fbpx

সীমানা পেরিয়ে (দ্বিতীয় পর্ব)

প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

কারও চোখে ঘুম নেই। পাহাড় কাটা রাস্তা। ইউটিউবে আজ পর্যন্ত কত ভিডিও দেখেছি তার হিসেব ইউটিউবই জানে। আজকে এই রাস্তায় আমরা যাচ্ছি। কার মাথায় কী প্ল্যান ছিল, সব উধাও। আমাদের দৃষ্টি শুধুই পাহাড়ের দিকে। যেই পাহাড়ই চোখে পড়ে, ‘ছবি তোল’ ‘ঐ যে, ঐটা’। একমুহুর্ত নিস্তার নেই। প্রত্যেকটা পাহাড়ই সুন্দর, আলাদা। আবার সব একরকম। আমরা এগোচ্ছি আর রাস্তা দুর্গম হচ্ছে। অনেক জায়গায় মেইন্টেনেন্স এর কাজ হচ্ছে, নতুন রাস্তা হচ্ছে। একটা টানেল পড়লো। কত কিলোমিটার যেন লম্বা, মনে নেই। অনিল পাজী বলেছিল। কিন্তু আমাদের এসব তথ্যে কিছু যায় আসে না। আমরা আগে চোখের ক্ষুধা মেটাচ্ছি। যারা কাশ্মীর গিয়েছেন, তাদের কাছে হয়তো মানালি আহামরি লাগবে না। তবে সাজেকের স্কেলে তুলনা করলে, মানালির কোন তুলনা নাই। আর আমরা যে সময়টাতে এসেছি, তখন মোটামুটি বর্ষাকাল। পাহাড়গুলো সবুজ। এই মৌসুমটা এখানে অফপীক সীজন। আমরা মানালিতে এই সময় কোন বরফ দেখতে পাবো না। কিন্তু বরফ না দেখে আমরা যাবও না।

Picture 27

গাড়ি চলতে চলতে একটা সময় আমরা খুব খাড়া উঠতে শুরু করলাম। আমাদের তখনও আইডিয়া ছিল না যে আমরা ঠিক কোথায় যাচ্ছি। একটা আপেল বাগানের পাশ দিয়ে এসে ছোট একটা মাঠের মত জায়গা। আমরা এসেছি প্যারাগ্লাইডিং করতে, কুল্লুতে। বাইরে দিয়ে ভয় দেখাইনি, ইজ্জতের প্রশ্ন। কিন্তু ভেতরে গলা শুকিয়ে গিয়েছিলো। যারা প্যারাগ্লাইডিং করাবে তাদের দেখে খুব একটা কনফিডেন্স পেলাম না। নাসরাতকে বললাম, ভাই তোরা কর। আমি আছি। কিছু একটা হলে বডিগুলো তো দেশে নিয়ে যেতে হবে। তো নাসরাত দামাদামি করছিলো। হঠাৎ মনে হল, ধুর কী আছে জীবনে, যা থাকে কপালে। আরেকটা গাড়িতে করে আমরা তিনজন আরেকটা পাহাড়ের উপরে উঠে গেলাম। পেটের ভেতরে সব যেন ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত অনুভূতি।

তিন জন রেডি। কাঁধে ভারি জিনিসপত্র নিলাম। যতই ভয় পাই, প্রথমে আমিই লাফ দিবো। কিন্তু লাফ দেয়ার জন্য পায়ে যতটুকু জোর লাগে সেটা পাচ্ছি না। আমার পেছনে যে গ্লাইডার, সে একা দৌড় দিলে হবেনা। আমাকেই আগে দৌড় দিতে হবে। কিন্তু আমার পুরো শরীর তখন প্রায় অবশ হয়ে আছে। অন্য দুই গ্লাইডার আমাকে হ্যাচকা টান দিয়ে পাহাড় থেকে ফেলে দিলেন। যেহেতু আমি দৌড় দিতে পারিনি, তাই কিছু সেকেন্ড ফ্রি-ফল হয়েছে, যেটা সচরাচর হয়না। প্যারাশুটে যখন বাতাস লেগেছে, তখন আমি আর আমার গ্লাইডার স্টেবল। ওয়েটলেস একটা অনুভূতি। বিশাল বিশাল পাহাড় আমার নিচে। নিচে পাহাড়ি নদী ‘বিয়াস নদী ‘। একদম সোজা নিচের দিকে তাকাতে পারছিনা। মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে। ভয় কাটানোর জন্য গ্লাইডারের সাথে কথা বলা শুরু করলাম। চিৎকার করলাম। আর নাসরাত পুরো ভিডিওতে শুধু বলছিল “অনেক বাতাস, অনেক বাতাস।” ১ মিনিটের ভেতরেই অবশ্য পরিস্থিতি মানিয়ে নিয়েছিলাম। এনজয় করছিলাম। তখন ভাবছিলাম যে এই কিছুক্ষণ আগে ভয়ে এটা করতে চাচ্ছিলাম না। প্রায় ৬ মিনিটের মত উড়েছি। নামার আগে দেখলাম রাকিব ভাইও উড়াল দিয়েছে। স্বাভাবিক ল্যান্ডিং হল। চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়েছিলাম কিছুক্ষণ। ভয় না পেয়ে কিছু করার চেয়ে, ভয় পেয়ে করতে পারার এক্সাইটমেন্ট বেশি। অন্যদের ছবি তুললাম। তিনজন একসাথে কিছুক্ষণ লাফালাম। সবকিছু এখন পেছনে। আপাতত এই মুহূর্তটা আমাদের। শুধুমাত্র এই মুহূর্তগুলোর জন্যেই আবার যেতে হবে। আবার যেতে হবে। না হয় পেলাম কিছুটা ভয়।

