কবিরা বাল্যকাল থেকেই জেদি, খামখেয়ালি আর স্বতন্ত্র-পরায়ণ হয়। সেইজন্যই কবিতা অনন্ত-স্বাধীন। কিন্তু অসীমকে সীমা দিয়ে ঘেরার একটা চেষ্টা মনুষ্য জাতির মধ্যে সবসময়েই রয়েছে। এইরূপ চেষ্টাই সভ্যতার লক্ষণ হিসেবে গণ্য । যা অসীম, যা অনন্ত তা মানুষের সহ্য হয় না। এজন্যই কবিতায় এত ছন্দের বাঁধন। প্যালিনড্রোম আর অ্যাক্রস্টিক বাংলা সাহিত্যের তেমনই সংযোজন। রবীন্দ্রনাথ এটাকে কেবলই বাইরের বাঁধন কিন্তু অন্তরের মুক্তি বলে বিবেচনা করেছেন।
‘বিনয়ী নবী’ ‘
রাধা নাচে অচেনা ধারা’
‘কবে বিবেক, তগ্র জাগ্রত’
এই লেখাগুলোর একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। প্রতিটা পঙক্তি উল্টো করে পড়ুন, একই থাকবে। এমন করে- কোনো শব্দ, বাক্য, লেখা কিংবা সংখ্যা যদি এমন হয় যে উল্টো দিক থেকে পড়লেও একই থাকে তখন সেটাকে বলে প্যালিনড্রোম। অসাধারণ না বিষয়টি?
প্যালিনড্রোম একটা ইংরেজি শব্দ, এসেছে গ্রিক Palindromos থেকে, যার মানে ‘উল্টো দিকে দৌড়ানো’। বাংলায় একে বলা যেতে পারে উভমুখী-সম। প্যালিনড্রোম শব্দের একটা উদাহরণ ‘জলজ’ উলটো সোজা যেভাবেই পড়া হোক একই থাকে। এমন আরও উদাহরণ হতে পারে ‘তরঙ্গরত’, ‘নবীন’ ইত্যাদি। প্যালিনড্রোম বাক্যের উদাহরণ হতে পারে – ‘ সে হেসে হেসে’, ‘কেউ কাজে খোঁজে কাউকে’ ইত্যাদি।
বাংলাতে প্যালিনড্রোম এর প্রচার তেমন একটা হয় নি। সব থেকে বিখ্যাত প্যালিনড্রোম শব্দ-বন্ধ ‘রমাকান্ত কামার’। আর বাংলা প্যালিনড্রোম নিয়ে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন সম্ভবত শরৎচন্দ্র পণ্ডিত (১৮৮১ – ১৯৬৮), যিনি দাদাঠাকুর নামেই বেশি পরিচিত। দাদাঠাকুরের সম্পাদনা করা ‘বিদূষক’ পত্রিকায় তিনি নিজেই অনেক বাংলা প্যালিনড্রোম বাক্য তৈরি করেছেন। ‘মার কথা থাক রমা, রমা তো মামা তোমার, চার সের চা, থাক রবি কবির কথা – এমন কিছু দারুণ বাক্য আমরা তার থেকে পেয়েছি। তার বিখ্যাত প্যালিনড্রোম লাইন ছিল এমন- কীর্তন মঞ্চ ‘পরে পঞ্চম নর্তকী। প্যালিনড্রোম শব্দ-যুগল বলতে বোঝায় এমন দুটো শব্দ, যাদেরকে পাশাপাশি বসানোর পর উলটো করে পড়লেও একই থাকে।
যেমন: ‘কার তারকা’, ‘সে হাসে’, ‘কে আঁকে’, ‘মেঘে ঘেমে’, ‘নীলিমা মালিনী’, ‘কথা থাক’, ‘মিতু তুমি’, ‘কোথায় থাকো’, ‘কেউ কাউকে’, ‘সহসা সাহস’ ইত্যাদি। এমন শব্দ-যুগল আছে প্রচুর। এরা দুটো আলাদা শব্দ। দুটো মিলে কোনো একটা অর্থ তৈরি হতেও পারে, নাও পারে। প্যালিনড্রোম শব্দ তৈরি অতি সহজ নয়, এজন্য শব্দ জানতে হবে, চর্চা করতে হবে।
