fbpx

অজানা কথন

অদেখা কোনো মূহুর্তের পেছনের অপেক্ষাটা সুন্দর। তেমনি সুন্দর জয়ের অন্তড়ালে থাকা গল্প, যার পাতায় পাতায় নতুন সম্ভাবনারা ডানা মেলে, গড়ে ওঠে এক একটি বুনিয়াদ। জয়ের মূহুর্ত সাক্ষী করে রাখে অনেককে, অথচ অগোচরে রয়ে যায় চড়াইউতরাই পার হয়ে শীর্ষে পৌঁছাবার শতসহস্র গল্প। নিভৃতে থেকে যাওয়া এমনকিছু অজানা কথন নিয়ে পাঠকদের উদ্দেশ্যে হাজির হয়েছে প্যাপাইরাস। তবে কাদের এই গল্পগুলো?

বলা বাহুল্য, গত ২০ই অক্টোবর ডুসডা ও কিউএমএইচ ক্লাবের উদ্যোগে পরিসংখ্যান বিভাগে পালিত হয় বিশ্ব পরিসংখ্যান দিবস। এই দিবসকে কেন্দ্র করে কিউএমএইচ স্ট্যাটিস্টিক্স ক্লাব আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্য আয়োজন করে ডেটা এনালাইসিস প্রতিযোগিতা। তিনটি শিক্ষাবর্ষ থেকে বিজয়ী তিনদল জয়ের সেই যাত্রাপথ পাড়ি শেষে জানিয়েছেন তাদের জয়ের পেছনের গল্পকথা।

গল্পকথক- ১ম বর্ষ থেকে নাভিদ নেওয়াজ, ২য় বর্ষ থেকে হাসনাইন আহমেদ আলভী ও ৩য় বর্ষ থেকে ছাহেরা আক্তার।

(১)

তারিখটা ঠিক মনে নেই, ভাবিও নাই যে মনে করতে হবে। সন্ধ্যায় টিউশন করিয়ে এসে বিছানায় গা এলিয়ে ফেসবুক স্ক্রল করছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়লো QMH STATISTICS CLUB এর একটা নোটিফিকেশন। ডিপার্টমেন্ট এর ৮ পর্বের সেমিনার, বিষয় “ডাটা এনালাইসিস”। তখন দেখে অবশ্য খুব একটা বুঝতে পারিনি ব্যাপারটা, পরে ক্লাসে স্যার ম্যাডামদের কথায় বেশ উৎসাহ পেয়েছিলাম। ভেবে দেখলাম স্ট্যাটিস্টিকস এর স্টুডেন্ট হয়ে ডেটা এনালাইসিস নিয়ে একটু ঘাটাঘাটি করলে মন্দ হয় না (যদিও এখনো স্ট্যাটিস্টিকস এর জ্ঞান অতি নগণ্য)।

খুব আগ্রহ নিয়ে প্রথমদিন সেমিনারে জয়েন করেছিলাম, কিন্তু টানা ৮ সপ্তাহ উপস্থিত থাকার মত ধৈর্য্য শেষ পর্যন্ত ছিল না। আমাদের মধ্যে কেবল অনসূয়া প্রায় ৬টা পর্বেই থাকতে পেরেছিল। শেষের দিকে আমি ওকে বলিয়ে ইমপরট্যান্ট কিছু জিনিষের স্ক্রিন রেকর্ড করে রেখেছিলাম। কমপিটিশন হবে জানতাম না তখন, কিন্তু এই রেকর্ডগুলো আমাদের অসম্ভব কাজে লেগেছিল পরবর্তীতে।

সেমিনার শেষ হলো, জানতে পারলাম “World Statistics Day” সম্পর্কে, আর সে উপলক্ষ্যে কমপিটিশন এর কথাও জানতে পারি শ্রদ্ধেয় তসলিম স্যার এর কাছ থেকে। একদিন আমাদের বান্ধবী ফারিয়া নক দিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো পার্টিসিপেট করবো কিনা কোনো টিমের সাথে। যেহেতু কম্পিটিশন করার কোন প্ল্যানই ছিলনা, তাই প্রথমে পাত্তা না দিয়ে উড়ায় দিলেও পরে অনসূয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, “চল কিছু একটা করি, যা আছে কপালে, ভার্সিটির প্রথম কমপিটিশন। ট্রাই তো করি!” এরপর হুটহাট প্ল্যান আর রাতারাতি আমি(নাভিদ), নোবেল আর অনসূয়া টিম করে ফেললাম। তারপর শুরু হলো কাজ! হাতে সময় ছিল ৩দিনের মত (অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর)। 

