সুপ্রিয় পাঠকমণ্ডলী, বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম হট টপিক হলো ভারত- পাকিস্তানের মধ্যকার যুদ্ধ। এরই সাথে চলে আসে একটি জিনিস, তা হলো ” গাজওয়াতুল হিন্দ”। আজকে আমরা জানবো গাজওয়াতুল হিন্দ মূলত কী? কুরআন- হাদীসে এ বিষয়ে কী বলা হয়েছে, এর কতটুকুই বা বর্তমান প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।
প্রথমেই আসি গাজওয়াতুল হিন্দ কী, এই ব্যাপারে। “ গাজওয়াতুল হিন্দ” ইসলামিক ঐতিহাসিক ও সূত্রপ্রাপ্ত ধারণা, যা বর্ণনা করে ভবিষ্যতে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমান ও অমুসলিমদের মধ্যে একটি প্রতিরোধমূলক বা পবিত্র যুদ্ধ সংঘটিত হবে। সরাসরি কোরআনে এই শব্দটি নেই, তবে বিভিন্ন হাদীসে এ বিষয়ে বাণী পাওয়া যায়। যেমন, তাওবান নামে সাহাবী বর্ণনা করেছেন: “ রাসূল (সা.) বলেছেন: আমার উম্মতের দুটি দল আছে, যাদেরকে আল্লাহ দুনিয়ার আগুন থেকে মুক্ত করবেন– একটি দল যারা হিন্দুস্থান (ভারত) এ জিহাদ করবে, আর একটি দল যারা ঈসা (আ.)- এর সঙ্গে থাকবে।” এ থেকে বোঝা যায়, মুসলিমদের মধ্যে এমন একটি দল থাকবে যারা ভবিষ্যতে ভারতীয় উপমহাদেশে যুদ্ধ করবে।
সূরা বাকারা ২:২৫৬ আয়াতে বলা হয়েছে, “ ধর্ম গ্রহণে কোনো জোরদারি নেই।” আবার আল্লাহ বলেছেন, “ তোমরা আল্লাহর পথে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করো, যারা তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে; কিন্তু সীমালঙ্ঘন করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।” (সূরা আল- বাকারা, আয়াত ১৯০)। এসব আয়াত থেকে বোঝা যায় ইসলাম যুদ্ধকে সীমিত ও প্রতিরক্ষামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে। গাজওয়াতুল হিন্দের মতো দাভাষ্য প্রচলনের মানদণ্ডে এসব নীতিগত নির্দেশনা উল্লেখযোগ্য।
থোয়বান (রাঃ) থেকে বর্ণিত আরেকটি হাদীসে এসেছে: “ রাসূল (সা.) বলেছেন: আমার উম্মতের দুটি দল আছে যাদেরকে আল্লাহ অগ্নি থেকে মুক্ত করবেন— একটি দল যারা ভারত (আল- হিন্দ) অভিযান করবে, এবং একটি দল যারা ঈসা (আ.)- এর সঙ্গে থাকবে।”
এই হাদীসেও ভারতের যুদ্ধের কথা এবং শেষ যুগে ঈসার অবতরণের প্রসঙ্গ উল্লেখ রয়েছে।
ঐতিহাসিক ব্যাখ্যার দিক থেকে দেখলে ইবনে কাঠীর (বিধায়া ও নিহায়া) উল্লেখ করেন, মুয়াউইয়া ইবনে সুফিয়ানের আমলে (বছর ৪৪ হিজরি, খ্রিস্টাব্দ ~৭১২) মুসলিমরা সিন্ধু আক্রমণ করেন এবং পরে ৪০০ হিজরিতে মাহমুদ গজনভী ভারত বিজয় করেন। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন এই অভিযানগুলো পূর্ণাঙ্গ গাজওয়াতুল হিন্দ নয়। শায়খ সালেহ আল- মুনাজ্জিদ ও অন্যান্য আধুনিক আলেমরা সতর্ক করেছেন, যদি ঐ হাদীসগুলো সহীহই হয়, তাহলেও এ যুদ্ধটি শেষ জামানায়, ঈসা (আ.)- এর অবতরণের সময়ের কাছাকাছি হবে, মুআওয়িয়ার যুগ বা তৎকালীন আক্রমণে ঘটেনি।
এখান থেকেই সুস্পষ্টভাবে বলা যায় যে, বর্তমান ভারত- পাকিস্তানের যুদ্ধ আমাদের ” গাজওয়াতুল হিন্দ” এর কোনো প্রকার ইঙ্গিত দেয় না ধর্মমতে। কেননা এখানে ঈসা (আ.)-এর অবতরণের কথা বলা রয়েছে। তাহলে বর্তমান পাক- ভারত যুদ্ধকে আমরা কীভাবে দেখতে পারি? আসুন, এ নিয়ে কিছু আলোচনা হয়ে যাক।
২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন, এখান থেকে এই যুদ্ধের সূত্রপাত। ৬ মে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ” অপারেশন সিন্দুর” নামক অভিযান চালায়। এই ব্যাপারে পাকিস্তান প্রতিক্রিয়া হিসেবে ” অপারেশন বুনিয়ান উল মারসুস” চালায়। ১০ মে, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ভারত ও পাকিস্তান একটি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়।
