fbpx

বুক রিভিউ – আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরী

বই- আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরী

লেখকের নাম: আনা ফ্রাঙ্ক

ঠিক তেরো বছর বয়সের এক সদ্য কিশোরী। বয়সটা শৈশব পেরিয়ে কৈশোরের বাগিচায় পদার্পণ করার, বিস্তীর্ণ জলরাশি ছুঁয়ে দেখার আর মুক্ত আকাশে বিহঙ্গের মত বিচরণ করার। কিন্তু সে কৈশোরকালের সৌন্দর্য উপভোগ না করে দেখেছিলো নৃশংসতা আর বর্বরতার বাস্তবচিত্র। তেরো বছর বয়সী একজন কিশোরী, যার চেনা পৃথিবীটা হঠাৎ করেই বদলে যেতে শুরু করেছিলো। হলোকাস্টের সময় অ্যামস্টারডার্মের সেই ভয়াবহ সময়কে সারা দুনিয়ার মানুষ প্রত্যক্ষ করল সেই ইহুদি কিশোরীর চোখ দিয়ে। এ হলো সেই কিশোরীর সেই ডায়েরি, দুই বছর দুই মাসের দিনলিপি, আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি। কিন্তু কি আছে সেই দুই বছর দুই মাসের দিনলিপিতে? 

আনা ফ্রাঙ্ক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভিষীকাময় অধ্যায়ের অনেক বড় একজন সাক্ষী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনিশ্চিত দিনগুলোর কথা ডায়েরিতে লিখেছিল নিয়মিতভাবে। তখনকার ভয়াবহ দিনগুলো এই কিশোরীর কলমের আঁচড়ে ডায়েরির পাতায় ফুটে উঠেছে জলজ্যান্তভাবে। 

ইহুদি ধর্মের হওয়াতে হিটলারের নাৎসী বাহিনীর রোষানলে পড়ে ফ্রাঙ্কের পরিবার। ফ্রাঙ্কের জন্মের সময় জার্মানির মাটিতে মাথা তুলে হুঙ্কার ছড়াচ্ছে হিটলার। যখন এডলফ হিটলার এবং নাৎসি পার্টি জার্মানির উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করে তখন আনা ফ্রাঙ্কের পরিবার নেদারল্যান্ডের আমস্টারডামে চলে আসেন। ইহুদি জনসংখ্যার উপর নিপীড়ন বেড়ে যাওয়ায় আনার বাবা অটো ফ্রাঙ্ক যেখানে কাজ করতেন সেই বিল্ডিংয়ের একটি বইয়ের আলমারির পিছনে লুকিয়ে যায়। লুকানোর জায়গাটিকে বিশেষভাবে “গোপন অ্যানেক্স” হিসাবে উল্লেখ করা হয়। এই মেয়েটি বাড়ীর পিছনের চিলেকোঠায় লুকিয়ে ছিল। দীর্ঘ  দুই বছরের একটু বেশী সময়। সে যেখানে লুকিয়ে ছিল সেই জায়গাটার আয়তন ৪৫০ বর্গফুট আর ঐটুকু জায়গায় মেয়েটিসহ মোট ছিল আটজন। যে বয়সটা তার থাকার কথা ছিল স্কুলে। পৃথিবীর খোলা আলো-বাতাসে প্রাণের অপরিমিত উচ্ছাসে যার দিন কাটাবার কথা ছিল সেই কিশোরী আনা ফ্রাঙ্ককে বরণ করে নিতে হলো ঘুপচি ঘরের নিরাপদ আশ্রয়। রাতের বেলা যেখানে ৰাতি জ্বালানো নিষেধ ছিল। দিনের বেলায় কোন জানালা খোলার উপায় ছিল না। সে এক অপরিসীম সহ্যাতীত সময়। দুই বছর ঐ জায়গাতেই থাকা, খাওয়া, ঘুম থেকে ওঠা, টয়লেট সারা, ঐখানেই সন্ধ্যে এবং রাত দেখা। বাইরে সারা শহরে নাৎসি বাহিনীর সদস্যরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। উপরে আকাশ থেকে বোমা বর্ষণ হচ্ছে। ধরা পড়লেই শেষ!

এখনকার সময়ের মতো ইন্টারনেট, মেসেঞ্জার, ওয়াটস-অ্যাপ এর কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি সেই ১৯৪২ সালে। তাহলে মেয়েটির সময় কাটত কিভাবে? মেয়েটি দিনলিপি লিখত প্রতিদিন। সেখানে সে লিখেছে নিজের বিশ্বাস, ভালোলাগা, যুদ্ধ, নিজের পরিবার ইত্যাদি।  কিভাবে তার শরীর বদলে যাচ্ছে সেসব বর্ণনাও সে অকপটে লিখে গেছে। ১৩-১৪ বছরের একটি মেয়ে কিভাবে এত সুন্দর, এত গভীর সব কথা লিখেছে, তা অবাক করার মত। মেয়েটি তার সব মনের কথা ডায়েরিতে লিখত। এত কিছুর পরও আনন্দ, সৌন্দর্য, মানুষের মহত্ত্বের প্রতি তার বিশ্বাস হারায়নি। 

কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। কোনো এক বিশ্বাসঘাতক তাদের ধরিয়ে দিয়েছিলো। তাদের গোপন চিলেকোঠার হানা দেয় নাৎসি বাহিনী। সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় বন্দী শিবিরে। ডায়েরির পাতায় শেষ আঁচড় টানার ঠিক সাত মাস পরে এই পৃথিবীর  সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছিল আনা ফ্রাঙ্কের। ফ্যাসিস্ট নাৎসীদের নির্মমতার সাক্ষর হিসেবে এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যেতে হয়েছিল তাকে মাত্র ১৫ বছর বয়সে। চলে গেছে সে কিন্তু রেখে গেছে তার কালজয়ী অমর দিনলিপি।

আনা ফ্রাঙ্কের দিনলিপি থেকে কয়েকটি প্রিয় উদ্ধৃতি: 

১. ‘আমি দুঃখ-কষ্টের কথা ভাবি না, ভাবি যা সৌন্দর্য এখনও বাকী রয়ে গেছে তার কথা।’

২. ‘ভাবলে ব্যাপারটা কত চমৎকার যে, আসলে পৃথিবী বদলে দেবার জন্য কারও এক মুহূর্ত অপেক্ষা করার দরকার নেই !’

৩. ‘যে নিজে সুখী সে অন্যকে সুখী করতে পারে’।

৪. ‘যেখানে আশা আছে, সেখানেই জীবন আছে। এই আশা আমাদের নতুন সাহস জোগায় এবং শক্ত হতে সবকিছুতে সাহায্য করে।’

৫. ‘সবকিছুর পরও আমি বিশ্বাস করি, মানুষ তার ভিতরে সত্যিই ভাল।’

শুরু থেকেই লেখিকা হওয়ার স্বপ্ন ছিল আনা ফ্রাঙ্কের। কিন্তু তা হলো না। যে ফুল চারিদিকে সুবাস ছড়াতে পারত, তাকে ঝরে যেতে হয়েছে কুঁড়িতেই। আনা আজো বেঁচে আছে পাঠকের হৃদয়ে কারণ বেঁচে আছে তার দিনলিপি, আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি-যার মৃত্যু নেই।

শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়