কীভাবে কী করবো না করবো প্রথমদিন এটা ভাবতে ভাবতেই শেষ; তার উপর SPSS কোর্স আমাদের বেশিদিন হয় নি ক্লাসে(করোনার জন্য বন্ধ হওয়ার আগে)। সেমিনার যেহেতু সম্পূর্ণটা অনসূয়া করেছে, তাই ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলাম শুরুতে। পরে দেবদূত হয়ে আবির্ভাব হয়ে নোবেল বলল, সে SPSS এর কিছু টিউটোরিয়াল এই কোয়ারেন্টাইনে বসে দেখেছে (যাকে বলে সুযোগের সদ্ব্যবহার) এবং বেসিক অংশগুলো পারে। ব্যাস, SPSS এর ঝড়টা পুরো ওর উপর দিয়েই গেল। কাজ করতে করতে আরো কিছু শিখা লেগেছিল যদিও। আর বাদ বাকি কাজ যা করার তা করে ফেলেছিলাম বাকি দুইজন মিলে।

আচ্ছা হ্যাঁ, মজার কথা বলতে ভুলেই গেলাম, আমরা দেড় দিন কাজ করার পর উপলব্ধি করলাম আমরা ভুল ডেটা সেট নিয়ে কাজ করেছি। স্যার সেমিনারে যেই ডেটা সেট দিয়ে বুঝিয়েছিলেন আমরা সেটা দিয়েই করে ফেলেছি। বলতে গেলে বিসমিল্লায় গলদ। সবাই বাকহীন হয়ে গেলাম, রাগ আসলো সবারই নিজেদের বোকামির উপর। তারপরও নিজেদের গুছিয়ে আবারো নতুন ডেটা সেট নিয়ে সব কাজ শুন্য থেকে শুরু করলাম। আমরা Maternal Education এর সাথে Antenatal Care এর সম্পর্ক দেখিয়ে রিসার্চটা করেছিলাম। এইটা ঠিক করাও একটা চ্যালেঞ্জ ছিল আমাদের জন্য আসলে। কারণ নতুন ডেটা সেট দেখে ভড়কে যাই আমরা, সিদ্ধান্থীনতায় ভুগি, শেষে সবাই একসাথে ফোনে কথা বলে এরকমটা ঠিক করি। সবার ওই তিনদিন একটাই কথা ছিল “উলটাপালটা হইলে হোক, সমস্যা কোথায়? শুধু মান-সম্মান না খোয়াইলেই হয়।“ এখন ভাবি ডিপার্টমেন্টে ক্লাস করছিলাম তখন সবে ২মাস, মান-সম্মান আবার কী! হাহাহা।

যেহেতু Antenatal Care টপিকটা আমাদের দেশের জন্য খুবই আলোচিত একটা ব্যাপার, সে দিক থেকে এটাকে হাইলাইট করারও তেমন কিছু ছিল না, আমরা শুধু বসে বসে রিলেশন বের করছিলাম। স্ট্যাটিস্টিকস এর সব টার্মগুলো মাথার মধ্যে তালেগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। আমি আর অনসূয়া একটা কথা বললে নোবেল সেটার ভুল ভাঙায় দিচ্ছিল, একইভাবে উলটাটাও হচ্ছিল। যদিও আমাদের সবচেয়ে বেশি উপকার করেছিল ক্লাব থেকে দেয়া দুটি রেফারেন্স, সাথে গুগল থেকে আরো অনেকগুলো রেফারেন্স ঘেটে ঘেটে সেখান থেকে আইডিয়া নিয়েই আসলে সবটা করা। টিউশনিতে গিয়েও সবাই এগুলা নিয়েই পড়ে ছিলাম দুই-তিন দিন। কিছু মজার ঘটনাও ঘটে তখন, ডেটা সেটে এরকম কিছু বেঢক মান ছিল যেগুলো নিয়ে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছিলাম আমরা। এই যেমন- একজন মা এর ৩৫টা সন্তান। আবার যেখানে চারটা Antenatal Visit ই কেউ ঠিকমতো করায় না সেখানে ৯৯ টা Visit! বুঝতে পারছিলাম না কাজ নিয়ে চিন্তা করবো নাকি এসব উদ্ভট বিষয় নিয়ে হাসবো। সব মিলিয়ে সেই ৩/৪ দিন খুনসুটি তো ছিলই, রাত ৩/৪ টায় হুট হাট একজনকে কল দিয়ে দেয়াও ছিল। কাজের কথার চেয়েও অকাজের কথা বেশি ছিল।