বাংলাতে প্যালিনড্রোম নিয়ে প্রথম বই লিখেছেন শ্রদ্ধেয় ফরিদ-উদ্দিন । ‘কথা-থাক’ নামের বইটি পুরোটা প্যালিনড্রোম কবিতা/ অণু-কাব্য নিয়ে সাজানো। তিনি বুয়েটে দাপ্তরিক কাজে কর্মরত । আমজনতার মাঝে প্যালিনড্রোমকে পৌঁছিয়ে দিতে তিনি ফেসবুকে গ্রুপ খুলেছেন “প্যালিন্ড্রোম প্রচার পর্ষদ” নামে। এই গ্রুপে তিমি প্রচুর সাড়াও পাচ্ছেন। সাধারণ মানুষ আগ্রহী হয়ে নিজেরাই খুঁজে খুঁজে প্যালিনড্রোম শব্দ-বাক্য এমনকি কবিতাও লিখছেন।
বাংলা সাহিত্যে সর্ব প্রথম অ্যাক্রস্টিক লিখেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। যে কবিতার প্রত্যেক লাইনের প্রথম অক্ষর মিলে কোন নাম বা অর্থপূর্ণ বাক্য হবে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার প্রিয় বন্ধু গৌর দাস বসাক এর নামে প্রথম অ্যাক্রস্টিক লিখেন।
”গম্ভীর গর্জন সদা জলধর
উথলিল নদ নদী ধরণী উপর
রমণী রমণ লয়ে সুখে কেলি করে
দানবাদি দেব যক্ষ সুখিত অন্তরে
সমীরণ ঘন ঘন ঝন ঝন রব
বরুণ প্রবল দেখি প্রবল প্রবল প্রবল প্রতাপ
সাধীন হইয়া পাছে পরাধীন হয়
কলহ করয়ে কোনো মতে শান্ত নয়।।”
উপরের কবিতাটির প্রত্যেক লাইনের প্রথম অক্ষর জুড়ে দেখা যায় “গউর দাস বসাক”। কিন্তু এটা কবির বন্ধুকে নিয়ে লেখা নয়, বর্ষাকাল নিয়ে লেখা। এটাও অ্যাক্রস্টিক।
যদিও অ্যাক্রস্টিক নিয়ে নতুন করে চর্চার অভাবে দিনকে দিন হারিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, অনেক সাহিত্য প্রেমিকেরও অ্যাক্রস্টিক সম্পর্কে ধারণা নেই বললেই চলে; যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
তবে সবগুলো সাহিত্য-মানে পৌছতে না পারলেও শ্রদ্ধেয় ফরিদ উদ্দীনের প্রচেষ্টায় প্যালিনড্রোম জগতের ভাণ্ডারে জোয়ারে এসেছে; ধীরে ধীরে এগুলোর রূপ-রস ছুঁয়ে যাচ্ছে সকলের মাঝে। এভাবে সাহিত্য প্রেমিকরা চর্চা অব্যাহত রাখলে বাংলা সাহিত্যের চূড়ায় প্যালিনড্রোম আর অ্যাক্রস্টিক তাদের স্থান সুদৃঢ় করে নিতে সক্ষম হবে ।
- আসিফ আব্দুল্লাহhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%86%e0%a6%b8%e0%a6%bf%e0%a6%ab-%e0%a6%86%e0%a6%ac%e0%a7%8d%e0%a6%a6%e0%a7%81%e0%a6%b2%e0%a7%8d%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%b9/শনিবার, ডিসেম্বর ১২, ২০২০