তখন সেকেন্ড ইয়ারে উঠছি- আমাদের টার্ম সিস্টেম ছিল-থার্ড টার্মের দ্বিতীয় সপ্তাহ। এমনিই সবাই বলে বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকেন্ড ইয়ারই হচ্ছে পাখা গজানোর সময়- তা আমাদের উপর এটা পুরোপুরিই ফলে গেল। যে দুটি কারণে আমরা কয়েক বন্ধুর পাখা গজানো ভাব আসলো তার একটি হচ্ছে আমাদের কয়েকজন মিলে একটা ভাল গ্রুপের মত হয়ে গেল যারা আড্ডা দিতে পছন্দ করি আর দ্বিতীয় কারণটি হল আমাদের মধ্যে এরকম একটা ধারণা হয়ে গেল যে আমাদের বিষয়ের পড়াশোনার ভাবগতিকটা আমরা বোধহয় খানিকটা কব্জা করে ফেলেছি। প্রথম বর্ষের রেজাল্টে তার কিছুটা প্রতিফলনও টের পেয়েছি। এই ভাবগতিকের একটা হলো নিয়মিত ক্লাস করা- এটা তাই আমরা খুবই মেনে চলতাম। কিন্তু মুশকিল হতো দুই ক্লাসের মাঝে দশ মিনিট সময় আমাদের এই ক’জনের গল্প এমন জমে উঠতো যে পরবর্তী ক্লাসের স্যার আসার পরও গল্প চলতেই থাকত। মাঝে মাঝে পরের ক্লাসের স্যার একটু দেরি করলে আমাদের একটু সুবিধাই হত। আমাদের এই দুই ক্লাসের মধ্যবর্তী আড্ডাটার একটা প্রায় নিয়মিত বিষয় ছিল চক দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে নানারকম লিখনী বা ছবি আঁকা- অবশ্যই খারাপ কিছু না- যেমন শাহ্রিয়ার প্রায়ই তখনকার সময়ের জনপ্রিয় ইংরেজী গানগুলোর কলি লিখে রাখত- আর মাঝে মাঝে আমি অন্যপাশে দাঁড়িয়ে তার তাৎক্ষনিক অনুবাদ কাব্য তৈরি করতাম- অন্যরাও অন্য নানান গল্পের ফাঁকে এগুলো নিয়েও মন্তব্য করত।
সেরকমই একদিন- আমাদের রুটিন অনুযায়ী Estimation কোর্সের ক্লাস শুরু হবার আগে- এই কোর্সে মাহ্মুদুল হক খান স্যার দুটো ক্লাস নিয়েছেন কিন্তু আজ থেকে নতুন শিক্ষক আসবেন- তাই ধরেই নিলাম যথাসময়ে শুরু নাও হতে পারে- সুতরাং আমি আর শাহ্রিয়ার আমাদের নিয়মিত চক আর বোর্ডের ব্যবহারে লেগে গেলাম। অন্যরাও মশগুল হয়ে গেল নানাবিধ গল্পে- হঠাৎ অন্যান্যদের মধ্যে একটু পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম তাই আমরাও সেদিকে মনোযোগ দিলাম- কী হয়েছে জানা দরকার। নুসরাত আর ডোরা বললো যে কেউ একজন আমাদের ক্লাসে ঢুকেছিলেন এবং তারপরই বেরিয়ে গেছেন। আমারও তখন খেয়াল হলো- আমিও যেন কেউ একজনকে দেখেছি। মাথায় হাত পড়লো যখন আমাদের মনে হলো যে এই কোর্সটা পড়াবেন যে নতুন শিক্ষক তাকে আমরা কেউ চিনি না- সেই স্যার এসে ফিরে যাননি তো?