আরেকটা মজার ব্যাপার হয়, নোবেল আর অনসূয়া সারাদিন কাজ করে রাতে ১টার মধ্যে ঘুমায় গেলেও, আমার কাজ ছিল সারাদিন মরার মত ঘুমিয়ে রাতে ওদের পেন্ডিং কাজ গুলো শেষ করা। বাকি দুইজন আর আমি পুরা আইসোলেটেড। এজন্য মিটিং এও বসতাম তিনজন রাত ১২টার পর। তবে হ্যাঁ, রিসার্চ পেপার লেখার কৃতিত্ব অনসূয়ার প্রাপ্য, এত সুন্দর করে সব কিছু গুছিয়ে সাবলীল ভাষায় ইংরেজিতে ৮/৯ পেজ লেখা ওর পক্ষেই সম্ভব ছিল। তারপর আসলো পেপার জমা দেয়ার দিন, কে স্যারকে মেইল করবে রিসার্চ পেপার, সেটা নিয়ে হয় আরেক যুদ্ধ আমাদের মধ্যে। যদিও এইটা হাস্যকর একটা ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত এই গুরুদায়িত্ব পড়লো আমার উপর।  সেই রাতে মরার উপর খারার ঘা হয় আমার ল্যাপটপে মাইক্রোসফট ওয়ার্ড হ্যাং খেয়ে যাওয়া। লক দেখাচ্ছিল, কিছু লিখতেও পারছিলাম না। পরদিন দুপুর ১২টার মধ্যে সাবমিট করা লাগবে। ইউটিউবে টিউটোরিয়াল দেখে দেখে সেটা আবার ঠিক করে বাকি লেখা কমপ্লিট করতে ভোর ৫টা বাজল, আর তারপর সাবমিট। 

একদিন পর রেজাল্ট পেয়ে যাই আমরা। অবাক হয়ে যাই আমরা আসলে রেজাল্ট শুনে। গ্রুপ থেকে জামি স্যার এর পোস্ট দেখে অনসূয়া খবরটা প্রথমে বাকি টিমমেটদের দেয়। “Statistics” নিয়ে প্রথম কোনো এচিভমেন্ট! সেটা কতটা ভালো লাগার ছিল বলে আসলেই বুঝানো সম্ভব না। তারপর পুরো ব্যাচ থেকে যেই শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা আমরা পাই সেটা বর্ণনাতীত। রেজাল্টের পর আসে নতুন কাজের ভার, যা হচ্ছে “World Statistics Day” তে Webinar এ আমাদের রিসার্চ প্রেজেন্টেশন দেয়া লাগবে। কিন্তু সময় মাত্র ৫ মিনিট! অনসূয়া একা হাতে সমস্ত স্লাইড বানায়, তারপর নোবেল আর আমি মিলে স্পিচ রেডি করতে থাকি। একদিন পর শুনি আসলে ভয়েস ওভার করা লাগবে, যেটার অভিজ্ঞতা আমাদের কারোরই ছিল না আগে কখনো। স্পিচ তিনভাগে ভাগ করে তারপর রেকর্ডিং করা শুরু করি। এরপর শুরু হয় আরেক যুদ্ধ। রেকর্ড করতে গিয়ে দেখি ৫মিনিটের জায়গায় আমাদের ১২মিনিট লেগে যায়। তারপর আরেক দফা কাটছাঁট ।

হাস্যকর ঘটনা ঘটে রেকর্ড করতে গিয়ে, নোবেলের রেকর্ডে মাছওয়ালা চিল্লাচ্ছিল, আমার বেলায়  আম্মু চেয়ার টান দিচ্ছিল পাশের রুমে। শেষে তিনজনই বাসার দরজা, জানালা, ফ্যান বন্ধ করে ৩০°সেলসিয়াস গরমের মধ্যে ঘেমে নেয়ে রেকর্ডিং শেষ করলাম। সবশেষে ২০ অক্টোবর Webinar, সকলের সামনে সেটা দেখানো হয়। এখানে ব্যাচমেট, সিনিয়রদের বাহবা ও ভালোবাসা দেখে আমরা মুগ্ধ। এই কয়েকদিনে আমাদের সিনিয়ররাও আমাদের অনেক সাহায্য করছিলেন, বিশেষ করে দ্বিতীয় বর্ষের সামা আপু, আলভি ভাই ও অর্নব ভাই; তৃতীয় বর্ষের ঐশী আপু, ইবনাত আপু ও মুশফিক ভাই। ডিপার্টমেন্টের সিনিয়ররা যে সবসময় আমাদের মাথার উপর ছায়ার মত থাকবে সেটা আরো ভালোভাবে বুঝেছি আমরা সেই কয়দিনে।

