জুলাই ১০, ২০২৫

রক্তমাখা ঘুঙুর

ডিসেম্বর ছুঁইছুইঁ। শহরের আপাদমস্তক কুয়াশার সাদা পর্দায় দুলছে। মালদা স্টেশন থেকে মাইল পাঁচেক দূরে- লোকবহর নেই, উষ্ণতা নেই, আয়োজন- প্রয়োজন জীবন্মৃত সেথায়। নিয়ন বাতির ছিটেফোঁটাও নেই। বৃক্ষরাশি জমায়েত হয়েছে উত্তর থেকে দক্ষিণে। আঁধারের কালো চাদর পরিহিত হিমশীতল কুয়াশাজড়ানো ঘন জঙ্গলে জনমানবহীন এক নিস্তেজ পরিবেশ। হুতুমপেঁচা ডেকে চলেছে আকাশ ছেয়ে বেড়ে ওঠা বটগাছটার ডালে। গাছের শাখা প্রশাখায় ঘর বেঁধে বাস করা পক্ষিকুলেরাও নেতিয়ে পড়েছে তীব্র ঠান্ডায়৷ জঙ্গলের তেমাথায় দাঁড়িয়ে থাকা কামিনী গাছ থেকে উঠে আসছে ঘ্রাণ; নরকের অন্তরালে এ যেনো স্বর্গের আভাস। অমাবস্যার তীব্র অন্ধকারে অভ্রের বুকে লালিত তারাগুলোও আজ কৃষ্ণবর্ণ। পত্রপল্লবের গা বেয়ে পড়া নিরন্তর শিশির চিমচিম নীরবতায় যেন স্নান করে চলেছে। থমথমে রাতের অন্ধকারে গাড়ি থেকে নেমে এসেছে অজ্ঞাত কেউ।

হাতে বহু পুরোনো একটা টর্চ। শুকনো পাতা মুড়িয়ে ক্রমশ এগিয়ে চলেছে সে; অন্য হাতে সাদা বস্তা সমেত। ভেজা পাতার উপর চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে বস্তা থেকে গড়িয়ে আসা রক্ত। বনলতাগুলো এ দুর্ধর্ষ দৃশ্যের সাক্ষী। মৃত্যুকে দ্রুত আলিঙ্গনের সুতীব্র প্রচেষ্ঠা। হঠাৎ থেমে আসে তার গতি। ম্লান হয় চাহনি। দাতঁকপাটির আড়ালে বাকাঁ হাসি তার। জঙ্গলের মাঝে বিস্তর নির্জন শ্মশানের সামনে এক অজ্ঞাত কেউ সদ্যমৃত কোনো লাশসমেত। সুপ্রাচীন শ্মশানের যেনো দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান আজ। আরো একটা লাশ। আরো একটা শবদাহ। নির্জনতায় যেনো জেগে উঠেছে সে আজ মস্ত উল্লাসে। মানব রক্ত পান করতে যেভাবে জেগে ওঠে এক নরখাদক। অজ্ঞাত মানবের সাথে শ্মশানের এ যেনো চিরচেনা চুক্তি। জেগে উঠেছে সে আজ আরো একটা লাশের অনন্ত পতনের অপেক্ষায়। মরা শ্মশান চরম তৃপ্তিময় আহারে যেনো বহুদিনের যন্ত্রণার অবসান খুজেঁ পাবে। অন্যদিকে চিতায় চড়ে লাশটি অপেক্ষা করছে আজ শ্মশানের জারক রসে পরিণত হওয়ার। যষ্ঠীহাতে আগুন নিয়ে অপেক্ষারত অজ্ঞাত ব্যক্তির লেলিহান অগ্নিশিখার বিস্ফোরণে কালস্রোতের প্রবাহে মুহূর্তেই ধ্বংস হতে থাকে লাশটির দৃঢ় শরীর। শ্মশান যেনো তার রক্তমাংসে তিলে তিলে গড়া শরীরের ভগ্নাবশেষ চেটেপুটে খাচ্ছে। কালো ধোঁয়ায় অমাবস্যার অন্ধকার মিশে একাকার। আগুনের স্ফুলিঙ্গে স্পষ্ট হয়ে ওঠে অজ্ঞাত ব্যক্তির হাতের সাবেকি বালাখানা। এক জোড়া ডাগর চোখে তার দীঘল কাজল রেখা। যেখানে কোনো শোক বা দুঃখস্রোত নেই। কেবল প্রতিশোধের তীব্র স্পৃহা। পেছন ফিরে আসার সময় হঠাৎ বড় কোনো ঢিবির সাথে ধাক্কায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে। ভাঙা টর্চের টুকরায় বিঁধে যায় তার পা। ভাঙা টর্চখানা হাতে নিয়ে জঙ্গলের চারিপাশ মাতাল করে টগবগিয়ে চলে যায় সে। জঙ্গলের ক্ষয়ে যাওয়া আঁধারে পড়ে থাকে তার ভাঙা টর্চের টুকরা আর তার তড়িঘড়িতে ফেলে যাওয়া রক্তাক্ত ঘুঙুর।

২২ শে ফাল্গুন ১৪০৫ বঙ্গাব্দ

তীব্র নিদ্রায় আচ্ছন্ন অকিলেশ। রাত ১২ ছুঁইছুইঁ। তৎক্ষনাৎ ফোন বেজে ওঠে তার। ফোনের ওপাশ থেকে একটা গদগদ কন্ঠ। ক্রোধে বলতে থাকে অকিলেশ, ” কি রগু! তোমায় না বলেছি রাতের বেলা কাছারির ঝামেলায় জড়াবে না আমায়!”
” কর্তাবাবু, খবর এসেছে। জঙ্গলে মাওয়ালরা নাকি একটা রক্তমাখা বস্তা পেয়েছে। বড়সাহেব আপনাকে কেসটা হ্যান্ডেল করতে বলেছেন। আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছেন তিনি।”
নিমিষেই মলিন হয়ে যায় তার মুখ। ফোন কেটে দিয়ে বলতে থাকে, ” এখন এ রাত- বিরাতে কার না কার রক্ত নিয়ে আমায় গবেষণা করতে হবে। যত্তসব উটকো ঝামেলা।”

রক্ত পরখ করে চলছে অকিলেশ। বস্তার মোড়কে আটকে থাকা সাদা কাপড়ের আধখান টুকরা অক্ষির অগোচর হয়নি তার। “ বুঝেছো রগু, এটা কোনো জন্তু জানোয়ারের কাজ নয়। নাহলে বস্তাসমেত রক্ত থাকার কথা নাহ। এতে নিশ্চয় রহস্য আছে, কি বলো? এ মিস্ট্রি, ডেফিনেটলি মিস্ট্রি” বুলি আওড়াতে আওড়াতে দিয়াশলাই জ্বালিয়ে আনমনে কি যেনো ভাবতে শুরু করলো অকিলেশ …

প্রিয় পাঠক পরবর্তী পর্বের জন্য অপেক্ষা করুন।

0512 Faria writers photo
শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Facebook
Threads
LinkedIn
Telegram
X
Reddit
Email
WhatsApp