জুলাই ১০, ২০২৫

“গাজওয়াতুল হিন্দ এবং বর্তমান”

 সুপ্রিয় পাঠকমণ্ডলী, বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম হট টপিক হলো ভারত- পাকিস্তানের মধ্যকার যুদ্ধ। এরই সাথে চলে আসে একটি জিনিস, তা হলো ” গাজওয়াতুল হিন্দ”। আজকে আমরা জানবো গাজওয়াতুল হিন্দ মূলত কী? কুরআন- হাদীসে এ বিষয়ে কী বলা হয়েছে, এর কতটুকুই বা বর্তমান প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।

প্রথমেই আসি গাজওয়াতুল হিন্দ কী, এই ব্যাপারে। “ গাজওয়াতুল হিন্দ” ইসলামিক ঐতিহাসিক ও সূত্রপ্রাপ্ত ধারণা, যা বর্ণনা করে ভবিষ্যতে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমান ও অমুসলিমদের মধ্যে একটি প্রতিরোধমূলক বা পবিত্র যুদ্ধ সংঘটিত হবে। সরাসরি কোরআনে এই শব্দটি নেই, তবে বিভিন্ন হাদীসে এ বিষয়ে বাণী পাওয়া যায়। যেমন, তাওবান নামে সাহাবী বর্ণনা করেছেন: “ রাসূল (সা.) বলেছেন: আমার উম্মতের দুটি দল আছে, যাদেরকে আল্লাহ দুনিয়ার আগুন থেকে মুক্ত করবেন– একটি দল যারা হিন্দুস্থান (ভারত) এ জিহাদ করবে, আর একটি দল যারা ঈসা (আ.)- এর সঙ্গে থাকবে।” এ থেকে বোঝা যায়, মুসলিমদের মধ্যে এমন একটি দল থাকবে যারা ভবিষ্যতে ভারতীয় উপমহাদেশে যুদ্ধ করবে।

সূরা বাকারা ২:২৫৬ আয়াতে বলা হয়েছে, “ ধর্ম গ্রহণে কোনো জোরদারি নেই।” আবার আল্লাহ বলেছেন, “ তোমরা আল্লাহর পথে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করো, যারা তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে; কিন্তু সীমালঙ্ঘন করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।” (সূরা আল- বাকারা, আয়াত ১৯০)। এসব আয়াত থেকে বোঝা যায় ইসলাম যুদ্ধকে সীমিত ও প্রতিরক্ষামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে। গাজওয়াতুল হিন্দের মতো দাভাষ্য প্রচলনের মানদণ্ডে এসব নীতিগত নির্দেশনা উল্লেখযোগ্য।

থোয়বান (রাঃ) থেকে বর্ণিত আরেকটি হাদীসে এসেছে: “ রাসূল (সা.) বলেছেন: আমার উম্মতের দুটি দল আছে যাদেরকে আল্লাহ অগ্নি থেকে মুক্ত করবেন— একটি দল যারা ভারত (আল- হিন্দ) অভিযান করবে, এবং একটি দল যারা ঈসা (আ.)- এর সঙ্গে থাকবে।”
 এই হাদীসেও ভারতের যুদ্ধের কথা এবং শেষ যুগে ঈসার অবতরণের প্রসঙ্গ উল্লেখ রয়েছে।

ঐতিহাসিক ব্যাখ্যার দিক থেকে দেখলে ইবনে কাঠীর (বিধায়া ও নিহায়া) উল্লেখ করেন, মুয়াউইয়া ইবনে সুফিয়ানের আমলে (বছর ৪৪ হিজরি, খ্রিস্টাব্দ ~৭১২) মুসলিমরা সিন্ধু আক্রমণ করেন এবং পরে ৪০০ হিজরিতে মাহমুদ গজনভী ভারত বিজয় করেন। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন এই অভিযানগুলো পূর্ণাঙ্গ গাজওয়াতুল হিন্দ নয়। শায়খ সালেহ আল- মুনাজ্জিদ ও অন্যান্য আধুনিক আলেমরা সতর্ক করেছেন, যদি ঐ হাদীসগুলো সহীহই হয়, তাহলেও এ যুদ্ধটি শেষ জামানায়, ঈসা (আ.)- এর অবতরণের সময়ের কাছাকাছি হবে, মুআওয়িয়ার যুগ বা তৎকালীন আক্রমণে ঘটেনি।