এইতো! এভাবেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে Statistics নিয়ে একটা বিশাল বড় কমপিটিশনের ছোট্ট গল্প। আর পরিসংখ্যানের ভাষায় যদি বলতে হয়, গ্রুপ করার সময় গ্রুপের নাম দিয়েছিলাম “Team Variance” আর শেষ অবধি নিজেদের মধ্যে Variance টা অনেক কম ছিল বলেই হয়ত  ফাইনাল রেজাল্ট এর Precision টা High ছিল। ফলস্বরুপ সংশপ্তক’৬৯ থেকে Team Variance এর এই ছোট্ট জয়।

এখনো ভাবলে ভালোই লাগে সেই তিনদিনের স্মৃতি! প্রতিযোগিতায় কেন অংশগ্রহণ করেছি জিজ্ঞেস করলে বলব, সবাই-ই অভিজ্ঞতার জন্য করেছিলাম আমরা। হারানোর তো কিছু নেই, যদি কিছু শেখা যায় এর বদৌলতে, এটাই! আর আমরা বলব, জেতা হারা যদি বাদ দেই, অনেক কিছুই শিখেছি এগুলো করতে গিয়ে, যেগুলা হয়ত এত তাড়াতাড়ি আমাদের শেখার কথা ছিল না। সেজন্য QMH Statistics Club বিশাল বড় ধন্যবাদের অংশীদার হয়েই থাকে। সামনে এই ক্লাব হয়ত আমাদের জন্য আরো অনেক কিছু করবে সেই প্রত্যাশা করতেই পারি আমরা। সাথে অনেক ধন্যবাদ “পরিসংখ্যান বিভাগ” কে।

(২)

“কনটেস্ট জিতবো ইনশাআল্লাহ্” থেকে “কনটেস্ট জিতছি আলহামদুলিল্লাহ”।

“ডেন জেক্সটেন জিন হাবেন”- অর্থাৎ কখনো কখনো সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় আমাদের পাঁচ ইন্দ্রিয়ের বাইরে মনের কথা শুনতে হয়৷ সত্যি বলতে এই জার্মান বাগধারাটি আসলে আমাদের জীবনের নানান গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তবে বিশ্ব পরিসংখ্যান দিবস উপলক্ষ্যে কাজী মোতাহার হোসেন স্ট্যাটিসটিক্স ক্লাব আয়োজিত ডেটা এনালাইসিস কম্পিটিশনে অংশগ্রহণ করার কথা ভাবলেই এই বাগধারাটি সাথে সাথেই মাথায় চলে আসে। শুরুটা হয় সিহাম আর আমার(আলভী) মধ্যে মেসেঞ্জারে বার্তা আদান প্রদানের মাধ্যমে। সিহাম-ই জানায় যে ক্লাব থেকে ডেটা এনালাইসিস নিয়ে একটি প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হচ্ছে যেটাতে আমরা চাইলে অংশগ্রহণ করতে পারি। বলতে গেলে ৬-৭ মাস ধরে পড়ে থাকা অলস মস্তিষ্ক তখনও সায় দিচ্ছিলো না যে আসলেই পারবো কিনা আমরা। তবু অংশগ্রহণ করতে তো দোষ নেই। যেই বলা সেই কাজ। টিমের তৃতীয় মেম্বার হিসেবে নিয়ে নিলাম আমাদের বন্ধু শোয়াইবকে।

এর কিছুক্ষণ পর হঠাৎ করেই মেসেঞ্জারে ঢুকে দেখি নতুন একটা গ্রুপ! নাম “কনটেস্ট জিতবো ইনশাআল্লাহ্”। কাজ শুরুর আগেই যেন এক অন্যরকম অনুপ্রেরণা কাজ করছে এবার। কিন্তু শুরুতেই বিধিবাম, কোন টপিক নিয়ে কাজ করবো আমরা তাইতো ঠিক করা হলো না। প্রাথমিকভাবে কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য বিবেচনায় সিজারিয়ান অপারেশন ঠিক করার পর  অন্য যেই  বিষয়ই আসতেছে কোনোটাই যেনো মনে ধরতেছে না। ঐদিন থেকে শুরু করে সাবমিট করার আগ পর্যন্ত তিনজনেরই ঘুম নেই বলতে গেলে। হাতে গোনা কয়েক ঘণ্টা ঘুম হয়েছে শুধু। তবু ফাইনাল ফাইলটা দেখে নিজেদের আশ্বাস দিচ্ছিলাম যে এখন হারি কিংবা জিতি নিজেদেরকে বলতে পারবো আমরা আমাদের সর্বোচ্চ দিয়েছি। এবার সাবমিট কখন করবো তাও যেনো কপাল পরীক্ষা করে দিচ্ছি। পরিসংখ্যানের ছাত্র হয়েও এরকম ১০টা নাকি ১০:৩০ কখন সাবমিট করলে কপাল ভালো হবে ঠিক করাটাও কৌতুক বটে। যাই হোক এবার রেজাল্টের পালা, দিবে পরদিনই।