আমরা সকালের নাস্তা করিনি। এদিকে দুপুর হয়ে যাচ্ছে। আমরা প্ল্যান করলাম একবারে মানালি যেয়ে খাবো। মানালি তখনো ২-৩ ঘণ্টার রাস্তা। রোদ উঁকি দিয়েছে। পাহাড়গুলো আরও স্পষ্ট হয়ে জেগে উঠেছে। অনিল পাজী একটা শালের দোকানের সামনে থামলেন। আমরা শাল কিনলাম। এক দোকানদার বাংলা জানে। কেন জানে জিজ্ঞেস করাতে বললো কাস্টমার হ্যান্ডেল করতে ইজি হয়। ভালো লাগলো ব্যাপারটা। এমনিতেই আমাদের ব্যাগ ফুল, তার ওপর গাড়ি ভর্তি করে আমরা শাল কিনেছি। রাকিব ভাই তো মোটামুটি দোকান খুলতে পারতেন।

মানালি পৌঁছাতে আমদের বিকেল হয়ে গেলো। মানালি মল রোডের পাশেই। আমরা আগে বুঝতে পারিনি যে অনিল পাজী এমন হোটেলে নিয়ে যেতেন, যেখান থেকে উনি কমিশন পেতেন। এবার আমরা আর তার কথা শুনিনি। নিজেদের মত ঠিক করলাম। অফপীক সীজন। মাত্র ৭০০ রূপিতে একটা রুম। ভাবা যায় ? অথচ সীজনে এসব রুম খালিই থাকেনা। আমরা ফ্রেশ হলাম। এখানকার আবহাওয়া খুবই অন্যরকম। আলগা একটা ঠান্ডা। খালি গায়েও থাকা যায়, আবার জ্যাকেট পরে থাকলেও আরাম লাগে। রাকিব ভাই ঘুমাবেন।

উনাকে ঘুম পাড়িয়ে আমি আর নাসরাত বের হয়েছি। মল রোড। প্রেমে পড়ে গেলাম এই মল রোডের। দুই পাশে এত সুন্দর সুন্দর দোকান যে ভাবা যায়না। এই মল রোডটা আমরা চক্কর দিয়েছি প্রায় কয়েকবার। নাসরাত আর আমি ভাবছিলাম যে এখানে একটা দোকান দিয়ে থেকে যাওয়া যায় কি না। রাকিব ভাই ঘুম শেষে আমাদের সাথে যোগ দিলেন। এই সিনিয়র ভদ্রলোকটাকে রাগিয়ে বেশ মজা আছে। অল্পতেই মারাত্মক রেগে যায়। আর শিশুসুলভ হওয়ায় কিছু পাম-পট্টি দিলে আবার ঠিক হয়ে যান। মানালিতে আমরা ডলারের বেশ ভালো রেট পেয়েছি। সবাই ডলার ভাঙিয়ে নিলাম। আমি নাসরাতের কাছ থেকে ধারও করেছি। ইন্ডিয়ার চকলেট টেস্টি।

Picture 34

অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। ডিনার করতে হবে। আমরা আগের খাবারগুলোর পুনরাবৃত্তি চাইনা। ইন্ডিয়ার মত বাজে খাবার জীবনেও খাইনি। এবার আমরা বিরিয়ানি খুঁজছিলাম। খুব সুন্দর একটা রেস্টুরেন্টে বৃষ্টি দেখতে দেখতে রাতের খাবার খেয়েছি আমরা। এই মল রোডের লাইটিং চোখ জুড়ানো। খুবই পরিষ্কার এবং সেইফ ফর ট্যুরিস্টস। রাত ১২টার দিকে যখন সব দোকান-পাট বন্ধ, তখনও আমরা এই রাস্তায় ঘুরছিলাম। ইন্ডিয়ার ট্যুরিস্ট প্লেসগুলোতে মল রোডগুলো সব অসাধারণ। সময় কেটে যায়।

আমরা যখন হোটেলে ফিরবো তখন বৃষ্টি হচ্ছে ঝুম। আমরা তিনজন দিলাম দৌড়। কালকে বরফ দেখতে হবে। মানালিতে শীতের মৌসুমে ভরপুর বরফ থাকে। এই বর্ষাকালে এখানে বরফ নেই। তবে মূল আকর্ষণ হলো রোহতাং পাস। ১৫ হাজার ফিট ওপরে। ওখানে নাকি বরফ আছে। আমরা আগামীকাল রোহতাং পাস যাচ্ছি।

রোহতাং পাস, বরফ আর সোলাং ভ্যালী
৫ম পর্ব (অগাস্ট ১৪, ২০১৯)

এই ট্যুরে আজকের দিনটা নিয়ে আমাদের খুবই উৎসাহ। প্রথমে আমাদের প্ল্যান ছিলো কাশ্মীরে যাবার। কাশ্মীরে যেতে পারলে বরফ দেখা যেত খুব সহজেই। কিন্তু এই মৌসুমে মানালিতে বরফ থাকেনা। তাই আমাদের প্ল্যান মোতাবেক রোহতাং পাস যাওয়া। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মোটামুটি ১৩ হাজার ফিট ওপরে। । মানালি থেকে প্রায় ৫০-৫৫ কি.মি. দূরে এর অবস্থান, প্রায় ৪ ঘণ্টা লাগে। মানালি থেকে গেলে পুরো রাস্তাটাই বিভিন্ন পাহাড় ঘেঁষে যেতে হয়। বছরে দুই মাস নাকি এই রাস্তা খোলা থাকে। আমরা সেই সময়েই যাচ্ছি। আর বাকি সময় বরফে ঢাকা থাকে।