এখান থেকেই সুস্পষ্টভাবে বলা যায় যে, বর্তমান ভারত- পাকিস্তানের যুদ্ধ আমাদের ” গাজওয়াতুল হিন্দ” এর কোনো প্রকার ইঙ্গিত দেয় না ধর্মমতে। কেননা এখানে ঈসা (আ.)-এর অবতরণের কথা বলা রয়েছে। তাহলে বর্তমান পাক- ভারত যুদ্ধকে আমরা কীভাবে দেখতে পারি? আসুন, এ নিয়ে কিছু আলোচনা হয়ে যাক।

২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন, এখান থেকে এই যুদ্ধের সূত্রপাত। ৬ মে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ” অপারেশন সিন্দুর” নামক অভিযান চালায়। এই ব্যাপারে পাকিস্তান প্রতিক্রিয়া হিসেবে ” অপারেশন বুনিয়ান উল মারসুস” চালায়। ১০ মে, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ভারত ও পাকিস্তান একটি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়।

যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও উত্তেজনা এখনও বিদ্যমান। তবে পহেলগামের সন্ত্রাসী হামলার বিষয়টি পাকিস্তান বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। পাকিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থ- সামাজিক অবস্থার কথা বিবেচনা করলে বলা যায়, এটি রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের কাজ নয়। কেননা ২০২২ সালে ইমরান খানের সরকার পতনের পর থেকে পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। ২০২৪-b২৫ সালে পিটিআই ও পিএমএল- এন নেতৃত্বাধীন সরকারের মধ্যে আলোচনার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, যার ফলে বিক্ষোভ ও রাজনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। পাকিস্তান বর্তমানে আইএমএফ- এর $৭ বিলিয়ন বেইলআউট প্রোগ্রামের আওতায় রয়েছে এবং সম্প্রতি $১ বিলিয়ন ঋণ ছাড় হয়েছে। এছাড়া, $১.৪ বিলিয়ন জলবায়ু সহনশীলতা ঋণও অনুমোদিত হয়েছে। তবে, ঋণের সুদের বোঝা ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ অর্থনীতির উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে। এমতাবস্থায় জনগণের সমর্থন, পাশাপাশি যুদ্ধের ব্যয় বহন করা অবাস্তবিকই বলা চলে।

পাকিস্তান বা ভারতীয় বামপন্থী ও জঙ্গি মহল কিছু সময় ধরে “ গাজওয়াতুল হিন্দ”কে জঙ্গিবাদের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করেছে। উদাহরণস্বরূপ, পাকিস্তানের জঙ্গি গোষ্ঠী (যেমন জইশ- ই- মুহাম্মদ) এই হাদীসকে হঠকারিতাভাবে ব্যবহার করে বলে প্রকাশ করেছে যে, ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলে তাদেরকে জান্নাতে সরাসরি প্রবেশাধিকার দেওয়া হবে।

তবে ভারতে ইসলামী পণ্ডিতেরা এর অপব্যবহার সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। জামিয়ত উলামা- এ- হিন্দ (ভারতের প্রখ্যাত মুসলিম ধর্মগোষ্ঠী) বারবার বলেছে যে, পাকিস্তান এই ব্যাখ্যাসূত্রকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে। জামিয়তের একটি নোটে মাওলানা সালমান মনসুরপুরী উল্লেখ করেছেন যে, নবী (সা.)- এর বাণীকে রাজনৈতিক বা সামরিক স্বার্থে ব্যবহার করা উচিত নয়।

পরিশেষে, গাজওয়াতুল হিন্দ মূলত কিছু হাদীসে বর্ণিত একটি ভবিষ্যদ্বাণীমূলক বিষয়; কোরআনে সরাসরি তা নেই। ঐতিহাসিক ঘটনা ও সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রসঙ্গ যাচাই করে দেখা যায়, এই ধারণাকে বর্তমান দিনে কখনও কখনও চরমপন্থীরা নিজেদের ইন্ধন দেওয়ার জন্য ব্যবহার করে, কিন্তু মূল ধর্মগ্রন্থের পরিপ্রেক্ষিতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি প্রযোজ্য নয়।

Facebook
Threads
LinkedIn
Telegram
X
Reddit
Email
WhatsApp

আরও লেখা সমূহ