এই কদিন না ঘুমানোতে পরদিন ঘুমটা বেশিই দীর্ঘ হয়ে গেলো। ফোনে মেসেজে দেখি ক্লাসের এক বন্ধু জানালো আমরা নাকি জিতেছি! তাড়াতাড়ি করে যখন সময় দেখলাম, দেখি যে দুপুর দুইটা (!) বাজে তখন। মেসেঞ্জারে ঢুকেই চোখে পড়লো গ্রুপের নাম চেঞ্জ “কনটেস্ট জিতছি আলহামদুলিল্লাহ”। তিনজনের এই কদিনের খাটনি অবশেষে সফলতার মুখ দেখলো তাহলে।

ডিপার্টমেন্ট থেকে বিশ্ব পরিসংখ্যান দিবস ২০২০ ওয়েবিনার-এ পালন করা হবে ২০ অক্টোবর। ঐদিন আবার আমাদের করা এই ডাটা এনালাইসিস এর উপর প্রেজেন্টেশন দিতে হবে। কিন্তু অলরেডি জিতে গেছি জিতে গেছি একটা ভাব যেন বাকিসব কিছুই গা ছাড়া দিয়ে দিলো। কোনোভাবেই কারও সিরিয়াসনেস আসতেছে না। ১৮ তারিখ  তসলিম স্যার বুঝিয়ে দিলেন কীভাবে কী করতে হবে। তারপর একটু নড়েচড়ে বসলেও কাজ যেন শুরুই করা হচ্ছে না। এর মধ্যে উড়ো-খবর পেলাম প্রেজেন্টেশন এর উপর নাকি আবার ফার্স্ট সেকেন্ড করা হবে। তাহলে তো এবার কোনোরকম প্রেজেন্টেশন দিয়ে পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই, অনন্য কিছু করতেই হবে। ঐদিকে আমাদের ফার্স্ট টাইম কোনো প্রেজেন্টেশন দেওয়া। সারারাত তিনজন গুগল মিট এ কথাই বললাম, কাজ কাজের জায়গাতেই পরে আছে। অবশেষে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় সকালে ফজরের পর কাজ শুরু। ঠিক করেছি পাওয়ার পয়েন্ট না, কাজ করতে হবে বাকিদের থেকে আলাদা কিছু নিয়ে। শুরু করে দিলাম হোয়াইটবোর্ডে অ্যানিমেশন এঁকে স্লাইড তৈরি করা। কাজ শেষ হলো সন্ধ্যায়। কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো ভিডিও রেন্ডারিং করতে অনেক টাইম নেওয়াতে। এখনো ভয়েস ওভার করা বাকি। ঐদিকে ইন্টারনেট, কারেন্ট দুইটাই যায় আসে এরকম অবস্থা। তারপর প্রেজেন্টেশন ভিডিও রেডি করে সাবমিট করতে অবশ্য ভালোই দেরি হলো। তসলিম স্যারও ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতেই দেখলেন ব্যাপারটা। পরে অবশ্য জানতে পারি যে আসলে প্রেজেন্টেশন এর ভিত্তিতে নতুন করে পজিশন দেওয়ার ঘটনা মিথ্যে। তারপরও অন্তত নতুন কিছু তো শেখা হলো। ২০ তারিখ যখন আবার ওয়েবিনারে নিজেদের জয়ী হওয়ার খবর শুনলাম, এই আনন্দ লিখে বুঝাবার নয়। তবে পুরো জার্নিতে টিম মেম্বারদের পাশাপাশি শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণ, ক্লাসমেট, সিনিয়র এবং জুনিয়র সবাইকেই পাশে পেয়েছি। ধন্যবাদ কাজী মোতাহার হোসেন স্ট্যাটিসটিক্স ক্লাব, ধন্যবাদ পরিসংখ্যান বিভাগ, ধন্যবাদ সবাইকে।

