fbpx

অক্টোবর ১৯, ২০২৪

কোটা: সুযোগ নাকি বৈষম্য?

মেধাবীরা কি অপরাধী, নাকি জিম্মি কোনো অশুভ শক্তির হাতে? কেনো তাদের বই-খাতা, শ্রেনিকক্ষ ছেড়ে এই মুক্তির আওয়াজ তুলে রাজপথে নামতে হচ্ছে? উত্তর হলো, তাদের রাজপথে নামতে হচ্ছে কারণ কোটা নামক বৈষম্যমূলক এক সিস্টেমে আটকা পরে গেছে তাদের ভবিষ্যৎ। নিজের মেধার সবটুকু নিংড়ে দিয়েও তারা নিজেদের পায়ের তলার মাটি টুকু নির্দ্বিধায় আরেকজনের হয়ে যেতে দেখছে। যেই পাহাড় তারা ডিঙানোর প্রাণপন চেষ্টা করছে নিজেদের শ্রম আর মেধায়, সেই পাহাড় চূড়ায় কেউ কেউ বসে পরছে ‘কোটা’ নামক মই চেপে। বলছি, সরকারী বিভিন্ন চাকরী, বিসিএস এর মতো প্রতিযোগীতা মূলক পরীক্ষায় কোটা ব্যবস্থার কথা। আর সেই কোটার বিরুদ্ধেই আমাদের আন্দোলন, আমাদের আন্দোলন বৈষম্যের বিরুদ্ধে।

প্রসঙ্গত, ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সরকারী চাকরীতে ৫৬ শতাংশ কোটা প্রচলিত ছিলো, যার মধ্যে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা, নারীদের ১০ শতাংশ, অনগ্রসর জেলার জন্য ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্যে ৫ শতাংশ এবং প্রতীবন্ধীদের জন্যে ১ শতাংশ হারে আসন নির্ধারিত থাকতো। ২০১৮ তে ছাত্রদের তীব্র আন্দোলনের মুখে তৎকালীন সরকার প্রধান কোটাব্যবস্থা পুরোপুরি বাতিলের ঘোষনা দেয়। কিন্তু, ২০২১ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের অংশটিকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান রিট করেন। সে রিটের শুনানি নিয়ে কেন ওই ৩০ শতাংশ কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয় এবং এ বছরের ৫ ই জুন সেই রুল যথাযথ ঘোষণা করে রায় দেয় হাইকোর্ট। এই ঘোষণার পর থেকেই ছাত্ররা নিজেদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করে, জুলাইয়ের শুরু থেকে তারা সড়ক অবরোধ সহ বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে আন্দোলন কে বেগবান করার চেষ্টা করে। ৭ই জুলাই থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থী-রা এই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে এতাত্মতা পোষন করে ক্লাস পরীক্ষা বর্জনের ঘোষনা দেয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এ ছাত্ররা চার দফায় তাদের যেসব দাবি তুলে ধরছে, সেখানে তারা ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের পরিপত্র বহাল রাখা, শুধুমাত্র অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর কোটা বহাল রেখে সকল বৈষম্যমূলক কোটা দ্রুততম সময়ে বাতিল এবং কোনো কোটা একাধিকবার ব্যবহার করা বন্ধ করা।

একটা গল্পের ছলে মুক্তিযোদ্ধা কোটা কিভাবে আমাদের সমাজের সবচেয়ে বড় বৈষম্যের সমার্থক হয়ে উঠেছে তার চিত্র দেখাই। ধরি, আমার দাদা একজন সার্টিফিকেট প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। তিনি যুদ্ধ করেছেন দেশের জন্যে, দেশের মানুষকে বৈষম্যের হাত থেকে রক্ষা করতে, তাদের প্রাপ্য অধিকার ফেরত পাইয়ে দিতে। আজ ২০২৪ সালে এসে তার পাঁচ পুত্র সন্তান ও চার কন্যা সন্তানের সন্তানাদি অথ্যাৎ আমার দাদার নাতি নাতনীর সংখ্যা মোট ২০ জন। আমরা সকলেই আমাদের দাদা (অথবা নানা)-র সেই মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটে ভর করে প্রতিযোগীতামূলক পরীক্ষার ফলাফল কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাষ্ট্রের বিভিন্ন উচ্চপদস্থ চাকরি নিজের করে নিবো, যেখানে আমাদের সহপাঠীরা নিজেদের মেধার জোরে পরীক্ষার খাতায় আমাদের চেয়ে দশ-কুড়ি নাম্বার বেশি পেয়েও তাদের দাদার মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট না থাকার কারনে বেকারত্বের ট্যাগ মাথায় নিয়ে ঘুরবে। আমরা হয়তো কোনোদিন সময় করে দাদার কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্পও শুনতে চাইবো না, কিসের বিরুদ্ধে ছিলো তাদের সেই আত্নত্যাগ, নিজের জীবন বাজি রেখে কেন তিনি যুদ্ধ করে ছিলেন, আমরা বরং কৃতজ্ঞ থাকবো ঐ একটা কাগজের জন্যে, যেটা দোহন করে আমরা নিজেদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছি। এবং সেটাও বহুজনে, বহুবার।

