ছবি তুলতে ভালো লাগে। যখন থেকে ক্যামেরা মোবাইল হাতে পেয়েছি, কিছু না কিছু ছবি তুলতাম। ফিল্মের হিসেবের বাঁধা নিষেধ যখন চলে গেল, মেমরি কার্ড ভরে যেত ছবিতে। অনেক কিছুর ছবি তুলতাম। যা পেতাম সামনে, যাকে পেতাম সামনে, ক্যামেরা দিয়ে মুহূর্তটা বন্দী করে রাখার চেষ্টা করতাম। অনেকদিন পরে এসব ছবি দেখে ভালো লাগতো স্মৃতি রোমন্থন করতে। ইউনিভার্সিটি শেষ করার পরে ডিএসএলআর হাতে পাই, তখন ছবি তোলা হয়ে গেল নেশার মত। বিশেষ করে যে কোন বিশেষ দিন যেমন পহেলা ফাগুন কিংবা পহেলা বৈশাখে ছবি তুলতে বের হয়ে যেতাম। বেশি দূরে যেতে হত না, ইউনিভার্সিটিতেই যেতাম, নানা রঙের মানুষের ছবি তুলতাম। আমার পছন্দ ছিল মানুষের এক্সপ্রেশন ধরে রাখার। বলবো না ভালো তুলি, নিতান্তই নতুনের মত ছবি তুলি। আর খুব ভালো লাগে যখন যার ছবি তুলি, সে ছবি দেখে খুশি হলে।
এত কথা বলার পেছনে একটা কারণ আছে। মানুষের ছবি যেমনি তুলি, সেই ছবিকেই যখন সব রং ফেলে দিয়ে, সাদা কালো করে উপস্থাপন করতে হয়, তখন একটা দম আটকানো অনুভূতি কাজ করে। শখের ছবিটিকে এডিট করে সাদা কালো করে ফেলার মাঝে একটা কঠিন সত্য লুকিয়ে থাকে। সেটা হল এই হাস্যোজ্জ্বল মানুষটা এই পৃথিবীতে আর নেই। ছবি তোলার সময় যতটা ভাল লাগে, সাদা কালো করতে আরো বেশিগুণ কষ্ট লাগে। স্মৃতির মাঝে একটা দেয়াল তুলে দিতে হয়।
আমার স্মৃতি অনেক দুর্বল। ছবির মাধ্যমে ওই মুহূর্তের ঘটনাটা মনে রাখি। ডুসডার প্রোগ্রামে এরকম একটা মুহূর্ত ছিল মুরশীদা ম্যাডামের ছবি তোলা। ওনার একটা ছবি তুলেছিলাম, ক্যামেরার প্রিভিউতে ছবি দেখে উনি অনেক খুশি হয়েছিলেন। ছবিটা আমারো পছন্দের ছিল, রঙিন ব্যাকগ্রাউন্ডের সামনে তার থেকেও রঙিন এক মানুষ কি সুন্দর একটি হাসি দিয়েছেন।
ম্যাডামের সাথে ক্লাসের সময় খুব কথা হয়নি। আমি স্যার ম্যাডামদের থেকে একটু দূরে দূরে থাকতাম। পড়াশোনায় খারাপ ছিলাম বলেই সাহস করে তাদের সামনে যেতাম না। ভার্সিটির পালা কোন রকমে শেষ করার পরে একবার ম্যাডাম আমাকে তার রুমে ডেকেছিলেন। আমার রেজাল্ট খারাপের কারণ নিয়ে কথা বললেন, জানতে চাইলেন আমার প্ল্যান কি?
আমি কি উত্তর দিয়েছিলাম ১৫ বছর পরে ভুলে গিয়েছি। ম্যাডাম ভুলেন নি। কিছুদিন আগে QMH Club এর প্রোগ্রাম শেষে উনি আমাকে ডাকলেন কথা বলার জন্য। জিজ্ঞাসা করলেন কেমন আছি, কি করছি এসব নিয়ে। টুকটাক কথাবার্তার পরে উনি বললেন যে ১৫ বছর আগে উনি আমাকে একই প্রশ্ন করেছিলেন। তখন আমার উত্তর শুনে উনি অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন, কিন্তু তখন আমাকে সাহায্য করতে পারেন নাই। কিন্তু উনি দোয়া করেছেন আমার জন্য। এইটুকু শোনার পড়ে আমার মনে হল আমি বড় একটা ভুল করেছি, সেটা হল উনি আসলে সেই পরিচিত ম্যাডাম না, উনি আমার ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র আপু। সেদিন উনার সাথে ঘণ্টার মত কথা বলেছিলাম। পরে আবার এসে কথা বলবো সেটাও বলেছিলাম।
টিচার্স ডেতে উনি আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন উইশ করার জন্য। তখন উনি আমাকে এটাও বলেছিলেন, “There are lots of exams you went through to get your aim; successes and losses come and go, but your dedication and hard work will always be with you to lead you towards a step ahead. You are the person who can change the world.” টিচার্স ডেতে তাঁকে উইশ করার বিনিময়ে এরকম দোয়া পাওয়ার ভাগ্য মনে হয় খুব কম মানুষেরই হয়ে থাকে। উনি আমাকে বলতেন যে ভার্সিটি আসলেই যেন উনাকে ফোন দেই।
সেই পরের সময়টা আর হয়নি। এর মাঝে একবার ডিপার্টমেন্টে গিয়েছিলাম প্যাপাইরাসের প্রোগ্রামের জন্য, উনি আমাকে ফোন দিয়েছিলেন। ফোন সাইলেন্ট করা ছিল বলে ধরতে পারিনি। যখন কলব্যাক করেছিলাম, উনি ততক্ষণে বাসায় চলে গিয়েছেন। কথা দিয়েছিলাম দ্রুতই উনার সাথে দেখা করবো। সেই শেষ কথা। এরপরে তাঁর কথা শুনি যখন জানতে পারি যে চলে গিয়েছেন। চলে গিয়ে উনি মনে করিয়ে দিলেন যে সময় কতটা নির্মম হতে পারে। কিছু কথা তাঁকে কখনোই আর বলা হবে না। সবচেয়ে বড় কথা, একমাত্র উনিই আমাকে এত বছর পরে কাছে টেনে নিয়েছিলেন, বলেছিলেন নিজের উদ্দেশ্য ঠিক রাখতে।
সবার ছবিই রঙিন থেকে সাদা কালো হবে। আগে অথবা পরে। একবার সাদাকালো হয়ে গেলে সেটাতে আর রং ফেরানো যায় না। উনি শিখিয়ে দিয়ে গেলেন, রঙিন থাকতে থাকতেই রং বিলিয়ে যাওয়া। সবার মাঝেই রং থাকে, উনার মাঝে রং ছিল সাদা। সব রং মিলে ছিল বলেই।
যেখানেই আছেন ভাল থাকবেন, ম্যাডাম, আপু। আপনার স্মৃতিচারণ করে অনেকেই লেখা লিখেছে। আমার স্মৃতিচারণ অসম্পূর্ণ। আমিও আপনার মত রং বিলাতে চাই।

- This author does not have any more posts.