সব শেষে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলতে চাই, “আরো কনটেস্ট জিতবো ইনশাআল্লাহ্।“

(৩)

গল্পটার শুরু গতবছরের ঠিক এই সময়টা থেকেই বলা চলে; কাজী মোতাহার হোসেন স্ট্যাটিসটিক্স ক্লাব আয়োজিত প্রথম ডেটা এনালাইসিস কম্পিটিশনের মাধ্যমে। গতবছর যখন সিনিয়রদের প্রেজেন্টেশন দেখলাম তখন থেকেই ঠিক করলাম পরের বছর দিতেই হবে। সেই থেকে অপেক্ষার প্রহর গুনতে লাগলাম। কিন্তু এই বছর করোনা পরিস্থিতিতে যেখানে ক্লাসই হচ্ছে অনলাইনে, সেখানে কম্পিটিশনের আশা করা যেন আকাশ-কুসুম কল্পনা। সব আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। এরমধ্যেই শুনলাম “World Statistics Day 2020” উপলক্ষে ক্লাব থেকে আবারো কম্পিটিশনের  আয়োজন করা হচ্ছে। মনে মনেখুশি হলেও গ্রুপ নিয়ে ঝামেলায় পড়লাম। নানান চড়াই-উৎরাই এর পর আমি(ছাহেরা), ঐশী আর মুশফিক এই তিনজন একটা গ্রুপ তৈরি করে ফেললাম।

নিজেদের একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ করে ফেললো মুশফিক। সেখানে কম্পিটিশন শুরুর আগে থেকেই আমরা তিনজন কল দিয়ে কী করবো না করবো যার মাথায় যা আসতো টুকটাক আলোচনা করতাম। যেদিন ডাটা দেয়ার কথা তার আগের রাতে আমরা যখন কথা বলছিলাম যে আগামীকাল শুরুতেই কী কী করবো ডেটা পাওয়ার পর, ঠিক তখনই শুনি আজকেই দিয়ে দিছে ডেটা। শুনে শুরুতে  কিছুটা ভয় ভয় লাগলেও ঐ রাতেই পুরো ডেটা পড়া, ভ্যারিয়েবল নাম ঠিক করা, স্কেল, আউটলায়ার চেক করা ইত্যাদি প্রাথমিক কাজ করে ফেললাম। পরের দিন সকালে ক্লাস করে আবার গ্রুপ কল। কোন বিষয় নিয়ে কাজ করবো সেটা ভাবা ছিলো আরেকটা চ্যালেঞ্জিং বিষয়। শেষমেশ ঠিক হলো যে Antenatal Care এর উপর যেসব ফ্যাক্টরস প্রভাব ফেলে সেগুলি নিয়েই হবে আমাদের প্রধান কাজ। একদিকে কীভাবে কী এনালাইসিস করা যায় সেই ভাবনা, আরেকদিকে এর সাথে রিলেটেড রিসার্চ পেপার খুঁজতে থাকা, সেগুলি পড়ে ধারণা নেয়া ইত্যাদি নিয়ে প্রায় একদিন চলে গেলো। ঠিক করা হলো যে এভাবে কাজ হবে না, একসাথে বসে কাজ করতে হবে। গেলাম পরের দিন সকালে ডিপার্টমেন্টে, গিয়ে দেখি মুশফিক কীভাবে কী করা যায় তার একটা সম্পূর্ণ  ধারণা নিয়ে রেখেছিলো। তখন সেমিনারে বসে সেগুলি করা হচ্ছিলো আর করা শেষে আমার আর ঐশীর রিপোর্ট লিখাও শুরু হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পরেই সেমিনার বন্ধ করে দিবে বলে আমাদের বের হয়ে যেতে হলো। তখন কী করবো! কোথায় যাবো! কিছুই ভাবতে না পেরে ডিপার্টমেন্টের নিচে সিঁড়িতে বসে কাজ করলাম বিকেল পর্যন্ত। সেদিন রাতেই আমাদের এনালাইসিস, রিপোর্ট লিখা প্রায় শেষ। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম আমাদের ভুল হয়েছে কাজে। তখন আমার আর ঐশীর অবস্থা বেগতিক, ঠিক ‘ছাইড়া দে মা, কাইন্দা বাঁচি’ এমন। এতো কাজ করার পর ভুল গেলো শেষে! পরে আবার নিজেরাই নিজেদেরকে সামলে বললাম যে নাহ! কোনোভাবেই হাল ছাড়া যাবে না।