তারপরই মনে হলো কোর্সটা পড়ানোর কথা সদ্য আমেরিকা থেকে বিশাল কৃতিত্বপুর্ণভাবে পিএইচডি করে ফিরে আসা একজন শিক্ষকের। আমাদের তখনকার বয়সের অভিজ্ঞতায় আমাদের কল্পনার মানসপটে এরকম একজন ইউএস ফেরৎ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের যে ছবি ফুটে উঠার কথা তা অনেকটাই বাহুল্যময়- যেমন আমাদের কল্পনায় তিনি আপাদমস্তক পাশ্চাত্য পোশাক, চালচলন, অঙ্গভঙ্গিসম্পন্ন খানিকটা আত্মম্ভরী কোন ব্যক্তি হওয়ার কথা। অথচ আমরা যাকে একঝলক দেখেছি তিনি তেমনটা নন- বরং অনেকটা অনাড়ম্বর, সৌম্য ও গাম্ভীর্যপূর্ণ চেহারার ব্যক্তিত্ব বলে মনে হয়েছে। আমরা যখন নানান অনিশ্চয়তা নিয়ে ভেবে অস্থির আলোচনায় ব্যস্ত, তখন বন্ধু জালাল হন্তদন্ত হয়ে বাইরে থেকে এসে ক্লাসে ঢুকল- জালাল বিভাগের সবচেয়ে বেশি খবরাখবর রাখে এবং জানে- আমাদের আলোচনার মাঝখানেই সে বলল যিনি এসেছিলেন তিনিই আমাদের এই কোর্সের শিক্ষক এবং সেইসাথে বাড়তি তথ্য দিল যে সে শুনেছে যে এই স্যার খুবই সংবেদনশীল ভাবে ভাবপ্রবণ।
পরিস্থিতিটি তাই কঠিন হয়ে উঠল কারণ আমাদেরকে তিনি যে ক্লাসরুম পরিস্থিতিতে পেয়েছেন এবং আমরা যে তার উপস্থিতি আমলে আনতে পারিনি এতে এমন হতে পারে যে তিনি হয়তো আমাদের উপরে রেগে গিয়ে আর আমাদের ক্লাসই নিবেন না এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। সবারই ভয়ে বুক কাঁপাকাঁপি অবস্থা- বিশেষ করে বোর্ডে লিখার দুই আসামী আমি আর শাহ্রিয়ারের অবস্থা সবচে খারাপ। আমাদের দুজনের ঘনিষ্টতম বন্ধু এহ্তেসাম সবসময়ই অভিভাবকসুলভ আচরণ করতো- তার বকাবকি আর তর্জন-গর্জন প্রায় প্রহারের পর্যায়ে পৌঁছে গেল আমাদের দুজনের কাছে। তবে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে সিদ্ধান্তে পৌঁছালাম আমরা যে- যাই হোক না কেন আমরা আগে স্যারের কাছে যাই, গিয়ে আমাদের অনিচ্ছাকৃত আচরণের জন্য মাফ চাই- তারপর স্যার কী করেন দেখি। জালাল যেহেতু স্যারকে চিনে তাকেই সবার সামনে থাকতে হবে।
গিয়ে উপস্থিত হলাম স্যারের রুমে- কে কী বলেছি তা মনে করতে পারবো না তবে হড়বড় করে সবাই মিলে যে নিজেদের অপরাধবোধটাকে প্রকাশ করেছিলাম সেটা মনে আছে। স্যারের মুখের দিকেই তাকিয়ে আছি সবাই- কিন্তু সেখানে রাগের চিহ্নমাত্র দেখতে পেলাম না- একটু পরেই একটা নির্মল হাসি ফুটে উঠল তার মুখে, বললেন, “আপনারা ব্যস্ত ছিলেন দেখে চলে এসেছি- ক্লাসে যান আমি আসছি”। স্যারের হাল্কা শ্লেষ ছাড়িয়ে বিস্ময় আমাদেরকে বেশি স্পর্শ করলো, বিস্ময় বা চমক ভাল জিনিস কিন্তু তারও একটা মাত্রা থাকা ভাল, একত্রে দুটো চমক আমাদের প্রায় হতচকিত করে দিল- এক স্যার রাগ করেন নাই- দ্বিতীয়টি তিনি আমাদের আপনি করে বলছেন- এর আগে কোন শিক্ষকের কাছ থেকে আপনি সম্বোধন শুনিনি আমরা কেউ। ক্লাসে এসে যে যার জায়গায় বসে রীতিমত ‘পিন-ড্রপ-সাইলেন্স’ অবস্থা তৈরি করে ফেললাম- স্যার যেন আবার কোনভাবে বিরক্ত না হোন। স্যারের ক্লাসের ‘পিন-ড্রপ-সাইলেন্স’ স্যারের পরবর্তী যত ক্লাস করেছি সেগুলোতেও বজায় থাকতে দেখেছি- না স্যার বিরক্ত হবেন বা রেগে যাবেন সেই ভয়ে নয়- মন্ত্রমুগ্ধের মত স্যারের ক্লাস শোনার জন্যই সবাই এটা করত।