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও উত্তেজনা এখনও বিদ্যমান। তবে পহেলগামের সন্ত্রাসী হামলার বিষয়টি পাকিস্তান বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। পাকিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থ- সামাজিক অবস্থার কথা বিবেচনা করলে বলা যায়, এটি রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের কাজ নয়। কেননা ২০২২ সালে ইমরান খানের সরকার পতনের পর থেকে পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। ২০২৪-b২৫ সালে পিটিআই ও পিএমএল- এন নেতৃত্বাধীন সরকারের মধ্যে আলোচনার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, যার ফলে বিক্ষোভ ও রাজনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। পাকিস্তান বর্তমানে আইএমএফ- এর $৭ বিলিয়ন বেইলআউট প্রোগ্রামের আওতায় রয়েছে এবং সম্প্রতি $১ বিলিয়ন ঋণ ছাড় হয়েছে। এছাড়া, $১.৪ বিলিয়ন জলবায়ু সহনশীলতা ঋণও অনুমোদিত হয়েছে। তবে, ঋণের সুদের বোঝা ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ অর্থনীতির উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে। এমতাবস্থায় জনগণের সমর্থন, পাশাপাশি যুদ্ধের ব্যয় বহন করা অবাস্তবিকই বলা চলে।
পাকিস্তান বা ভারতীয় বামপন্থী ও জঙ্গি মহল কিছু সময় ধরে “ গাজওয়াতুল হিন্দ”কে জঙ্গিবাদের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করেছে। উদাহরণস্বরূপ, পাকিস্তানের জঙ্গি গোষ্ঠী (যেমন জইশ- ই- মুহাম্মদ) এই হাদীসকে হঠকারিতাভাবে ব্যবহার করে বলে প্রকাশ করেছে যে, ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলে তাদেরকে জান্নাতে সরাসরি প্রবেশাধিকার দেওয়া হবে।
তবে ভারতে ইসলামী পণ্ডিতেরা এর অপব্যবহার সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। জামিয়ত উলামা- এ- হিন্দ (ভারতের প্রখ্যাত মুসলিম ধর্মগোষ্ঠী) বারবার বলেছে যে, পাকিস্তান এই ব্যাখ্যাসূত্রকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে। জামিয়তের একটি নোটে মাওলানা সালমান মনসুরপুরী উল্লেখ করেছেন যে, নবী (সা.)- এর বাণীকে রাজনৈতিক বা সামরিক স্বার্থে ব্যবহার করা উচিত নয়।
পরিশেষে, গাজওয়াতুল হিন্দ মূলত কিছু হাদীসে বর্ণিত একটি ভবিষ্যদ্বাণীমূলক বিষয়; কোরআনে সরাসরি তা নেই। ঐতিহাসিক ঘটনা ও সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রসঙ্গ যাচাই করে দেখা যায়, এই ধারণাকে বর্তমান দিনে কখনও কখনও চরমপন্থীরা নিজেদের ইন্ধন দেওয়ার জন্য ব্যবহার করে, কিন্তু মূল ধর্মগ্রন্থের পরিপ্রেক্ষিতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি প্রযোজ্য নয়।
- কাজী শাফিন আলমhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a7%80-%e0%a6%b6%e0%a6%be%e0%a6%ab%e0%a6%bf%e0%a6%a8-%e0%a6%86%e0%a6%b2%e0%a6%ae/বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ১৪, ২০২৩
- কাজী শাফিন আলমhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a7%80-%e0%a6%b6%e0%a6%be%e0%a6%ab%e0%a6%bf%e0%a6%a8-%e0%a6%86%e0%a6%b2%e0%a6%ae/বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ১৪, ২০২৩
- কাজী শাফিন আলমhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a7%80-%e0%a6%b6%e0%a6%be%e0%a6%ab%e0%a6%bf%e0%a6%a8-%e0%a6%86%e0%a6%b2%e0%a6%ae/বৃহস্পতিবার, জানুয়ারি ১১, ২০২৪
- কাজী শাফিন আলমhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a7%80-%e0%a6%b6%e0%a6%be%e0%a6%ab%e0%a6%bf%e0%a6%a8-%e0%a6%86%e0%a6%b2%e0%a6%ae/সোমবার, আগস্ট ১২, ২০২৪
- কাজী শাফিন আলমhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a7%80-%e0%a6%b6%e0%a6%be%e0%a6%ab%e0%a6%bf%e0%a6%a8-%e0%a6%86%e0%a6%b2%e0%a6%ae/বৃহস্পতিবার, অক্টোবর ১০, ২০২৪