পরেরদিন আবার ক্যাম্পাসে আসলাম আমরা কিন্তু ডিপার্টমেন্ট বন্ধ পেলাম। ভুলেই গেছিলাম যে ১৫ই অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের শোক দিবস ছিলো। এখন কী করা! তখনই ঐশীর আম্মু বললেন যাতে উনার অফিসে যাই উনার সাথে। আল্লাহ্‌ মালুম, তখন আন্টি না থাকলে কী যে করতাম তিনজন! যাহোক, আন্টির অফিসে আমরা তিনজন একসাথে আবার কাজ শুরু করলাম। ইউটিউব, গুগল, রেফারেন্স পেপার থেকে পড়ে আর শিখে ঠিক করা হলো যে সাধারণ দিক বিবেচনা না করে আমরা “Antenatal Care” এর উপর “Socio-demographic Factors” এর প্রভাব দেখবো। আবার শুরু থেকে পুরো কাজ করা হলো, রিপোর্টে সংশোধন করা হলো। টেবিল, ইন্টারপ্রিটেশান নতুন ভাবে ইউটিউবে দেখে আবার লিখা হলো। কাজ করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে আসলো। বাসায় গিয়ে তিনজনেরই জ্বর। তাও সেদিন এডিটিং, কভার পেজ ইত্যাদি সব করতে করতে সব একদম শেষ করে এখন সাবমিটের পালা। এ নিয়ে অবশ্য কোনো ঝামেলা হয়নি, ঠিক করা হলো যা কিছু সাবমিট করা হবে সেটা মুশফিকই করবে। রাত ১টা ১৮ মিনিটে সাবমিট করা হলো। ঐদিন একটু শান্তির ঘুম হলো।

দু’দিন যাবৎ চোখ, মাথা ব্যথা, ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও ক্লাস মিস দেয়া, আসলে কতোটুকু কাজ করতে পারলাম ভালোভাবে তা নিয়ে নানান চিন্তা কাজ করতেছিলো। পরেরদিন রাতে হঠাৎ মেইল পেলাম গুগল মিটের, এরশাদ স্যারের কাছ থেকে। মুশফিক, ঐশী আগে জয়েন করলেও আমার জয়েন দিতে দেরী হলো। জয়েন দিয়ে দেখি ওরা দু’জন, এরশাদ স্যার, ফারজানা ম্যাম আর জামী স্যার। মৌখিক কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে আমাদের কাজ নিয়ে। সেদিন দেরিতে জয়েন দেয়াতে খুব মন খারাপ হলো। সেদিনই মোটামুটি ভাবে ধারণা পেলাম হয়তো আমরা জিতবো। কিন্তু ফলাফল না দেখে শান্তি পাচ্ছিলাম না। পরদিন ফলাফল ঘোষণা করা হলে নিজেদের নাম দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে যাচ্ছিলাম। টানা কয়েকদিনের ব্যস্ততা, অসুস্থতা এসব তখন কিছুই মনে হচ্ছিলো না। কিছুটা ভালো সময় কাটানোর জন্য আমরা সেদিনই বাইরে থেকে ঘুরে আসলাম।