Estimation কোর্সটা চলাকালীনই নিজের মধ্যে একটা বিশাল পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। আমি সবসময় ক্লাসের শেষ সারিতে বসতাম- ক্লাসও শোনা হতো- অন্যরা কে কী করছে সেদিকে খেয়ালও রাখা যেত- মাঝে মাঝে চিরকুট পাঠিয়ে দিয়ে বন্ধুদের সাথে মন্তব্য বিনিময়ও করা যেত আবার মোক্ষম সুযোগ পেলে পেটে জমে থাকা দু’একটা কথাও ফিসফাস করে বলে ফেলা যেত। Estimation কোর্সের দ্বিতীয় ক্লাস থেকেই আমি প্রথম সারিতে বসা শুরু করলাম- উল্টো কারণে- পেছনে বসলে চিরকুট চালাচালিতে মনযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে- যদিও দু’একদিনের মধ্যে টের পেলাম চিরকুট চালাচালি এমনিতেই বন্ধ থাকে এই ক্লাসে। ক্লাসে পাঁচ-সাত মিনিট দেরিতে ঢুকা ছিল আমার নিয়মিত ব্যাপার কারণ দশ মিনিট পর থেকে শুনলেও পুরা ক্লাস বুঝে যেতাম- কিন্তু Estimation কোর্সটা অভ্যাস সম্পূর্ণ পাল্টে দিল- এখন ক্লাসে একদম প্রথম মিনিট থেকে থাকা জরুরি হয়ে উঠল আমার কাছে।
এই সব পরিবর্তনের মুল কারণ হ’ল আমাদের নতুন শিক্ষকের ক্লাসের জাদুকরী আকর্ষণ- অনবদ্য ও সহজভাবে পরিসংখ্যানের মত কঠিন একট বিষয় যে পড়ানো যায় আর তা মন্ত্রমুগ্ধের মত পুরো পঞ্চাশ মিনিট শোনার আগ্রহ প্রতিটি ছাত্রের মধ্যে থাকতে পারে তা আমাদের বেশিরভাগের কাছেই এর আগ পর্যন্ত অবিশ্বাস্য ব্যাপার ছিল। স্যারের প্রতিটি বাক্য যেন পুর্ব থেকে সাজানো- প্রথম শুরু করার সময় যেন তিনি জানতেন পঞ্চাশ মিনিট পর তিনি কোথায় গিয়ে থামবেন। আরো কিছু জিনিস ঘটতে শুরু করল- যেমন এর আগ পর্যন্ত আমরা যেসব হোমওয়ার্ক পেয়েছি সেগুলো করতাম না সেরকম নয় তবে এগুলোতে সেরকম আগ্রহোদ্দীপনা থাকত না- কিন্তু Estimation এর প্রতিটি হোমওয়ার্ক আর এসাইনমেন্ট অত্যন্ত সময় দিয়ে এবং মনোযোগের সাথে করতে শুরু করলাম- দুটো কারণে- কাজগুলোর মধ্যে নতুনত্ব থাকায় তার সমাধান করতে পারার মধ্যে আনন্দ আর দ্বিতীয়তঃ সঠিক সমাধান করতে পারলে সেটাতে স্যারের তারিফ করার ধরন- বিন্দুমাত্র কৃতিত্বও স্যারের প্রশংসা থেকে বঞ্চিত হত না। নিজের এসব পরিবর্তনের কারণে কোন এক সময় টের পেলাম আমি অন্যান্য কোর্সেও একজন মনোযোগী ছাত্র হয়ে গেছি- যদিও আমার বাহ্যিক দস্যিপনার কোন পরিবর্তন হ’ল না। তবে পড়াশোনায় যে সত্যি সত্যিই মনোযোগী হয়েছিলাম পরবর্তীতে নিজের রেজাল্টে তা দেখতেও পেয়েছি। অনেক পরে বুঝতেও পেরেছি এই পরিবর্তন কত সুদুরপ্রসারীভাবে আমার কর্ম তথা জীবনকে প্রভাবিত করেছে।
আমার Estimation কোর্সে ভাল ফল হয়তোবা স্যারের নজরে পড়তেও পারে কিন্তু স্যার যে আমার জীবনপথেরই গতি বদলে দিলেন সেটা স্যার মনে হয় টেরও পেলেন না। আমার মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিসংখ্যান বিভাগের থেকে পাস করা কত পরিসংখ্যানবিদের যে জীবনপথের দিক নির্ধারণে প্রভাব রেখেছেন আমাদের এই শিক্ষক তা গণনা করা যাবে বলে মনে হয় না।
এযাবৎ আমার বা স্যারের পরিচয় প্রকাশ না করলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিসংখ্যান বিভাগের সংশ্লিষ্ট সবাই-ই উপরে আলোচিত স্যার যে অধ্যাপক ডঃ এম আতাহারুল ইসলাম সেটা বুঝে ফেলেছেন বলে আমার বিশ্বাস। আজ একটি বছর হয়ে গেল স্যার দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতার জন্য চিকিৎসাধীন আছেন- দোয়া করি স্যার যেন সম্পূর্ণ সুস্থ্য হয়ে আমাদের মাঝে আবার কর্মময় হয়ে উঠেন।
প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও শিক্ষক
পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
- This author does not have any more posts.