রোহতাং পাস যেতে হলে আগে থেকে পারমিট নিতে হয় ‘হিমাচল ট্যুরিজম এবং কুল্লু ডিস্ট্রিক্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ থেকে। মানালি থেকেই নেয়া যায়। অনিল পাজী আমাদের জন্য আগেই পারমিট নিয়ে রেখেছিলেন। আমরা ভোরে উঠে গিয়েছি। ব্যাগ-পত্র গুছিয়ে ৯টার দিকে হোটেল থেকে আমরা চেকআউট করবো। কারন রোহতাং পাস ঘুরে এসে আজ রাতেই আমাদের জার্নি শুরু হবে, শিমলার দিকে রওনা হবো। সারা রাতের জার্নি। অনিল পাজী গত কিছুদিন অল্প ঘুমিয়ে গাড়ি চালিয়েছেন। গতকাল আমরা যখন মানালি ঘুরেছি, উনি সারাদিন ঘুমিয়েছেন। কিন্তু উনি চাইলেও ঘুমাতে পারেন না। উনার দুইটা বউ। একজন দিল্লীতে, আরেকজন মরিশাসে। হ্যাঁ, মরিশাসে। দিল্লী থেকে মানালি আসার সময় তার মুখ থেকে এই গল্প শুনেছি। গল্প শুনে আমার ভালই ঘুম কেটে গিয়েছিলো। তিনজনের মধ্যে আমার হিন্দির উপর দখল ভালো ছিলো। পাজীর সাথে অনেক গল্প করেছি রাস্তায় আর পান মশলা খেয়েছি। কিচ্ছু করার নেই। সজাগ থাকতে হবে।

প্রতিবেলার খাবারটা আমাদের জন্য একটা টেনশনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছু হলেই ভেজ আর নন-ভেজ। নন-ভেজ তো সচরাচর পাচ্ছিনা কোথাও। আর ভেজ এর কথা মনে হলে এখনো মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। ইন্ডিয়াতে ভেজ মানেই শিমের বিচির ঝোল, পনির দিয়ে মটর। এগুলো খেয়ে এত বড় একটা জাতি টিকে আছে কীভাবে? আমরা প্রচুর চকলেট নিয়ে রেখেছি সাথে। ডাল-ভাত-মাংস-সবজিকে মিস করছি ক্ষণে ক্ষণে। আমাদের ব্যাগ গোছানো শেষ। সকালের নাস্তা করতে হবে। বাইরে যেতে মন চাচ্ছে না। আমরা যেই হোটেলে উঠেছি তার বারান্দার ভিউটা অসাধারণ। একদিকে পাহাড়, সেখানে মেঘের খেলা হচ্ছে। আরেকদিকে দেবদারু আর পাইন গাছের সারি। আমরা রুম সার্ভিস থেকে পরোটা-ডিমভাজি আর চা আনিয়ে নিলাম। বারান্দায় পায়ের ওপর পা তুলে চা খেয়েছি। এসব ঘোরাঘুরির সবচেয়ে বড় উপাদান হলো লাইক মাইন্ডেড পিপল। এবং আমাদের তিনজনের প্যাক্টটা অসাধারণ। সকালের এই নাস্তার কথা মনে থাকবে অনেকদিন।

আমরা রওনা হয়ে গিয়েছি। সবাই খুব ফুরফুরা মেজাজে। বিয়াস নদীর পাশ দিয়ে যাত্রা শুরু। গতকাল বৃষ্টি হওয়ায় নদীতে আজকে বেশ স্রোত। রোহতাং পাস যেতে আমাদের মোটামুটি ৪ ঘণ্টা লাগবে, অর্থাৎ মাত্র ৫৫ কি.মি. যেতে। মানালি মল রোড পার হয়ে অল্প পরেই আমরা এক জায়গায় থামলাম। এখানে এক দোকান থেকে আমরা বরফে ঘোরার পোশাক নিয়ে নিয়েছি। হাতমোজা আর পা-মোজা একদম কিনে নিতে হয়। আর বাকিটা ভাড়া। ফেরার সময় ফেরত দিয়ে যেতে হবে। আমরা জ্যাকেটের ওপরেই পরে নিলাম।

পাহাড় ঘেঁষা রাস্তায় আমাদের গাড়ি চলতে শুরু করল। ‘কৃশ’ সিনেমার শ্যুটিং যেখানে হয়েছিলো, সেই জায়গাটা দেখলাম দূর থেকে। বর্ষাকাল হওয়ায় কোন বরফ নেই এসব রাস্তায়। অথচ শীতের মৌসুমে সবকিছু বরফে ঢাকা থাকে। কিন্তু আমরা দেখছি সবুজ। একে তো বিশাল বিশাল পাহাড়, সৃষ্টিকর্তা সেগুলো সবুজ রঙে ঢেকে দিয়েছেন, অপরূপ। যখনই আমরা পাহাড়ের দেশে এসেছি, আমরা তিনজন একটা বিষয় খেয়াল করেছি যে এই জায়গাগুলোর যেসব ছবি আমরা তুলছি, তাতে সৌন্দর্য পুরোটা ধরতে পারছে না। আমরা তিনজনই এই বিশ্বাসে উপনীত হলাম যে আল্লাহ্‌ আমাদের যে চোখ দিয়েছেন, একমাত্র সে চোখ দিয়েই এই সৌন্দর্যের পুরোটা অবগাহন করা সম্ভব। মানুষের বানানো ক্যামেরা সেটা পারবে না, এটাই স্বাভাবিক। এরপর থেকে আমরা ক্যামেরার পেছনে খুব বেশি সময় দেই নি।

Picture 35

রাস্তাগুলো এমন যে আপনি গাড়ির যে পাশেই বসেন, সবকিছু দেখতে পাবেন। তাই আমাদের মধ্যে কোন ঝগড়া-ফ্যাসাদ হয়নি। কিছু পয়েন্টে আমরা দাঁড়িয়ে ছবিও তুলে নিচ্ছি। অনেকক্ষণ চলার পর, যে জায়গায় এসেছি, জায়গাটা পরিচিত লাগছিলো। রাইট, ‘3 Idiots’ মুভির একটা সিন এখানেও ছিল। জায়গাটা একটা বাঁধের মত। নদীর পানি এখানে জমা হয়। বলা চলে পাহাড়ের পাদদেশে যাদের বসতি, তাদের পানির রিজার্ভের। এখান থেকে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে পানির লাইন চলে গিয়েছে নিচে। খুবই সুন্দর আইডিয়া। কিছু পানি খাওয়ার জন্য আমরা পানিতে হাত দিয়ে ঠান্ডায় জমেছিলাম ২ মিনিট। বরফও এত ঠান্ডা হয় না।