তারপর!!! তারপর নির্দেশ পেলাম প্রেজেন্টেশনের কিন্তু এবার একটু ভিন্নধর্মী হবে। এবার লাইভ না হয়ে আমাদের রেকর্ড করে পাঠাতে হবে। মনে হতে থাকলো সেই স্কুলে থাকতে যে ভাব-সম্প্রসারণ পড়েছি, লিখেছি তার কথা, “স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন”। পাওয়ার পয়েন্ট নিয়ে তেমন একটা কাজ করা হয়নি আবার এবার সাথে ভিডিও করে আমাদের ভয়েস সংযোজন করে দিতে হবে! বিশাল এক কাজ মনে হচ্ছিলো। আবার বিজয়ী দল, যেমন তেমন হলে চলবে না। খুব ভালো না হলেও মানসম্মত কিছু একটা হওয়া চাই। চলে আসলাম ডিপার্টমেন্টে। কিছুক্ষণ কাজ না করতেই আবারো সেই সেমিনার বন্ধ করে দিবে তাই বের হয়ে গেলাম। কী করা যায় ভেবে সাইন্স লাইব্রেরির কাছে গিয়ে সেখানে বাহিরে সিঁড়িতে বসে নিজেদের স্ক্রিপ্ট বানানো শুরু করলাম আবার। সব লিখা শেষ করে সময় ধরে ধরে দেখতে লাগলাম কার কতোটুকু সময় লাগে। সেদিন ঠিক করা হলো যে পরের দিন একসাথে বসে সবাই ভয়েস রেকর্ড করবো কিন্তু রাতেই ঐশী তাড়াহুড়ো করে কল দিয়ে বললো যে আজকেই সব ঠিক করে ফেলতে হবে যেহেতু আমাদের তখনো পাওয়ার পয়েন্টের কাজ বাকি ছিলো। তড়িঘড়ি করে যে যার স্ক্রিপ্ট নিয়ে বসে পড়লাম। একবার এটা ভুল হচ্ছে, আরেকবার ওটা ভুল হচ্ছে। এভাবে করতে করতে মুশফিক মোট ৩৪টা রেকর্ড করলো, আমার কোনো হিসেব ছিলো না। ঐশীর অবশ্য খুব বেশি করতে হয়নি, দু’বারেই হয়ে গিয়েছিলো। সেমিনারে কাজ শেষ হওয়ার আগেই হয়তো আবারো বের হয়ে যেতে হতো তাই পরেরদিন ঠিক করা হলো যে আন্টির অফিসে যাওয়া হবে কাজ করতে। সবাই তাই করলাম। স্লাইডে কালার, ডিজাইন, ফন্ট ইত্যাদি পছন্দ করা নিয়ে বেশ কিছুক্ষন সময় লাগলো, স্লাইড সব বানানো শেষে আসলো ভিডিও করা আর সাথে ভয়েস সংযোজন। নানান রকম ঘাটাঘাটি করে শেষে সব কাজ শেষ করতে করতে সন্ধ্যা ৬টা প্রায়। এটা ছিলো অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা। খুব ভালো কিছু করেছি বলবো না, তবে মানসম্মত হয়েছে এতোটুকু বিশ্বাস রাখি নিজেদের উপর।

একদম শুরু থেকে ভাবলে আমাদের প্রধান লক্ষ্য ছিলো নতুন কিছু শিখা, অভিজ্ঞতা অর্জন করা। জিতবো ভেবে অংশগ্রহণ করা হয়নি কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে জিতে গেলাম। এক্ষেত্রে উৎসাহ, ভালোবাসা, কিছু সমালোচনা সবকিছুর সম্মুখীন হয়েছি। নতুন কাজ শিখেছি, আত্নবিশ্বাস বেড়েছে। এখানে না বললেই নয় যে, এই কম্পিটিশনে অংশগ্রহণের সাহস, অনুপ্রেরণা হিসেবে মূলত যে মানুষটার অবদান উল্লেখযোগ্য তিনি আমাদের শ্রদ্ধেয় তসলিম সাজ্জাদ মল্লিক স্যার। উনার সেমিনারে অংশ না নিলে হয়তো শিখা হতো না অনেক কিছু, সাহস পেতাম না ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও।

ধন্যবাদ শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণকে, সিনিয়রদের, বন্ধু-বান্ধবদের যারা সবসময় পাশে ছিলেন, সাপোর্ট করেছেন। ধন্যবাদ কাজী মোতাহার হোসেন স্ট্যাটিসটিক্স ক্লাবকে এতো সুন্দর  আর শিক্ষনীয় একটা কম্পিটিশনের জন্য। ধন্যবাদ ‘প্যাপাইরাস’ কে, আমাদের অভিজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগ দেয়ার জন্য। আর সবশেষে ধন্যবাদ প্রাণের পরিসংখ্যান বিভাগকে।

ছকে বাঁধা পড়ালেখা-পরীক্ষার বাইরে নতুন কিছু করতে পারার মধ্যে কাজ করে অপরিমেয় আনন্দ, যার সুযোগ করে দিয়েছে কিউএমএইচ স্ট্যাটিস্টিক্স ক্লাব। তাই পেছনের গল্পকথায় বিচরণ করতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রত্যেকেই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে এই ক্লাব ও ক্লাবের আহবায়ক তসলিম সাজ্জাদ মল্লিক স্যারের প্রতি। যাদের ছত্রছায়া না থাকলে হয়তো এই সুযোগটা পাওয়াই হতো না। এই অর্জন অপূর্ণ রয়ে যেত যাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা ছাড়া সেই সকল শিক্ষক, সিনিয়র ও বন্ধুসহ সর্বোপরি পরিসংখ্যান বিভাগকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছে সকলেই।

অজানা এই গল্পকথন অনুপ্রেরণার জোগান দিবে সকল স্বপ্নদ্রষ্টাদের, সূচনা করবে নব দিগন্তের- এমনটাই প্রত্যাশা তাদের।