গোধূলির আলোর রেশ পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমেছে৷ বক শালিকগুলো ঘরে ফিরছে। আবছা আলোয় পশ্চিমের সুউচ্চ সুপারি গাছেরা দুলছে। গুড়গুড় বৃষ্টির ঠান্ডা হাওয়ায় ভেসে আসে আসন্ন ঝড়ের আভাস। ঝালরওয়ালা বেলকনিতে বসে দিলারা বেগম চা খাচ্ছেন। মস্তিষ্ক তার পুরনো স্মৃতিতে টইটম্বুর। সংসারে তার ৩৪ টি বছর কেটে গেলো। বড় ছেলে নিহাল তো ছোট থেকেই বড্ড ভীতু। মা কাতুরে ছেলে তার। নিতান্তই ডানপিটে স্বভাব। মায়ের নেওটা যাকে বলে। বৃষ্টি হলেই নিহাল, ছোট ছেলে সুফি আর আয়েশা বায়না ধরতো খিচুড়ি আর বেগুন ভাজা খেতে। এইতো সেদিনকারই কথা সব। সুফিটা ছিলো বাবা অন্ত প্রাণ। তিন সন্তানদের আঁকড়ে ধরেই কেটে যেতো তার দিন। ধীরে ধীরে তার সংসারটাও ডালপালা মেলতে শুরু করে। বৃষ্টির রাতগুলোতে একতলা ঘরের ছাদ ফুটো হয়ে যখন বৃষ্টির টুপটুপ ফোঁটা ঝরে পড়তো ছোট ছোট ছেলেমেয়ে গুলোকে বুকে আঁকড়ে রাখতেন। পাখির বাসায় মায়ের ডানায় আগলে থাকা সদ্য জন্ম নেয়া পাখির ছানারা যেমন থাকে। মা মরা মেয়ে দিলারা বেগম তার নিজ হাতে গড়া এই সংসারে ফিরে পেয়েছিলেন মমতার স্বাদ। অফিস থেকে আসার সময় জামাল সাহেব তার জন্য বৃষ্টি ভেজা কদমফুল নিয়ে আসতেন। কদম তার অনেক পছন্দের। পাড়া বেড়ানো ছেলেমেয়েদের সাথে কতবার মোড়লার মোড়ের ওই খালের ধারের কদম গাছ থেকে চুরি করে নিতেন তার প্রিয় কদম ফুল। মোড়লার পদ্মবিলে নৌকা নিয়ে কতবার সবুজ পানির বুকে হারিয়ে গেছেন। সুফি টাও তার মতোই দুরন্ত স্বভাবের। ছোট থেকেই সারা বাড়ি মাথায় করে রাখতো। চিলেকোটার পাশের রুমটাতে থাকার জন্য দুই ভাইয়ের সে কি ঝগড়া! মেয়ে আয়েশা তার বরাবরই শান্ত স্বভাবের। ঝিলখেতের এক তলা বাড়িতে চরম ভালোবাসায় সাজানো সংসারটাই ছিলো তার নিতান্ত সম্বল। ভাগ্যের পরিহাসে জামাল সাহেব কোনো এক ভোরবেলায় পাড়ি জমান পরপারে। বিদায়ের করুণ বেলায় রঙিন জীবনে দিয়ে যান শুভ্রতার ছাপ। আর কখনো জামাল সাহেবের সাথে ঝিলখেতের বাড়িটার ছাদে রাতের আকাশ দেখা হয়নি তার। চায়ের কাপে গড়িয়ে যায়নি বেলা। প্রিয় কদম ফুল তার অছোঁয়া থেকে যায়। তারপর? কত শত বসন্ত এলো গেলো। সুফি, নিহাল আর আয়েশাও সময়ের স্রোতে কীভাবে বড় হয়ে গেলো টের পাননি তিনি। ঝিলখেতের বাড়িটার কথা খুব মনে পড়ে তার। কন্সট্রাকশনের জন্য বাড়িটা ভাঙা পড়ে যায়৷ স্বামীর রেখে যাওয়া শেষ স্মৃতিটাও রক্ষা করতে পারেন নি। আজ কত বড় এপার্টমেন্ট সেথায়। এক এক তলায় তার এক এক গল্প। তার বহুবছরের সংসারের অস্তিত্বের ছিটেফোঁটাও নেই সেখানে। সেখানের কোথাও জামাল সাহেবের ছোঁয়া নেই। নিহালের মা মা বলে বাড়ি মাথায় করা, সুফির ভায়োলিনের আওয়াজ, আয়েশার নির্জন দুপুরের পায়ের ঘুঙুরের শব্দ, জামাল সাহেবের হারমোনিয়াম কোনো কিছুই বেজে ওঠেনা। সব কিছুই অস্তিত্বহীন মস্ত অট্টালিকার চারিধারের কোলাহলের কাছে। তাতে কি! বড় ছেলে নিহালটা তো বারিধারায় কয়েকমাস অাগে ফ্ল্যাট কিনেছে। ছেলে তার মস্ত বড়লোক। সুফি তো বড় ডাক্তার; ভায়োলিনের জায়গায় ছেলের হাতে এখন স্টেথোস্কোপ। আর আয়েশা! সে তো স্বামী সন্তান নিয়ে বেশ খুশি! তিন সন্তানের ছেলেমেয়েদের দাদী হয়েছেন তিনি। এ যেনো তার চরম যত্নে লালিত ভরা সংসার। হঠাৎ মালীনির আগমন। “কিগো মাসি? এই বৃষ্টিমাখা ঠান্ডায় আর কত বসে থাকবে? বৃদ্ধাশ্রমে আজ খিচুড়ি আর বেগুন ভাজা হয়েছে। খাবেনা? চলো চলো সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে৷ “হুশ ফেরে দিলারা বেগমের৷ কাপের চা কবেই শেষ। স্মৃতিচারিত চোখে চশমা গুজে দিয়ে বলেন “তুই যা, আমি আসছি”। পঁয়ষট্টি ছুঁইছুঁই দিলারা বেগম ভাবেন আজ বেলকনিতে চারটা চায়ের কাপ থাকলে মন্দ হতো না। চেয়ার ছেড়ে এক পা এক পা করে চলে আসার সময় হঠাৎ পেছন ফিরে তাকান তিনি। মুহুর্তেই দুটো চোখ অশ্রুতে সিক্ত হয় তার। সাদা পাঞ্জাবীতে শুভ্রতার ছাপে আবছা আলোয় তার চিরচেনা জামাল সাহেব। চারিদিকে আতরের যেনো মিষ্টি সুভাস। বিধ্বস্ত হরিণীর ন্যায় বলে ওঠেন তিনি “তুমি এসেছো? কতদিন তোমার অপেক্ষায় আছি। আমায় নেবেনা সঙ্গে? এই সাদা কালো জঞ্জাল ভরা মিথ্যে শহরে আকাশের বুকে তোমার আমার লাল-নীল সংসার হবে বলো?”
- ফারিয়া তাবাসসুম মেহরিনhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%ab%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a6%bf%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%be-%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a6%b8%e0%a7%81%e0%a6%ae-%e0%a6%ae%e0%a7%87%e0%a6%b9%e0%a6%b0%e0%a6%bf%e0%a6%a8/বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ১২, ২০২৪