পুরো রাস্তা জুড়ে মেঘের ভেতর দিয়ে আমরা যাচ্ছি। হঠাৎ করেই চারপাশ সাদা মেঘে অন্ধকার হয়ে যায়, আবার মেঘ চলে যায়। এই মেঘের অন্ধকার সাদা রঙের, এই অন্ধকারে আলো থাকে। মেঘ ভেদ করে আর পাহাড় বেয়ে চলতে চলতে আমরা মাঝখানে এক জায়গায় থেমেছি খাবারের জন্য। এখানে অনেক দোকান আছে। আমরা পাউরুটি-ডিমভাজি খেয়েছি। অনিল পাজী সকালের নাস্তা করছেন এখানে। উনি একবারের খাবারে প্রায় ৮-১০টা বিশালাকার রুটি খেয়ে ফেলেন।

রোহতাং পাস পৌঁছাতে ১টা বেজে গিয়েছে।  প্রচণ্ড বৃষ্টি। আমরা একটা ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে ম্যাগি নুডুলস খেলাম। কী জঘন্য খাবার! ভালো নুডুলসের প্যাকেটগুলো দিয়ে এরকম বাজে খাবার কেন রান্না করছে জানি না। আমরা কেউই শেষ করতে পারি নি। এখানে অনেক ঘোড়া আছে। আরামে যেতে চাইলে ঘোড়ায় চড়ে যেতে হয়। আমি চেয়েছিলাম, কিন্তু নাসরাত আর রাকিব ভাই পাত্তা দেন নি। লোকজন বললো যেখানে বরফ, সেখানে যেতে হাঁটতে হবে আরও আধা ঘণ্টা। নাসরাতকে বললাম, চল, চলে যাই। ঝাড়ি খেয়েছি, আর কিছু বলার সাহস পাই নি। হেঁটে হেঁটে রওনা হয়েছি। অসম্ভব কাদা আর ঘোড়ার  মল। বুট ভাড়া করেছিলাম দেখে সমস্যা হয়নি।

 এতটাই বৃষ্টি যে সামনে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। এক লোক ভুট্টা ভাঁজছিলেন। তার ছাতার নিচে আশ্রয় নিয়েছিলাম। মজার কথা হল আমরা যে পোশাক ভাড়া করেছি, সেগুলো স্বাভাবিক স্নো-ফলের জন্য। এই অস্বাভাবিক বৃষ্টিতে কোথায় যে ঠান্ডা পানি চলে যাচ্ছে আমরা টের পাচ্ছি। আর পানি কতটা ঠান্ডা সেটা নিয়ে বলার কিছু নেই। বৃষ্টি কিছুক্ষণ পরেই থেমে গেলো। ঐ দূরে একটা পাহাড়ে সাদা বরফ দেখা যাচ্ছে। আমাদের চলার গতি বেড়ে গেলো।

Picture 38

বরফ দেখলাম,বরফ। জীবনে প্রথম। অসাধারণ অনুভূতি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে অনুভব করলাম। নাসরাত আর রাকিব ভাই খুব চিল টাইপের মানুষ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমার হঠাৎ চুপ হয়ে যাওয়া দেখে ভাবেন আমি তাদের কাজে বিরক্ত কি না। ব্যাপারটা মোটেও তা না। আমার ন্যাচারটাই এরকম। হঠাৎ হঠাৎ মন নিয়ে আমি উধাও হয়ে যাই।

আমরা এখন যেখানে আছি, শীতের সময় এখানে কোনভাবেই আসা যায়না। শীতে বরফ মানালিতেই থাকে। সব জায়গায় স্নো-ফল হয়। রেগুলার স্নো-ফলের কারনে, বরফ পরিষ্কার এবং ধবধবে সাদা থাকে। এখন যেহেতু বর্ষাকাল, এখন এখানে স্নো-ফল হয় না। যার ফলে এখানে যে বরফ আছে, সেটা অনেক পুরোনো। এই পুরোনো বরফে মানুষ আসতে আসতে অস্বাভাবিক রকমের নোংরা হয়ে গেছে বরফ। মানুষের পায়ের কাদা আর ঘোড়ার মল। রোদ উঠে গেছে। ভয়ানক ঠান্ডাটা এখন আর নেই। দূরে সাদা মাথাওয়ালা পাহাড়গুলো দেখা যাচ্ছে। অসাধারণ দৃশ্য। ক্যামেরা ঠিক ধরতে পারছে না। কিছু ইন্ডিয়ানদের সাথে কথা হলো। তামিল এবং পাঞ্জাবি। একটা বাঙালি পরিবারের সাথেও দেখা হলো। ভদ্রলোক ঢাকা ব্যাংকে চাকরি করেন।

Picture 39

বরফ দেখা আপাতত হয়ে গেলো। তবে এই নোংরা বরফ দেখে কাশ্মীর যাওয়ার ইচ্ছাটা আরও প্রবল হয়েছে আমাদের। আমাদের গাড়ি খুঁজছি। এখানে মোবাইলের নেটওয়ার্ক নেই। অনেক খুঁজে অনিল পাজীর গাড়িতে ফেরত আসলাম আমরা। আলখাল্লা খুলে ফেললাম। এখন টের পেলাম ঠান্ডা কাকে বলে, কত প্রকার ও কী কী। জানালার গ্লাস বন্ধ করে আনুমানিক ৩টার পরে আমরা মানালি ফেরত যাচ্ছি। সুন্দর একটা স্পটে আমরা অনেক ছবিও তুলেছি। সোলাং ভ্যালি যাবো।

