fbpx

অবেলার অভিজ্ঞতা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরুর জীবন থেকেই বাকি সব শিক্ষার্থীর মতো আমিও অপেক্ষায় আছি কালো গাউন পরে নিজের সমাবর্তনে অংশগ্রহন করার জন্যে। তবে নিজের স্নাতক শেষ করার আগেই বিশেষ সমাবর্তনে অংশগ্রহনের সুযোগ হলো, যদিও কালো গাউন আর সমাবর্তন টুপি ছাড়াই খুশি থাকতে হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে (মরণোত্তর) Doctor of Laws (Honoris Causa)  ডিগ্রি প্রদান করার জন্যে এই বিশেষ সমাবর্তনের আয়োজন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশেষ সমাবর্তনের বিশেষ আকর্ষণ ছিলো সমাবর্তন বক্তা হিসেবে বঙ্গবন্ধু কন্যা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতি।

গত দেড়মাস আগে যখন বর্তমান শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহনের জন্য রেজিস্ট্রেশন শুরু হয় তখনই ঝটপট করে নিজের রেজিস্ট্রেশন করে ফেলি, বন্ধুদেরও তাগাদা দিই।অনুষ্ঠানের দিন কয়েক আগে হাতে পেয়ে যাই নিজের নাম লেখা আমন্ত্রনপত্র। এই আমন্ত্রনপত্রই কাজে লাগবে অনুষ্ঠানে প্রবেশের পাস হিসেবে, সেখানে সময়সূচীও উল্লেখ ছিলো। অবশেষে সেই দিন এলো। ক্লাস ছুটি ও দেশের হরতাল পরিস্থিতির জন্যে বন্ধুরা সবাই মিলে যেতে না পারলেও ভোরে ক্যাম্পাসে পোঁছে গেলাম মুন্সীগঞ্জ থেকে। নির্দেশনা অনুযায়ী মোবাইল ফোন ,ব্যাগ সবকিছুই রেখে যেতে হবে। আমার সঙ্গী হিসেবে পেলাম সহপাঠী বন্ধু অনসূয়া, জুবায়ের ও আদনানকে। ওরা সকাল নয়টায় চলে এলো আমার হল গেটে। সবার মোবাইল ফোন, ব্যাগ হলে রেখে আমরা রওনা হলাম আমাদের গন্তব্যে।

গন্তব্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ। আমরা কার্জনের ক্যান্টিন থেকে হালকা নাস্তা সেরে হাঁটতে থাকলাম। পথে বিভিন্ন রঙের গাউনে দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের, তারা সকলে  সমাবর্তন শোভাযাত্রার সাথে অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করবে। মাঠের দুই পাশের গেইটকেই ব্যবহার করা হয়েছিলো। সুইমিংপুল সংলগ্ন গেইটটি আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ ও শিক্ষকদের জন্যে এবং জিমনেসিয়াম সংলগ্ন গেইটটি আমাদের জন্যে বরাদ্দ ছিলো। গেইটের সামনে ছিলো লম্বা লাইন, আশেপাশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের সদস্যরা পুরো এলাকা নিরাপত্তার চাঁদরে ঢেকে রেখেছিলো। তাদের সাথে কাজ করছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলো স্বেচ্ছাসেবক দল- BNCC, রোভার স্কাউট, রেঞ্জার ইউনিট। সবাই মিলে একটি সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিতে বদ্ধপরিকর ছিলো। আমরা ঝটপট দুইভাগে নিজেদের লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। অনেকক্ষন লম্বা লাইনের সাথে গুটি গুটি পায়ে আমরা প্রবেশ করলাম মাঠে। পাশের লাইনে থাকা বন্ধু আদনান ও জুবায়ের আগেই অপেক্ষা করছিলো। দ্বিতীয় দফা নিরাপত্তা বলয় পার হয়ে আমরা ঢুকলাম মূল প্যান্ডেলে, সেখানে প্রতিটি আসনে রাখা ছিলো স্যুভেনিয়র সহ একটি করে গিফট ব্যাগ। আলো বাতাসের অবাধ বিচরনের কথা মাথায় রেখে নিজেদের আসনে বসে পরলাম।

