশ ঘণ্টা। অবশেষে সবাই পৌঁছে গেলাম আমাদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে।
সবচেয়ে আজব লাগল আমার, দীর্ঘ যাত্রার পরও সবার চোখে মুখে নেই ক্লান্তির ছাপ। মুখে আছে স্বস্তির হাসি। নামলাম ট্রেন থেকে। একটা সিএনজি ধরে সোজা বাসায় আসলাম। জীবনে মোটামুটি অনেক বার ট্রেন ভ্রমণ করেছি, হয়তোবা সামনে আরো করতে হবে। কিন্তু এই ঈদের যাত্রাটা অন্যরকমই; জমা থেকে যাবে অনেক দিন মনের কোনো এক জায়গায়।
- মো: মুহেব্বুল ইসলামhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%ae%e0%a7%8b-%e0%a6%ae%e0%a7%81%e0%a6%b9%e0%a7%87%e0%a6%ac%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a7%81%e0%a6%b2-%e0%a6%87%e0%a6%b8%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%ae/সোমবার, আগস্ট ১২, ২০২৪