Picture 40

রাকিব ভাই এর জোরাজুরি। উনি সোলাং ভ্যালিতে ক্যাবল কারে উঠবেন। এখানে এখন ট্যুরিজমের সিজন না। তাই সব বন্ধ। তবে সোলাং ভ্যালি খুবই সুন্দর। ভ্যালি মানে হচ্ছে দুই পাহাড়ের মাঝের সমতল জায়গা। তখন জানতাম না। পরে গুগল থেকে জেনেছি। শীতের সময়ে সবকিছু বরফে ঢাকা থাকে। এখন আমরা যেখানেই তাকাচ্ছি, শুধু সবুজ আর সবুজ। সবুজ মন ভালো করে দেয়।

Picture 41

আমরা আবার মানালি ফিরে এসেছি। আনুমানিক ৭–৮টা বাজে। এখানে ডিনার করে কিছুটা সময় কাটিয়ে আমরা শিমলার পথে রওনা হবো ১০টার মধ্যেই। শিমলা এখান থেকে প্রায় ২৫০ কি.মি.। পাহাড়ি রাস্তায় কম করে হলেও ১০ ঘণ্টা লাগবে, মানে সারারাত। হয়ত ভোরে শিমলায় পৌঁছে যেতে পারবো।

শিমলা: কুফরি আর মলরোড
৬ষ্ঠ পর্ব (অগাস্ট ১৫, ২০১৯)

শিমলা, হিমাচল প্রদেশের রাজধানী। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা ৭ হাজার ফিটের কিছু বেশি। ৮ লাখের মত মানুষের বসবাস শিমলার ২৫ বর্গ কি.মি. এলাকায়। পুরোটাই পাহাড়ের ওপর। পাহাড়ের ওপরে এবং গা ঘেঁষে বসতি স্থাপন করা হয়েছে। আমার চোখে শিমলার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো এর নির্মলতা।

মানালি থেকে শিমলার পথে আমরা রওনা হই আনুমানিক রাত ১০টার দিকে। একটানা চালালে কম করে হলেও ৮টা বাজবে পৌঁছাতে। এই রাস্তা পুরোটাই পাহাড়ি। অনিল পাজী ভালোই চালাচ্ছেন। আমি যখন সামনে বসেছি তখন শেষরাত। মেঘের ভেতর থেকে কিছুক্ষণ পরপর চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। মোহময় পরিবেশ। প্রচণ্ড শব্দে গান বাজছে। এই শব্দ আমার দুই ভ্রমণ সঙ্গীর ঘুমকে ব্যাঘাত ঘটায় না। তারা ভাবলেশহীন ভাবে ঘুমিয়ে যাচ্ছেন। রোহতাং পাসে যথেষ্ট ধকল গিয়েছে। সামনের সিটে বসে চোখ ঘুমে জড়িয়ে যাচ্ছে আমার। আমি ঘুমিয়ে গেলে হয়ত কোনো জরিমানা নেই। কিন্তু ভয় পেয়েছি তখন, যখন দেখলাম অনিল পাজীর চোখ ঘুমে জড়িয়ে যাচ্ছে। গতকাল সকাল থেকে উনি গাড়ি চালাচ্ছেন। ঘুম আসাটাই স্বাভাবিক। এই পাহাড়ি রাস্তায় একবার নিঃশ্বাস নিতে নিতে তিনটা মোড় দিতে হয় রাস্তায়। এখানে ঘুম চোখে নিয়ে গাড়ি চালানো আর ডেথ সার্টিফিকেট লিখা একই কথা।

দুইজন কথা বলা শুরু করলাম। কোন একটা চায়ের দোকান খোলা পেলেই হয়। রাত তখন ৪টার মত হবে। একটা চায়ের দোকান পাওয়া গেলো। দুইজনে মিলে ৪ কাপ চা খেলাম। অনিল পাজীকে জিজ্ঞেস করলাম যে শিমলা আর কত দূর? উনি বললেন আরও ৩ ঘণ্টার রাস্তা। উনাকে বললাম চলেন একটু  ঘুমিয়ে নেই গাড়ির ভেতরে। ২ ঘণ্টা ঘুমিয়ে তারপর যাবো। কিন্তু উনি কী বুঝলেন জানি না, এমন একটা ভাব নিলেন যে আমি তার দক্ষতাকে প্রশ্ন করছি। ইন্ডিয়ার মানুষ এমনই। কিন্তু উনার এসব আচরণ এইবার প্রশ্রয় দিবো না। আমরা গাড়িতেই ঘুমিয়ে নিচ্ছি।

বেলা অনেক হয়ে গিয়েছে। ৭টার ওপরে বাজে। নাসরাত আর রাকিব ভাই জমপেশ ঘুমিয়েছেন। আমার চোখে তখনও ঘুম। অনিল পাজীর রেস্ট হয়েছে। গাড়ি আবারও চলতে শুরু করলো। শিমলা অন্যরকম সুন্দর। একে তো পাহাড়ের গা ঘেঁষে সব বাড়ি করা হয়েছে। আর সেসব বাড়িগুলো  রং-বেরঙের আচ্ছাদনে ঢাকা। একেবারে ছবির মত সুন্দর। “3 Idiots” মুভির সিন গুলো মাথায় ভেসে উঠছিলো। মনের মধ্যে একটা গানের লাইন বাজছিলো-‘বেহতি হাওয়াসা থা…’। এরমধ্যেই আমরা বুঝে গিয়েছি ছবি তোলার চেষ্টা করে লাভ নেই। এই সৌন্দর্য ক্যামেরা নিতে পারবে না। জানালা দিয়ে তিনজনই মাথা বের করে দিয়েছি।

১০টার কিছু পরে আমরা আমাদের হোটেলে পৌঁছেছি। এই হোটেল অনিল পাজীর ঠিক করা। খুবই সুন্দর হোটেল। শিমলার এই পাহাড় ঘেঁষা বিল্ডিংগুলোর ডিজাইন এমন যে সবার প্রথমে হলো টপ-ফ্লোর। সেখানে রিসেপশন। আমাদের রুম তার ঠিক নিচতলায়। ভাল লেগেছে ব্যাপারটা।