এবারে প্রবেশ করা যাক মূল অনুষ্ঠানে। সময়সূচী অনুযায়ী সকাল ১০ টায় সমাবর্তন শোভাযাত্রা মঞ্চে আগমন করলে সবাই একসাথে জাতীয় সংগীত গেয়ে অনুষ্ঠানের শুরু হয়। মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় চ্যান্সেলর এর সদয় অনুমতিক্রমে অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন মাননীয় ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (এমপি), শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি (এমপি), স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী সহ আরো অনেক নেতৃবৃন্দ। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সকল অনুষদের ডিন ও শিক্ষকেরা। জাতীয় সঙ্গীত শেষে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন ঘোষনার পরই ধর্মগ্রন্থ সমূহ থেকে পাঠ করা হয়। পর্যায়ক্রমে আল-কুরআন, গীতা, ত্রিপিটক, বাইবেল থেকে পাঠ করা হয়। এরপর একটি মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক পরিবেশনার আয়োজন করা হয়। শুরতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থিম সং পরিবেশন করে সংগীত বিভাগের শিক্ষার্থীরা। পরবর্তী আয়োজনে নাট্যকলা, সঙ্গীত ও নৃত্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা তাদের পরিবেশনায় ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা খন্ডচিত্রে তুলে ধরে। বেলা সাড়ে ১১ টায় “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব” শিরোনামের একটি প্রামান্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। সেখানে বঙ্গবন্ধুর ঘটনাবহুল বিশ্ববিদ্যালয় জীবন, স্বাধীনতা সংগ্রামে তার অসামান্য অবদান খুব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়। পুরো আঙ্গিনা খুবই উৎসব মুখর ছিলো, লক্ষ্য করলাম নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে অনেকের হাতে মোবাইল ফোন রয়ে গেছে। তবে মোবাইল বিহীন আমাদের সময়টা ভালোই কেটেছিলো।

এরপরের আনুষ্ঠানিকতা ছিলো সমাবর্তন বক্তা কে তার ক্রেস্ট প্রদান এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে (মরণোত্তর) Doctor of Laws (Honoris Causa) ডিগ্রি প্রদান, তাঁর পক্ষে ডিগ্রি গ্রহন করেন তাঁর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (এমপি)। তুমুল করতালির মধ্যে এই আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। তার পরপরই পর্যায়ক্রমে ভাইস চ্যান্সেলরের বক্তব্য প্রদান করেন অধ্যাপক ডা. মোঃ আখতারুজ্জামান, বিশেষ অতিথির বক্তব্য প্রদান করেন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি। তারা তাদের বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুকে বিভিন্ন আঙ্গিকে চিত্রায়িত করেন। অসামান্য ব্যাক্তিত্ব, বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বিভিন্ন ঘটনা উঠে আসছিলো। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ। আমরা তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম, কখোনাবা নিজেদের মাঝে একটু খোশগল্প, গিফট ব্যাগে থাকা স্মরনিকার বিভিন্ন তথ্য নিয়ে একটু আলাপ আলোচনা।

বেলা বারোটায় সমাবর্তন বক্তার সাইটেশন প্রদান করেন প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ। তিনি অল্প সময়ে সমাবর্তন বক্তার জীবনকে চমৎকার ভাবে তুলে ধরেন। তখন মাথার উপর সূর্য্যিমামা আস্তে আস্তে রেগে যাচ্ছে, সাথে পানির বোতল না থাকায় তৃষ্ণা তখন টের পাচ্ছিলাম আমরা। সোয়া বারোটায় সমাবর্তন বক্তা তার বক্তব্য শুরু করেন। তার সাবলীল বক্তব্য খুবই উপভোগ্য ছিলো। পুরোটা সময় আমরা তন্ময় হয়ে শুনছিলাম একজন দেশনেত্রী, একজন পিতাহারা কন্যার গল্প। তাঁর ছাত্রজীবনের কথা, তাঁর পরিবার হারানোর গল্প, বাংলাদেশকে নিয়ে তাঁর স্বপ্নের কথা বলছিলেন তিনি। আমরা হাজারো শিক্ষার্থী অনুপ্রাণিত হচ্ছিলাম সেসব শুনে। সমাবর্তন বক্তার বক্তব্যের শেষে সভাপতি আয়োজনের সমাপ্তি ঘোষনা করেন।

কিছুটা ক্লান্তি আর অনেকটুকু ভালোলাগা নিয়ে আমরা ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এই দিনটি ব্যাক্তিগত ভাবে আমার কাছে আলাদা জায়গা দখলে করে থাকবে আজীবন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসেও এই দিনটি স্মরনীয় হয়ে থাকবে।