গল্প ছেড়ে এবারে বাস্তবতায়, এই কোটা যখন অব্যাহত ছিলো তখনকার চিত্র এই যে, কোটা-র জন্যে বরাদ্দকৃত আসনের বিপরীতে যথেষ্ট সংখ্যক প্রার্থী পরীক্ষায় পাশ নম্বর না পাওয়ার কারনে সেইসব আসন ফাঁকা রয়ে গেছে, অথচ সেই একই পরীক্ষায় যথেষ্ট নম্বর পেয়েও কোটা না থাকার কারণে অনেকের চাকরী হয় নি। একই চিত্র ছিলো, বিসিএস সহ আরো বিভিন্ন চাকরী ক্ষেত্রে। মুক্তিযুদ্ধের ৫৩ বছর পরে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের একজন সদস্য হয়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ব্যবহার করা নিজের অযোগ্যতা কে সকলের সামনে তুলে ধরা, দেশের একজন সম্মানিত নাগরিকের সম্মান কেও প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রথম পাঠে আমরা শিখি, পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরনের বিরুদ্ধে আমাদের দাদা-নানা রা যুদ্ধে গিয়েছিলেন, অথচ সেই যুদ্ধকে পুঁজি করে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কোটা নামক বৈষম্যের সাথে পরিচিত না হোক, তারা যেনো আত্নসম্মান আর নিজের মেধা দেশের জন্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে আমারা সেই পথ সুগম করতে চাই।

প্রতিবন্ধী কোটা এবং সমাজের পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠীর জন্যে যৌক্তিক কিছু কোটা, এবং সেইসব কোটার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা এই আন্দোলনের আরো একটি দিক৷ কোটাব্যবস্থা সবসময়ই নাগরিকের সমতা নিশ্চিতের কথা বলে, কখনোই কোনো একটা বিশেষ গোষ্ঠী কে সুবিধা প্রদান করার জন্যে কোটা নয়। বরং পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠীকে সমান সুযোগ দেয়ার জন্যে কোটা ব্যবস্থার উদ্ভব হয়। ভৌগোলিক ও আর্থসামাজিক কারণে আমাদের দেশের কিছু অঞ্চলের লোক, যারা সুবিধাবঞ্চিত তারা জেলা কোটা কিংবা ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠী কোটার আওতায় এবং শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধীদের জন্যে কোটাব্যবস্থা হয়তো থাকতে পারে, এবং সেটা শতকরা ৫ শতাংশ বা তার কম হওয়াই উচিত।

স্বাধীন বাংলায় অর্ধশত বছর পরে আমরাও সংবিধান মোতাবেক সমতা চাই, নিজেদের অধিকার চাই। গত বেশকিছু দিন ধরে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর সাধারন ছাত্ররা এই দাবি নিয়ে আন্দোলনে রাজপথে, বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজের শিক্ষার্থীরা, চাকরী প্রত্যাশীরা তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নেমে আসছে রাস্তায়, অবরোধ করছে রাজধানী শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। তারা তাদের দাবিটুকু পৌঁছে দিতে চাইছে নীতি-নির্ধারক দের কাছে। আর এই অধিকার আদায় না হওয়া পর্যন্ত সচেতন ছাত্রসমাজ রাজপথে থাকবে তাদের সাম্যের উদ্দীপ্ত কন্ঠস্বর নিয়ে। দেশের ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে এই ছাত্রসমাজ যৌক্তিক দাবি নিয়ে পথে নেমে এসেছে, নিজেদের রক্তের বিনিময়ে হলেও সেই দাবি তারা সমুন্নত রেখেছে। দেশকে বৈষম্যমুক্ত করতে আরো একবার তারা সফলতার মুখ দেখবে সেই আশায় আমরা বুক বাধছি। দিনশেষে আমাদের ধ্বনি এখন, দফা এক দাবি এক, Quota Not Comeback.

কোটা প্রথা নিপাত যাক, মেধাবীরা মুক্তি পাক।

0701 End