Picture 42

রুমের ভিউটা খুবই পছন্দ হয়েছে আমাদের। হোটেলের মালিকের আচরণ খুবই ভালো। যাই হোক, আমরা জার্নি করতে করতে অস্বাভাবিক রকমের ক্লান্ত। আপাতত আমরা ফ্রেশ হয়ে একটু দম নিলাম।

তিনজন লাল রঙের গেঞ্জি পড়ে আমরা বের হচ্ছি। এবার আমাদের গন্তব্য হলো কুফরি। রাকিব ভাইয়ের পছন্দের জায়গা। অনিল পাজীর গাড়িতে করে কুফরি যেতে যেতে শিমলার আশপাশটাও মোটামুটি দেখা হয়ে যাচ্ছে। আসার পথে পাজী দূর থেকে মল রোড টাও দেখিয়ে দিয়েছেন। বিকালে আমরা সেখানে যাবো। আজকে এখনো বৃষ্টি হয়নি এখানে। গাড়ি থেকে যেখানে আমরা নামলাম সেখান থেকে ঘোড়া দিয়ে কুফরির মেইন পয়েন্টে যেতে হয়। সেখানে অনেক ধরনের রাইড আছে। সবমিলিয়ে প্যাকেজ, ১৫০০ রূপির মত। এক্স্যাক্ট এমাউন্ট খেয়াল নেই। আমাদের আশেপাশে অনেক দালাল ঘুরছে। কিন্তু আমার শ্রদ্ধেয় রাকিব ভাই-এর কথা হলো যে উনি ঘোড়ায় যাবেন না, পায়ে হেঁটে যাবেন। আমি আর নাসরাত জানি না যে এখানে পায়ে হেঁটে যাওয়া সম্ভব কি না। আমার মনে হচ্ছিলো ঘোড়াতে করেই যাই। এক দালাল এসে বললো যে এখানে কোনভাবেই পায়ে হেঁটে যাওয়া সম্ভব না। ঘোড়া যে রাস্তা দিয়ে চলে সেই রাস্তায় পায়ে হেঁটে যাওয়া রীতিমত অসম্ভব। শেষমেশ ঘোড়াতে করেই যাচ্ছি।

জীবনে এই প্রথম ঘোড়ায় উঠলাম। অস্বাভাবিক রকমের অস্বস্তি। তাছাড়া ঘোড়াটা খুব বেশি বড় না। একটা অবলা প্রাণীর ওপর জুলুম হয়ে যাচ্ছিলো। আমরা যার ঘোড়ায় উঠেছি সেই সহিসের তিনটা ঘোড়া। সহিসের সাথে কথা বলতে বলতে জানা গেলো ঘোড়াগুলোকে অনেক ছোটবেলা থেকে ট্রেনিং দেয়া হয়। শুধুমাত্র ঐ সহিস ছাড়া আর কারও কথা এই ঘোড়া শুনবে না। সহিসের বয়স ২২ কী ২৩। ঘোড়ার বয়স ১২। এর মানে বুঝলাম যে ঘোড়াগুলো ছোটবেলা থেকে এই সহিসের সাথেই বড় হয়েছে। এটাই এখানকার নিয়ম।

এই রাস্তায় কোনোভাবেই পায়ে হেঁটে যাওয়া সম্ভব ছিলো না। হাঁটু সমান কাঁদা। রাতে বৃষ্টিও হয়েছিলো। এই মৌসুমে ঘোড়া ছাড়া এখানে যাওয়া যাবে না। আমরা চলে এসেছি কাছাকাছি। শুরু হলো বৃষ্টি। আমরা তখন ঘোড়ার উপরে। টগবগ করে ঘোড়া চড়তেও জানি না। ভিজেছি সবাই মিলে। ঘোড়া থেকে নেমে গিয়েছি। এখনও বৃষ্টি হচ্ছে। প্রায় আধা ঘণ্টা বৃষ্টি হলো। প্যান্টে–জুতায় কাঁদায় মাখামাখি, একটা অস্বস্তিকর অবস্থা। বৃষ্টির তীব্রতা কমে গেলে আমরা মূল পয়েন্টের দিকে হাঁটা আরম্ভ করলাম। একটা জিপ গাড়ি এসে আমাদের নিয়ে গেলো।

Picture 43

এখানে আপেল গাছের ছড়াছড়ি। হাতের কাছেই আপেল আর আপেল। আপেল ছেঁড়া নিষেধ। লোভ হচ্ছিলো প্রচণ্ড। কিন্তু নৈতিক কারণে ছিঁড়তে পারছি না। বিভিন্ন রাইডে চড়লাম। একটু বাচ্চা বাচ্চা মনে হয়েছে। তারপরও ভালো লেগেছে। আনন্দ করেছি। নাসরাত শেষমেশ আপেল একটা ছিঁড়ে ফেলেছে। কিন্তু এটা কোথায় খাবে ভেবে পাচ্ছে না। বাথরুমে যেয়ে খেয়ে আসলো। আমরা বের হবার সময় আপেল কিনেছিলাম। সব আপেল এখনো পাকে নি।

Picture 44

হোটেলে ফেরার পথে আমাদের সারা শরীরে কাঁদা আর কাঁদা, সাথে ঘোড়ার মলের গন্ধ। ফিরতে ফিরতে ৩টা বেজে গিয়েছে। অনিল পাজীকে বললাম, পাজী, আপনি ভালো করে ঘুমিয়ে নেন। কিন্তু এই লোককে আমরা যতই রেস্ট নিতে বলি না কেন, উনি উনার দুই বউয়ের সাথে কথা বলতে বলতে রেস্ট নেয়ার টাইম পান না। আমরা ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নিলাম। শরীরে কোন শক্তি নেই। ক্ষুধায় বেহাল অবস্থা। সামনে যা পাবো খেয়ে ফেলবো। আমাদের হোটেল থেকে মল রোডে হেঁটে গেলে ১০–১৫ মিনিট লাগে। আমরা সেদিকেই লাঞ্চ করবো। পাহাড়ি উঁচু-নিচু রাস্তায় আমাদের অবস্থা নাজেহাল। রাকিব ভাই কোত্থেকে যেন খবর পেলেন এখানে জামে মসজিদ আছে, সেখানে মাটন পাওয়া যায়। কিন্তু মসজিদ কোথাও পাচ্ছি না। উনি খুঁজেই যাচ্ছেন। ইন্ডিয়ার খাবারে তার আর কোন বিশ্বাস নেই। শুধু কাঁদতে পারছেন না। আমি আর নাসরাত রাকিব ভাইকে বললাম চলেন আগে এখানে কোথাও নন-ভেজ থালি খেয়ে নেই। একটা রেস্টুরেন্টে আমি আর নাসরাত খেয়ে নিলাম। ক্ষুধা থাকায় মন্দ লাগেনি। গলা ভর্তি করে খেয়েছি। রাকিব ভাইকে সাধলাম, উনি ছুঁয়েও দেখলেন না। উনি আজকে মাটন খেয়েই ছাড়বেন। অনেকক্ষণ খুঁজেও পেলেন না। কিছু খাচ্ছেনও না।

Picture 45

ক্ষুধা থাকায় তখন মল রোডের সৌন্দর্য চোখে পড়ে নি। খাওয়ার পর যেন দেহে প্রাণ এসেছে। যেদিকেই তাকাচ্ছি, মুগ্ধতা। অসাধারণ। এত পরিষ্কার আর ছিমছাম করে সাজানো হয়েছে যে বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা ঘড়ির দোকান পেয়েছি। Fastrack এর শোরুম পেয়েছি। আমি ছাড়া বাকি দুইজন কেনাকাটায় খুঁতখুঁতে স্বভাবের। ওরা মূলত ম্যাচিউরড। আমি শিশু। ঘড়ি কিনে নিয়েছি। ততক্ষনে বাহিরে পাহাড়ের অন্ধকার নেমে এসেছে। রাস্তায় লাইটগুলোতে প্রাণ দেয়া হয়েছে। আলো আঁধারির এমন একটা খেলা চলছে এখানে, যে কারও মন ভাল হয়ে যাবে।

আশেপাশের বিল্ডিং সুন্দর, বিল্ডিং এর দোকান সুন্দর, সামনের রাস্তা সুন্দর, রাস্তার মানুষ সুন্দর। যেদিকেই তাকাই ভালো লাগে। এতটাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম যে ছবি তোলার কথা আমাদের মনে ছিলো না অনেকক্ষণ। দ্যা রিজ নামক একটা বিল্ডিং এর সামনে আমরা। অনেকটা ইউরোপ টাইপ ফিলিং এই জায়গাটায়। সন্ধ্যায় সবাই যে সপরিবারে এখানে চলে এসেছেন, ঘুরছেন। মোটামুটি প্রত্যেকটা মানুষের চেহারায়, চলনে একটা নির্মলতা আছে। মানুষের চালচলন, চেহারায় একটা রুচিবোধের ছাপ আছে। কোথাও কোন হইচই নেই। ছবি তুললাম আমরা।

Picture 47

শিমলার সেই বিখ্যাত গির্জাটার সামনে আমরা। সেখান থেকে পাহাড়ের কিনারায় এসে রেলিং ধরে তাকিয়ে ছিলাম কিছু সময়। দম নিচ্ছি। দূরে বাড়ি-ঘরের আলো পাহাড়ের আকৃতি জানান দিচ্ছে। আজকে আমাদের ঘোরাঘুরির শেষ সন্ধ্যা। কালকে থেকে ফেরার পথ ধরতে হবে। পরিচিত ভিড়ে ফিরে যেতে হবে। মনটা স্তব্ধ হয়ে গেলো। মনে হচ্ছে বিষণ্নতা পেয়ে বসছে। সময়টা আরেকটু ধীরে যেতে পারতো।

ঘরে ফেরা
শেষ পর্ব (অগাস্ট ১৬ -১৭, ২০১৯)

মল রোড থেকে আমরা হোটেলে চলে আসি ১০টার দিকে। আজ রাতে বেশি ঘুমানোর সুযোগ নেই। রাত ৩টায় আমরা রওনা হবো। শিমলা থেকে দিল্লী যাওয়া ৮–১০ ঘণ্টার ব্যাপার। কারো চোখে উৎফুল্লতা নেই। বিষণ্ন মনে আমরা গাড়িতে উঠেছি। আমি সামনে। উনারা দুইজন ঘুমাচ্ছেন। গতরাতে বৃষ্টি হয়েছে। শিমলা থেকে ফেরার পথে দেখলাম অনেক জায়গায় পাহাড় ধসে পড়েছে। আমাদের রাস্তা ব্লক না হলেই হয়।

আসার সময় চন্ডীগড়ের কোন একজায়গায় নেমে আমরা সকালের নাস্তা করলাম। রাস্তায় দেখার মত কিছু নেই। আমাদের মধ্যে ছিল ক্লান্তি আর উদাসীনতা আর অনিল পাজীর মধ্যে ছিলো ঘরে ফেরার আনন্দ। আমাদের চকলেট কিনে নিতে হবে। আমাদের প্ল্যান অনুযায়ী রাস্তায় আর কোথাও সময় পাওয়া যাবে না। তখন প্রায় দুপুর। একটা শপিং মলের সামনে দাঁড়ালাম। এখান থেকে যদি চকলেট কিনে নেয়া যায়। কিন্তু রাকিব ভাইয়ের ইন্টারন্যাশনাল কার্ড এখানে একসেপ্ট করে না। আমরা সিংগাড়া খেয়ে রওনা দিয়ে দিলাম।

দিল্লী এয়ারপোর্টের টার্মিনালে পৌঁছেছি ৩টার কিছু আগে। আমাদের ফ্লাইট ৫টায়। সব ঠিক থাকলে সন্ধ্যা ৮টায় কলকাতা নিউমার্কেটে পৌঁছাতে পারবো। কিন্তু ডিপার্চার লেইট। প্রথমবার আমরা এয়ারপোর্টের কিছুই বুঝতাম না। এবার আমাদের ভাব দেখে যে কেউ মনে করবে যে আমরা ফ্রিকোয়েন্ট ট্রাভেলার। ইমিগ্রেশান শেষ করে ৬.৩০ এ টেক-অফ হলো। বুদ্ধি করে এবার জানালার পাশে সিট নিয়েছি। জানালার পাশে বসতেই হবে। জানালা দিয়ে সূর্যাস্ত দেখলাম।

Picture 48

কলকাতায় ল্যান্ড করার পরে আমাদের আর দেরি করার সময় নেই। বাজে ৮.৩০। নিউমার্কেটে যেয়ে চকলেট কিনতে হবে আর হোটেল খুঁজতে হবে। আগামীকাল মানে ১৭ তারিখ ভোর ৫টায় আমাদের গাড়ি ছাড়বে। কিন্তু নাসরাতের ব্যাগের কোন হদিস নেই। প্রায় ১ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে ব্যাগ পেলাম। বের হয়ে গাড়ি নিতে নিতে ১০টা বেজে গেলো। নিউমার্কেট পৌঁছাই রাত ১১ টায়। কিছু দোকান এখনো খোলা আছে। আমাদের কাছে আর ডলার ছিলো না। হোটেলে কত রূপি লাগে জানিনা। কিছু রাখতে হবে।

রাকিব ভাই টাকা থেকে রূপিতে কনভার্ট করে নিলেন। চকলেট কিনে নিলাম আমরা। কিন্তু বাঁধ সাধলো হোটেল পেতে। কোথাও কোনো হোটেল নেই। আশেপাশের ৫ কি.মি.-র ভেতরে সব হোটেল নাকি বুকড। কী যন্ত্রণা! এর মধ্যে বৃষ্টির পানিতে কলকাতা ডুবে গিয়েছে। রাতে আমার ঘুম হয় নি। মেজাজ ভালো না।

কোত্থেকে এক দালাল আসলো। এত কথা বলে! সে আজকে আমাদের উপকার করেই ছাড়বে। আমরা কিছু বলতে গেলে উল্টা কথা শুনিয়ে দিচ্ছে। হোটেল খালি নেই কোনো। দালাল বলছে যে আপনারা আগে জায়গাটা দেখেন। যদি থাকতে চান থাকবেন। নাসরাত আর রাকিব ভাই গেলেন। আমি ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে নিউমার্কেটে দাঁড়িয়ে রইলাম। ১২টার ওপরে বাজে। উনারা গিয়েছেন প্রায় আধা ঘণ্টা হয়ে গিয়েছে।  বিরক্তির সীমা ছিলো না তখন।

নাসরাত আসলো। পুরো কলকাতা পানির নিচে তখন। আমরা যেখানে গেলাম, সেখানে এক রুমে অনেক সিংগেল খাট বিছানো। সবগুলো খাট বুকড। আমরা ফ্লোরিং করবো। নাসরাত ভয়ে আমাকে বলতে পারছিলো না। জায়গাটা এক মুসলিম ভাইয়ের। উনার আচার ব্যবহার খুবই ভালো। আমরা ৩ ঘণ্টা ঘুমাবো।

হরিদাসপুর বর্ডার পর্যন্ত আমি বেশিরভাগটাই ঘুমিয়েছি। ইন্ডিয়ার বর্ডারে যখন নামলাম তখন সকাল প্রায় শেষের দিকে। এখানের দোকানে এসে দেখি দুনিয়ার চকলেট। আমরা তিনজন শুধুশুধুই কালকে এত পরিশ্রম করলাম। এখান থেকে ব্যাগ ভর্তি করে নেয়া যেত। নিয়েছি কিছু চকলেট। সব রূপি ভাঙিয়ে টাকা করে নিয়েছি। ইমিগ্রেশানে রূপি পেলে নাকি রেখে দেয়।

কয়েকজন কুলিকে জনপ্রতি ১০০ টাকা করে দেয়াতে আমাদের ব্যাগ-পোটলা সব পার করে দিলো। আমরাও কোন ঝামেলা ছাড়া পার হয়ে গেলাম। দেশে চলে এসেছি। বড় করে একটা শ্বাস নিলাম। কী শান্তি! তখন দুপুরের কাছাকাছি। আমি আর রাকিব ভাই যশোরে সিংগারা আর চা খেলাম। আহ! দেশের খাবার। চোখ বন্ধ হয়ে গেছে আনন্দে। অযথা পনিরের ব্যবহার নেই। উৎকট কোন স্বাদ নেই। একদম দেশের স্বাদ।

এবার স্ক্যানিয়াতে। গাড়িতে উঠে গিয়েছি। মাঝখানে গাড়ি চেকিং হলো। কষ্টের ব্যাপার হলো দেশে এসে এক সহযাত্রীর মোবাইল চুরি হলো। আমরা যখন ফেরি পার হই তখন রাত। চাঁদ উঠেছে আকাশে। কর্মব্যস্ত জীবনে ফেরত যাবার অপেক্ষা।

Picture 49

(শেষ)

সিনিয়র অফিসার | ব্যাংক এশিয়া লিমিটেড

প্রাক্তন শিক্ষার্থী
পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সেশনঃ ২০১২-১৩ (৬২তম ব্যাচ)

রিফাত রেজা

প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেশনঃ ২০১২-১৩ (৬২তম ব্যাচ)